সময়চিত্র- বইমেলা, বাংলা ভাষা এবং কিছু প্রশ্ন by আসিফ নজরুল

Saturday, February 15, 2014

বইমেলার সঙ্গে আমার প্রজন্মের মানুষের পরিচয় আশির দশক থেকে। ১৯৮৮ সাল থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমি চাকরি করার সুবাদে এই পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
বিচিত্রার শাহরিয়ার কবির, মঈনুল আহসান সাবের, মাহমুদ শফিক, শামীম আজাদ তখনই ছিলেন খ্যাতিমান লেখক। বিচিত্রায় যাঁরা লিখতেন, তাঁদের আরও অনেকের বই বের হতো তখন। কাজেই বইমেলা আসার বহু আগে থেকে এর তোড়জোড় টের পাওয়া যেত সেখানে। প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, প্রুফ রিডার আসতেন, গল্প করার জন্য আসতেন বড় লেখকেরা, প্রচারের জন্য নবীন লেখকেরা। বিচিত্রা তখন প্রভাবশালী সাপ্তাহিকী ছিল বলে বইমেলার দিনগুলোতে সাহিত্য পাতার সম্পাদক মঈনুল আহসান সাবেরের টেবিল ঘিরে থাকত নানা ধরনের সাহিত্যানুরাগী মানুষ।
বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বহু নতুন ধারার জনক ছিলেন। বিচিত্রাই বাংলাদেশে খুব বিস্তৃতভাবে বইমেলা কাভার করা শুরু করেছিল, ফেব্রুয়ারিতে লেখকদের নিয়ে বিভিন্ন প্রচ্ছদ-কাহিনিও। শওকত ওসমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক আর হুমায়ূন আহমেদকে বিচিত্রার কাভারে দেখতাম আমরা, সশরীরে দেখতাম বিচিত্রা অফিসে। সে সময়ের বহুল আলোচিত একটি প্রচ্ছদ-কাহিনি ছিল সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আলাপচারিতা। সৈয়দ হক হুমায়ূন আহমেদকে প্রশ্ন করেন: আপনি ছয় ফর্মায় উপন্যাস লেখেন কী করে? হুমায়ূন আহমেদের পাল্টা প্রশ্ন ছিল: আপনি ছয় লাইনে কবিতা লেখেন কেমন করে? আমরা বইমেলায় গিয়ে দেখতাম সেখানে বড় একটি আলোচনা ছিল বিচিত্রার এসব প্রচ্ছদ-কাহিনি আর বইমেলার সংবাদকে ঘিরে।
আমার ঔপন্যাসিক হওয়ার সূচনাও বিচিত্রা থেকে। সে সময়ের একজন জনপ্রিয় লেখক ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অদ্ভুত এক উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানে ছাত্রনেতারা মাথায় ফেট্টি বাঁধেন, হাতে থাকে তাঁদের হকিস্টিক আর হূদয়ে শুধু নারীর ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। অথচ আমাদের চেনা ছাত্ররাজনীতি ছিল তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন, এরশাদবিরোধী সময়ে ছাত্রনেতাদের জীবনযাপনও ছিল আরও অনেক অগ্রসর। খুব বিরক্ত হয়ে হয়ে আমি নিজেই লিখে ফেলি একটি উপন্যাস নিষিদ্ধ কয়েকজন। বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় তা ছাপা হওয়ামাত্র সবিস্ময়ে দেখি কয়েকজন প্রকাশক এসে হাজির অফিসে, আমার বই বের করতে চান বইমেলায়। পিএইচডি করতে লন্ডনে যাওয়ার আগে এর পরের চার বছরে বইমেলাই হয়ে ওঠে আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রাঙ্গণ। তখনকার সময় বহু মানুষ ঈদ-পূজা-জন্মদিন, আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল খেলা বা নাটক-যাত্রার মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করত। আমরা করতাম একুশের বইমেলার জন্য। বইমেলার নতুন বইয়ের গন্ধ, নবীন লেখকের লাজুক গাম্ভীর্য, বইমেলা চত্বরের দুমড়ানো ঘাস, হঠাৎ বাতাসে ছিটানো ধুলোকণা—সবকিছুর জন্য। বইমেলার বিকেল আর সন্ধ্যা কেন সর্বদাই অস্তগামী আর বইমেলার মাস কেন দ্রুতগামী, এই আফসোস কখনো শেষ হতো না আমাদের।
একুশের বইমেলা এখন বহুগুণ বড় হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে এখন তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল পরিসরে সম্প্রসারিত হয়েছে। দৈনিক পত্রিকা আর টিভিতে বইমেলা প্রধান সংবাদ হচ্ছে, প্রতিদিন নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে, বইয়ের বিজ্ঞাপনে রঙে ঢেকে যাচ্ছে অসুস্থ খবরের বিষাদ। উপন্যাস আর লেখা হয়নি, এই দুঃখে বইমেলা থেকে আমি দূরে আছি বহু বছর। তবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি নতুন বইয়ের খবর, দূর থেকে আরও নিবিড়ভাবে অবলোকন করার চেষ্টা করি বইমেলার মাহাত্ম্য আর বিশালত্ব। অনুভব করার চেষ্টা করি বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে ধারণ আর বেগবান করার ক্ষেত্রে এর অবদান। কিন্তু আমি একই সঙ্গে বিচলিত হই মধ্যবিত্ত আর নব্য ধনিক শ্রেণীর ওপর সারাটা বছর ধরে ভিনদেশি ভাষার ক্রমবর্ধমান আধিপত্যেও। ভাবি বইমেলার মর্মবাণীকে, বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে আসলে কতটা অর্থবহ করতে পেরেছি আমরা এই স্বাধীন বাংলাদেশে?
ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তার রাজনীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞান ও উপলব্ধি খুব সীমিত। তবু এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বইমেলা শুধু বাংলা ভাষায় বই প্রকাশের অনুষ্ঠান নয়, এটি বাংলাকে প্রাণের ভাষা হিসেবে উদ্যাপন, বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয় ধারণ ও প্রকাশ করার এক স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন। ফেব্রুয়ারির বইমেলা আমাদের অনিবার্যভাবে নিয়ে যায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় স্মৃতিচারণায়। বাংলাকে তখন শুধু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি, ধর্মসর্বস্ব এক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্ত করাও হয়েছিল এই অঞ্চলের মানুষের মনোজগৎকে। বাংলাদেশ যে কখনো পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ যে কখনো সাম্প্রদায়িক নয়, এই দেশের মানুষের ইতিহাসবোধ আর কৃষ্টির শুরু যে ১৯৪৭ সালের বহু যুগ আগে থেকে, তার জোরালো ও দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার লড়াইয়ে বিজয়ী না হলে এত তাড়াতাড়ি আমরা পাকিস্তান নামক কূপমণ্ডূক রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ পেতাম না, বইমেলাও হয়তো তখন হতো না এমন প্রাণের মেলা!
আমাদেরই তাই সবচেয়ে ভালো করে জানার কথা যে নিজ ভাষা মানে শুধু স্বাতন্ত্র্য নয়, এর মানে স্বাধীনতা, জাতিসত্তা, আত্মমর্যাদাবোধ এবং আত্মপরিচয়। নিজ ভাষাকে জীবনযাপনে, আচার-অনুষ্ঠানে আর সব সামাজিকতায় তাই আত্মস্থ করতে হয়। কিন্তু আমরা কি আসলে তা পারছি আর? বইমেলার এক মাস আমাদের নিজ ভাষার সবচেয়ে শৈল্পিক প্রকাশ আর সৃজনশীল আত্মপরিচয়ের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু ভাষাভিত্তিক এই সংস্কৃতিবোধ বারো মাসের আকাশ সংস্কৃতির দাপটে কি দূষিত হওয়ার হুমকিতে পড়েনি? আমাদের একদল শিশু কি বাংলা শেখার আগে কিংবা বাংলার চেয়ে ভালো করে বলতে শিখছে না হিন্দি কিংবা ইংরেজি? পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে রক্ত দিয়ে লড়াই করে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার সময় আমরা কি এমন একটি সময়ের প্রত্যাশা করেছিলাম?
অন্য ভাষা শেখা বা বলায় আমার কেন কারোরই আপত্তি থাকার কথা না। আমি ইংল্যান্ড আর জার্মানিতে পড়াশোনা করার সময় দেখেছি সেখানকার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী একাধিক বিদেশি ভাষা জানেন। ফ্রান্সের মানুষ অনর্গল বলতে পারছে চীনা ভাষা, কিংবা জাপানের মানুষ বলছে স্প্যানিশ, এটা খুবই সাধারণ এমনকি প্রত্যাশিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে গোলাকায়নের এই যুগে। কিন্তু আমার জানামতে, এই ভাষাশিক্ষা মূলত জ্ঞানচর্চা বা জীবিকার প্রয়োজনে। ঠিক সে ধরনের সচেতন সিদ্ধান্ত থেকে আমরা যেকোনো ভাষা শিখতে পারি। কিন্তু ভিনদেশি ভাষা শিক্ষা যদি হয় বাধ্য হয়ে, আকাশ সংস্কৃতির কাছে নিজের অজান্তে সমর্পিত হয়ে, তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ আছে।
অন্য ভাষা জানার প্রয়োজন কী, এটি কেন চর্চা করা হচ্ছে, সেটিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। ইংরেজি পৃথিবীর সবচেয়ে কমন ভাষা বলে আমাদের ইংরেজি জানতে হবে, ভারতে পড়তে গেলে হিন্দি বা কোরিয়ায় পড়তে গেলে কোরিয়ানও। কিন্তু বিদেশি ভাষা যদি আমাদের সামাজিক জীবনযাপন এবং আচার-অনুষ্ঠানকে গ্রাস করে, বাংলার স্থান দখল করে ফেলে—আমার আপত্তি সেখানেই। বিয়ে, জন্মদিন, যেকোনো উদ্যাপনে কেন আমরা দেখব বিদেশি গান আর নাচের অনুকরণ সংস্কৃতি? ছাব্বিশে মার্চ বা ষোলোই ডিসেম্বর কেন পাড়ার ক্লাবেও আনন্দ করে বাজানো হয় হিন্দি এমনকি উর্দু গানও? যিনি ভারতীয় সিরিয়াল দেখবেন তিনি হিন্দিতে তা দেখুন, কিন্তু স্পোর্টস চ্যানেল বা এইচবিও হিটস-এ ছবি দেখতে গেলে কেন আমাকে শুনতে হবে হিন্দি!
অন্য ভাষা যখন প্রাত্যহিক জীবনযাপন আর সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের রিংটোনে প্রবেশ করে, তখন নিজস্ব সামাজিক সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্যবোধ আর আত্মমর্যাদাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বল হয়ে গেলে ভিনদেশি ভাষা-সংস্কৃতির হাত ধরে আসে ভিনদেশি পণ্য এমনকি ভিনদেশি রাজনীতির আধিপত্য। বাংলা বইমেলায় এক মাসের অনুষ্ঠানের সময়ে হলেও আমরা কি কখনো ভেবে দেখছি তা? একবারও কি আমরা আলোচনা করছি নিয়ন্ত্রণহীন আকাশ সংস্কৃতি কীভাবে গ্রাস করছে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি আর স্বাধীন সত্তাকে? কীভাবে তা বেসুরো হয়ে আছে বইমেলা, একুশে আর পয়লা বৈশাখের আবেদনের সঙ্গে?

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

গল্প- অষ্টাদশী by উম্মে মুসলিমা

Sunday, January 26, 2014

তরুবুর সঙ্গে দেখা ফরিদপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে আমারও ফরিদপুরে ট্রেন বদল। সেই সুচিদি। অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো দেখতে ছিল বলে আমরা বন্ধুরা তরুবুকে ডাকতাম সুচিদি।
সুচিত্রা সেন এ বয়সে দেখতে কেমন হয়েছিলেন, জানার কোনো উপায় নেই। কদিন আগে কে যেন ফেসবুকে সুচিত্রা সেনের এখনকার একটা ছবি আপলোড করেছিল। আমি ভালো করে না তাকিয়েই দ্রুত মাউস ঘুরিয়ে নিচে চলে আসি। সেটা হতে পারে আমি সেই সাগরিকা বা হারানো সুর-এর মোহনীয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই বা সুচিত্রার নিজেকে আর প্রকাশিত না করার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে চাই বলে। সুচিদিকে দেখে আন্দাজ করা যায় কি মৃত্যুর এই কদিন আগেও দেখতে কেমন ছিলেন সুচিত্রা সেন? সিঁথি অনেক চওড়া, পাতলা চুল, সাদার আধিক্য। পাবনাই তাঁতের সবুজ-কমলা শাড়ি, ব্লাউজের হাতার ভাঁজে ছেঁড়া, দুটো সোনার ক্ষয়ে যাওয়া চুড়ির সঙ্গে দুটো কাচের চুড়ি, এক পা তুলে কংক্রিটের বেঞ্চের ওপর হাতের ব্যাগটা কষে চেপে ধরে বসে আছে। পা তুলে রাখার কারণে উরুর কিছুটা অংশ বেখেয়ালে বেরিয়ে আছে। দু-একজন পথচারী আড়চোখে দেখেও নিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পানের পিক ফেলতে গেলে শাড়ির ওপর খানিকটা ছলকে পড়লে সুচিদি তটস্থ হয়ে কী দিয়ে তা মোছা যায় তার অনুসন্ধান করতে লাগল। পানের খিলি জড়ানো ফেলে দেওয়া কাগজটা নিচু হয়ে মাটি থেকে তুলতে গিয়ে পা নামাতে হলো। যাক, এতক্ষণে স্বস্তি পেলাম। পান চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতের কী ছিরি করেছে? আগে হাসলে একগালে টোল পড়ত। এখনো হেসে উঠল। কিন্তু টোলটা পুকুরের জলে ঢিল ফেলার মতো ঢেউ না তুলে বলিরেখার সঙ্গে এক লাইনে হারিয়ে গেল। দাঁড়িয়েছিলাম। আমার হাতে পানের পিকলাগা আঙুল ছুঁইয়ে পাশে বসতে বলল আমাদের সেদিনের সুচিত্রা সেন। কত বদলেছি আমি, সুচিদি—আমাদের চারপাশ। তবুও ঠিক, সেই ফেলে আসা দিনগুলোর মতোই আপনস্বরে একটুও অবাক না হয়ে সুচিদি বলল,

‘এখেনটায় বোস রুমা। কদ্দিন পর দেখা বল তো। বাড়ি যাচ্ছিস? চাচি বেঁচে আছে?’

‘না গো সুচিদি।’

সুচিদি কি একটু কেঁপে উঠল? আমার মায়ের মৃত্যু তাকে কেঁপে ওঠার মতো আঘাত দেওয়ার অতখানি যোগ্যতা রাখে না। তাহলে? ‘কদ্দিন পর নামটা শুনলাম! ভুলেই গেছলাম’—স্বগতোক্তির মতো করে বলে কী মনে করে আনমনে নিজের গালে হাত বুলাল সে। হয়তো বা কারও প্রশংসা বা হারানো যৌবনের কথা মনে হলো তার। দেখলাম, সুচিদির চিবুকের বিখ্যাত তিলটির ওপর একটা চুল। সাদা।

‘বাড়িতে কার কাছে যাচ্ছিস? কে আছে?’

‘আর বোলো না। রবুদার মেয়েটাকে নিয়ে ভারি ঝামেলা হচ্ছে। ভাবি মারা গেছে চার বছর হলো, জানো তো। ভারি জেদি আর একরোখা মেয়েটি। রবুদা সামলাতে পারছে না। গত পরশু ঘুমের ওষুধ খেয়ে সে এক কাণ্ড...’

‘ও। কত বয়স হলো ওর?’

‘এই তো আঠারো।’

সুচিদি আবার পা তুলে বসল। স্টেশনের লাল দালান ছাড়িয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঝলমলে রাধাচূড়া। তার ওপরে ঝুঁকে আছে কৃষ্ণ মেঘ। সুচিদি কোন দিকে চেয়ে আছে বুঝলাম না। হয়তো আকাশে। কিন্তু আমি জানি, সুচিদিকে ‘এই তো আঠারো’ টেনে নিয়ে যাচ্ছে পেছনের দিকে।

সুচিদি, মানে তরুবু ছিল পাতার বড় বোন। পাতা আমার বন্ধু। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব মাঝে একটা মসজিদ আর ক্লাবঘরের। ক্লাবটা ওদের বাড়ির ঠিক পাশে। পাতার বাবা ছিলেন রেজিস্ট্রি অফিসের মুহুরি। তরুবু তখন তিন-চার বছর আগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ডাইনিং চেয়ারের কভারে কাটওয়ার্ক করে, কেক-টিকিয়া-কাবাব বানানো শেখে, একতলার ছাদে রোদ পড়ে এলে আচারের বয়াম তুলতে গেলে ক্যারমবোর্ড থেকে চোখ তোলা ক্লাবের সব ছেলের একমাত্র দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। ছেলেগুলোর সারা দিনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। তো আমার ভাই রবিউল মাহমুদ ছিল ওই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। বাবা ওর নাম রেখেছিল মো. রবিউল হোসেন। তখন কবি আল মাহমুদের সোনালি কাবিন-এর ভক্তরা নিজেদের নামের শেষে সবাই মাহমুদ যোগ করতে শুরু করল। আমার ভাই রবু কবিতা লিখত। একদিন ক্লাবে কবিতা পাঠের আসরে মাইক এনে মাইকের মুখ পাতাদের বাসার দিকে ঘুরিয়ে ‘জন্ম আমার আজন্ম বৃথা’ নামে তার নিজের লেখা কবিতা পড়ল। ক্লাবের আর এক ত্যাঁদড় সদস্য মোমিনুল রবুদার কবিতা আবৃত্তির পরপরই মাইক কেড়ে নিয়ে ঘোষণা দিল—‘রবিউল মাহমুদ এতক্ষণ যে কবিতাটি পড়লেন, সেটি দাউদ হায়দারের “জন্ম আমার আজন্ম পাপ”-এর হুবহু নকল। এ ক্লাব থেকে নকল কবিদের উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।’

আমি আর পাতা তখন ওদের চিলেকোঠায় সুচিদির বানানো মুড়ির মোয়া খাচ্ছিলাম আর সব কানে আসছিল। আমার ভাইয়ের ভরাট গলার কবিতা আমাকে কবির বোন হিসেবে যখন গর্বিত করতে উদ্যত, তখনই ওই ঘোষণা। আমি দ্রুত অন্য গল্পে মোড় নিলাম। কিন্তু পাতা বিশ্বাস করল না। বলল,

‘এ হতেই পারে না। মাসিক পাথরকুচিতে রবুদার কবিতা আমি পড়েছি। একটাও নকল না। বললেই হলো!’

কিন্তু যার জন্য এত কবিতা রচনা, এত কবিদের আবির্ভাব, তার কোনো বিকার নেই। কবিতা-টবিতা ওসব ওর কানেই যায় না। সুচিদি দিব্যি বালিশের ওয়ারে ক্রুশকাঁটার কাজ করছে আর মুখ না তুলেই তার জিজ্ঞাসা,

‘কীসের এত হইচই রে ক্লাবে?’

‘রাজকন্যাকে জয় করার মহড়া চলছে’—পাতার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। তরুর তুলনায় পাতা একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু পাতা ক্লাসে থার্ড-ফোর্থ হয়। অনেক বই পড়ে। আমাদের বাড়ি এসে রবুদার আলমারি থেকে বই নিয়ে যায়। আমার কেন জানি মনে হয়, পাতা রবুদাকে ভালোবাসে। রবুদা অবশ্য ভাবে পাতা তরুর অনুরোধে বই নিয়ে যায়। ক্লাস নাইনে পড়া পাতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হজম করতে পারবে এ বিশ্বাস তার ছিল না বলেই একদিন বইয়ের মধ্যে চালান করে দেয় তরুর উদ্দেশ্যে প্রেমপত্র। পাতা আর আমি ওদের চিলেকোঠার ছাদে দরজা বন্ধ করে সে চিঠি পড়েছিলাম। এখনো মনে আছে, চিঠিতে এ রকম লেখা ছিল—‘সুচরিতাসু, আমি কত বসন্তরজনী তোমাকে নিয়ে শয্যা রচনা করেছি।’ আমার ভারি লজ্জা লাগছিল বলে আমি আর পড়িনি। পাতা তা হস্তান্তর করেনি প্রাপককে। করবেই বা কেন? সুচিদির তখন ফরিদপুর কলেজের ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে বিয়ের কথা প্রায় পাকা। তবে পাত্র বছর খানেক সময় নিয়েছিল এমএ পাস করার জন্য। এমএ পাস করলে পাংশা কলেজে পৌরনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করতে পারবে—এ রকম নিশ্চয়তা সে পেয়েছিল। সুচিত্রা সেনকে গ্রহণের যোগ্য করে তুলতে হবে না নিজেকে!

চিঠিটা পেলে তরু কী সিদ্ধান্ত নিত জানি না। তবে তরুর ভালো গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন, ঘর-সংসার সামলানো, অনুগত পুত্রবধূ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখে মনে হয়নি সে কোনো বিপ্লব করার ক্ষমতা রাখে। রবুদাকে বিয়ে করার মতো বোকামি কেন করতে যাবে তরু? পাত্র হিসেবে রবুদার কী পরিচয়? বিএ পাস করে কেবল সাহিত্য করলে ওর কাছে কে মেয়ে দেবে? হ্যাঁ, জমাজমি আমাদের ভালোই ছিল। কিন্তু কলেজের অধ্যাপক আর বেকারের মধ্যে তুলনা চলে? তবে কেন জানি রবুদা ধরেই নিয়েছিল, তরু তাকেই ভালোবাসে। জোর করে তরুর বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

‘আজ তরুবুর মুখে ক্ষীর। দুলাভাইয়ের বোন আর ভগ্নিপতি আসবে। তুই আসিস কিন্তু’—একটু গলা বাড়িয়ে রবুদার ঘরের দিকে মুখ করে আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেল পাতা।

রবুদা খানিক ঝিম ধরে বসে থেকে গায়ে একটা জামা চড়িয়ে বেরিয়ে গেল। গ্রামে ঢোকার মুখে রেলগেটের দোকানে গিয়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকল যতক্ষণ না তরুর বৈবাহিক লোকজন আসে। রবুদা নাকি ওদের মোটরবাইক আটকেছিল। তরুর হবু ননদাইকে নামিয়ে দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে তরু সম্পর্কে যাচ্ছেতাই অপবাদ দিয়েছিল, যাতে ওরা ওখান থেকেই ফিরে যায়। 

ফিরে তো যায়ইনি, উপরন্তু মুখে ক্ষীরের দিন পাত্রকে ডেকে পাঠিয়ে পরদিনই কলমা পড়িয়ে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে কেদারনাথের পগারপার। মোটা, বিরল কেশ, ভোঁতামুখের অধ্যাপককে সুচিদির ভক্তরা নাম দিয়েছিল কেদারনাথ। হূদয় ভেঙে গেল অনেক যুবকের। ক্লাবঘর কিশোরদের দখলে চলে গেল। খড়ের ছাউনির দুর্বল ক্লাবঘরের চাল অভিভাবকদের মনোযোগের অভাবে এক বৈশাখে উড়ে গিয়ে পাতাদের উঠোনে গিয়ে পড়ল। সবকিছু লন্ডভন্ড। রবুদা একমুখ দাড়ি নিয়ে দেড় মাস পর খালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি এল। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে পাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়তে গেলাম। পাতা শহরের স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলো। মা রবুদার জন্য সুন্দরী পাত্রী জোগাড়ের প্রাণান্ত চেষ্টা চালাতে লাগল। রবুদা কবিতা ছেড়ে ঠিকাদারি শুরু করেছে। চোখের দিকে তাকানো যায় না। কেমন জিঘাংসার আগুন জ্বলজ্বল করে।

দুই বছর পর মায়ের চিঠি।

‘পর সমাচার এই যে, গতরাতে তোমার প্রাণের বান্ধবী পাতা বিষপানে আত্মহত্যা করিয়াছে। পুলিশ আসিয়াছিল। সে লিখিয়া গিয়াছে তাহার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে। তরু ও তরুর স্বামী আসিয়া সব ব্যবস্থা করিয়াছে। তাহার মা পাগলপ্রায়। ছুটি হইলে চলিয়া আসিও। রবুর জন্য পাত্রী পছন্দ হইয়াছে। ইতি মা।’

আমার হোস্টেলের বান্ধবীরা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। আমি পাতার চিঠিগুলো বের করে পড়ার চেষ্টা করলাম। কোথায় পাতার বেদনা তা খোঁজার জন্য বারবার করে পড়তে থাকলাম। কিন্তু কান্নায় আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। আমার রুমমেট আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিল। ছুটি হতে আরও দিন সাতেক দেরি থাকলেও আমার রুমমেট আমাকে নিয়ে পরদিনই রওনা দিল। আমি ছুটে গিয়ে পাতার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। পাতার মা উদ্ভ্রান্তের মতো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, তার ছড়ানো দু-হাত আমার পিঠে উঠে এল না। তরুবু তার বাঁ হাতে স্ফীত তলপেট চেপে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিল। সে হাতের ছোঁয়া আমার আবেগকে দু-কূল প্লাবিত করতে ব্যর্থ হলো। আমি চোখ তুলে সুচিত্রা সেনকে খুঁজলাম। এ কবছরেই সুচিদির বয়স এত বেড়েছে! নাকি গর্ভবতীদের চেহারা এ রকম হয়ে যায়? অত টিকলো নাক ওরকম মোটা দেখাচ্ছে কেন? নাকি এসবই আমার ঝাপসা চোখের প্রতিফলন? শোকে-বিহ্বলে কেমন নিষপ্রাণ আচরণ সবার। কেন পাতা এমন করল, কী হয়েছিল ওর—কাউকে জিজ্ঞাসা করার সে পরিবেশও আমাকে কেউ উপহার দিল না। আমি একাই ওর ঘরে গেলাম। ওর বইখাতা ছুঁয়ে ওর হাতের স্পর্শ নিলাম। আমার দেওয়া মানিপ্ল্যান্টটা ওর খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত। ওর বালিশ টেনে নাকে ধরলাম। নারকেল তেলে মেথি মিশিয়ে সারা বছর চুলে দিত পাতা। বালিশে পাতার জীবন্ত গন্ধ। আমি ‘পাতা পাতা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মানিপ্ল্যান্টের পাতারা একটুখানি নড়ে উঠল।

সুচিদি সংবিৎ ফিরে আমার ঘাড়ে হাত রাখল। এ স্পর্শেও প্রাণের ছোঁয়া নেই। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল,

‘আব্বা তো ছবছর হলো মারা গেছে। মাও অসুস্থ। আমার কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। যেতে চায় না।’

‘তোমার কটা গো সুচিদি?’

‘দুটো। ছেলেটা বড়। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেব ভাবছি।’

‘ওমা! এত তাড়াতাড়ি?’

‘মেয়েটা পাতার মতো দেখতে।’

‘তো?’—বলে ফেলেও আমি চাইলাম না সুচিদি পাতার কথা তুলুক। পাতার জন্য আমার কষ্ট তো সুচিদির কষ্টের কাছে কিছুই না।

সুচিদি আবার আনমনা। মাথার ঘোমটা ঘাড়ে এসে পড়ল। কানে ভারী দুটো পাশা। অনেক দিন ধরে পরে থাকার কারণে কানের লতি কেটে পাশা ঝুলে পড়েছে। সুচিদিকে এখন বেশ দেখাচ্ছে। কিন্তু আলো আমার আলো-এর সুচিত্রা সেনের মতো নয়। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছল সে। ট্রেন আসার ঘণ্টা হলে সবাই তটস্থ হয়ে নামিয়ে রাখা ব্যাগ হাতে তুলে নিল। আমার ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে আবার মাথার ঘোমটা টেনে ব্যাগটা কোলের ওপর তুলে সুচিদি বলল,

‘পাতা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল।’

আমার হাতের ব্যাগ বেঞ্চের ওপর ধপ করে পড়ে গেল। মানুষজন প্লাটফর্মে জড়ো হতে শুরু করেছে। আর আমি ভারসাম্য রাখতে না পেরে বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। সুচিদি উঠে দাঁড়াল।

‘রবুর মেয়ের বয়স কত বললি?’

‘আঠারো, কেন?’

‘পাতারও আঠারোই ছিল কিনা।’ 

ইঞ্জিনের মুখে ঘন ধুলো উড়িয়ে ট্রেন আরও সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুচিদি বসে থাকা আমাকে কোনো ধরনের তাড়া না দিয়েই ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। সুচিদি যে বগিতে উঠল, আমি সেটাতে উঠেও আবার নেমে এসে পরের বগির জন্য একটু জোরে পা চালালাম।

জেমকন সাহিত্য পুরস্কার পেলেন পারভেজ হোসেন ও মুম রহমান

Sunday, September 18, 2011

০১১ সালের জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ও জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন ও মুম রহমান। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রূপসী বাংলা হোটেলের বলরুমে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
পারভেজ হোসেনকে তাঁর 'যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের' গ্রন্থের জন্য নগদ দুই লাখ টাকা, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র এবং মুম রহমানকে তাঁর 'অন্ধকারের গল্পগুচ্ছ' নামে গল্পের পাণ্ডুলিপির জন্য নগদ ৫০ হাজার টাকা, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়েছে। জেমকন গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শাহেদ আহমেদ পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে এ অর্থমূল্য তুলে দেন।
অনুষ্ঠানে প্রথমেই মনোজ্ঞ সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট শিল্পী অদিতি মহসিন। বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় তিনি গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথের কিছু গান। এতে সাহিত্য আসরের অন্য রকম আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা, মিলনায়তনের বাইরে তখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। গানের পর শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে শুরু হয় অনুষ্ঠানের মূল পর্ব।
গানের পর মূল অনুষ্ঠানে তরুণ কথাসাহিত্যিক মুম রহমানের গল্প সম্পর্কে আলোচনা ও সম্মাননা পাঠ করেন ভারতের কবি রণজিৎ দাশ। কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেনের গল্প নিয়ে আলোচনা ও সম্মাননা পাঠ করেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। পরে পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই লেখককে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও কাজী নাবিল আহমেদ।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন জেমকন গ্রুপের পরিচালক ড. কাজী আনিস আহমেদ। তিনি বলেন, 'আমরা ২০০০ সাল থেকে কাগজ সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করি। পরে ২০০৭ সাল থেকে তা জেমকন সাহিত্য পুরস্কার নামে প্রতি বছর প্রদান করে আসছি। বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল লেখকদের সম্মানিত করার জন্যই মূলত এ পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। জেমকন সাহিত্য পুরস্কার সৃষ্টিশীল লেখকদের প্রেরণা জোগাবে বলে আমার বিশ্বাস।'
পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন বলেন, পুরস্কার আসলে জোনাকির মতো, ফুর্তি ও উৎসবের মধ্যেই তা শেষ। কিন্তু পুরস্কারপ্রাপ্তি বা স্বীকৃতি লেখককে কঠিন দায়িত্বের মধ্যে ফেলে। আবার এই দায়বোধের পাশাপাশি পুরস্কারপ্রাপ্তি লেখককে আরো নতুন উদ্যমে কাজ করার প্রেরণা জোগায়। তবে লেখকের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আসলে পাঠকের ভালোবাসা। জেমকনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তরুণ কথাসাহিত্যিক মুম রহমান বলেন, 'এ পুরস্কার পেয়ে যেমন আনন্দ অনুভব করছি, তেমনি অনেক বেশি দায়িত্ব মাথার ওপর এসে গেল বলে মনে হচ্ছে। আমি মনে করি, জেমকনের এ পুরস্কার তরুণদের জন্য ভবিষ্যত সৃজনশীল কাজে প্রেরণা জোগাবে।' অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি মোহাম্মদ রফিক, কবি কামাল চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের, কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক ড. রফিকুল্লাহ খান, কবি শামীম রেজা, কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল প্রমুখ।

বইপত্র- রোকেয়ার আলো by সুদীপ্ত শাহীন

Tuesday, August 16, 2011

প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদে বাংলাদেশের নারী ও রোকেয়ার দর্শন—সম্পাদনা করেছেন নাজমা চৌধুরী \ ২০১০ \
পাঠক সমাবেশ \ পৃষ্ঠা ৮৭ \ ২৯৫ টাকা
উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। পাশাপাশি মহীয়সী একজন নারী, একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব হিসেবেও নন্দিত। সংগঠক, সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। নারীমুক্তির পথিকৃৎ ও নারীবাদের প্রবক্তা হিসেবেও তাঁর অবদান চিহ্নিত।

এ রকম বহুবিধ অভিধায় তিনি সম্মানিত। তাঁর সকল কর্ম ও সৃষ্টির বহুধা হলেও সবকিছুর মূলে রয়েছে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমতা নিশ্চিত করা। এ কারণে তাঁর যাপিত জীবন, কর্ম ও সৃষ্টির আলোকে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা বর্তমানের বিদ্যোৎসাহী, আলোকপিয়াসী, মুক্তমনা নারীরা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো দেশের প্রধানতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা। নতুন শতাব্দীতে নারীর জন্য এই প্রাপ্তি মহার্ঘ্য এক সম্পদতুল্য, যার শুরুটা হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে। ২০০০ সালে উইমেন্স স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৬-এ পরিবর্তিত নাম দাঁড়ায় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, যারা প্রতিবছর আয়োজন করে রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালার। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালে উপস্থাপিত বক্তৃতার সংকলন বই প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদে বাংলাদেশের নারী ও রোকেয়ার দর্শন। সম্পাদনা করেছেন নাজমা চৌধুরী। লেখকেরা হলেন মাহমুদা ইসলাম, মালেকা বেগম, হাসনা বেগম ও সুলতানা কামাল। উপর্যুক্ত লেখকক্রম অনুযায়ী বিষয়গুলো হলো—রোল অব ওমেন ইন পলিটিক্স অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন, রোকেয়ার নারী ও ধর্মভাবনা: জাতীয় নারীনীতি, রোকেয়ার দৃষ্টিতে পারিবারিক আইন ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিত। এ ছাড়া রয়েছে লেখক পরিচিতি এবং সম্পাদকের লেখা ভূমিকা—রোকেয়ার দর্শন: রাজনীতিতে নারী, নারী আন্দোলনের স্বরূপ ও ধর্মের রাজনীতি।
বক্তৃতার শিরোনাম দেখে সহজেই অনুমিত হয় বিষয়বিন্যাসের স্বরূপ, যার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লড়াই-সংগ্রামের সারকথা। মানুষের সারস্বত জীবনের মৌল প্রসঙ্গগুলোই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। রাজনীতি, নারী আন্দোলন, ধর্মভাবনা, নারীনীতি, পারিবারিক আইনের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শিরোনামে রেখে তার ভেতরেও দৃষ্টি প্রোথিত করা হয়েছে, যাতে শুধু তথ্য সন্নিবেশন নয়, গভীর পর্যবেক্ষণ, তীক্ষ বিশ্লেষণ, নিরপেক্ষ মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে অতীতের প্রতি যেমন দৃষ্টিপাত করা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎ রূপরেখা ও প্রত্যাশার কথাও ব্যক্ত হয়েছে। ভূমিকাংশেও এমনটিই বলা হয়েছে: রোকেয়ার অবদান এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে বর্তমানে নারীসমাজের অবস্থান বিশ্লেষণ রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালার পরিধির বিস্তার ঘটবে। বর্তমান সংকলনে অন্তর্ভুক্ত বক্তৃতামালা এভাবেই বাংলাদেশে নারীর সমস্যাসংকুল অবস্থানের কয়েকটি দিক তুলে ধরেছে। রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালা রোকেয়া স্মরণে নিবেদিত হলেও এর একটি বৃহৎ প্রায়োগিক পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে, যা বিভাগের রোকেয়াচর্চাকে গুরুত্ববহ ও সম্ভাবনাময় করেছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা সমুন্নত করার প্রশ্নে রোকেয়া চর্চার কোনো বিকল্প নেই। যে অবস্থায়, যে পরিধিতে এ রকম কর্ম সম্পাদন হোক না কেন, তার জন্য সাধুবাদ জানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে যখন এ রকম কর্ম সম্পাদন হয়, তখন সেটি আমাদের সবাইকে আশান্বিত করে। নতুন সম্ভাবনায় বুক বাঁধতে শেখায়। এ রকম আয়োজন এবং শেষাবধি তার গ্রন্থভুক্তকরণ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কেননা, রোকেয়াচর্চার মধ্য দিয়েই যাওয়া যাবে আলোকপানে, যার জন্য প্রয়োজনে আলোকের এই স্রোতধারাকে বেগবান করা। লেখক-সম্পাদকের যৌথ প্রয়াসে আলোচ্য বই শত ফুল ফোটার সুযোগ করেছে। এখন মঞ্জুরিত হওয়ার পালা। যা হলে রোকেয়ার ঋণ শোধরানোর কিঞ্চিৎ সুযোগ মিলবে আর শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো সম্ভব হবে সম্পাদক-লেখককে। সেই প্রত্যয় ও প্রতীতিতে জয়তু জানাই রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালাসংশ্লিষ্ট সবাইকে।

সাদা ফুল সাদা আগুন by ওমর আলী

প্রভুর বাগানে সারা রাত সাদা ফুল ফুটে থাকে
জ্যোৎস্নায় ধবল কিরণ দেয় মিটিমিটি কিংবা নিজেরাই আলোকিত
দু-একটা সাদা ফুল পৃথিবীতে ছিটকে পড়ে
উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে সাদা চুন

সেনা চেরিব হামুরাব্বি তুতান খামেন কিংবা তারও আগে থেকে
পিরামিডগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে
তাদের গায়ে সঞ্চরমান সাদা ফুল
স্যাফোর কবিতার মতো জীবন্ত সাদা আগুন যেন
ইউসুফ জুলেখার কিংবা রাধা কৃষ্ণের কিংবা
রোমিও জুলিয়েটের উদগ্র প্রেমের মতো
চণ্ডীদাস ও রজকিনী রামতারা ওরফে রামীর প্রেম
নিকষিত হেম
প্রভুর বাগানে সারা রাত সাদা ফুল ফুটে থাকে
কিছু সাদা ফুল মর্ত্যে ছিটকে পড়ে
ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত ফসফরাসের আলোতে
আলোকিত হয় যেমন সমুদ্রে রাতে কতকগুলো মাছের আলো থাকে
কী সুন্দর সাদা আগুন উড়তে থাকে সারা রাত
সাদা মাছির মতো...

শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া- মাটির রং থেকে মাটির ঘরে

Wednesday, June 8, 2011

দেশের মাটিকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। গভীর মমতায় পর্যবেক্ষণ করতেন মাটির ধূসর, গৈরিক, পাটকিলে, ছাই রঙের বৈচিত্র্য। সেই সব রং তুলে আনতেন তাঁর ছবিতে অসাধারণ ‘টেক্সচার’, সুষমামণ্ডিত সমন্বয় আর অনিন্দ্য বিন্যাসে। শুধু রঙেরই ছবি। আর কিছু নেই। তবু সেই ছবির দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।

জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন তাঁর কবিতায়, ‘আমার মতো আর কেউ নেই’, তিনিও আমাদের দেশের চারুকলার ভুবনে ছিলেন ঠিক তেমনই। তাঁর মতো আর কেউ নেই। তিনি মোহাম্মদ কিবরিয়া। গতকাল মঙ্গলবার তিনি চলে গেলেন মাটির ঘরে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে।
বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং দেশের নির্বস্তুক চিত্রকলার পথিকৃৎ এই বরেণ্য শিল্পী ল্যাবএইড হাসপাতালে সকাল সাতটা ১৫ মিনিটে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত মাসের মাঝামাঝি অবস্থার অবনতি হলে জাতীয় হূদেরাগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে গত ৩১ মে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর হূদ্যন্ত্র, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের কার্যক্ষমতা কমে গিয়েছিল। শেষ দিকে ফুসফুসেও সংক্রমণ দেখা দেয়।
শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কনিষ্ঠ পুত্র জুনের কিবরিয়ার দেশে ফেরার অপেক্ষায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১০ জুন শুক্রবার সকাল নয়টায় মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হবে সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এরপর চারুকলা অনুষদ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আনা হবে। বাদ জুমা এখানে জানাজার পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে দাফন করা হবে।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদে শিল্পী ও কলারসিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ল্যাবএইড ও বারডেমে দেশের দেশবরেণ্য শিল্পী, শিল্পশিক্ষক, তাঁর অনেক ছাত্র ও শিল্পানুরাগী উপস্থিত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পকলা চর্চায় তাঁর অবদান জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শোকবাণীতে বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতে দেশের শিল্পক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
চারুকলা চর্চায় মোহাম্মদ কিবরিয়া একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। বিমূর্ত চিত্রকলার এই ধারা পরিচিত ‘কিবরিয়া ধারা’ বলে। গত পাঁচ দশকের চিত্রকলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ধারাটির প্রভাবই সব থেকে গভীর ও ব্যাপক। তাঁর অনুসারীর সংখ্যাও সে কারণে সর্বাধিক। প্রথম পর্যায়ের কাজে তিনি অবয়ব ও জ্যামিতিক বিন্যাস নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তাঁর কাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি নির্বস্তুক ছবির চর্চায় নিবেদিত হন।
শিল্পকর্ম রচনা ছিল তাঁর কাছে গভীর সাধনার বিষয়। নীল, কালো, ধূসর, পাটকিলে—এ ধরনের কিছু রং নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। তাঁর ছবি স্নিগ্ধ, মাধুর্যমণ্ডিত। বিনম্র। একধরনের নিঃসঙ্গ ধ্যানমগ্নতার দ্যোতনায় উদ্ভাসিত তাঁর চিত্রতল। তাতে গভীর আবেগের কোমল সঞ্চার। প্রকৃতির অন্তর্গত সত্তার স্বরূপ উন্মীলনে উন্মুখ। দর্শকের সংবেদনশীলতাকে খুব সহজ সাবলীলতায় স্পর্শ করে যায় সেই ছবি। দৃষ্টিকে আটকে রাখে।
জীবনপঞ্জি: মোহাম্মদ কিবরিয়ার জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিঁউড়ি গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ রফিক, মা সায়েরা বেগম। বীরভূম জেলা স্কুলে পাঠ শেষে ১৯৪৫ সলে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এখান থেকে স্নাতক হন। পরের বছর ১৯৫১ সালে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকায় এসে নওয়াবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৪ সালে যোগ দেন সরকারি চারুকলা ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপচিত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৮৭ সালে তিনি অধ্যাপক হন এবং ১৯৮৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন, ২০০৮ সালে তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হন। স্ত্রী আনজুম কিবরিয়া, দুই পুত্র নাশরিদ কিবরিয়া ও জুনের কিবরিয়া।
প্রদর্শনী: দেশ-বিদেশে তাঁর অনেক একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে। উল্লেখযোগ্য এককের মধ্যে আছে: ১৯৬০ সালে টোকিওর গ্যালারি ইয়োসিদো, ’৬৩ সালে বিজুতসু শিপ্পানায়, ’৭৯ সালে দিল্লিতে দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে তাঁর ২০টি ছবির বিশেষ প্রদর্শনী, ঢাকায় ২০০০ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে। এ ছাড়া জাপানের মারুচিনি ও যুগোস্লাভিয়ার দ্যে যোশেফ ব্রজ টিটো গ্যালারিতে তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, লাহোর, করাচি, কলকাতা, জাপান বিভিন্ন স্থানে তাঁর যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে।
পুরস্কার: ১৯৫৭ সালে ঢাকায় আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৫৯ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত প্রথম তরুণ শিল্পী প্রদর্শনীতে ‘স্টারলেম’ পুরস্কার। ’৬০ সালে সর্বজাপান প্রিন্ট প্রদর্শনীর পুরস্কার, ’৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন একুশে পদক, ’৮৫ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার এবং ২০০২ সালে পেয়েছেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ সম্মাননা।
মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনেকেই এসেছিলেন ল্যাবএইড ও বারডেম হাসপাতালে।
কাইয়ুম চৌধুরী: বাংলাদেশের শিল্পজগতে অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী। অনেক উত্তরসূরি তৈরি করে গেছেন। নির্বস্তুক চিত্রকলার পথিকৃৎ তিনি। নতুন একটি শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। বিমূর্ত ধারার চর্চা করলেও তাঁর কাজে বাংলাদেশের সত্তাকে পাওয়া যেত।
রফিকুন নবী: তাঁর খ্যাতি আমাদের দেশ, উপমহাদেশ বা কেবল এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বহু বিখ্যাত গ্যালারিতে তাঁর কাজ সংগৃহীত আছে। আমাদের দেশে তিনিই প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান শিল্পী। নম্র, বিনয়ী, নিরহংকার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য মিশে ছিল কাজে। জাপান থেকে ফেরার পর তাঁর বিমূর্ত ধারার কাজ আমাদের অবাক করে দিয়েছিল। রঙে-রেখায় টেক্সচারে প্রতিটি কাজ আলাদা।
মনিরুল ইসলাম: ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তিনি যত বড় শিল্পী, মানুষ হিসেবে তার চেয়েও বড়। কোনো দিন কারও নামে নিন্দা, বিষোদগার করতে শুনিনি। কাছে গেলে অন্তর থেকেই তাঁর প্রতি একটা শ্রদ্ধা উঠে আসত। শিল্পী হিসেবে তাঁর একটি নিজস্ব শিল্পজগৎ ছিল। অনেকেই ছবি আঁকেন, কিন্তু নিজস্ব শিল্পভুবন না থাকলে শিল্পী হওয়া যায় না। কোনো অবয়বের আভাস নেই তাঁর কাজে। পেইন্টিং বা ছাপচিত্র সব ক্ষেত্রেই তিনি একেবারে শুদ্ধ নির্বস্তুক। তাঁর ছবি দর্শককে আটকে রাখে। কোনো চড়া, ঝলমলে রং নেই, তবু অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকা যায় তাঁর ছবির দিকে।
শহীদ কবির: অনেক লম্বা সময় তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর মতো নিবেদিতপ্র্রাণ শিল্পী আমাদের দেশে আর একজনও নেই। শুধু শিল্পকর্মের জন্যই সারা জীবন ব্যয় করেছেন। মাটির প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা, গভীর আবেগ। বহুবার দেখেছি বিভিন্ন ধরনের মাটি এনে তার রং, ভেতরের সত্তার বিষয়টিকে তিনি আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। সংগীত ও সাহিত্যেও ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান। কোনো গোঁড়ামি ছিল না। ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি তাঁর প্রিয় ছিল। একবার আমাকে বলেছিলেন, এই গানটি শুনলে মনে হয় মাটির সঙ্গে বুক মিলিয়ে শুয়ে থাকি। একটা মরমি ব্যাপার ছিল তাঁর।
মাহমুদুল হক: আমাদের চিত্রকলায় তাঁর যত অনুসারী তৈরি হয়েছে, আর কারও এত অনুসারী সৃষ্টি হয়নি। এ থেকেই আমাদের চিত্রকলায় তাঁর প্রভাব ও অবদান বোঝা যায়।
আবুল বারক আলভী: তিনি ছাত্রদের সব সময় উৎসাহ দিতেন। খুব বেশি ভুল ধরতেন না। কিন্তু উপযুক্ত পরামর্শটি দিতেন। শুধু ছাত্ররাই নয়, অনেক শিক্ষকও তাঁদের কাজ দেখাতে আনতেন কিবরিয়া স্যারের কাছে।
নিসার হোসেন: সব ধরনের দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে থেকে শিল্পচর্চা করেছেন। আমাদের চারুকলায় তিনি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে আরও উপস্থিত ছিলেন গ্যালারি চিত্রকের পরিচালক শিল্পী মনিরুজ্জামান, চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষক আনিসুজ্জামান, জয়া শাহরীন, শিল্পী রফি হক, আহমেদ নাজিরসহ অনেকে। সবাই বলছিলেন, ইহজাগতিক নিয়মে মোহাম্মদ কিবরিয়া চলে গেলেন বটে, তবে বাংলাদেশের চিত্রকলা তাঁকে সঞ্জীবিত করবে নিঃসন্দেহে।

আশা হতাশার বয়ন by সিলভিয়া নাজনীন

শিল্পীর সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে শিল্প। শিল্পের গঠন, গড়ন ও গভীরতার স্তরে স্তরে বীজের মতো ছড়িয়ে থাকে নানাবিধ সুপ্ত কথকতা। পরিশুদ্ধ আত্মার অনুনাদ ধ্বনিত হয় মহৎ শিল্পের পরম্পরায়। শিল্পীকুলের অভিলক্ষ সেই মহাসারণি। ‘কনটেমপ্লেশন’ শিরোনামে মুর্শিদা আরজু আল্পনার একক প্রদর্শনী। চলছে ধানমন্ডির ঢাকা আর্ট সেন্টারে। বার্লিন প্রবাসী শিল্পী আল্পনা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, নানা বিচ্ছিন্ন অনুভূতিকে একত্র করেছেন তাঁর চিত্রকর্মে।

শিল্প বিশ্লেষিত হয় শিল্পের সৌন্দর্য, রং, ব্যঞ্জনা, ইতিহাস, ভাষা এবং উপস্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আল্পনার চিত্রকর্মে সৌন্দর্যবোধ উজিয়ে জীবনদর্শন প্রকট হয়ে উঠেছে। ঢাকায় বেড়ে ওঠা এবং জার্মানিতে দীর্ঘ সময়ের জীবনযাপন—এই সময়কে তিনি নতুন দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর প্রতিটি ক্যানভাসে। তাঁর চিত্রপটে টেক্সটের ব্যবহার দর্শককে আরও একাত্ম হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। প্রদর্শনীর অধিকাংশ শিল্পকর্মই শিল্পীর আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ।
মাধ্যম নিয়ে শিল্পীর বিশেষ কোনো ভাবনা নেই বলেই মনে হয়। ভাবের স্ফুরণই মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর ক্যানভাসে। অ্যাক্রেলিক, পেনসিল, কালি, চারকোল, জলরঙের ব্যবহারে বক্তব্য ফুটিয়ে তোলাই তাঁর মোক্ষ। ব্যক্তিগত গণ্ডির বাইরে তাঁর ভাবনার বলয়কে ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি গল্পের মতো বর্ণনা করেন তাঁর চাওয়া-পাওয়া, নারীসত্তার সংকট, প্রেম-বিরহ, স্মৃতি-বিস্মৃতির বহুস্তরিক আখ্যান। তাতে শিল্পগুণ পুরোপুরি রক্ষিত হয়, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
শিল্পী আল্পনার কাজ নারীবাদী চেতনায় ঋদ্ধ। নারীর দৈনন্দিন সংকট, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বিবিধ বর্ণনায় চিত্রতলে মূর্ত হয়ে ওঠে বর্তমান সময়ের বৈরী বিশ্বব্যবস্থা। বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে তাঁর কাজ প্রতিবাদের অভিব্যক্তিতে উচ্চকিত। সারফেসকে নানা ধরনের অসংগতিপূর্ণ বিভাজনের মাধ্যমে এবং বর্ণ প্রয়োগের অমার্জিত পদ্ধতিতে তাঁর কাজে তৈরি হয় অসামঞ্জস্য এবং ভাসমানতার অনুভূতি, যা দর্শকের অস্বস্তিকে প্রকট করে তোলে।
শিল্পী তাঁর আত্মজৈবনিক অভিঘাতে উন্মুল। তৃতীয় বিশ্ব, নারী প্রশ্ন, বর্ণবৈষম্যের অভিশাপ এখনো ছোবল মারার জন্য প্রস্তুত। দেশ-কাল-সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পের ভূমিকা কতটুকু তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শিল্পীর ব্যক্তি অনুভূতির একান্ত প্রকাশের চেয়ে শিল্পে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক উপস্থিতিই বিবেচনার বিষয়। শিল্পী বলেন, তাঁর চিত্রপটে পাশ্চাত্যের বড় শহরে বসবাস ছাপ রেখেছে। প্রতিনিয়ত নানা প্রশ্নের উদ্রেক, রহস্যময়তা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, মর্মপীড়া, উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ফ্যান্টাসি, ট্যাবু প্রভৃতির সমাবেশ ঘটেছে।
অভিব্যক্তিবাদী শিল্পধারার সঙ্গে তাঁর কাজের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ইমেজের আপাত বিচ্ছিন্ন উপস্থিতি, রঙের পাতলা পর্দা গলিয়ে বেরিয়ে আসা ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব শিল্পী আল্পনার শিল্পকর্ম বস্তুত সময়ের অস্থির পাণ্ডুলিপি।

প্রচ্ছদের প্রবাদপুরুষ by শাশ্বতী মজুমদার

কাইয়ুম চৌধুরী যখন ঢাকা আর্ট কলেজে পড়ছেন তখন পূর্ববঙ্গে ইসলামি ভাবধারার ছবির খুব রমরমা। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি করছেন, নন অবজেক্টিভ ফর্মে ছবি আঁকছেন।

কাইয়ুম চৌধুরী এই পথের ধার দিয়েও গেলেন না। তিনি গ্রামবাংলার ছেলে। চিত্রা নদীর পাড়ে তাঁর শৈশব কেটেছে। নদী, নৌকা, জেলে আর গ্রামীণ জীবন তাঁর সত্তায় মিশে আছে। এদিকে তাঁর শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে চিত্রে তুলে ধরতেই আগ্রহী। তাঁর লোকশিল্পের সংগ্রহশালা কাইয়ুম চৌধুরীকে দেখাল নতুন পথ।
এসব কারণে কাইয়ুম চৌধুরী লোকশিল্পের কর্মকে অবলম্বন করে গ্রামবাংলার ছবি আঁকতে শুরু করলেন। সৃষ্টি করলেন তাঁর চিত্রের নিজস্ব ধারা। গ্রামীণ ঐতিহ্যের ফর্মকে আধুনিক রূপদান করে শিল্প সৃষ্টি করেছেন এই শিল্পী। কাইয়ুম চৌধুরী ছবির ক্যানভাসের ক্ষেত্রেও ব্যতীক্রমী পথ গ্রহণ করেন। পেইন্টিং খুব বেশি না করে তিনি ঝুঁকলেন প্রচ্ছদের দিকে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল প্রচ্ছদের দিকে। তাঁর ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা এসেছে বইয়ের ছবি দেখে। ছোটবেলায় তাঁদের বাড়িতে ভারতবর্ষ, প্রবাসী এসব পত্রিকা আসত। এসব পত্রিকায় ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারীদের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি। এসব ছবি তাঁকে খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ওই ছবিগুলো দেখতাম, খুব সুন্দর ছবি। কিন্তু মনে খুব দাগ কাটত না। দাগ কাটত গল্পের বই কাঞ্চনজঙ্গা সিরিজের প্রচ্ছদ ও ভেতরে আঁকা ছবিগুলো। কাঞ্চনজঙ্গা সিরিজের সব ছবি প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা। আর ভালো লাগত সমর দের করা প্রচ্ছদের ছবি। জসীমউদ্দীনের এক পয়সার বাঁশি বইয়ের প্রচ্ছদ আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
ছোটবেলায় কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদশিল্পের প্রতি যে গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছিল তা-ই তাঁকে পরবর্তীকালে প্রচ্ছদশিল্পের কিংবদন্তিতে পরিণত করে।
প্রথমদিকে তাঁর চিত্রে কিছুটা কিউবিস্ট ধারার প্রভাব দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে তাঁর কাজের ধারা পরিবর্তিত হয়। তাঁর ফিগারগুলো আরও বেশি বিমূর্ত ও লিরিক্যাল হয়ে ওঠে। আমাদের লোকশিল্পের সাবলীলতা ফুটে ওঠে তাঁর শিল্পে, লোকশিল্পের ফর্মগুলোকে আত্মস্থ করেছেন নিবিড়ভাবে। লোকশিল্পীরা টেপা পুতুল বানায় বিক্রির জন্য। একটা পুতুলের পেছনে বেশি সময় তো দেওয়া যাবে না। ওরা তাই পুতুলের ফর্মটাই মিনিমাইজ করে ফেলেছে। এভাবেই গড়ে উঠেছে লোকশিল্পের নিজস্ব ধারা। কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি শিল্পচর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের চারুশিল্পের জগৎকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। এ দেশের প্রচ্ছদশিল্প ও গ্রাফিক ডিজাইনের ক্ষেত্রে তিনি অবিসংবাদিত একজন ব্যক্তিত্ব।

বইপত্র- প্রামাণ্য বাংলাদেশ

বাংলাদেশ: সিক্স ডিকেডস—সম্পাদনা: আনিসুজ্জামান, মুহাম্মদ জমির, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম \ এপ্রিল ২০১০ নিমফিয়া পাবলিকেশন \ প্রচ্ছদচিত্র: শিশির ভট্টাচার্য্য \ দাম: ২০০০ টাকা

১৯৪৭ থেকে ২০০৭—দীর্ঘ ছয় দশকে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বহু আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে দুই বার পতাকা বদল হয়েছে। ১৯৪৭ সালে বিদেশি শাসকেরা চলে যাওয়ার সময় এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের মধ্যে যে মুক্তি খুঁজেছিল, তা তিরোহিত হতে সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় এসে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পরবর্তীকালে শিক্ষা আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমেই পাকিস্তানি শাসকদের চরম জবাব দেয় বাঙালি জনগোষ্ঠী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করে সামরিক জান্তা। যার পরিণতি ২৫ মার্চের গণহত্যা। এরপর দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে, যা কেবল একটি পতাকা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতায় সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি। গণতন্ত্র ও সাম্যই ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা পেয়েছি? পেলে কতটুকু পেয়েছি, না পেলে কেন পাইনি, কাদের কারণে পাইনি—সেসব আজ ইতিহাসের বিষয়।
ছয় দশকে সাতটি প্রতিপাদ্য বিষয় বাছাই করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এর মধ্যে ‘টারবুলেন্ট ফার্স্ট ইয়ারস, ১৯৪৭-৫২’: অধ্যাপক-শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, ‘কোয়েস্ট ফর রিজিওনাল অটোনমি’: দিলারা চৌধুরী, ‘আন্ডার মিলিটারি রুল, ১৯৫৪-৭০’: আবুল মাল আবদুল মুহিত, ‘দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ১৯৭১’: মোহাম্মদ জমির, ‘দি মুজিব এরা: ১৯৭২-৭৫’: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ‘আন্ডার জিয়া অ্যান্ড এরশাদ’: মেঘনা গুহঠাকুরতা, ‘টু ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেটিক পলিসি: ১৯৯১-২০০৬’: আতাউস সামাদ।
একটি বইয়ের কয়েকটি অধ্যায়ে বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিশাল ক্যানভাস ধারণা সহজ নয়। আর এ ধরনের লেখায় বিশ্লেষণের সুযোগও কম। তার পরও আনিসুজ্জামানের ভাষাভঙ্গিটি বেশ সরস, এবং ধারাবর্ণনার মধ্যেও আছে নিখুত বিশ্লেষণ। অন্যান্য লেখকও অনেক পরিশ্রম করে তথ্য-উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, যাতে পাঠক চোখ বোলালে সব ঘটনার সারাংশ জানতে পারেন।
তবে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আলোকচিত্র। দীর্ঘ ৬০ বছরের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনার সচিত্র স্মারক হয়ে উঠেছে এটি। এতে দেশ বিভাগের সময়ের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে দাঙ্গাকবলিত জনপদের। আছে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল, আছে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ছবি। আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাতটি শাসনামলের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রও।
সেদিক দিয়ে বলা যায়, এই বই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সম্পাদনের দায়ভার যাঁরা নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন তাঁরা হলেন আনিসুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ জমির; এঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ঔজ্বল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি আবু জাফর শামসুদ্দীন

লেখক-চিন্তাবিদ আবু জাফর শামসুদ্দিন তৎকালীন ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ থানার দক্ষিণবাগ গ্রামে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু ১৯৩২ সালে। তিনি অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, মননশীল প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনি রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই হলো: পদ্মা মেঘনা যমুনা, প্রপঞ্চ, দেয়াল, রাজন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা, শেষ রাত্রির তারা প্রভৃতি। তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক পান।

১৯৪৭-এর আগস্টে দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন জাফর ভাই— আবু জাফর শামসুদ্দীন। মুসলিম লীগ নয়, বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিলেন যৌবনের শুরুতেই। তার আগে ঢাকায় থাকাকালে ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ভাবধারাও প্রভাব বিস্তার করেছিল তাঁর ওপর। পাকিস্তানে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের জন্মলগ্নে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তার সঙ্গেও। তবে, সরাসরি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হয়তো কোনো দিনই সেভাবে ছিলেন না, বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। কিন্তু কোনো সময়ই রাজনৈতিক তথা সামাজিক দায়িত্বকে অবহেলা করেননি। সাধ্যমতো ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের সময়ের কথাই বলি। দৈনিক সংবাদ-এ তাঁর নিয়মিত কলামে ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের গতিধারার সমর্থন জোগাতে চাইত, তার বিরুদ্ধে তিনি যে আপসহীন অবস্থান নিয়েছিলেন, সে জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া হতো তাঁকে। কিন্তু সে হুমকি কোনো দিন তাঁর সংকল্পে বা কাজে কোনো দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক ধারার বিস্তার নিষ্কণ্টক হবে, চলার পথে প্রতিপক্ষের আঘাত আসবে না, এটা কোনো দিনই মনে করতেন না তিনি। এই প্রশ্নে তাঁর চিন্তা ছিল খুবই স্পষ্ট। আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের বাংলাদেশ শাখার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাবে স্বীকৃতি দিতে এতটুকুও ইতস্তত করেননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশেষ করে মধ্য এশিয়া ঘুরে এসে তাঁর লেখায় সে দেশ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি একবারও।
পারস্পরিক সম্পর্ক যখন গভীর হয়ে উঠেছে, তখন একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বাকশালে শামিল হওয়ার আহ্বান নিয়ে খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস যেদিন আপনার কাছে গিয়েছিলেন, সেদিন ও রকম পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছিলেন কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক, যে পদ্ধতিতে সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে যাওয়া হচ্ছিল, তা ছিল ভুল। আর কেন জানি মনে হচ্ছিল, যা তখন করা হচ্ছিল, তা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু না।’
জাফর ভাইয়ের সঙ্গে তখনকার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছিল এমন একসময়, যখন আরও বেশ কিছুদিন শুধু বেঁচে থাকাই নয়, সক্রিয়ভাবে বেঁচে থাকাটা দরকার ছিল আমাদের জন্যই।
তবে এই সময়টুকুর যেটুকু তাঁকে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, বিশ্বাসের প্রয়োজনে জীবনে যেকোনো ঝুঁকি নিতে ইতস্তত না করাটা একজন বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। ‘সত্য মূল্য’ না দিয়ে শুধু সাহিত্য নয়, কোনো ক্ষেত্রেই খ্যাতি চুরি করে জনমনে স্থায়ী আসন লাভ করা যায় না। সাহিত্যিক হিসেবে আবু জাফর শামসুদ্দিন কতটুকু কালোত্তীর্ণ বলে বিবেচিত হবেন, তা নিয়ে নানা অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন নানাজন। কিন্তু মানুষ আবু জাফর শামসুদ্দিন, সত্যনিষ্ঠ আবু জাফর শামসুদ্দিন যে অতুলনীয়, তা স্বীকার করতে সবাই বাধ্য হবেন বলে মনে করি আমি।

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী...

Thursday, May 26, 2011

তিনি এসেছিলেন বাংলা কাব্যের অঙ্গনে সম্পূর্ণ নতুন সুর আর কণ্ঠস্বর নিয়ে। দিয়েছিলেন বাংলা গানের এক নতুন ভুবনের সন্ধানও। তিনি মহাবিদ্রোহী, বিষণ্ন, তীব্র রোমান্টিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা কাব্যের প্রচলিত অঙ্গন। 'বিদ্রোহী' কবিতার অভূতপূর্ব উচ্চারণে চমকে দিয়েছিলেন সমগ্র উপমহাদেশ।
'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য'_ এই বিস্ময়কর দ্বৈতসত্তায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং মানবতায় হৃদয় সংবেদী প্রেমিক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন আজ। সব সংকীর্ণতার দেয়াল ভেঙে বাংলা সাহিত্যে নতুন কাব্যধারা সৃষ্টি করেছিলেন যিনি, সেই চিরবিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন জাতীয় পর্যায়ে উদযাপন শুরু হচ্ছে আজ। আজ থেকে ১১২ বছর আগে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ এক ঝড়ের রাতে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্য সমালোচকরা তাকে যথার্থই 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ ঝড়ের মতোই সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল ছেঁড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের পাশাপাশি তার কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন এমন এক মানবিক সমতার সমাজ গড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যে সমাজে মানুষের পরিচয় হবে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্রের সকল ভেদাভেদের ঊধর্ে্ব। তাই মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিল তার উচ্চারণ। নজরুল এক আশ্চর্য প্রতিভা! একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে বিদ্রোহী; 'এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।' কী কবিতায়, কী গানে, উপন্যাসে, গল্পে, সাংবাদিকতায় তথা সম্পাদকীয় নিবন্ধে, প্রবন্ধে_ সর্বত্রই মানবমুক্তির প্রেমময় বাণী, দ্রোহের বাণী ঝঙ্কৃত হয়েছে তার সৃষ্টিতে।
বাংলা কাব্যে নতুন যুগের স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হয়ে যে দীপ্র তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেই তারুণ্যই শতদল হয়ে ফুটেছিল তার সাহিত্যিক জীবনে। ১৯২১ সালের শেষ দিকে যখন 'বিদ্রোহী' কবিতা লেখেন (১৯২২ সালে প্রকাশিত), তখনই বাংলা কবিতায় চিরকালের জন্য অমর হয়ে গিয়েছিল তার আসন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগি্নবীণা' আগুনের হল্কা ছড়িয়ে দিয়েছিল শোষিত-বঞ্চিত সমাজে। তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়তে, হিন্দু-মুসলিম বিরোধ আর সংকীর্ণতার পাষাণ প্রাচীর ভাঙতে এবং শাসন-শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে। অগি্নবীণা, বিষের বাঁশী, ধূমকেতু প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের। একের পর এক নিষিদ্ধ হতে থাকে তার কাব্যগ্রন্থ; কিন্তু প্রতিজ্ঞায় অনড় কবির কলম থেমে থাকেনি। কারাগারেও গেয়েছেন 'ভাঙার গান'। চিরকালের মানবমুক্তির বাণীবাহক নজরুলের পক্ষেই লেখা সম্ভব হয়েছিল 'মহা_ বিদ্রোহী রণক্লান্ত,/আমি সেই দিন হব শান্ত,/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না_।'
'দারিদ্র্য'কে নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণকারী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি দারিদ্র্যের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন 'অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস...।' হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের মহামন্ত্রে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে তিনি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করার সাধনায় সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাও পালন করেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়েও ইসলামী ঐতিহ্য আর হিন্দু পুরাণের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' এই অনন্য দর্শন প্রতিষ্ঠা করে সবার হৃদয়ে মানবতার কবি হিসেবে অমর হয়ে আছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার কবিতা ও গান অনন্য প্রেরণা জুগিয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন নাগরিকত্ব দিয়ে। বাংলাদেশের প্রধান বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণেই হয়েছে তার শেষশয্যা।
কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ সকালে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে। বিটিভি ও বেতারসহ দেশের বেসরকারি টেলিভিশন ও এফএম রেডিও স্টেশনগুলো দিবসটি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা।
নজরুলজয়ন্তীর কর্মসূচি হিসেবে আজ ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও কুমিল্লার দরিরামপুরে তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠানমালা শুরু হচ্ছে। নজরুল স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। সেমিনার, আলোচনা সভা, সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খ্যাতনামা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে মুখর হয়ে উঠবে ত্রিশালের দরিরামপুর।
রাষ্ট্রপতির বাণী : রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান তার বাণীতে বলেছেন, নজরুল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক শাশ্বত দিকপাল, উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে সংগ্রামী, সমাজ সংস্কারক, জাতীয়তাবোধের ধারক, প্রেমের পূজারি, সাম্য ও শান্তির বাহক।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, তিনি 'বিদ্রোহী কবি', আধুনিক বাংলা গানের 'বুলবুল'। তার শিকল ভাঙার গানে সে সময়কার ঝিমিয়ে পড়া বাঙালি সমাজ জেগে উঠেছিল। তার সাহিত্যকর্ম মানব অনুভূতির গভীরে প্রোথিত হয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
বিরোধী দলের নেতার বাণী : বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, বাংলা সাহিত্যের এ কালজয়ী পুরুষকে জাতীয় কবি হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখা তার সৃষ্টির পরশে ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানমালা : রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন নজরুলজয়ন্তী পালন করবে। সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের অনুষ্ঠানমালা। ত্রিশালে কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে। কুমিল্লার দৌলতপুর ও চট্টগ্রাম শহরে যথাযথ মর্যাদায় নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। নজরুলের স্মৃতিধন্য জেলাগুলো ছাড়াও দেশের সব জেলায় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন করবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। আজ সকালে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে আলোচনা ও কবির সাহিত্যকর্মের পরিবেশনা।
আওয়ামী লীগ : সকাল ৮টায় জাতীয় কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির জন্মদিন পালনের জন্য দল, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকসহ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলা একাডেমী : জাতীয় কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানমালা। বিকেলে একাডেমীতে রয়েছে আলোচনা সভা।
শিল্পকলা একাডেমী : সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে দু'দিনের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
ছায়ানট : ছায়ানট তাদের নিজস্ব মিলনায়তনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আয়োজন করেছে সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে নজরুলের নাটক ও চলচ্চিত্রের গান পরিবেশিত হবে।
এছাড়া নানা আয়োজনে জন্মদিন উদযাপন করবে জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, বিশ্ব কবিতা কণ্ঠ পরিষদসহ নানা সংগঠন।

জাগরণের কবি নজরুল

সাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতীক নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যুগবাণী, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আরও ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যকার, দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার এবং একজন সফল সমাজসংস্কারক, মানবতার কবি, জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি ... নজরুল। প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, সকলের কবি ... নজরুল।

জাতীয় কবি নজরুল আমাদের বড়ই আপন। বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আনন্দ-বেদনার সাথী। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতির কর্ণধার। তার আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের দেহে ও প্রাণে সঞ্চার করেছে তারুণ্যের বিপুল ঐশ্বর্য। তাঁর অগি্নঝরা লেখনী থেকে বেরিয়ে এসেছে মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ পরিবর্তনের দর্শন, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের চেতনা। তাঁর সৃষ্টি আমাদের জাতির অঙ্গ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কবিতা ও গান মুক্তিযোদ্ধাসহ গোটা বাঙালি সমাজকে করেছে উজ্জীবিত, যুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ প্রবাদপুরুষের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর মহান স্মৃতির প্রতি আমি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্য গগনে পূর্ণ আভায় দেদীপ্যমান তখনই এক নতুন শৈলী নিয়ে ধূমকেতুর মতো অপর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে। উজ্জ্বল এই নক্ষত্রটি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২১ সালে 'বিদ্রোহী' কবিতা নিয়ে নজরুলের আবির্ভাবের পর বাংলা কাব্য ও ছন্দের জগতে নতুন একটি ধারার প্রবর্তন ঘটে, যা অপরাপর কবি-সাহিত্যিকদের কাব্যধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। তাঁর আবির্ভাবটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে সচকিত করেছিল। তিনি কবিতার ভাষায় নজরুলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন_
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগি্ন-সেতু
দুর্দিনের এই দুর্গ-শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে'
আছে যারা অর্ধ-চেতন।
বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের এই আহ্বানে বিদ্রোহী কবি সাড়া দিয়েছিলেন।
নজরুলের শৈশব জীবন একটি নিশ্চিন্ত স্বাভাবিক জীবন ছিল না। চরম দারিদ্র্য ও প্রবল চাঞ্চল্য তাঁর জীবনে একই সঙ্গে বিরাজমান ছিল। গৃহের শৃঙ্খলা ভেঙে অচেনা পথে বেরিয়ে পড়ার একটি স্পৃহা ছিল তার। তবুও জীবন-জীবিকার জন্য কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে সেই কৈশোর বয়স থেকে। জীবনের প্রথম পেশা মসজিদে আজান দেওয়া শুরু করেন তিনি কৈশোরে। তারপর রুটির দোকানে চাকরি, লেটোর দলে গান বাঁধা, যাত্রার দলে যোগ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নজরুল গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেশেন, তাদের কথা, সুর ইত্যাদি রপ্ত করেন। তিনি দেখেছিলেন জীবন অত্যন্ত কঠিন। সমাজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। তাই সাহিত্যের উপাদান ও উপজীব্য হিসেবে তিনি দারিদ্র্য, অবহেলা ও বঞ্চনাকেই গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের বিরাজমান অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি 'বিদ্রোহী' হয়ে ওঠেন। তাই দ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিতে। পরাধীন দেশে সাধারণ মানুষকে তিনি দারিদ্র্য ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির গান শুনিয়েছেন।
জন্মসূত্রে তিনি মুসলমান। কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার হিন্দু পুরাণ ও মহাভারতের কাহিনীকে তিনি আত্মীয়করণ করেছিলেন অবলীলায়। তিনি লিখেছেন :
আমি হোম-শিখা, আমি সাগি্নক জমদগি্ন,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগি্ন।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য;
নজরুলের গানের শিল্পগুণ, সুর, মাধুর্য ও গায়কী ঢং অন্যান্য গানের চেয়ে সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্বে ভরপুর। বাণীর ঐন্দ্রজালিক সমন্বয়ে রচিত গানগুলো অতিমাত্রায় উচ্চ মার্গীয়। গানের ভাষা, প্রকরণশৈলী ও সুর অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তাঁর গানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। আশৈশব দেশজ সঙ্গীতের যেসব ধারায় তিনি অবগাহন করেছেন যেমন বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, সাঁওতালি এগুলোকে তিনি নিপুণ হাতে প্রয়োগ করেছেন তাঁর নতুন গানে। অনেক নতুন গানে অপ্রচলিত রাগ-রাগিণীকে প্রয়োগ করেছেন। তিনি ১৮টি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দোলনচাঁপা, দেবযানী, মীনাক্ষী, অরুণ রঞ্জনী, নির্ঝরিণী, রূপমঞ্জুরি, সন্ধ্যা-মালতী, বনকুন্তলা, অরুণ ভৈরব, শিবানী ভৈরব, রুদ্র ভৈরব, উদাসী ভৈরব ও বেনুকা।
নজরুল কাব্যে আমপারা, অসংখ্য হামদ ও নাতে রাসূল (সা.) রচনা করেছেন। আবার শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন এবং বৃন্দাবন গীতও রচনা করেছেন অনেক। এত উচ্চমানের হাম্দ ও নাত অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিক লিখতে পারেনি। অপরদিকে প্রেম ও ভক্তিপূর্ণ মনোমুগ্ধকর শ্যামাসঙ্গীত বা কীর্তন কোনো কবি-সাহিত্যিক লিখতে পেরেছেন কি-না আমার জানা নেই। তাঁর হাম্দ ও নাত শুনলে অনাবিল আনন্দে হৃদয়-মন ভরে যায়। আবার কীর্তন ও শ্যামসঙ্গীত শুনলে অদৃশ্য আবেগে দেহমন আবিষ্ট হয়। আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে তিনি একমাত্র কবি, যিনি সমান দক্ষতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে রূপায়িত করেছেন।
১৯৪২ সালের কথা। সৃষ্টিশীল জীবনের সায়াহ্নে তিনি 'বাঙালির বাংলা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। নবযুগ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটি প্রমাণ করে নজরুল একজন মহান কবি বা সাহিত্যিকই নন বরং তিনি একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। প্রবন্ধটির শুরুতে তিনি লিখেছেন, 'বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে 'বাঙালির বাংলা'_ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে'। এই প্রবন্ধের শেষে নজরুল লিখেছেন_ 'বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।'
তাঁর কবিতা ও গানে যুগে যুগে এ দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের অগি্নঝরা দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান আমাদের দেহে ও প্রাণে প্রবল শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে_
'এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/
কারার এই লৌহ কপাট-ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম/
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে/
একি অপরূপ রূপে মা তোমার
হেরিনুপল্লী জননী/
এবং দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে
লঙ্ঘিত হবে রাত্রি নীশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার'
তিনি রচনা করেছেন এ ধরনের আরও অনেক গান ও কবিতা।
নজরুলের কাব্যে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়েছে চিরকল্যাণময়ী নারীর শতরূপ। প্রেম, মমতা, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের কথা রূপায়িত হয়েছে তার লেখায়। তিনি লিখেছেন :
নর নহে, নারী, ইসলাম, পরে প্রথম আনে ঈমান
আম্মা খাদিজা জগতে সর্বপ্রথম মুসলমান।
পুরুষের সব গৌরব ম্লান, এই এক মহিমায়।
তার শ্যামা সঙ্গীতেও মায়ের প্রতি ভক্তিরসের ধারা প্রবহমান_
ভক্তি, আমার ধূপের মত
ঊধর্ে্ব উঠে অবিরত
শিবলোকের দেব দেউলে
মা'র শ্রীচরণ পরশিতে।
নজরুল আরও লিখেছেন :
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
অর্থাৎ নজরুল এখন থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে পরাধীন সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য লক্ষ্য করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে একটি স্বাধীন দেশে এখনও কি নারীরা সমান অধিকার বা মর্যাদা ভোগের সুযোগ পাচ্ছেন? আর নারীর অধিকার কিছুটা সমুন্নত করতে উদ্যোগী হলে আজও এ দেশে প্রবল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়। তবে যত বাধাই আসুক বাংলাদেশে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য প্রতীক নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যুগবাণী, ধূমকেতু, লাঙল, গণবাণী ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আরও ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যকার, দক্ষ অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার এবং একজন সফল সমাজসংস্কারক। তার গুণ ও অবদানের কথা বলতে গেলে বহু সময়ের প্রয়োজন। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে নজরুলই প্রথম ও শেষ বাঙালি, যিনি সৃজনশীল প্রতিভায় বাঙালি চেতনাকে সামগ্রিকভাবে ধারণ করতে সক্ষম হন। আর এসব কারণেই তিনি বাঙালির জাতীয় কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
একটি পরিশীলিত সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার মাধ্যমে আমরা তার প্রতি সত্যিকার অর্থে সম্মান প্রদর্শন করতে পারি।

রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত জাতীয় কবি

Wednesday, May 25, 2011

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহের কিংবা প্রেমের কবিই নন, তিনি আমাদের জাতীয় কবিও। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে এ মর্যাদা দেওয়া হলেও তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ এবং সৃষ্টিকর্মের প্রসারে নেই আন্তরিক কোনো উদ্যোগ। নজরুল গবেষকরা জানান, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমেও অবহেলিত এ কবি। সরকারি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি উপেক্ষিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে উদ্‌যাপন করলেও নজরুলজয়ন্তী পালনের ক্ষেত্রে এমন কোনো চিন্তা সরকারের নেই।


জানা যায়, দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হলেও প্রচারের অভাবে এটি পড়ে রয়েছে অন্তরালে। একই অবস্থা নজরুলবিষয়ক ওয়েবসাইটেরও। বন্ধ হয়ে গেছে নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত স্থানকেন্দ্রিক পর্যটন কার্যক্রম। এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় কবির ১১২তম জন্মোৎসব।
জাতীয় কবির মৃত্যুর সাড়ে তিন দশক পরও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রকাশ সম্ভব হয়নি তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী। নির্মাণ করা হয়নি কোনো তথ্যচিত্র। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুল এখনো অনেকটাই অচেনা, অজানা।
নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানগুলোকে ঘিরে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিলেও কখনোই সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারি না থাকায় নজরুলের নামে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধের পথে। এ সবের পাশাপাশি চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নজরুলের নামে জাতীয় পর্যায়ে আজও কোনো পদক বা পুরস্কার চালু করা হয়নি।
নজরুলের সাহিত্য ও সংগীত বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেই পর্যাপ্ত বাজেট। জানা যায়, নজরুল ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও প্রকাশনা খাত মিলিয়ে বাজেট ১৫ লাখ টাকা। আর নজরুলের নামে একমাত্র সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে গবেষকের পদ মাত্র একটি। অন্যদিকে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান 'নজরুল একাডেমী' এখন গবেষণার কাজ বাদ দিয়ে শুধু সংগীতচর্চাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
গবেষক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নজরুল বিষয়ে গবেষণার দুঃখজনক দিক হচ্ছে, যাঁরা এ বিষয়ে পিএইচডি করেন, তাঁরা চাকরি পান না। আমি আমার তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত পাঁচজন শিক্ষার্র্থীকে পিএইচডি করিয়েছি। তাঁদের কারোরই চাকরি হচ্ছে না।'
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতেও উপেক্ষিত জাতীয় কবি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে তাঁর রচনা পড়ানো হয় মাত্র ২৬ নম্বরের জন্য। আর সেটাও ঐচ্ছিক, আবশ্যিক নয়। শিক্ষাবিদদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বিষয়ে পাঠ্যসূচি সাজানো হয়েছে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পাঠক্রম দিয়ে। নজরুলের ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকা আড়াল করার উদ্দেশ্যেই ওই মডেলকে অনুসরণ করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠসূচিতে জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের রচনা এক শ নম্বরে আবশ্যক করার প্রস্তাব দিয়ে বেশ কয়েকবার তিনি তিরস্কৃত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সংগীত বিভাগেও অবহেলিত ক্ষণজন্মা এই সংগীতস্রষ্টা। সংগীত বিভাগে পাঁচজন রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষকের বিপরীতে নজরুলসংগীতের শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেখানে যেসব বিভাগ খোলার কথা ছিল, তার বেশির ভাগই খোলা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু নজরুলের নামে করেই যেন তাঁর প্রতি দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে রাষ্ট্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমেও সেভাবে স্থান পাচ্ছে না জাতীয় কবির রচনাবলি।
সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে দেশের একমাত্র গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীতেও উপেক্ষিত নজরুল। একাডেমী খ্যাতিমানদের পাশাপাশি অনেক অখ্যাত ব্যক্তির জীবনী প্রকাশ করলেও জাতীয় কবির জীবনী প্রকাশ করেনি। এখনো পূর্ণাঙ্গ নজরুল রচনাবলি প্রকাশ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। কবির অনেক বই এখন পুনর্মুদ্রণ করার মতো সময় নেই বাংলা একাডেমীর! জানা যায়, ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমীকে নজরুলের শতাধিক গানের স্বরলিপি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। অনেক বছর কেটে যাওয়ার পর তিন খণ্ডে স্বরলিপি প্রকাশ করা হলেও, পরে তা আর প্রকাশ করা হয়নি। একই সঙ্গে, একাডেমীতে নির্মিত 'নজরুল মঞ্চ' বইমেলার সময় ছাড়া ব্যবহার করা হয় না। বইমেলার সময় মোড়ক উন্মোচন করার কাজে এই মঞ্চটি ব্যবহৃত হয়। বাকি সময় মঞ্চটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে।
সরকারি আরেকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত আড়াই শতাধিক বই, এগারোজন শিল্পীর চিত্রপ্রতিলিপি, বিশজন শিল্পীর চিত্রকর্মের ভিউকার্ড প্রকাশ করেছে। অনেক বিদেশি শিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে বই প্রকাশিত হলেও নজরুলের আঁকা চিত্রকর্মের বই প্রকাশ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে তাঁর নাটক, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত বইও একাডেমী প্রকাশ করেনি। শিল্পকলা একাডেমী নিজস্ব প্রযোজনায় নাটক নির্মাণ করলেও, তাতে ঠাঁই হয় না নজরুলের। অথচ বিদেশি নাট্যকারের নাটক অহরহ প্রযোজনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু নজরুলের লেখা আশিটি নাটকের একটিও এখনো প্রযোজনা করেনি শিল্পকলা একাডেমী।
জাতীয় কবির গান এখন অবহেলিত। নজরুলের প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো গান রয়েছে। কিন্তু সব গান না বাজিয়ে ঘুরেফিরে শ'খানেক গানের মধ্যেই আটকে আছে নজরুলসংগীতের চর্চা। সরকারি বেতার-টেলিভিশনেও নজরুলবিষয়ক অনুষ্ঠান ও নজরুলসংগীতের প্রচার বাড়েনি। এমনকি দেশের রণসংগীতও অবহেলিত। সেনাবাহিনীর রণসংগীত 'চল চল চল' নজরুলের লেখা। কিন্তু সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রণসংগীতকে বাদ দিয়ে বাজানো হয় অন্যান্য দেশাত্মবোধক গান। এমনকি জাতীয় প্যারেডের সময়ও তেমন মর্যাদা পায় না গানটি। আর দশটি গানের মতোই বাজানো হয় এটি।
কবির স্মৃতিধন্য স্থানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নেই। সংরক্ষিত না হওয়ায় বদলে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে কবির স্মৃতিচিহ্ন। অন্যান্য দেশে জাতীয় কবির স্মৃতিজড়িত সব স্থান সংরক্ষণের আওতায় নেওয়া হলেও, এদেশে তা হয়নি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থান, স্থাপনাগুলো দেখার সুযোগ করে দিতে নজরুল ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন 'নজরুল পর্যটন' চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এ কার্যক্রম গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বন্ধ। এ প্রসঙ্গে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার বলেন, নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানগুলোর সংস্কার চলছে। সংস্কার সম্পন্ন হলে এই প্রকল্প আবার শুরু হবে।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নজরুল চিকিৎসাধীন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলার ১১৭ নম্বর কক্ষে। এ কক্ষটিও সংরক্ষিত নয়।
নজরুল ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ঢাকায় নজরুলের স্মৃতিধন্য ৩১টি স্থান রয়েছে। সেসব স্থান সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিফলক বসানোর জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কাছে নজরুল ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ২০০৬ সালে আবেদন করা হয়েছিল। সে আবেদনে সাড়া দেয়নি ডিসিসি। ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত কবি ধানমণ্ডির যে বাড়িতে বাস ছিলেন, পরিকল্পনার অভাবে সে বাড়িটি এখন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। বাড়ির সামনের যে বাগানে কবি হাঁটতেন, তা পরিণত হয়েছে গ্যারেজে। এভাবেই জাতীয় কবিকে অবহেলিত করে রাখা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পরিকল্পনাও নেই সরকারের।

সমকালীন শিল্পঃ শিল্পীর ক্যানভাসে by শাশ্বতী মজুমদার

Wednesday, March 2, 2011

শিল্পী রোকেয়া সুলতানার কাজের মূল বৈশিষ্ট্য ছন্দোময় কম্পোজিশন আর উষ্ণ রঙের ব্যবহার। নারী ও প্রকৃতি তাঁর কাজের প্রধান বিষয়। আশির দশকে ম্যাডোনা সিরিজ এঁকে বিখ্যাত হয়েছিলেন এ শিল্পী। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি সিরিজ হলো জল, বায়ু, মাটি, সম্পর্ক।
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা তাঁর কর্মের অনুপ্রেরণা। টেম্পারা, মিক্সড মিডিয়া, এক্রেলিকে তিনি বেশির ভাগ ছবি এঁকেছেন। ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, ফোরগ্রাউন্ডের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রভেদের অনুপস্থিতি, ছন্দোময় রেখার মাধ্যমে ফিগারের উপস্থাপন শিল্পীর কাজে এনে দিয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাই কাজের ভিড়েও তাঁর কাজকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়।
ক্যানভাসকে শিল্পী তুলনা করের তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরির সঙ্গে। কারণ তাঁর প্রতিদিনকার আবেগ আর অনুভূতিরই রূপদান করেন তাঁর শিল্পকর্মে। নিজের শিল্পকর্ম সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো ‘আমি আমার শিল্পকর্মকে নির্দিষ্ট কোনো শিল্প আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না বরং বিশুদ্ধভাবে নিজস্বতা বজায় রাখতে চাই।’
সমকালীন বাস্তবতা নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে তাঁর শিল্পকর্মে।
‘ধরণী’ নামের চিত্রকর্মটি তিনি সম্প্রতি এঁকেছেন। এখানে বিশাল ক্যানভাসে একটি নারী-ফিগারকে চিত্রায়িত করেছেন, যার শরীরের বিভিন্ন অংশ ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে ভাগ করা, ফিগারটির পাশেই একটি কালো রঙের চেয়ার।
ছবিটি নিয়ে শিল্পী তাঁর নিজস্ব ভাবনা সম্পর্কে বলেন, মেয়েরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই থাকে বঞ্চিত। তারা তাদের কথা, চাওয়া-পাওয়া সব সময় প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। তাই তাদের অবদমিত গোপন ইচ্ছাগুলো লুকিয়ে থাকে তাদের মনের নিভৃত কোণে। দৈনন্দিন কাজে ব্যবহূত ড্রয়ারে আমরা যেমন আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখি, তেমনি মেয়েদের এই গোপন ভালো-মন্দ আকাঙ্ক্ষাগুলোও তারা লুকিয়ে রাখে মনের এক একটি কোণে। আর পাশের চেয়ারটি হয়তো বা কেউ আসবে বা তাদের আত্মিক মুক্তিকে আহ্বান করবে, এরই প্রতীক।
শিল্পী তাঁর প্রিয় রং লাল আর হলুদ ব্যবহার করে ছবিটি এঁকেছেন। তাঁর সংবেদনশীল সত্তার প্রকাশ ঘটেছে ছবিটিতে। এই ছবির ধারাবাহিকতায় আরও ছবি আঁকবেন বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীর অবস্থান নিয়ে শিল্পী উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে ইভ টিজিং এবং এর শিকার মেয়ে ও তাদের আত্মীয়স্বজনের দুর্ভোগ নিয়ে শিল্পী মর্মপীড়ায় ভোগেন। এ বিষয়ে তিনি মানুষের সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করেন। পরবর্তী সময়ে এ বিষয় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করবেন বলে ভাবছেন।
শিল্পী রোকেয়া সুলতানার জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ১৯৮০ সালে বিএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাপচিত্রে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। রোকেয়া সুলতানা প্রথম নারী শিল্পী, যিনি ১৯৯৯ সালে এশিয়ান বিয়ানালে পুরস্কার লাভ করেন।

দ্রোহ ও সৃজনের জেলজীবন by মুর্তজা বশীর

Friday, February 11, 2011

নানা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ করেছেন বাংলাদেশে ও বিশ্বের নানা প্রান্তের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক। জেল-জুলুমেও তাঁদের চিরতরে স্তব্ধ করা যায়নি। তাঁদের সেই সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করেই আয়োজন জেলখানার লেখালেখি। লিখেছেনঃ মুর্তজা বশীর

১৯৫০ সালের ৭ জুন আমি জেলে যাই। সেদিন কমিউনিস্ট পার্টি ‘মুক্ত এলাকা দিবস’ ঘোষণা করেছিল। স্থানগুলো হলো বাংলাদেশের ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের হাজং, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ আর মাদ্রাজের তেলাঙ্গানা। জনযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। আমি একটা পোস্টার এঁকেছিলাম। যার বিষয় ছিল ময়মনসিংহের মানচিত্র হাতুড়ি-কাস্তে দিয়ে ঘেরা। পোস্টারের ওপরে লেখা ছিল মুক্ত এলাকা দিবস, যা দেয়ালে লাগাতে গিয়ে আমি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হই।
জেলে আমাকে রাখা হয় ১৪ সেলে। ‘শকুন্তলা ফাটক’ বলে যার একটা সুন্দর নাম ছিল। আমার রাজনৈতিক সতীর্থ আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন, আলী আকছাদ, শ্রমিকনেতা আবদুল বারি এবং ক্ষেতমজুর নেতা মনু মিয়াও এখানে ছিল। জেলের ১৪টি কক্ষই দুদিকে লম্বা শিক দিয়ে ঘেরা ছিল। দুজন করে থাকার নিয়ম, তবে একজনও থাকত।
সকালে যখন লকআপ খুলে দেওয়া হতো, তখন আবদুল্লাহ আলমুতী, আলী আকছাদসহ অন্যরা শুনতে চাইত, রাতে আমি কী লিখেছি। রাতে লেখা গল্প-কবিতা তখন আমি পড়ে পড়ে তাদের শোনাতাম।
প্রথম দিকে যখন খাতা ছিল না, মুতী ভাই কিছু লেখার জন্য মাঝেমধ্যেই তাগাদা দিতেন। তখন খবরের কাগজের সাদা মার্জিনের মধ্যে পেনসিল দিয়ে লিখতাম। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে আমি কমলা রঙের মলাট দেওয়া একটা খাতা আনিয়েছিলাম এবং ওই লেখাগুলো উঠিয়ে রেখেছিলাম।
সেখানে আমি সতীর্থ সঙ্গীদের প্রতিকৃতি এঁকেছিলাম। কয়েকজন কয়েদিও ছিল। জেলখানায় একটা রজনীগন্ধার ঝাড় এত ভালো লেগেছিল যে মনে হয়েছিল মুক্ত জীবন। তার ড্রয়িংও আমি করেছি। ওই খাতায় আমি বেশ কিছু গল্প-কবিতাও লিখেছিলাম।
কবিতাগুলো ছিল মূলত সুকান্ত ভট্টাচার্যের অনুকরণে, গণচীনের অভ্যুদয় ও নতুন জীবনের জয়গান নিয়ে। দুঃখটা হলো, এসবের সবই আমার হারিয়ে গেছে।
আমাদের বেগমবাজারের বাসায় মূল ফটক দিয়ে ছোট একটা করিডোর ছিল, যেখানে ঢুকলেই ছিল ইলেকট্রিকের মিটার, তার পাশে তালা মারা দরজা। ওটিই ছিল আমার স্টুডিও। সেখানে আমি ছবি আঁকতাম। ওই ঘরে একটা কালো টিনের বাক্সে আমার জেলজীবনের খাতাটা রাখা ছিল। সঙ্গে ছিল ইতালি থেকে আমিনুল ইসলামের লেখা চিঠি ও ছবি এবং শিল্পী পরিতোষ সেন ও দিলীপ দাশগুপ্তের লেখা চিঠি ও ছবি।
এ ছাড়া খুবই মূল্যবান একটি জিনিস যত্ন করে খামের ভেতর রাখা ছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ আবুল বরকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় ধরেছিলাম। আমার হাতে ছিল কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য পানিভেজা রুমাল। ওই রুমালের এক কোণে একটা লাল ফুল এমব্রয়ডারি করা ছিল। যার লাল উজ্জ্বল রং রক্তের উজ্জ্বলতায় হারিয়ে গিয়েছিল। বায়ান্নর সেদিনের ঘটনা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন দুপুর গড়িয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সারি সারি ব্যারাকের সম্মুখের ঘাসে আমি এবং হাসান হাফিজুর রহমান বসেছিলাম চার-পাঁচটা ব্যারাক পেরিয়ে, লাল খোয়া রাস্তার একধারে।
হাসান বলছিল নতুন কবিতার কথা, আর আমি ভাবছিলাম আজকে জাদুঘরে ঢাকা আর্ট গ্রুপের ২য় চিত্র প্রদর্শনীর কথা। যেখানে আমার তেলচিত্রগুলো রাখা ছিল। হঠাৎ দেখলাম, ব্যারাকগুলোর দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা চলন্ত জটলা। দৌড়ে গেলাম। বেশ লম্বা, শ্যামবর্ণ, মুখমণ্ডল পরিষ্কারভাবে কামানো, সারা চেহারায় বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ভরে যাওয়া ঘাম আর পরনের প্যান্টের পেটের নিচ থেকে কল খুলে দেওয়ার মতো অঝোরে রক্তের ঢল। সবার সঙ্গে আমিও তাকে ধরেছি, আমার সাদা পাজামায় কে যেন আবীরের রং পিচকারি দিয়ে ছড়িয়ে রাঙিয়ে দিল। আমি তাকে ধরেছি বুকের কাছে, আমার মাথা তার মুখের কাছে। একসময় সে চোখ তুলে তাকাল। একটা ছোট শিশুর ন্যায় গড়গড় করে নামতা পড়ার মতো করে বলল, আমার বাড়িতে খবর দেবেন...আমার নাম আবুল বরকত...বিষ্ণুপ্রিয় ভবন, পল্টন লাইন...।
পরমুহূর্তে জবাই করা মুরগির মতো হাঁ করে জিব কাঁপিয়ে ফিসফিস করে বলল, পানি। পানি।
বাঁ হাত দিয়ে মৃদুভাবে ধরেছি তার পিঠ, ডান হাতখানা তার বুকের ওপর। সে হাতে রুমালখানা রেখেছি ধরে, যা মুখের ঘাম মোছার কারণে ভেজা আর নোংরা। ভাবলাম কী করব। জিব কাঁপছে অনবরত খোলা মুখের ভেতর। একটু ইতস্তত করলাম। মনে দ্বিধা, এক ধরনের অপরাধ বোধ। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। জিবটা বারবার নড়ছে। পরমুহূর্তেই নিংড়িয়ে দিলাম হাতের রুমাল।
শহীদ বরকতের অমর স্মৃতিমাখা সেই রুমালসহ আমার জেলজীবনের সবকিছুই বাক্সবন্দী অবস্থায় ওই রুম থেকে চুরি হয়, যা আমার জীবনে অনেক বড় ক্ষতি করেছে। চোরেরা পরে হয়তো সবই ফেলে দিয়েছে। কারণ, এসবে তার কোনো কাজেই আসবে না। নেওয়ার সময় হয়তো ভেবেছিল, অনেক দামি কিছু আছে।
প্রসঙ্গত, একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনা নিয়ে আমি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’ বলে একটি গল্প লিখি। এবং সেই সংকলনে ‘রক্তাক্ত একুশে’ নামে একটি লিনোকাটও করেছিলাম। একটি কবিতাও লিখেছিলাম ‘পারবো না’ এই শিরোনামে, যা ছাপা হয়েছিল সেই বছরই কলকাতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায়।

মুর্তজা বশীর: শিল্পী, সাহিত্যিক, গবেষক। বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

কারাগারের কবিতা

বিদের যদি স্তব্ধ করে দেওয়া যায় লাখ লাখ মানুষ স্তব্ধ হয়ে যাবে, লাখ লাখ মানুষ হারাবে কণ্ঠস্বর। জেল-জুলুমেও স্তব্ধ করা যায়নি এমন চারজন কবির কারাগারে রচিত কবিতা অনুবাদ করেছেন আন্দালিব রাশদী

নাজিম হিকমেত
আমন্ত্রণ


দূর এশিয়া থেকে লাফিয়ে এসে
ঘোটকীর মাথার মতো বেরিয়ে এসেছে
ভূমধ্যসাগরের দিকে—সে আমাদের দেশ।

কবজি রক্তস্নাত, দাঁত কপাটিলাগা, খালি পা
এ মাটি রেশমের কার্পেটের মতো ছড়িয়ে আছে
এই নরকই স্বর্গ আমাদের।

ধনিকতন্ত্রের দরজাগুলো বন্ধ করে দাও, আর খুলতে দিয়ো না
মানুষের কাছে, মানুষের দাসত্ব নিশ্চিহ্ন করে দাও
এই আমন্ত্রণটি আমাদের।

বৃক্ষের মতো এককভাবে বাঁচতে, স্বাধীনভাবে
জঙ্গলের গাছের মতো ভ্রাতৃভাব নিয়ে
এই প্রত্যাশাটি আমাদের।

[নাজিম হিকমেত তুরস্কের কবি, অত্যাচার ও দারিদ্র্যের কবি, গ্রেপ্তার ও নির্বাসনের কবি। বছরের পর বছর অন্তরীণ ছিলেন। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৬৩ সালে মস্কোতে মৃতুবরণ করেন।]

সামিহ আল-কাসিম
কারা-কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা শেষ


আমার ছোট্ট কারা-প্রকোষ্ঠের সরু জানালা দিয়ে
আমি গাছ দেখি—আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে
আর ছাদের ওপর আমার পরিবারের লোকজনের ভিড়
জানালাগুলো আমার জন্য কাঁদছে, প্রার্থনা করছে
আমার ছোট্ট কারা-প্রকোষ্ঠের সরু জানালা দিয়ে
আমি তোমার বড় কারা-প্রকোষ্ঠ দেখতে পাচ্ছি।

[সামিহ আল-কাসিম ১৯৫০ দশকের ফিলিস্তিনি ‘প্রতিরোধের কবি’। বহুবার জেল খেটেছেন।]

হাবিব জালিব
প্রতিরোধের অধিকার


যে বাতি কেবল প্রাসাদেই জ্বলে
হাতেগোনা পছন্দের কজনের সেবায়
যে আলো কেবল তাদের লাভটুকু রক্ষা করে
এমন একটা নিয়ম, আলোহীন ভোর
আমি কবুল করতে অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না।
সিংহাসনে যারা আছে, আমি তাদের দেখে সন্ত্রস্ত নই
আমিও বিজয়ী, শহীদ, শত্রুদের বলে এসো
কারাদেয়ালের ভেতর আমাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করছ কেন?

এমন নিপীড়ন, হূদয়ের অন্ধকারের মতো
আমি অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না
শাখায় শাখায় ফুল ফুটছে, তুমি তাই বলছ
সুরাপায়ীর পাত্র উপচে পড়ছে, তুমি তাই বলছ
বুকের ক্ষতগুলো নিজেরাই সারা যাচ্ছে, তুমি তা-ই বলছ
এসব খোলা মুখ মিথ্যে, আত্মার এই অপমান
আমি কবুল করতে অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না।

শতকের পর শতক আমাদের শান্তি হরণ করছ
মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আমাদের আর বোকা বানাবে না
যেন তুমি ওসব ক্ষতের আরোগ্যকারীর ভান করছ?
তুমি আরোগ্যকারী নও, যদি কেউ তোমাকে মানে মানুক
আমি কবুল করতে অস্বীকার করি, আমি জানতে চাই না।

[পাকিস্তানি বিপ্লবী কবি হাবিব জালিবের জীবন কেটেছে কারাগারে আশ্রয়হীন অবস্থায় খোলা রাস্তায়। ১৯৮৮ সালে তিনি কারামুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন, সরকার শেষকৃত্যে সহায়তা করতে এগিয়ে আসলেও কিন্তু তার পরিবার থেকে সরকারি সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা হয়।]

ফাজিল আল-আজ্জাবি
আমার অবসর সময়ে


আমার দীর্ঘ বিরক্তিকর অবসর সময়
আমি পৃথিবী বৃত্ত নিয়ে খেলতে বসে যাই
পুলিশ কিংবা দলবল ছাড়া আমি রাষ্ট্র গড়ি
যা কিছু মানুষের ভালো লাগে না, আমি ভেঙে ফেলি
শূন্য মরুভূমির ভেতর দিয়ে আমি গর্জে ওঠা নদী বইয়ে দিই
আমি মহাদেশ ও মহাসাগর সৃষ্টি করি
যদি দরকার হয়, ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখি
আমি জাতিসমূহের নতুন মানচিত্র তৈরি করি।

হাঙরভরা প্রশান্ত মহাসাগরে জার্মানিকে গড়িয়ে দিই
দরিদ্র শরণার্থীরা জলদস্যুর জাহাজ পৌঁছে যাক উপকূলে, কুয়াশায়
বাভারিয়ার প্রতিশ্রুত বাগানের স্বপ্ন দেখতে দেখতে
আমি আফগানিস্তান ও ইংল্যান্ডকে জায়গা অদল-বদল করে দিই
যাতে মহামাননীয়া রানির সৌজন্যে তরুণেরা হাসিস ফুঁকতে পারে
কুয়েতকে বেড়া ও মাইনপোঁতা সীমান্ত থেকে উঠিয়ে
চন্দ্রগ্রহণের দ্বীপ কমোরোতে পাচার করি
অবশ্যই তেলক্ষেত্রগুলো অক্ষত রাখি
একই সময় প্রচণ্ড ড্রামবাদ্য বাদনের মাঝখানে তেহরানকে
পাঠিয়ে দিই তাহিতি দ্বীপপুঞ্জে।
সৌদি আরবকে তার মরুভূমিতে গুটিসুটি মেরে থাকতে দিই
সেখানে অসংকর উটের বিশুদ্ধতা রক্ষা করুক
আর আমি আমেরিকাকে সমর্পণ করি ইন্ডিয়ানদের কাছে
ইতিহাসকে কেবল দিতে
এত দিনের না পাওয়া ন্যায়বিচার
আমি জানি, পৃথিবীটা বদলানো সহজ কাজ নয়
তবুও কাজটা করা যে খুব জরুরি।

[ফাজিল আল-আজ্জাবি তুর্কি কবি, জন্ম ১৯৪০ সালে, জীবন কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে। তাঁর কবিতায় একটি কাল্পনিক ভূগোলক স্পষ্ট। ইউরোপ তাঁর কাছে সাম্রাজ্যবাদী অমানবিক মহাদেশ।]

লালনের ননী চুরি, গৌতম ঘোষের ছলচাতুরি by বিধান রিবেরু

Monday, February 7, 2011

যার মৃতু্য তারিখ একশো বছর পার করে ফেলে, বিশেষ উদ্যোগ না থাকলে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত উদ্ধার করা কষ্টকর, আর তিনি যদি হন লালনের মতো দার্শনিক বাউল, প্রচারবিমুখ, তাহলে অনেক কাহিনীই কল্পনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সেটা হয়ে ওঠে মিথ। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালন ফকির মারা যাওয়ার ১৪দিন পর 'হিতকরী' পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়, সেখানে বলা হয়_'ইঁহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না, শিষ্যেরা হয়ত তাঁহার নিষেধক্রমে, না হয় অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না।' (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৬৭৪) যদিও এই পত্রিকায় 'সাধারণে প্রকাশ' দোহাই দিয়ে লালন ফকিরকে কায়স্থ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। তবে সেটা নিশ্চিত নয় বলেই তারা বলেছে 'সাধারণে প্রকাশ'। অতএব লালন হিন্দু ঘরের না মুসলমানের তা নির্দিষ্ট করে বলতে যাওয়ার মধ্যে একটা সামপ্রদায়িক গন্ধ যেমন থাকে তেমনি সেই তর্কে যাওয়া মূঢ়তারও প্রকাশ বৈকি।

অসামপ্রদায়িক মানসিকতার লালনকে নিয়ে তবুও টানাহেঁচড়া থামে না। সমপ্রতি লালনকে নিয়ে মুক্তি পাওয়া গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র 'মনের মানুষ'-এ সেই রকমই সামপ্রদায়িকতা ও মূঢ়তা চোখে পড়ে। এবং আমাদের পীড়া দেয়। লালনের জাতধর্মকে প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে ছবিটি যদি করা হতো, তাহলে ছবির জাত কি চলে যেত?

চলচ্চিত্রে শুরুর দিকে আমরা দেখি কিশোর লালন কবিরাজকে গান শোনাচ্ছে, 'আর আমারে মারিস নে মা, ঃননী চুরি আর করবো না'। কবিরাজ ও তার পরিবারের সঙ্গে গঙ্গা স্নানে যাওয়ার আগে নিছক এই গানটি পরিবেশনার মাধ্যমে সনাতন ধর্মের একটা আবহ সৃষ্টির চেষ্টা এখানে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একদিকে পুণ্য অর্জনের জন্য যাত্রা, অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণের আকুতি। কিন্তু কেউ কি হলফ করে বলতে পারে, লালনের জলবসন্ত হওয়ার আগে এই গান রচিত হয়েছিলো। তাছাড়া তখন তো লালনের গান সংগ্রহ করে তেমন কেউ ছিলো না। যেহেতু বাউল হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের পরই। যদি বলি, বাউল ধর্মকে গ্রহণ করার পর এই গানের সৃষ্টি? তাহলে কি বিশ্বাস করা যায়, শুধু কৃষ্ণের ক্ষমা প্রার্থনা রাষ্ট্র করার জন্যই এই গান বেঁধেছিলেন লালন? না।

আমরা মনে করি, লালনের এই গানে 'মা' পরমেশ্বরেরই একটা মেটাফোর। আর 'ননী' কামুক ভোগবিলাসি জীবনের এক অসাধারণ রূপান্তর। এই ভবে ভোগবিলাস যেমন আছে, তেমনি আছে পরমেশ্বরের সাধনা। শুদ্ধ ভোগবিলাসে ভাগ্যের রূপান্তরে পরমের মার খাওয়ার দৃশ্যকল্পই কি লালন এই গানে ধরতে চাননি? লালন গবেষকরা এই প্রশ্নের মীমাংসা করবেন। কিন্তু লালনের গানের শ্রোতা হিসেবে আমরা মনে করি, নেহায়েৎ কৃষ্ণ বন্দনার জন্য লালন এই গান রচনা করেননি। তাতে কি, সিনেমাটোগ্রাফার কাম পরিচালক গৌতম ঘোষ অবলীলায় ঐ 'ধর্মীয়' গানটি 'হিন্দু' লালনকে দিয়ে গাইয়ে নিয়েছেন।

বাউল ও লালন বিষয়ক পণ্ডিত অধ্যাপক উপেন্দ্রকিশোর ভট্টাচার্য বাউলদের 'মনের মানুষ' সম্পর্কে বলেন_

"মানব-দেহস্থিত পরমতত্ত্ব বা আত্মাকে বাউল 'মনের মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। আত্মাকে 'মানুষ' বলার তাৎপর্য মনে হয় এই যে, আত্মা মানবদেহকে অবলম্বন করিয়া বাস করিতেছেন ও মানবদেহের সাধনার দ্বারাই তিনি লভ্য এবং এই মানবাকৃতি তাঁহারই রূপ মনে করিয়া বাউল তাঁহাকে 'মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। এই মানুষ অলক্ষ্য অবস্থায় হূদয়ে বা মনে অবস্থান করিতেছেন, বোধহয় এই কল্পনা করিয়া তাহারা তাঁহাকে 'মনের মানুষ' বলিয়াছে। এই আত্মাকে তাহারা 'মানুষ', 'মনের মানুষ', 'সহজ মানুষ', 'অধর মানুষ', 'রসের মানুষ', 'ভাবের মানুষ', 'আলেখ মানুষ', 'সোনার মানুষ', 'সাঁই' প্রভৃতি নানা নামে অভিহিত করিয়াছে।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৪০)

লালন যেমনটা বলেন:

"এই মানুষে আছে, রে মন,

যারে বলে মানুষ রতন, লালন বলে পেয়ে সে ধন

পারলাম না রে চিনিতে।।"

(ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৫৯৪)

দুঃখের বিষয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে ভিত্তি করে নির্মিত গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র 'মনের মানুষ'-এ সেরকম কোনো আত্মঅনুসন্ধানের হদিসই মেলে না। যা মেলে সে শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করা একদল কামুক নারী এবং 'পালের গোদা' লালন। অবশ্য বিচ্ছিন্ন জঙ্গলে আস্তানা গাড়ার আগে দেখানো হয় সিরাজ সাঁই লালনকে এক নারীর কাছে পাঠাচ্ছেন 'নারীসঙ্গ' পাওয়ার জন্য। সেই নারীর যে মুখভঙ্গি ও সংলাপ সেটাকে দর্শক কি বলবেন? 'অমাবস্যায় পূর্ণিমা' জাগানোর নারীর কামুক অনুরোধে বিবাহিত লালন সাড়া দেন। গৌতম ঘোষের ছবি অনুযায়ী লালন তখনো লালন হয়ে ওঠেননি। তবে 'হয়ে' ওঠার প্রক্রিয়া চলছে। প্রশ্ন হলো, গৌতম ঘোষের সিরাজ সাঁইয়ের কি আর কোনো তরিকা ছিলো না? বাউল ধর্মের গূহ্য ও গূঢ় বিষয়কে এভাবে যৌনতার মোড়কে আনা ব্যবসায়িক চাতুরি ছাড়া আর কি? বাউল ধর্মে অমাবস্যাকে দেখা হয় ঘোর অন্ধকার কামের সময় হিসেবে, আর পূর্ণিমাকে ধরা হয় প্রেমের মেটাফোর। "কামের স্বরূপকে বাউলরা নিরবচ্ছিন্ন দেহ-ভোগের অন্ধকারময় শক্তি বলিয়া বুঝিয়াছে। এই 'অমাবস্যা'র মধ্যেই তাহাদের 'পূর্ণচন্দ্র' উদিত হয়। এই পূর্ণচন্দ্র 'সহজ মানুষ' বা 'অধর মানুষ', ইনিই প্রেম-স্বরূপ।ঃ এই 'অধর মানুষ' বা পরমাত্মা সহস্রারে অটল-রূপে বিরাজিত। ইনি এই যোগের সময় রস-রূপে প্রকৃতি-দেহে ক্রীড়া করেন এবং পূর্ণভাবে মূলাধারে প্রকৃতির কারণ-বারিতে আবিভর্ূত হন। এই আবির্ভাবকে তারা পূর্ণিমার যোগ বলে। ইহাই বাউলদের 'অমাবস্যার পূর্ণচন্দ্র উদয়'। এই সময় তাহাদের 'অমাবস্যা-পূর্ণিমা'র একত্র যোগ। এই যোগের তৃতীয় দিন বা কোনো সমপ্রদায়ের মতে চতুর্থদিনে 'মানুষ ধরা'র প্রশস্ত দিন।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৯১) এতো দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার একটাই কারণ, আমরা বলতে চাই বাউল ধর্ম ও তার জীবনাচরণ সাধারণের চেয়ে ভিন্ন, তাদের রয়েছে গোপন দর্শন ও চর্চা। 'নারীসঙ্গ' ও 'অমাবস্যায় পূর্ণিমা'য় চোখেমুখে কামুকতা ও পোশাকে নগ্নতা এনে পরিচালক ঘোষ যে দোষ করেছেন তা স্খলন হবে কিনা তার জবাব প্রকৃত বাউলরাই দিতে পারবেন। আমরা তো সামান্য মাত্র! এই চলচ্চিত্রে নারীকে এমন 'ভোগ্যপণ্য' ও 'কামুক'রূপে আনা হয়েছে একাধিকবার।

ছবিতে কলমি নামের এক নারী চরিত্র রয়েছে। দেখা যায় আখড়ার প্রথম নারী সদস্য সে। এক মুসলমানকে বিয়ে করে সে পালিয়ে এসেছে। তার অভিযোগ লালনের গৌতম ঘোষ কথিত 'দোস্ত' কালুয়া তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই সে ঐ কাজ করেছে। কিন্তু এরও আগে সে একজন ব্রাহ্মণের স্ত্রী। গৌতম ঘোষের 'আনন্দবাজারে' এসে সেই নারী এমনই কাম তাড়নার শিকার হয় যে সে একবার কালুয়ার দিকে ঝোঁকে তো আরেকবার গভীর রাতে লালনের ঘরে প্রবেশ করে। লালনের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করে বলে 'তোমার শরীর জেগে উঠেছে', 'আমার জ্বালা মিটাও গো সাঁই'। এই কলমিকেই আবার লালন পরামর্শ দেন কালুয়াকে 'নারীসঙ্গ' দেয়ার জন্য।

আরেক নারীকে দেখা যায়, বিধবা হওয়ায় যাকে 'সতীদাহ' প্রথায় জীবন্ত পোড়ানো হচ্ছিলো। সেই নারীকে লালন ও তাঁর শিষ্যরা রক্ষা করে এবং কথিত 'আনন্দবাজারে' ঠাঁই দেয়। সেই নারীকে আবার কলমি লালনের কাছে পাঠায়। 'সেবা' করার জন্য। লালন আবার সেই নারীকে সাধনসঙ্গিনী করে দেন তাঁরই শিষ্য দুন্দু শাহ-এর। আখড়ায় আরেক নারীর দেখা মেলে। ইনি গ্রামীণ চেকের জামা পরা নারী বাউল। প্রকৃত নাম বিবি রাসেল। উনার জীবনের এক ট্র্যাজেডির কথা পরিচালক বলেন, এবং সেখানেও যৌনতা, ট্র্যাজেডিটা হলো ব্রাহ্মণের দ্বারা এই নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো। যে মুহূর্তে এই সত্যটা দর্শকের কাছে উন্মোচিত হয়, সেটি যে নিছক হাল্কা ও সস্তা হাততালির জন্য পরিচালক করেছেন তা পরিষ্কার। নয়তো, মোলস্না ও ব্রাহ্মণের সঙ্গে বাহাসে যখন লালন 'কুলিয়ে' উঠতে পারছিলেন না তখন সেই নারী-বাউল ধর্ষণের কথা বলে ব্রাহ্মণের চোখা মুখ ভোঁতা করে দেবে কেন? এরপর লাঠালাঠির দৃশ্যে মোলস্না ও ব্রাহ্মণের হাত ধরাধরি করে পুকুরে নেমে যাওয়ার দৃশ্যটি এতোটাই স্থূল কমেডি যে দেখলে বিরক্তি ধরে যায়।

কথা হচ্ছিলো নারী ও কাম নিয়ে। বাউল ধর্মের যে সাধনা সেটি বাইরের মানুষের পক্ষে বোঝা অতো সহজ নয়। কাম মানুষের প্রবৃত্তি। জীবনকে যুক্ত করে সাধনা করতে হলে, পরমের কাছে পেঁৗছুতে হলে কামকে বাদ দেয়া যায় না। তবে নারী সেই সাধনার 'বস্তু' নয়, 'সঙ্গী'। বাউলদের কাম সম্পর্কিত নানা বিষয় হুট করে বাইরের মানুষের কাছে প্রকাশ হলে ভুল বোঝার অবকাশ আছে। আর তাই, বাউলরা প্রায়ই বলেন, "আপন ভজন-কথা না কহিবে যথা-তথা, আপনাতে আপনি হইবে সাবধান।" এই গোপনীয়তা বাউলরা ধর্মাদেশের মতোই রক্ষা করেন। বাউল গবেষক ভট্টাচার্য আমাদের জানান, তিনি রাঢ়ের বাউলদের মুখে অনেকবার শুনেছেন: "যে জানে না উপাসনা, সে যেন পদ্মলোচনের পদ শোনে না।" (ভট্টাচার্য ১৯৫৩: ৩৬৯) দুঃখের বিষয়, না জেনে ও না বুঝে, উড়ে এসে জুড়ে বসে, 'পদ্মলোচনের পদ' নিজেরা শুদ্ধ শোনেননি, আমাদেরও শোনানো ও বোঝানোর কাজটি করতে চেয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলী ও গৌতম ঘোষ। তাঁদের এই লালনকে শুনে এবং বুঝে ভারতের বুদ্ধিজীবী তপন রায়চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন "ছবিটি শ্রেষ্ঠ অর্থে ধর্মগ্রন্থ" হয়ে উঠেছে। (রায়চৌধুরী ২০১০: ৫৪)

'মনের মানুষ' চলচ্চিত্রে জমিদার ও ভূস্বামীদের মিত্র হিসেবে লালনকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শ্রেণীচরিত্রই শুধু নয়, আপন ছলচাতুরিকেও প্রকাশ করেছেন ঘোষ-গং। প্রান্তিক মানুষের সম্রাট লালনকে, সাধনার গোপনীয়তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, যৌনতার মোড়কে যেভাবে তারা উপস্থাপন করেছেন, তাতে লালন পরিণত হয়েছেন পণ্যে, যেভাবে নারীরাও এখানে পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত। সমাজে যে ভাষা-বলয় কর্তৃত্ব করছে, যাদের সংস্কৃতি আধিপত্য বিস্তার করে আছে তারই পুন:উৎপাদন এই চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান। এখানে শত বছর আগের কুষ্টিয়া ছেউড়িয়ার লালন নাই। এখানে যিনি আছেন, তিনি কলকাতার জমিদার বাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লালন, তিনি বর্তমান সময়ের দুই বাংলার পুঁজিপতিদের লালন।

সহায় : ভট্টাচার্য, উপেন্দ্রনাথ (১৯৫৩), বাংলার বাউল ও বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি (৩য় সংস্করণ), কলকাতা।

অসহায় : রায়চৌধুরী, তপন (২০১০), মনের মানুষ, দেশ পত্রিকা, ১৭ ডিসেম্বর ২০১০, ৭৮ বর্ষ ৪ সংখ্যা, কলকাতা।

আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি থেকে

মর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১১তে প্রকাশিত হবে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় অংশ 'উঁকি দিয়ে দিগন্ত'। বইটি প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন সমর মজুমদার। বইটির দাম রাখা হয়েছে ২৪০ টাকা। ইত্তেফাক সাময়িকীর পাঠকদের জন্য এখানে বইটির চুম্বক অংশটুকু ছাপা হলো।

বলা আমাকে মাটিতে নামিয়েছে কি নামায়নি, ঝড়ের মতো দাশুমাস্টার এসে ঘরে ঢুকলেন। ঠিকমতো আলোগুলো জ্বালানো হয়নি। কোনো দিকে না চেয়ে দাশুমাস্টার বললেন, এই, তোরা দু-ভাই আমার সঙ্গে আয়। আর তোরা সব সোজা বাড়ি চলে যা।

আমাদের হারিকেনের বাতি একদম কমানো। মাস্টারমশাইয়ের পিছু পিছু আমরা দু-ভাই হাঁটছি। চাঁদ নেই, অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসছে। কাত্যায়নী ঠাকরানির মাটির বাড়িটা এদিকের শেষ হিঁদুবাড়ি। ঠাকরানি বহুদিন দেশছাড়া, বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। ওই বাড়ির পরেই খোনা ফকিরের দোকানের পাশ দিয়ে শিবতলার দিকে যাওয়ার গলিরাস্তাটা, তার পরেই মোসলমানপাড়ার শুরু আর শুরুতেই আমাদের ফাঁকা নতুন বাড়ি। এই বাড়িটা বাবা কিনেছিলেন বিনোদবাবুর কাছ থেকে। সেজন্য এখনো ওটা বিনোদবাবুর বাড়ি। আমরা পুরনো বাড়িতেই থাকি। এ বাড়িটা পড়ে আছে খালি। একটা পেয়ারা গাছ, দু-কোণে দুটো ডুমুরগাছ। গাধাপুইনি, কাঁটানটে আর ঘাসেভরা বাড়িটা। কাছে আসতেই দেখি দেয়াল ঘেঁষে ঠিক কোণের কাছটায় অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলোকে আবছা দেখা যাচ্ছে। কারা আছে, কে আছে বোঝার উপায় নেই। একজন একটু কাছে এগিয়ে এল, দেখলাম শ্রীধর কাকা, তার হাতে একটা পাঁঠা কাটার টাঙি। একবার যেন মনে হল, খোনা ফকিরের বড় ছেলে শঙ্করীদা আর বোধহয় আগুরিদের বেন্দাবনদাকে দেখলাম। সবারই হাতে কিছু-না-কিছু আছে, লাঠি, হুড়কো, বগি_এইসব।

একজন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে যায়, মোলস্নাদের ছেলে দুটি? দাশুমাস্টার কথা বলে উঠলেন। গলা নয় যেন শানানো ইস্পাত, খবরদার, আমার ছাত্তর ওরা। আমি ওদের বাড়িতে পেঁৗছে দিয়ে আসি।ঃএইখানেই ওদের ছেড়ে দাও মাস্টার, আর এগিয়ো না। মোচনরা সব ওদের আস্তানায় জড়ো হয়েছে।ঃসে আমি দেখছি, দাশুমাস্টার বললেন।

শুকনোর দিনে ধুলোভরা রাস্তায় পা ডুবে যাচ্ছে। এইটুকু রাস্তা, মনে হচ্ছে অনেক দূর। আস্তানায় এসে দেখি সারা মোসলমানপাড়ার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। একদিকে রাস্তার ইটের ভাঙা মিনার, তার মাথায় পাকুড়গাছের চারা আর একদিকে ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে আমরা হা-ডু-ডু, হিঙেডারি খেলি, মাদার মহররম সব সেখানেই শুরু হয়। জায়গাটা এখন মানুষে ভরা। সবার হাতেই বাঁশ, লাঠি, একটা-দুটো কিরিচ। লাঠিওয়ালারাই বেশি। মোসলমানপাড়ার বাকি নেই কেউ; শুধু বাবা, নাজিরবক্স চাচার বুড়ো বাপ_এরকম কয়েকজন নেই। এমনকি লতিফ চাচার মতো আধবয়েসি মানুষটাও কোঁচরভর্তি কি কি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দাশুমাস্টার একেবারে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে বললেন, এই শোনো তোমরা, মোলস্নাবাড়ির ছেলে এই দুটি আমার কাছে পড়তে যায়। ওদের দিয়ে গেলাম। কেউ কোনো কথা বলল না। যা, এখানে দাঁড়াস না, বাড়ি চলে যা, এই বলে মাস্টারমশাই নিজের বাড়ির দিকে ফিরলেন। কেউ একটি কথাও বলল না। ধুলোভরা সাদা অাঁধারে দাশুমাস্টার একবারে মিলিয়ে গেলে একজন বলে উঠল, কপাল ভালো মাস্টারের, ভালোয় ভালোয় ফিরে গেল!

মনে হল, মোসলমানপাড়ার সবাই এসেছে। তবে মোটমাট ক-টাই বা লোক? সবসুদ্ধ এক শ' হয় কি না! লাঠি ঠুকতে ঠুকতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে মলিস্নকবাড়ির ফকির চাচা। তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে খুব খারাপ একটা পচা ঘা। ওই ঘা বহুকাল ধরে শুকোয়নি। পানসে রক্ত গড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে। হাড়-মাংস খসে পড়েছে, আঙুলটার আর সামান্যই বাকি। লোকে বলে কুঠ্ হয়েছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাছে এসে আমাকে দেখে বলল, কি বলব বাপ, আলস্না মেরে রেখেছে, নাইলে ওই কটা হিঁদু মালাউনকে এক লাপটেই সাবড়ে দেতম। লতিফ চাচা কোঁচড়ে কি নিয়ে যেন ঘুরছে, একজন বলল, বালি, সামনা সামনি হলেই হিঁদুগুনোর চোখে বালি ছুঁড়ে একদম কানা করে দেওয়া হবে, তারপর পিটিয়ে, ঠেঙিয়ে কিংবা কুপিয়ে কুপিয়ে মারো কেন আরাম করে। শুনলাম খবর দেওয়া হয়েছে সেই লেঠেলদের গাঁ ধারসোনায়, আসছে তারা সব। অবশ্যি হিঁদুরাও তাদের হিঁদু-গাঁ ক্ষীরগাঁয়ে খবর দিয়েছে। ভয়-পেদো হিঁদুরা আসবে কি-না কে জানে। মোসলমানপাড়া ঢোকার মোড়ে মোড়ে আড়াআড়ি করে গরু-মোষের গাড়ি রেখে দেওয়া হয়েছে। ওইসব পেরিয়ে আসতে আসতেই তাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হবে। ভারি মজা! গাঁয়ে শুধু হিঁদু আর মোসলমানরা আছে! ওহিদ চাচা, বঁ্যাক চাচা, ননু কাকা, ভুতো কাকা, মোবাই শেখ, মনবশ চাচা, ষষ্ঠীদা, পঞ্চাদা, পঞ্চা হাড়ি, চক্কোবত্তি মশাই, আশু ভশ্চায্যি, রাম সামন্ত_এরা কেউ নেই। কোনোদিন ছিলও না। শুধু হিঁদু আর মোসলমান আছে!

পণ্ডিতমশাই বলে গেলেন, আগে বাড়ি যা, কোথাও দাঁড়াবি না। এতক্ষণ আমরা দু-ভাই বোকার মতো ঘোরাঘুরি করছিলাম, শেখদের বাড়ির নাছ-দুয়োরের পাশের গলি দিয়ে বাড়ি যাব, শুনতে পেলাম, ও-বাড়ির একটা ঘর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে মেদিনী ফাটাচ্ছে। দুয়োর খুলে দে, খুলে দে বলছি, এই মা, হারামজাদি, দুয়োর খোল্, মালাউনের বংশ রাখব না, একবার ছেড়ে দে খালি। খুলবি না? এই ভাঙলম দুয়োর! দুমদাম শব্দ আসতে লাগল। ঘরে কিবরিয়া আটক আছে। ও কেমন খেপা সবাই জানে, মহররম খেলতে গিয়ে মানুষ খুন করার জোগাড় করে, মাদার নাচাতে গিয়ে একেকটা বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ও ছাড়া থাকলে এতক্ষণে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত।

ভাত দেওয়ার সময় ফুফু একটি কথা বলেনি। আমরা সবাই মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম। রাত খুব তাড়াতাড়ি নিশুতি হয়ে যাচ্ছিল বলেই বোধহয় আস্তানা আর বিনোদবাবুর বাড়ির কোণ থেকে হলস্না-চিৎকার অনেক স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। এমনকি দু-চারটে কথাও শোনা যাচ্ছিল। ভাতঘর থেকে বেরিয়ে কোনো চাচাকেও দেখতে পেলাম না। জানি না কেউ কেউ আস্তানায় গিয়েছে কিনা।

ঘরে আজ অন্ধকার নীল ফোঁটাটা নেই। আলোই জ্বলছিল। বাবা বিছানার ওপর বসে। মা-ও ঘরে। দেয়ালে একনলা বন্দুকটা ঠেস দিয়ে রাখা, ফ্লুট বাঁশিটা একই জায়গায় রয়েছে, ভেসিলিন-মাখানো খাঁড়াটাও দেয়ালে টাঙানো। বাবা মাকেই বলছিলেন, সন্ধেবেলায় ওবেদ শেখ তার দলিজে বসে ছিল। মোসলমানপাড়া থেকে হিঁদুপাড়ার দিকে গরুর গাড়ি যাওয়ার রাস্তা সে বন্ধ করে দেবে। ওর গোয়ালের একদিকের কোণের দেয়াল গাড়ির চাকার ধাক্কা লেগে বারবার ভাঙছে বলে সে ওপথে গাড়িই যেতে দেবে না। দেয়ালের কোণে একটা খুঁটো পুঁতে দিলেই তো দেয়াল বাঁচে! ক-বার নাকি তেমন খুঁটো পুঁতেছিল, কারা উপড়ে দিয়েছে। সে তাই রাগ করে একটা খুঁটো দিয়েছে দেয়ালের কোণে আরেকটা রাস্তার ঠিক মাঝখানে। এটা সে করতে পারে না, সরকারি রাস্তা তো তুমি বন্ধ করতে পার না! এদিকে রামযুক্ত হাজরার গরুর গাড়ি আসছিল কয়লাটয়লা নিয়ে। হিঁদুপাড়ার রাস্তায় কাদা, সে মোসলমানপাড়া দিয়ে যাবে। রাস্তার খুঁটো দেখে তার মেজাজ খারাপ। ওবেদ তো বসেই ছিল দলিজে, রামযুক্তটা গোঁয়ার, সে তাকে কোনো কথা না বলে রাস্তার মাঝখানের খুঁটোটা উপড়ে ফেলল। বেশ, তাই কর্, খুঁটোটা উপড়ে ফেলে চলে যা, তা না, সে দেয়ালের কোণের খুঁটোটাও তুলে ফেলে দিল। ওবেদ নিজে উঠে এসে রামযুক্তর ঘাড় চেপে ধরল, রামযুক্ত, এই তোর গাড়ি আটকে দেলাম। দেখি তুই কেমন বাপের ব্যাটা, গাড়ি নিয়ে যা দেখি। বোধহয় কিবরিয়া আশেপাশে ছিল, সে এক ছুটে এসে রামযুক্তের গলা ধরে ঝুলে পড়েছে। লেগে গেল ঝটাপটি। রামযুক্ত আমার সঙ্গে যাত্রায় সং-এর পার্ট করত, আমি জানি তার গায়ে খুব বল। এক ঝটকায় কিবরিয়াকে ঝেড়ে ফেলে সে শুধু বললে, গাড়ি যেতে দিবি না? গাড়ি যেতে দিবি না? এই থাকল গাড়ি, যাচ্ছি আমি। শালার নেড়ের খুব বাড় বেড়েছে। শালাদের পাড়া জ্বালিয়ে দোব আজ। এই বলে গাড়ি ওইখানেই রেখে রামযুক্ত চলে গেল। এখন গাড়ি মাঝখানে_এদিকে মোসলমানরা, ওদিকে হিঁদুরা। আমি জানি একটা কিছু ঘটবেই। বাতাসভরা বিষ। নিঃশ্বাস সবাইকেই নিতে হচ্ছে। বিষ ঢুকবে না?

মোহনা by হরিশংকর জলদাস

Saturday, February 5, 2011

কালিন্দীর যে-তীরে ডমরনগর, সে-তীরে বারাঙ্গনাপল্লী। এই পল্লী নগরীর বাইরে, বাজারের পাশে। ও-পাড়ের মাঝিরা যে-ঘাটে নৌকা ভিড়ায়, তার থেকে সামান্য পশ্চিমে বারাঙ্গনাপল্লীটি। জোয়ার ভাটার নদী কালিন্দী। ভাটায় জল নেমে গেলে চর ভেসে ওঠে। বারাঙ্গনাপল্লী থেকে দু’কদম হাঁটলেই নদীপাড়।

ওখান থেকে ঢালু হয়েছে ভূমি। বারাঙ্গনারা সকালে একবার, সন্ধেয় আরবার গা-গতর ধুতে যায় নদীজলে। পুরুষ-বর্জ্য শরীর থেকে সাফ করতে হয় যে তাদের। রাতে দিনে অতিথি আসে বারাঙ্গনাগৃহে। শরীর-ক্ষুধার তো কোনো রাত দিন নেই। মাহুত, মশালচি, সৈন্য, চারণকবি, টিকিনাড়া ব্রাহ্মণ, বাজারিয়া, হাটুরিয়া সবাই আসে ক্ষুধা মিটাতে। আর আসে ভীমের একজন সেনানায়ক, চণ্ডক তার নাম। মোহনার কাছে আসে সে। নদী-সমুদ্রের মিলনস্থল মোহনা। মিষ্টি আর নোনা জলে মাখামাখি, লুটোপুটি। নদী সমুদ্রকে আর সমুদ্র নদীকে পেয়ে তৃপ্ত। মোহনার কাছে এলেই চণ্ডকের তৃপ্তি। মোহনা তার নদী।
বারাঙ্গনাপল্লীটি তত বড় নয়, তবে এর মাঝখানে বিশাল চত্বর। চত্বরের চতুর্দিকে সারি সারি ঘর, মাটির দেয়াল। ঘরগুলো উঁচু উঁচু, প্রশস্ত আঙিনা। সেই আঙিনায় অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। মিলনের স্থান ভিতরে। ভিতরটা নয়নাভিরাম। একদিকে বিশাল খাট, চারদিকে অগুরু চন্দনের সুবাস। একটু দূরে তাকিয়ার ওপর গুবাক-তাম্বুলের বাটা। অতিথিকে গুবাক-তাম্বুলে আপ্যায়নের রেওয়াজ আছে।
এই বারাঙ্গনাপল্লীর প্রধানা জানকি। জানকি একদা এই পল্লীরই বারাঙ্গনা ছিল। এখন প্রৌঢ়া জানকি ত্রিশ-চল্লিশ জন যৌবনবতী বারাঙ্গনার দেখাশোনা করে। তাদের নিরাপত্তার দিকেও নজর তার। পল্লীর চারদিকে সুউচ্চ মাটির পাঁচিল। দক্ষিণ দিকে প্রবেশদ্বার। ওই দ্বার দিয়েই আসা যাওয়া। পাঁচিল ডিঙানোর উপায় নেই।
শুধু ডমরনগরে নয়, আরও বিশাল বিশাল নগরীতে বাররামাদের আবাসস্থল। গৌড়, চম্পকনগর, মগধ, বৈশালী—এসব নগরে চিরায়ুষ্মতীরা বাস করে। তারা নগরীর শোভা। গঙ্গা-করতোয়া-কালিন্দী-সংলগ্ন ভূমিতে বারাঙ্গনারা বহু বহু প্রাচীনকাল থেকে কামলোভীদের তৃপ্তি দিয়ে আসছে। সমাজে তারা আদরণীয়। বাররামারাও তা জানে। ডমরনগরের বারাঙ্গনাপল্লীর মেয়েরা জানে যে, তারা ভোগের, ভোগের পর ছুড়ে ফেলারও। মোহনা, কুন্তি, সুবর্ণা, দময়ন্তী, অঙ্গনা, মেনকারা এও জানে যে, সমাজে তাদের কদর ওইটুকু সময় পর্যন্ত, যতদিন তাদের গতরে যৌবন আছে। তাই তারা স্তনের পরিচর্যা করে, অধরের পরিচর্যা করে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মহুল মদ গরম করে ডলে। উষ্ণ মদে গতরের ব্যথা সারে। দীর্ঘ সময় মদের গন্ধ লেগে থাকে শরীরে। ওই গন্ধে গ্রাহকের দেহমন আনচান করে।
বারাঙ্গনাপল্লীর দুয়ারে দুয়ারে দীপাধার হাতে দাঁড়িয়ে থাকে চিরায়ুষ্মতীরা। তাম্বুল চর্চিত অধর তাদের। বারাঙ্গনাদের সন্তান হতে নেই। তবু হয়। কন্যাসন্তানেই সুখ তাদের। বিগতযৌবনে এই কন্যাই মূলধন। ডমরনগরের বারাঙ্গনাপল্লীতে এই পেশায় প্রথম যেদিন হাতেখড়ি হয়, সেদিন সকালে নাপিতানী এসে নখ খুঁটে দিয়ে যায়। মেয়েটির মাথায় ঘষে ঘষে সুবাসিত তেল মাখানো হয়। নদীতে স্নান করানো হয়। নতুন কাপড় আলতা কাজল পরিয়ে ধানদূর্বা দেয়া হয় তার মাথায়। ওর হাত ধরে লক্ষ্মী ঢুকবে যে এই বারাঙ্গনাপল্লীতে।
মোহনার স্পষ্ট মনে আছে—এই বৃত্তিতে ব্রতী হবার প্রথম দিনের কথা। সদ্য রজস্বলা হয়েছে সে। বামুনঠাকুর এসে গোধূলি লগ্নে একটি বঁটির সঙ্গে বিয়ে দিল তার। সিঁথিতে চিকন করে সিঁদুর দিল, গলায় ঝুলাল গাঁদাফুলের মালা। রাতের অতিথি ফুলমালা ছিঁড়তে বড় ভালোবাসে। অতিথি জানে—এ মালা শুধু মালা নয়, মেয়েটির অক্ষতযোনীর প্রমাণও। অক্ষতযোনীতে যুবা প্রৌঢ় বৃদ্ধ কার না আগ্রহ!
জানকির কাছ থেকে মোহনার কুমারিত্ব কিনে নিয়েছিল চণ্ডক। উচ্চ মূল্যে। সেরাতে আধা পন কড়ি দিয়ে মোহনার ঘরে ঢুকেছিল চণ্ডক।
বঁটির সঙ্গে বিয়ের পর থেকে ভাবনায় পড়েছিল মোহনা। বিয়েই যদি, বঁটির সঙ্গে কেন? জিজ্ঞেস করেছিল জানকিকে, ‘লোহার সাথে বিয়া কেনে, মানুষের সাথে নয় কেনে?’
জানকি বলেছিল, ‘এই পাড়ার অক্ষতযোনীদের গাছ বা লোহার সাথে বিয়া দেওয়ার নিয়ম। গাছ ত অমর, লোহার ক্ষয় নাই। এক গাছ মরল ত, তার বীজ থেকে আরেক গাছ জন্মাল, গাছ চিরায়ু, লোহা অক্ষয়। বারবধূরাও চিরায়ুষ্মতী। এক মোহনা গেলে, আরেক কাঞ্চনা আসে। জায়গা খালি থাকে না। তাই অমর জিনিসের সাথে মোদের বিয়া হয়। তোহারও হয়েছে।’
সেই থেকে বঁটিটিকে কাছে কাছে রাখে মোহনা। ভাবে—ওই-ই ত মোর স্বামী।
মোহনা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। জালিকদের ঘরে ফর্সা রঙের নারী নেই। মোহনার চুল কোঁকড়ানো। কোঁকড়া চুল খুব বেশি লম্বা হয় না। কিন্তু বিপুল হয়। মাথাভর্তি চুল মোহনার। চিপচিপে শরীর। চোখেমুখে এখনো গ্রামজীবনের শৈশব লেপ্টে আছে। কালিন্দী এগিয়ে যেতে যেতে যেতে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেই বাঁকে জেলেপল্লী। সেই পল্লীর নাম গাঙ্গী। সেই গাঙ্গী থেকে তিন বছরের মোহনাকে চুরি করে এনেছিল সনকা। কিনে নিয়েছিল জানকি। তারপর লালন-পালন। তারপর চ্লকের ডুবসাঁতার, মোহনায়। মদিরারক্তিম চোখে চণ্ডক মোহনার ঘরে ঢুকেছিল সেরাতে। মোহনার গলার মালায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, ‘এই মালা আমার, এই মোহনা আমার। এর ঘরে আর কাউরে ঢুকতে দিও না।’ [অংশ]

ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে

Tuesday, February 1, 2011

মাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য আর ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয় একুশে ফেব্রুয়ারি। এর মানে হচ্ছে, যাতে আমরা আমাদের সময়কে এবং নিজেদের নতুন করে ভিন্নভাবে বুঝতে সক্ষম হই। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, নিজেদের বোঝার অর্থই হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি-কেন্দ্রিক গুরুত্ব।

এই গুরুত্ব আমাদের চলমান জীবনধারার ক্ষেত্রে খুব আবশ্যক। একুশের মাসে আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ইতিহাসের যে তাগিদ আমরা প্রতিবছর অনুভব করি, তা জাতির প্রেরণার বড় শক্তিও বটে। একুশের শহীদদের দায়িত্ব যদি আমাদের রাজনীতি না নেয়, তাহলে আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ইতিহাসের পতন ঘটবে। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতরা হচ্ছেন আমাদের ইতিহাসের বীর। তাঁরা জীবন উৎসর্গ করে আমাদেরকে সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ইতিহাসের কাছে ফিরিয়ে আনেন। তাঁরা অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের অগ্রবাহিনী ছিল ছাত্র ও যুবসমাজ। কিন্তু মনে রাখা দরকার, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা আর ভাষাকে সমৃদ্ধ করা দুটো এক বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে বলা যায় জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেনে ভাষা আন্দোলন হয়নি; কিন্তু সেসব দেশে ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। সে জন্য বড় অবদান রেখেছেন ওই সব ভাষার প্রধান লেখকরা। আমাদের এখানে এ কাজটি হয়নি। আমাদের সার্বিক প্রয়োজনেই বিলম্বে হলেও এ কাজটি শুরু করা দরকার। আমরা যদি মনে করি, শুধু ভাষা আন্দোলনের ত্যাগের বিষয়টির ওপর জোর দিয়েই ভাষার উৎকর্ষ সাধনের কাজটি সম্পাদন করে ফেলব, তাহলে তা ভুল হবে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাসংলগ্ন থাকতে হলে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতির কাজ চালিয়ে যেতে হবে। ভাষা আন্দোলনের পর সুদীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও আমাদের ভাষা ও সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুলের যুগে যা ছিল, তা থেকে কতটা এগিয়েছে? এ প্রশ্নটি উপেক্ষা করা যাবে না। ভাষা আন্দোলন আমাদের যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে তাকে অর্থবহ করে তুলতে হবে।

লেখক : বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
শিক্ষাবিদ, শিল্পকলা বিশ্লেষক ও সাহিত্যিক
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু