Home » , » এরশাদের বিচার হতেই হবেঃ সপ্তম সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট

এরশাদের বিচার হতেই হবেঃ সপ্তম সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট

Written By Unknown on Wednesday, December 29, 2010 | 6:32 PM

সামরিক শাসন জারির জন্য এইচ এম এরশাদ ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান অপরাধ করেছেন। এ জন্য তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। শুধু এরশাদই নন, এর আগে ১৯৭৫ সাল থেকে যাঁরা সামরিক শাসন জারি করে দেশ চালিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত আছেন, তাঁদের বিচারও হতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ সামরিক শাসন জারি বা জারির চেষ্টা করতে না পারেন, সে জন্যই তাঁদের প্রত্যেকেরই বিচার হওয়া উচিত।

সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ে এসব কথা বলা হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট দেওয়া রায়ে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ এ রায়ে স্বাক্ষর করেছেন।
যেসব বিচারক সামরিক শাসকদের সহযোগিতা করবেন তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
রায়ে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির ১২১ ক (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র), ১২৪ (কোনো আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগে বাধ্য করার বা বাধা দান করার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতি, গভর্নর প্রমুখ ব্যক্তিকে আক্রমণ করা) ও ১২৪ ক (রাষ্ট্রদ্রোহ) ধারা অনুযায়ী এরশাদ অপরাধ করেছেন, বিষয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখবে সংসদ।
আদালতের রায়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের নজির উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এরশাদসহ এ দেশে অন্য সামরিক শাসকদের আমাদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
রায়ে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে যাতে কেউ সামরিক শাসন জারি করার সাহস না পান সেজন্য সামরিক শাসকদের শাস্তির ব্যবস্থা করে নির্ভুল আইন প্রণয়ন করতে হবে। বারবার সামরিক শাসন জারির ফলে দেশে, সমাজে দুর্নীতি ও অস্ত্রবাজি বাড়ে বলেও রায়ে বলা হয়।
রায়ে বিশ্বের সামরিক শাসক সুহার্তো, পিনোসে, গর্টিয়ারি, ইদিআমিন, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফের পরিণতির কথা উল্লেখ করে বলেন, তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তাও সামরিক শাসকদের খতিয়ে দেখা উচিত। দিনের শেষে সামরিক শাসকদের এমনই পরিণতি বরণ করতে হয়। এ কারণে আমাদের দেশের সামরিক শাসকদেরও ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বিচারের ব্যবস্থা করা জরুরি।
রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, এরশাদ প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানের কোনো মূল স্তম্ভ ধ্বংস করেননি। তবে জিয়াউর রহমান যেভাবে সংবিধানের মূল স্তম্ভ ধ্বংস করেছেন তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তিনি সংবিধান ধ্বংসের অপরাধ করেছেন যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের শামিল। তিনি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকার পদদলিত করে বাংলাদেশের সংবিধান দীর্ঘ চার বছর স্থগিত রেখেছিলেন। এর ফলে সামরিক আদালত বা ক্যাঙ্গারু আদালতের মাধ্যমে দেশে বিচার চলেছে।
আদালত রায়ে বলেন, দেশে সামরিক শাসনের দ্বার উন্মোচন করেন খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমান। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজাকারদের চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর সংবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন মোশতাক-জিয়াচক্র। তাঁরাই সামরিক শাসনের মাধ্যমে সংবিধানের প্রতি প্রথম কুঠারাঘাত করেন।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, জিয়া শুধু সামরিক আইন প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি সংবিধানের দুটি মূল স্তম্ভ ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করে দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বাঙালি থেকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রচলন করেন।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। এ জন্য আপামর জনসাধারণ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। অথচ জিয়া সামরিক কায়দায় ক্ষমতায় গিয়ে এই তত্ত্বটি ধূলিসাৎ করে দেন। দেশের জনগণের পাসপোর্ট ও অন্যান্য দলিলপত্রের কারণে আপাতত বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংবিধানে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত না হলেও অচিরেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ আবার সংবিধানে ফিরে আসবে বলে রায়ে আশা করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, যে ‘জয় বাংলা’ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার উদ্দীপক স্লোগান, তা পাল্টিয়ে জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি কায়দায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রচলন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, আরেক শীর্ষ রাজাকার কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমানকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বসান। এ ছাড়াও বাংলাদেশবিরোধী লোকজনকে দেশের উচ্চতর পদমর্যাদায় বসিয়েছিলেন।
যেখানে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেসব স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য জিয়াউর রহমানের সময় সে স্থানটি শিশু পার্কে পরিণত করা হয় বলে রায়ে অভিমত জানান আদালত।
‘আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেব’ জিয়ার এ বক্তব্য উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়, তিনি বহু অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে উচ্চ মর্যাদায় চাকরি দেন।
সংবিধান সংশোধনী বিষয়ে আদালত রায়ে বলেন, হাইকোর্ট কোনো আইন অবৈধ ঘোষণা করলে এমনিতেই তা বাতিল হয়ে যায়। এ জন্য সংশোধনীর জন্য তা সংসদে উত্থাপন করার প্রয়োজন নেই। কারণ হাইকোর্ট আইন প্রণয়ন করে না বরং সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হলে তা বাতিল করে। এটি হাইকোর্টের চিরন্তন ক্ষমতা।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী-সংক্রান্ত রায়কে একটি বৈপ্লবিক রায় উল্লেখ করে আদালত বলেন, সংসদ ছাড়া আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা কারোর নেই। সংসদই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন করতে পারে।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে মুজিবনগর সরকার গঠন থেকে সংবিধান কার্যকর করার সময় পর্যন্ত গৃহীত সমস্ত কাজকে ক্রান্তিকালীন বিধান হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সামরিক শাসকরা তাঁদের অবৈধ কাজকে ওই অনুচ্ছেদে যুক্ত করে বৈধতা দিয়েছেন। এই অনুচ্ছেদে ভবিষ্যতে কোনো বিধান যুক্ত করার পথ চিরতরে বন্ধ করা হলো। কোনো সংসদ সংবিধানপরিপন্থী কোনো আইন পাস করতে পারে না এবং বৈধতা দিতে পারে না। সামরিক আইন, আদেশ অবৈধ হওয়ায় এর অধীনে জারি করা সমস্ত কাজ, ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা এবং সেই আদালতে বিচারও অবৈধ।
এরশাদের সামরিক শাসনের সময় চট্টগ্রামের একটি সামরিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত সিদ্দিক আহমেদের দায়ের করা রিট আবেদনে সপ্তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জারি করা সামরিক শাসন, ওই সময় থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা সামরিক আইন, সামরিক বিধি, সামরিক আদেশসহ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সমস্ত আদেশ ও নির্দেশকে সংবিধানপরিপন্থী এবং অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
এরশাদের সামরিক শাসনামলের সকল আদেশ, কার্যক্রম, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের আদেশ অবৈধ। তবে ওই সময়ে জনস্বার্থে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত বা কাজ ভবিষ্যৎ বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য ক্ষমা করা হয়। রায়ে বলা হয়, মার্জনার অর্থ এই নয় যে, এসব কাজ বৈধ হয়ে গেল। ভবিষ্যতের জন্য এমন কাজ কেউ করলে তা অবৈধ হবে।
আদালত রায়ে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। জিয়ার উত্তরসূরি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে এরশাদ তাঁর দায় এড়াতে পারেন না। এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করেছেন। সংবিধান স্থগিত করেছেন। সামরিক ফরমান জারির মাধ্যমে সামরিক আইনকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন মেনে নেওয়া যায় না। এমন কার্যক্রম মার্জনীয় নয়। আরো বলা হয়, সংবিধান জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের ওপর সামরিক আইনসহ কোনো আইনেরই অবস্থান হতে পারে না।
রিট আবেদনকারীর বিচারের বিষয়ে আদালত বলেছেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার তাঁর অবশ্যই রয়েছে। সামরিক আদালত ক্যাঙ্গারু আদালত ছাড়া কিছুই নয়, কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে রিট এখতিয়ারের মাধ্যমে তাঁর প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তাঁকে প্রতিকার পেতে হলে তাঁকে অন্য কোনো আইনি পন্থায় আবেদন করতে হবে, অবশ্য যদি তিনি চান। রিট আবেদনকারীর সাজার বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে তাঁকে নিম্ন আদালতে আÍসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু