খোলা হাওয়া- শুধু আবেগ নয়, ভালোবাসাটাও চাই by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

Friday, February 21, 2014

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ ১৬ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে বাংলায় একটি রিট করেন, যাতে তিনি ১৯৮৭ সালের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটির বাস্তবায়নে আদালতের নির্দেশনা কামনা করেন।
জনাব আকন্দ তাঁর রিটে উল্লেখ করেন, গত ২৭ বছরে সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা এ আইনটি ঢালাওভাবে অমান্য করে চলেছেন। উচ্চ আদালত রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে সর্বস্তরে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন এবং এপ্রিলের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বরপ্লেট এক মাসের মধ্যে লেখার নির্দেশও দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

এই নির্দেশকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং বাংলা ভাষার প্রসার ও চর্চা এবং নানাবিধ বিকৃতির হাত থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষার ক্ষেত্রে আদালতের আগ্রহকে আমরা একুশের চেতনার প্রতিফলন হিসেবেই দেখতে চাই। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার বিকৃতি রোধ করার জন্য উচ্চ আদালত যে নির্দেশনাটি দিয়েছিলেন, তা ছিল সুচিন্তিত ও সময়োপযোগী। একটি ভাষার শরীরে বিভিন্ন ভাষার জল-হাওয়া লাগবে এবং তার বেড়ে ওঠায় এদের একটা প্রভাব থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু জোর করে সেই ভাষার ওপর একটি বা দুটি ভাষার ঝাপটা ক্রমাগত বইয়ে দিলে সেই ভাষাটি তার সুস্থতা হারায়। সদর দরজা দিয়ে যে মেহমান আসবেন, তাঁকে বরণ করে নিতে সবচেয়ে অসামাজিক বাঙালিও তৈরি থাকেন। কিন্তু সিঁধ কেটে যে চোর ঘরে ঢুকবে, তাকে ঘরের মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়ার কথাটা তো কেউ কল্পনাও করবে না।
এখন বাংলা ভাষা পড়েছে হিন্দি আর ইংরেজির চোরাগোপ্তা আক্রমণের সামনে, ক্রমাগত সিঁধ কেটে ঢুকছে নানা অপ্রয়োজনীয় শব্দপদ। এই আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে আমরা বিদেশি ভাষার হাতে আমাদের ক্রিয়াপদগুলোও তুলে দিচ্ছি। দুই বছর আগে উচ্চ আদালত এই আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তারপর অনেক দিন-মাস চলে গেলেও ভাষার বিকৃতি ঠেকাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ১৬ ফেব্রুয়ারি দেওয়া উচ্চ আদালতের নির্দেশটিকেও শেষ পর্যন্ত মান্য করা হবে না। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অবশ্য একটা কৈফিয়ত খাড়া করবেন, কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তারও একটা তালিকা পেশ করবেন। কিন্তু যাকে বলে আস্তিন গুটিয়ে কাজে নেমে পড়া, তা আর হবে না। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতেও আমরা ভাষার ক্ষেত্রে অরাজকতার পুরোনো ছবিটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবার দেখব।
বাংলা ভাষার জন্য তরুণেরা বুকের রক্ত দিয়েছেন। সেই রক্তের রেখা ধরে একটি দেশ স্বাধীন হলো। বাংলা ভাষা পেল রাষ্ট্রভাষার সম্মান। বিশ্বসভায় এই ভাষার প্রতিনিধিত্ব আমরাই করছি। খুব বেশি দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে এই ভাষা স্বীকৃতি পাবে। আমরা যদি ভাষার অগ্রযাত্রাকে একটি রেখা এঁকে বর্ণনা করতে চাই, তাহলে তো সেই রেখা এত দিনে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কি তাই? নাকি এই রেখা চলছে ভূমির সমান্তরাল এবং কখন সেটির মাথাটা মাটির দিকে হেলে পড়ে যায়, তা নিয়ে আমরা চিরশঙ্কায় থাকি?
এটি কেন হবে যে ভাষার প্রশ্নে স্বাতন্ত্র্য-অন্বেষী একটি জাতির স্বাধীনতার এত বছর পরও এই ভাষাকে তার পথচলার জন্য আদালতের হাত ধরতে হবে? তবে কি বাংলা ভাষার পায়ে শক্তি নেই, তাকে চলতে হয় ইংরেজি ও পণ্যসংস্কৃতির ভাষার লাঠি ধার করে এবং মাঝেমধ্যে যখন সে হোঁচট খেতে যায়, তা ঠেকানোর জন্য আদালতকে একটা হাত বাড়িয়ে দিতে হয়? এ কাজটি কি আদৌ আদালতের, নাকি পরিবারের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, সমাজের? শুরুতে মাননীয় আদালতকে সাধুবাদ জানিয়েছি, কিন্তু একই সঙ্গে একটু কি আত্মগ্লানিতে ভুগতে হয় না আমাদের? উচ্চ আদালত যে উদ্যোগটি নিয়েছেন, সেটি তো ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিকভাবে আমাদেরই নেওয়া উচিত ছিল, অনেক আগেই। আমরা কি তাহলে নিজেদের ভাষাটাকেই উদ্ধার করতে পারছি না বিকৃতি আর অবহেলার চোরাবালি থেকে? উচ্চ আদালতের দুই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হবে, তেমনটি আশা করা কঠিন কিন্তু এটুকুও যদি হতো যে আমাদের কাজটি আদালতকে করতে দেখে আমরা লজ্জায় জিব কাটলাম, তাতেও একটুখানি ফল পাওয়া যেত। কিন্তু তারও কোনো নিদর্শন তো চোখে পড়ছে না। মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো ভাবনা নেই, শুধু কিছু পার্বণিক আবেগ ছাড়া।
মাতৃভাষার জন্য বুকভর্তি পার্বণিক দরদের প্রয়োজন নেই, একটুখানি সত্যিকার ভালোবাসা থাকলেই যথেষ্ট। সঙ্গে যদি থাকে অল্পখানি আত্মসম্মান এবং এক চিমটি নিষ্ঠা, তাতেই কাজ হয়, বাংলা ভাষা তার সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হয়। এবং এই বিকাশের এক শটা পথ বেরিয়ে যায়। আমার অভিজ্ঞতায় পাওয়া তিনটি উদাহরণ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। প্রথম উদাহরণটি নিউইয়র্কের কোরীয় জনগোষ্ঠী, দ্বিতীয়টি চীনের একটি শহরে এবং তৃতীয়টি ঘরের কাছের কলকাতা থেকে কুড়ানো। নিউইয়র্কের ফ্লাশিং অঞ্চলে প্রচুর কোরীয়র বাস, ওই এলাকায় আমি কিছুদিন ছিলাম। আমার প্রতিবেশী এক কোরীয় পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই পরিবারে একই ছাদের নিচে তিন প্রজন্ম বাস করত। বৃদ্ধ দাদাসাহেব ও তাঁর স্ত্রী, তাঁদের দুই ছেলে, যাঁদের বয়স ৪০ থেকে ৫০ এবং তাঁদের চার সন্তান, যাদের বয়স সাত থেকে আঠারোর মধ্যে। বুড়োবুড়ি কোরিয়া থেকে নিউইয়র্ক এসেছিলেন সেই কবে। দুই ছেলে জন্মেছেন সেই শহরে। ছেলেদের বাচ্চারাও। নিউইয়র্কে (এবং উত্তর আমেরিকা-ইউরোপের নানা শহরে) আমি এ রকম অভিবাসী বাঙালি পরিবার দেখেছি—তিন না হলেও দুই প্রজন্মের তো বটেই। এদের সবার সন্তানকে একটা গড় হিসাবে আনলে বলা যাবে, ১০টির মধ্যে নয়টি সন্তানই বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না, বুঝতে বা বলতে পারলেও। তবে সেই বলতে পারারও দেখা মেলে কদাচিৎ। অথচ কোরীয় পরিবারটির ঘরের ভেতরে একমাত্র ভাষা তাদের মাতৃভাষা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটি কী করে সম্ভব? তারা ততোধিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কেন নয়?
বটে; কেন নয়। বেশির ভাগ অভিবাসী বাঙালি বাবা-মা নিজেরাই যে বাচ্চাদের সঙ্গে ইংরেজি ছাড়া বাংলায় কথা বলেন না। ‘বাংলা শিখে কী হবে?’ তাঁরা জিজ্ঞেস করেন। কোরীয় পরিবারগুলোকেও এই প্রশ্ন করা যায়; কোরীয় শিখে কী হবে? উত্তরে আমার পরিচিত পরিবারের দাদামশাই ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে এবং ১৪ বছরের এক নাতি চোস্ত ইংরেজিতে জানায়, শিকড়টা মাটিতে থাকবে, সংস্কৃতিটা জাগ্রত থাকবে, মনটা সুন্দর থাকবে আর পূর্বপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কটা অটুট থাকবে, সে জন্য।
আর নেহাতই যদি ‘বাংলা বিসর্জিয়া ইংরেজি শিখিয়া আরোহণ করিব সমৃদ্ধি-চূড়ায়’ জাতীয় লজিক থাকে আমাদের মাথায়, তাহলে সেখানেও কোরীয়রা আমাদের লজ্জা দেবে। তাদের কোরীয় ভাষা জানা, বাড়িতে কোরীয় ভাষা বলা, কোরীয় ভাষায় বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শোনা, তর্ক-বিতর্ক-মান-অভিমান-ঠাট্টা-কাজিয়া-তামাশা করা সন্তানেরা বিরাট বিরাট চাকরি করছে আমেরিকায়। সমৃদ্ধির চূড়ায় ওরাই তো উঠে বসেছে।
আমি কান পেতে শুনেছি—না, যখন তারা কোরীয় বলে, একটি ইংরেজি শব্দও তারা ব্যবহার করে না।
আমার দ্বিতীয় উদাহরণেও আছে ভাষার এই অভঙ্গুর অবয়বটির ছবি। চীনের একটি শহরে বেরিয়েছিলাম জাদুঘর দেখতে। শহরে ইংরেজি জানা মানুষের সংখ্যা কম। অনেক খুঁজে পেতে যে একজনকে পাওয়া গেল, তাঁর ইংরেজি খুবই উন্নত। বয়সে তরুণ, পেশায় আইটি বিশেষজ্ঞ, ব্যবহারে অমায়িক। আমাদের আস্ত দুই ঘণ্টা সময় দিলেন সেই তরুণ, সুন্দর ইংরেজিতে সব বোঝালেন। কিন্তু মাঝখানে কফি খেতে বসে যখন জাদুঘরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে নিজ ভাষায় কথা জুড়ে দিলেন, আমি কান পেতে রইলাম অন্যান্য ভাষার শব্দ ইত্যাদি শোনার জন্য। হতাশ হতে হলো। পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করেন কি না তাঁর বলা ভাষায়। তরুণ হেসে জানান, তার প্রয়োজন হয় না, যেহেতু প্রায় প্রতিটি বিদেশি বস্তুকে (অর্থাৎ বিশেষ্যকে) চৈনিক ভাষায় বর্ণনা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিভাষা তৈরি
আছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মডেম—এসব খটমট আপাত অনুবাদ-অযোগ্য শব্দেরও একটি নয়, একাধিক।
সবচেয়ে অবাক হলাম শুনে, সেই শিশুবেলাতেই তাদের শেখানো হয়, ভাষার পৃথিবীটা এত বড় যে সেখানে অস্থির পরিব্রাজক হয়ে একজীবন কাটিয়ে দিলেও এর অল্পটাই দেখা হয়। চৈনিক তরুণ আমাকে আরও জানান, ভাষার গাঁথুনি একটা গানের মতো। গানের সুরটা কেউ বেসুরো করে গাইলে যেমন সেই গান শুনতে ইচ্ছা করে না, ভাষার ভেতরের গানটাকে ধরে না রাখতে পারলে সেই ভাষার লাবণ্য চলে যায়।
গানের কথায় কলকাতায় যাওয়া যায়। কলকাতায় বাংলা খুব অসহায়। শুধু যে অবহেলা, তা নয়, ইংরেজি-হিন্দির আগ্রাসনে শিক্ষিত বাঙালির ভাষা ক্রমেই যেন অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। লেখালেখিতে একটা সতেজ ভাব আছে, সন্দেহ নেই; কিন্তু মুখের ভাষায়, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীর, আছে একটা জগাখিচুড়ি ভাব। অথচ কলকাতারই এক এফএম রেডিওর—নামটা ভুলে গেছি—একটা অনুষ্ঠান শুনে মনে হলো, বাংলা ভাষার ভেতরের গানটাকে তার মতো করে জাগাচ্ছে এই রেডিওটি। এই গান ওদের এক রকম, আমাদের আরেক রকম। কিন্তু দুই গানে একটা মিল তো আছে। স্মৃতিচারণার এই অনুষ্ঠানটি, দুই বছরের বেশি আগে শোনা, এখনো মনে আছে, কারণ ঝলমলে, পরিচ্ছন্ন বাংলায় ক্রমাগত কথা বলে গেলেন তিনজন অংশগ্রহণকারী এবং আরজে অথবা কথাবন্ধু। বাংলাকে যদি এভাবে আপন মহিমায় এবং স্বাস্থ্যে তুলে আনতে পারে একটি এফএম রেডিও কেন্দ্র (!), হাতে ইংরেজি স্যালাইনের নল না ঢুকিয়ে অথবা পট্টি না লাগিয়ে, হিন্দির রোজ-পাউডার না ঘষে, তাহলে আমাদের এফএম রেডিও কেন্দ্রগুলো কেন এমন ভাব করে যে বাট-সো-লাইকের পেরেক না ঠুকে দিলে বাংলার কাঠামোটা ভেঙে পড়বে? আর বাংলা ভাষার ভেতরের গান? সে না হয় তোলা থাক আরেক জন্মের জন্য।
অথচ বাংলা ভাষার অবিরাম চর্চা, উৎকর্ষের দিকে তার যাত্রা, তার ভেতরের মনোহর গানটার ক্রমাগত বেজে যাওয়া—সবই সম্ভব হয় এই ভাষার জন্য আমাদের সত্যিকার ভালোবাসাটা জাগাতে পারলে। শুধু বুকভরা ফেব্রুয়ারি-জাত আবেগ নয়, হূদয়ভরা প্রকৃত ভালোবাসা থাকতে হবে, চোখভরা স্বপ্ন থাকতে হবে ভাষাটা নিয়ে।


সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

খোলা হাওয়া- সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শেষ কোথায়? by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

Thursday, January 16, 2014

বাংলাদেশে গত দুই-আড়াই দশকে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে হয় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি জিতেছে। একটি দল একবার হারলে আরেকবার জেতার সুযোগ পেয়েছে।
কিন্তু প্রতিটি নির্বাচনেই একটি পক্ষ বারে বারে হেরেছে—সেই পক্ষটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তারা ভোট দিতে গেলে জামায়াত-বিএনপির কোপানলে পড়ে, না দিতে গেলে আওয়ামী লীগের রোষের শিকার হয়। বিএনপি-জামায়াত বিশ্বাস করে, সংখ্যালঘুরা আওয়ামীপন্থী; আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে, তাদের ভোট না দিয়ে সংখ্যালঘুদের উপায় নেই। ফলে নির্বাচনের মৌসুম শুরু হলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানেরা আতঙ্কে থাকেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর যে বর্বর নির্যাতন করা হয়েছিল রামসাগর ও অন্যান্য জায়গায়, তার তুলনা দেখা গেছে শুধু একাত্তর সালে। দেশের মানুষ এই বর্বরতার প্রতিবাদ জানিয়েছিল, সরকার একটি কমিটি করে তদন্তও করেছিল। কমিটি একপ্রস্থ সুপারিশও তৈরি করেছিল। কিন্তু সে অনুযায়ী কোনো কাজ হয়নি। গত ১৩ বছরে বরং যা হয়েছে, তাকে বলা যায় নিরবচ্ছিন্ন ঠোঁটসেবা।

যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার ‘অপরাধে’ হিন্দুসহ অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর এত নির্যাতন, ঠোঁটসেবাটা তারাই বেশি দিয়েছে। কথা অনেক হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। বিচ্ছিন্ন কিছু ধরপাকড় এবং দু-এক অপরাধীর জেল-জরিমানা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ অপরাধী রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করা, অপরাধীদের শাস্তির বিধান করা, নির্যাতনের কারণগুলো চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকারের ব্যবস্থা করা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এসব কিছুই হয়নি। রাষ্ট্র তার জনগণের একটি অংশকে কার্যত অবহেলাই করে গেছে।
ফলে এবারও নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে এসেছে। ওই নির্বাচনটি নিয়ে এমনিতেই প্রবল শঙ্কা ছিল মানুষের মনে। ১৮-দলীয় জোট যেকোনো মূল্যে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল, সরকারও বদ্ধপরিকর ছিল যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করার। তবে বরাবরের মতো এই ‘মূল্য’টা কোনো নেতা-নেত্রীকে দিতে হয়নি, দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের। নির্বাচনের আগে সরকার আরও ঘোষণা দিয়েছিল, ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে—সে লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামানো হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনও ভোটারদের সুরক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে সন্ত্রাস হবে এবং ব্যাপক আকারে হবে। কিন্তু ভোটকেন্দ্র হওয়ার অপরাধে ৫৩১টি স্কুল যখন পুড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন মনে হয়েছিল, এ দেশে সবই সম্ভব। যারা স্কুলে আগুন দিতে পারে, তারা যে মানুষের ঘরবাড়িতেও আগুন দিতে পারে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপই নিল না। আমাদের সরকারগুলো এমনিতেই পা-ভারী, চলে পা টানতে টানতে। এক দিনের রাস্তা যায় এক মাসে। সরকারের প্রস্তুতিহীনতা ও উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে ১৮-দলীয় মাঠকর্মীরা নেমে পড়ল সংখ্যালঘু নির্যাতনে। সাতক্ষীরা, যশোর, দিনাজপুরসহ নানা জায়গায় নারকীয় তাণ্ডব হলো, তাদের মন্দির পুড়ল, প্রতিমা ভাঙচুর হলো, বাড়িতে আগুন দেওয়া হলো, মেয়েরা ধর্ষিত হলো। এই সহিংসতা চলল অব্যাহতভাবে এবং এই তাণ্ডবে কোনো কোনো জায়গায় অংশ নিল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরাও। ১৩ জানুয়ারির কাগজেও পড়লাম, দেশের তিন জায়গায় মন্দির ভাঙচুর হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। অথচ ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় জানালেন, সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে তিনি এবার কঠোর হবেন।
নতুন সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সচিবালয়ে তাঁদের প্রথম দিনটিতে সাংবাদিকদের জানালেন, হ্যাঁ, সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করতে সরকার কঠোর হবে। কিন্তু এই ‘হবে’টা ঠিক কবে, তা বোঝা গেল না। যেকোনো ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ‘কবে’টা যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল এবং সেটি গতকাল হলেই ভালো। অর্থাৎ এসব উদ্যোগে এক দিন দেরি করাটাই অপরাধীদের অনেকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া। ১০ জানুয়ারি এবং ১৩ জানুয়ারির মধ্যে যে শুধু অনেকগুলো হামলার ঘটনা ঘটল, তা নয়, অনেক মানুষের জীবনের স্বপ্ন ভেঙে গেল; তাঁরা চোখের সামনে উপাসনালয় পুড়তে দেখলেন, রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বাস হারালেন; মনুষ্যত্ব আরেকবার রক্তক্ষরণের শিকার হলো। সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজন যে কথা বলতে পছন্দ করেন এবং কথার পেছনে কাজ করার প্রতিজ্ঞাটা যে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে, তা প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের ব্যক্তিরা যেমন জানেন, অপরাধীরাও জানে। ফলে সহিংসতা চলতে থাকে, থানা-পুলিশ কিছু ধরপাকড় করে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যায় পর্দার আড়ালে।
অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এখন দুটি ফরিয়াদ নিয়ে সরকার ও দেশবাসীর কাছে উপস্থিত হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, ভোটার তালিকা থেকে তাঁদের নাম কেটে দেওয়া হোক, যাতে নির্বাচন এলে তাঁদের টার্গেট না করা হয়; অথবা তাঁদের জন্য আলাদা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। এসব শুনে আর এখন কেউ এ কথাটি জোর গলায় বলতে পারবে না, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বস্তুত, ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধদের ওপর যখন নৃশংস হামলা হয়, তখনই একটি কাগজে লেখা হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা-ও পুড়িয়ে ফেলা হলো।
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কারণ খুঁজতে পরিশ্রম করতে হয় না—এসব এখন সবার কাছেই স্পষ্ট। প্রথম কারণটি হচ্ছে ভূমিদস্যুতা, দ্বিতীয়টি তাদের গায়ে আওয়ামী ভোটব্যাংকের সিল পড়ে যাওয়া এবং তৃতীয় হচ্ছে জঙ্গিবাদপ্রসূত অসহিষ্ণুতা, যা ভিন্ন ধর্মের মানুষ ও তাদের মন্দির-প্যাগোডা-গির্জার ওপর আক্রমণকে ন্যায্যতা দিচ্ছে। মুসলমানদের চেয়ে সংখ্যালঘুদের জমি দখল করাটা সহজ—তাদের ওপর আক্রমণটা তীব্র করলে তারা ভিটেমাটি ফেলে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পার হয়ে চলে যাবে, এ রকম প্রত্যয় থেকে হামলা হয়। এই হামলায় থাকে সব দলের ভূমিদখলদার। এই তিন কারণের ত্রিশূল থেকে বাঁচার উপায় সংখ্যালঘুদের জানা নেই। ফলে জীবন বাঁচাতে সত্যিই তাঁরা দেশান্তরিত হচ্ছেন। ১৯৭৮ সালে যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু, ২০১১ সালে এসে সেই সংখ্যা নেমে গেছে ৯ শতাংশের নিচে। এই পরিসংখ্যান আমাদের লজ্জিত করে, মর্মাহত করে। যাঁরা বাংলাদেশকে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’ বলে বিশ্বসভায় পরিচয় করিয়ে দিতে চান, তাঁদের এই পরিসংখ্যান পরিহাস করে।
২০১৩ সাল ছিল অব্যাহত সন্ত্রাসের বছর, সে বছর বাংলাদেশ ধর্মীয় উগ্রতার যে চেহারা দেখেছে, তার পুনরাবৃত্তি কখনো ঘটুক, কোনো বিবেকবান মানুষ তা চাইবেন না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই দেশে বিবেক নামের বস্তুটি এখন দুষপ্রাপ্য। গত ৫ মে ঢাকা শহর ছিল হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের দখলে, সেদিন বায়তুল মোকাররম এলাকায় আগুনের হাত থেকে রক্ষা পেল না কোরআন শরিফও। পুড়তে থাকা কোরআন শরিফের ছবি টিভিতে দেখে চোখের পানি ফেলেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু তা নিয়ে ধর্মীয় দলগুলো কোনো উচ্চবাচ্য করল না। এত ধর্মীয় দল-গোষ্ঠী-সংগঠন দেশজুড়ে, অথচ এ রকম একটি বর্বর ঘটনার কোনো প্রতিবাদ করা হলো না। এই নীরবতা আমাদের মনে করিয়ে দিল, বিবেক বিদায় নিয়েছে; এখন মতলব হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান। ফলে উগ্রবাদীরা যদি ভিন্ন ধর্মের মানুষকে নির্যাতন করে, তাদের উপাসনালয়ে আগুন দেয়, তার প্রতিবাদও জোরেশোরে হয় না। দলগুলো ব্যস্ত থাকে ভোটের এবং ক্ষমতার চিন্তায়, প্রশাসন ব্যস্ত থাকে সরকারের মতলব বুঝে কাজ করতে। কোনটা আন্তরিকতা, কোনটা ঠোঁটসেবা, তা তো প্রশাসনের মানুষ বোঝে। সে জন্য আইনের হাতটাও আর লম্বা হয় না। আইনের হাতটা দিন দিন ছোটই হচ্ছে বরং, বিশেষ করে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের জন্য।
কিন্তু এই অবস্থা তো চলতে দেওয়া যায় না। ১৯৬৪ সালে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন রুখে দাঁড়ানোর জন্য। রুখে এবারও দাঁড়াতে হবে। নতুন সরকার নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে—বৈধ না অবৈধ, এ নিয়ে প্রচুর বাগ্যুদ্ধ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এই বিতর্কে যায় না। ভোট দিতে না পেরে মানুষ হতাশ হয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষকেই এখন নজর দিতে হচ্ছে জীবনসংগ্রামে। এখন সরকার যদি সত্যিকার অর্থে কঠোরতা দেখায়, সব ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতাকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করে, নিজের দলের অপরাধীদেরও রেহাই না দেয় এবং জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনে, তাহলে মানুষ বৈধ-অবৈধ বিতর্কটি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক হানাহানি চায় না। ফলে এই হানাহানি বন্ধ করতে সরকার যে উদ্যোগ নেবে, তাতে মানুষের সমর্থন থাকবে।
একই সঙ্গে বিবেকবান প্রত্যেক মানুষকে এখন এগিয়ে আসতে হবে। ২০১৪ সালে আমরা সত্যিকার অর্থে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শেষ আমরা চাই, তার শুরুটা এখনই হোক।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

খোলা হাওয়া- এ রকম বছর যেন আর না আসে by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

Wednesday, January 1, 2014

২০১৩ সালটা যত তাড়াতাড়ি আমরা ভুলে যেতে পারব, ততই মঙ্গল। না, এ বছরের ভালো দিকগুলো ভুলে যাওয়ার কথা আমি বলছি না, বলছি বছরজুড়ে চলা নৃশংসতা,
বীভৎসতা আর মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা। রাজনৈতিক হানাহানিতে মানুষ মরেছে, পুলিশ মরেছে; মরেছেন রাজনৈতিক কর্মীরা, নিরীহ বাসযাত্রীরা, অটোরিকশার চালকেরা। গবাদিপশুও মরেছে। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের তাণ্ডবে বিদ্যুৎকেন্দ্র পুড়েছে, বাস ও ট্রেন পুড়েছে, ট্রেনের লাইন উড়ে গেছে, প্রতিপক্ষের বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়েছে, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, দোকানপাট, মন্দির-প্যাগোডা ধ্বংস হয়েছে, এক লাখের মতো গাছ কাটা পড়েছে। এক বছরের নিরবচ্ছিন্ন তাণ্ডবে ব্যবসা-বাণিজ্য রসাতলে গেছে, পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে, যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। কৃষকের ফসল মাঠে শুকিয়েছে, সবজি পচেছে খেতে। দুধ উৎপাদকেরা বিক্রি করতে না পেরে দুধ ফেলেছেন নালায়। কর্মহীন মানুষ কপাল চাপড়ে কেঁদেছেন।
সবই হয়েছে এবং হচ্ছে যাকে কেন্দ্র করে, তার নাম ক্ষমতার লড়াই এবং আরও অবিশ্বাস্য যা, কিছু যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর প্রাণপণ প্রয়াস। এবং এই প্রয়াসে যুক্ত হয়েছে হাজার হাজার তরুণ, যাঁদের কাছে দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং স্বজাতি হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধও অপরাধ মনে হচ্ছে না। তাঁরা বরং বিশ্বাস করছেন, এসব অপরাধ ছিল ইসলাম রক্ষার লড়াই। তাঁদের রাত-দিন সে রকমই শেখানো হচ্ছে।
একদিকে যেকোনো মূল্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করার সরকারি সংকল্প, অন্যদিকে বিরোধী দলের যেকোনো মূল্যে এই নির্বাচন প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞা। সরকার বলছে, যথাসময়ে নির্বাচন করাটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা; অন্যদিকে বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয় সরকার ছাড়া যেকোনো নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতার কথা। দুই পক্ষই অনড় অবস্থানে এবং এই প্রত্যয়ে স্থির নিশ্চিত যে সত্য তাদের পক্ষে।
যদি দুই পক্ষের রাজনীতিবিদেরাই শুধু এ রকম একটা বিশ্বাস-যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন, তাতেও নাহয় একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেত, যেহেতু পৃথিবীর সব দেশেই দুই বা তার বেশি দলে বিভক্ত রাজনীতিবিদেরা একে অন্যের বিরুদ্ধে অবস্থানে দাঁড়িয়ে বাগ্যুদ্ধ (মাঝেমধ্যে মুষ্টিযুদ্ধও) করেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুই পক্ষে শুধু রাজনীতিবিদ নেই, আছেন শিক্ষাবিদেরাও, চিকিৎসক-প্রকৌশলী-আইনজীবী-ব্যবসায়ীরাও। আছেন মুদি দোকানদারেরাও। এমন বিভাজিত দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কি না, সন্দেহ। কোনো টিভি চ্যানেলের টক শোয় যদি দুজন উপাচার্য (সাবেক অথবা বর্তমান), দুজন সাংবাদিক এবং দুজন পেশাজীবী উপস্থিত হন, প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে, দুই দলে বিভক্ত হয়ে তাঁরা নিজেদের দলকে পূত-পবিত্র এবং বিরুদ্ধ দলকে শয়তানের সহযাত্রী ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েছেন।
বাংলাদেশের আম আদমিরা রাজনীতির এই আদমশুমারির বাইরেই থেকে যাবে চিরকাল। ২০১৩ সাল ছিল আম আদমির জন্য নীরবে যন্ত্রণা সওয়ার বছর এবং দলবাজদের গলা চড়িয়ে চিৎকার করার বছর। এই নীরবে সহা এবং উচ্চকিত দল-চিৎকারের ছবিটা আর কোনো বছর এত প্রকট ছিল না।
আমি মানুষের বিবেক ও শ্রেয়বোধে চিরকালই বিশ্বাসী। তাই ঢাকার কয়েকটি দৈনিকে যেদিন গাজীপুরে কাভার্ড ভ্যানে পুড়ে অঙ্গার হওয়া মনিরের ছবিটি বেরিয়েছিল—মনির রাস্তার পাশে বসে তার পুড়তে থাকা আয়ুর শেষ আর কয়েকটি ঘণ্টা প্রত্যক্ষ করছিল এক ভয়ানক অবিশ্বাস ও অসম্ভবতার যন্ত্রণায় এবং তার বাবাও চোখের সামনে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশকে প্রত্যক্ষ করছিলেন এক ভয়ানক নির্বাক কষ্টে—আমার মনে হয়েছিল, হয়তো মনিরের চোখ দিয়ে অন্তত একবার আমাদের নেতা-নেত্রীরা বাংলাদেশটাকে দেখবেন এবং বলবেন, অন্তত মনিরের জন্য আমরা শান্তির একটা শপথ নেব। কিন্তু সেটি ঘটেনি। নেতা-নেত্রীরা চলেছেন তাঁদের রাজনীতির ‘আদর্শে’। শিশু মনিরের পর আরও অনেক লাশ পড়েছে।
৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের ব্যাপক তাণ্ডব হলো। সে রাতে পুলিশি অভিযানে হাজার হাজার আলেম ও এতিম মারা পড়েছেন বলে দাবি জানানো হলো (এই দাবি ৩০ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া আবারও করলেন), গণহত্যার তথ্যও হাজির করা হলো। এক এনজিও দাবি করল, হাজার হাজার না হোক, ৬১টি লাশ পড়েছে, যদিও যাদের লাশ গোনা হলো, তাদের কেউ কেউ সশরীরে হাজির হয়ে জানালেন, না, এ যাত্রায় তাঁরা মারা পড়েননি। অথচ মাদ্রাসা-মক্তব থেকে হাজির করানো অসংখ্য শিশু-কিশোরকে ২৪ ঘণ্টা কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই না যেতে হলো। এই শিশু-কিশোরের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিটা কি কারও চোখে পড়েছে? তাদের কথা কেউ কি একবার ভেবেছে?
২০১৩ সালটি শিশুরা ভুলে যেতে চাইবে। এই বছর তারা নিয়মমতো স্কুলে যেতে পারেনি অথবা গিয়েছে বোমা-ককটেল-সহিংসতার মাঝখান দিয়ে; তাদের ক্লাস-পরীক্ষা পিছিয়েছে, মাঠের খেলাধুলা তারা ভুলেছে। এই শিশুরা আগামী দিনের নাগরিক, এ কথা বলেন নেতা-নেত্রীরা। আগামী দিনের নাগরিকদের জিম্মি করে যাঁরা ক্ষমতায় যেতে চান, তাঁদের কী বলা যায়? আগামী দিনের রাজনীতিবিদ?
বাংলাদেশে আর কোনো বছর শিশুরা রাজনীতির কাছে এভাবে জিম্মি হয়নি। এক যুদ্ধাপরাধী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেলে মহানন্দে দুই আঙুলে বিজয়চিহ্ন দেখিয়েছিল। এই বিজয় চিহ্নকে বিজয়ী করতে এরপর তার দলটি নেমে গেল ধ্বংসযজ্ঞে। এবং আশ্চর্য, তাদের সঙ্গে তাল দিতে শুরু করল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। বছরজুড়ে চলা সহিংসতার বড় কারণ ছিল দুই দলের এই যুগ্ম আন্দোলন।
আন্দোলনটি এতটা পরিব্যাপ্ত ও সহিংস হতো না, যদি না শাসক দল নির্বাচনের প্রশ্নে একলা চলার নীতি গ্রহণ করত। যদি নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতো এবং সমঝোতা হতো, তাহলে এই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়তো ঠেকানো যেত। কিন্তু শাসক দল থাকল অনমনীয়। সংবিধানের প্রশ্ন তুলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে এগোল দলটি। ফলে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন আর বিএনপির নির্বাচনী আন্দোলন এক হয়ে গেল এবং একসময় বিএনপির আন্দোলন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর আন্দোলন।
অথচ এই সহিংস সংঘাতে মারা পড়তে বসেছে দেশটাই। দেখেশুনে মনে হয়, গণতন্ত্রে বুঝি শুধু নির্বাচনটাই প্রধান। দলগুলোয় গণতন্ত্র নেই, তৃণমূলে গণতন্ত্র নেই, কোনো দলের আচরণে গণতন্ত্র নেই; নির্বাচনে হেরে গেলে সংসদ থেকে শত মাইল দূরে থাকা চাই, ক্ষমতায় থাকলে অর্থ-সম্পদ বাড়ানো চাই, বিদেশের ব্যাংকে টাকা পাচার করা চাই—অথচ সব সংগ্রাম ওই নির্বাচন নিয়ে। দেশ লাটে উঠুক, মানুষ পুড়ে মরুক, শিক্ষা গোল্লায় যাক, ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ুক—নির্বাচনটাই হলো মুখ্য। নির্বাচন মানে ক্ষমতায় থাকা অথবা যাওয়া। ক্ষমতা মানেই শক্তি-প্রতিপত্তি, অগাধ সম্পদ, বিদেশভ্রমণ, মাখনের মধ্য দিয়ে গরম ছুরি চালানোর মতো সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আখের গুছিয়ে নেওয়া।
২০১৩ সাল আমাদের দেখিয়ে দিল, গণতন্ত্রের নামে আমরা কত বীভৎস আচরণকে বৈধতা দিয়েছি। দলবাজেরা অবশ্য এই বীভৎসতাকেও যুক্তিযুক্ত করেন নানা উপায়ে। ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বরের ‘সরকারি অবরোধে’ এক বৃদ্ধা হাসপাতালে মারা গেলে তাঁর মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে বলে এক টক শোয় দাবি জানালেন এক দলীয় বুদ্ধিজীবী। অথচ শাহবাগে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মারা পড়া অনেক মানুষের মৃত্যুর দায় কে নেবে, সে কথাটি তিনি এড়িয়ে গেলেন। এই অকারণে, অসময়ে চলে যাওয়াদের মধ্যে আমার ছাত্রী মাসুমাও ছিল। মাসুমার জন্য কোনো নেতা-নেত্রী এক ফোঁটা সমবেদনা দেখাননি। তার চলে যাওয়ার কষ্ট তা তার নিকটজন ও আমরাই শুধু অনুভব করেছি। আর শিশু মনিরকে তো আমরা ভুলেই গেছি।
বছর শেষ হলো সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার কিছু সহকর্মীর ওপর সরকার-সমর্থকদের আক্রমণের ঘটনা দিয়ে। এটিকেও দলের চশমা চোখে লাগিয়ে দেখছেন অনেকেই। অথচ এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা মানে এদের ব্যাপকতা বাড়া। বিএনপি আমলে এ রকম ঘটেছে, তখন ওই দলের বুদ্ধিজীবীরা সেসব ঘটনা এড়িয়ে গেছেন। শুরু থেকেই সবাই মিলে এসব অন্যায় রুখে দিলে আজ হয়তো আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতাম। আমার দুঃখ হয়, ২০১৩ সালটা আমরা কাজে লাগিয়েছি অসংখ্য তরুণকে বিধ্বংসী কাজে নামিয়ে—দলের নামে, গণতন্ত্রের নামে, ধর্মের নামে। এরা কি কখনো আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে? রেললাইন ধ্বংস হলে দেশের ক্ষতি হয়, কিন্তু সেটি পুষিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু বিশালসংখ্যক তরুণকে সহিংসতার শিক্ষা দিয়ে মাঠে নামালে যে ক্ষতি তারা দেশ ও নিজেদের করে, তা কি কখনো সামাল দেওয়া যায়?
এত চড়া মূল্যে কেনা ক্ষমতা কি দেশের কোনো মঙ্গল করতে পারে? কোনো দিন? এ বছর রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে অসংখ্য তরুণ পোশাককর্মী মারা গেলেন। এই ক্ষতি অপূরণীয়। সেখানে যারা আটকা পড়লেন, তাদের উদ্ধারে ছুটে এসেছে অসংখ্য মানুষ। উদ্ধারকাজে প্রাণও দিয়েছেন দু-তিনজন। এনাম মেডিকেলে মানুষ দেখেছে সেবার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ২০১৩ সালের এসব ছবিকেই আমি মনে রাখব। হরতাল-বোমা-সন্ত্রাস উপেক্ষা করে শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে—তাদের প্রত্যয়ী মুখ আমি মনে রাখব। নীলফামারীতে আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলায় পাঁচজন মানুষ খুন হলে এলাকার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীরা একসঙ্গে এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন—এই ঐক্যের ছবিটি মনে রাখব।
২০১৩-এর নৃশংস চেহারাটি বাংলাদেশের প্রকৃত চেহারা নয়—প্রকৃত চেহারা ধারণ করেছেন অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে। প্রকৃত চেহারাটি যেমন রাজশাহীতে এক পুলিশকে বাঁচাতে নামা সাহসী ঝরনা বেগমের, উপড়ে ফেলা ট্রেনলাইন ধরে ধেয়ে আসা ট্রেনের যাত্রীদের বাঁচাতে নামা সেই কৃষকের, প্রাইমারি ও জেএসসি পরীক্ষায় পাস করা প্রত্যয়ী ও হাস্যোজ্জ্বল সেই শিশুদের।
বাংলাদেশ ক্ষমতার রাজনীতির কাছে, ধর্মান্ধতার কাছে, সন্ত্রাসের কাছে, দুর্নীতি-দুরাচারের কাছে হারতে পারে না। এই মুহূর্তে মনে হতে পারে হয়তো আমরা পিছিয়ে পড়েছি, কিন্তু একটা লড়াইয়ে হারা মানে যুদ্ধে হারা নয়। যে জাতি একাত্তরে যুদ্ধ করে জিতেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা সে জানে।
জেএসসি-প্রাইমারি পরীক্ষায় পাস করা শিশুদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে আমার মনে হয়েছে, একটা অন্ধ সময় আমরা পার করছি বটে, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টাও ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু