সহজিয়া কড়চা- ঘটনার চেয়ে চেতনাই প্রধান by সৈয়দ আবুল মকসুদ

Tuesday, February 18, 2014

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের চলে যাওয়ার আগে থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সরকারি ভাষা কী হবে তা নিয়ে আলোচনা হতে থাকে দুই দেশেরই রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর অনুসারীদের প্রস্তাব হিন্দি হবে সে দেশে সরকারি ভাষা।
মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ইচ্ছা উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। দুটিই বহু ভাষাভাষী মানুষের দেশ। হিন্দি ও উর্দু কোনো দেশেরই সর্বজনীন ভাষা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ তো নয়ই, সিকি মানুষের মুখের ভাষাও নয়।

ভারতে হিন্দিকে একমাত্র অফিশিয়াল ভাষা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। বাংলা, উর্দু ও তামিলের পক্ষে ওকালতি হয়েছে। তবে কোনো আন্দোলন হয়নি, যেমনটি হয়েছে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলায়। ১৯৬৫ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দা আকাশবাণী থেকে বলেছিলেন, আজ থেকে সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি চালু হলো। তাঁর এই বক্তব্যে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। চেন্নাইয়ে (মাদ্রাজ ছিল তখনকার নাম) ১২ জন তামিল ভাষার দাবিতে শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে দুজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পরিস্থিতি সামাল দিয়ে টিকে যান।
প্রাপ্ত দলিলপত্রে দেখা যায়, পূর্ববাংলার দলমত-নির্বিশেষে নেতারা ও বুদ্ধিজীবী সমাজ বাংলাকেই পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছে। ঢাকার নবাব পরিবারের কেউ কেউ এবং দু-চারজন মৌলবাদী দালাল গোছের লোক ছাড়া বাংলার পক্ষে ছিল গোটা পূর্ব বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু হবে না হিব্রু হবে, পাঞ্জাবি হবে না সিন্ধি হবে—তা নিয়ে বাঙালিদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তখনকার কাগজপত্র দেখে মনে হয়, কেন্দ্রীয় সরকার বা জিন্নাহ যদি বলতেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ ও পাখতুন—তাতেও বাঙালিরা আপত্তি করতেন না। তাঁদের দাবি ছিল তাঁদের ভাষার অধিকার রক্ষিত হোক, ওপারের দুম্বা বা উটের তাঁরা গলা কাটবেন না লেজ কাটবেন, তা তাঁদের ব্যাপার।
বিপত্তি বাধালেন জিন্নাহ। খুবই বুদ্ধিমান মানুষ, কিন্তু নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিলেন। ওই গুজারাতী ও খোজা মুসলিম নেতার সুন্নি ও সুফিবাদী মুসলমানদের দেশ বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। সে জন্য তাঁকে বিশেষ দোষও দেওয়া যায় না। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় নেতা। গান্ধীজি ছাড়া সবার সঙ্গেই কথা বলতেন ইংরেজিতে। বাঙালি নেতারা বরং তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন উর্দুতে। তাতে তাঁর ধারণা হয়ে থাকবে যে পূর্ব বাংলার সবাই বাংলা-টাংলা কিছু একটা বললেও উর্দু বোঝে এবং বলতে পারে। তাঁর বাংলা সম্পর্কে ভুল ধারণা ও ঔদ্ধত্যের কারণে পরোক্ষভাবে বাঙালির উপকারই হয়েছে: জন্ম নেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা।
জিন্নাহর একটি উদ্ধৃতি ভুলভাবে ব্যবহূত হচ্ছে বহুদিন ধরে। তা হলো তাঁর সেই কুখ্যাত উচ্চারণ: উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য...। মূল ভাষণটি আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর কথাটি ছিল এ রকম: ‘লেট মি টেল ইউ ইন দ্য ক্লিয়ারেস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ,... আলটিমেটলি ইট ইজ ফর ইউ, দ্য পিপল অব দিস প্রভিন্স, টু ডিসাইড হোয়াট শ্যাল বি দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব ইওর প্রভিন্স। বাট লেট মি মেক ইট ভেরি ক্লিয়ার টু ইউ দ্যাট দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান ইজ গোয়িং টু বি উর্দু অ্যান্ড নো আদার ল্যাঙ্গুয়েজ।’ কথাটার অর্থ অবশ্য একই দাঁড়ায়, তবে উদ্ধৃতি হিসেবে ভুল। তিনি বলেছিলেন: সুস্পষ্ট ভাষায় আমি তোমাদের বলছি,...শেষ পর্যন্ত সেটা তোমাদের বিষয়, এই প্রদেশের মানুষের বিষয় যে তোমাদের ভাষা কী হবে। কিন্তু আমি তোমাদের পরিষ্কার করে বলতে চাই যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। অর্থাৎ তিনি বলেছিলেন, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা যাবে না, বাংলা প্রাদেশিক ভাষা হয়ে থাকতে পারে।
এটি ছিল একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি। তাঁর আশপাশে যাঁরা থাকতেন তাঁদের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল: মাননীয় কায়েদে আজম, আপনি যে বক্তৃতাটা করলেন সেটাও তো উর্দুতে করেননি, করেছেন ইংরেজিতে। আপনাকে উর্দুতে কখনো কিছু লেখালেখি করতে দেখিনি। তাহলে আগ বাড়িয়ে উর্দু উর্দু করছেন কেন?
জিন্নাহ যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিলেন, তাতে শেষ পর্যন্ত কোনো বড় রকমের অগ্নিকাণ্ড ঘটত না। কিন্তু তাতে ঘি ঢেলে দেন খাজা নাজিমউদ্দিন, যার ফলে সারা পূর্ব বাংলায় দাবানলের সৃষ্টি হয়। যদিও মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন থেকে লীগের সব নেতাই ছিলেন বাংলার পক্ষে। নূরুল আমীন ১৪ আগস্টের কয়েক সপ্তাহ আগেও কলকাতায় এক আলোচনা সভায় পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা বাংলা করার পক্ষে মত দিয়ে বক্তৃতা করেন।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায় কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতার কারণে, কিন্তু তার দায়দায়িত্ব বর্তায় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সরকারের ওপর। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আগেও পুলিশের গুলিতে এখানে শ্রমজীবী মানুষ নিহত হয়েছেন, কিন্তু সে মৃত্যু আর একুশের শাহাদত এক রকম নয়। একুশের জীবনদান পূর্ব বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের কাজটির সূচনা ঘটায়। শুধু সাংস্কৃতিকও নয়, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার, তার গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে একুশের রক্তাক্ত ঘটনা।
বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে মহৎ কোনো কিছুরই সে সদ্ব্যবহার করতে পারে না। তা থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে গিয়ে জাতিগতভাবে পায় না বিশেষ কিছু। বাঙালির এক একটি উপলক্ষ এক একটি উপসর্গ হয়ে দেখা দেয়। সেই উপসর্গের ধাক্কা চলে বহুদিন। সেই ধাক্কায় ঘটনাটিই বড় হয়ে ওঠে, তার ভেতরের আসল জিনিসটি হারিয়ে যায়। যদিও ঘটনা নয়, চেতনাই আসল।
বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি সাংস্কৃতিক কর্মীদের শুধু নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আবেগের সৃষ্টি করত, স্বাধীনতার পর থেকে তা হারিয়ে যায়। সারা দেশ থেকে একুশের সংকলন প্রকাশিত হতো। সেসব সংকলনের লেখায় বিচ্ছুরিত হতো জাতীয়তাবাদী চেতনা। বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের সড়ক তৈরিতে সেসব সংকলনের লেখা বিরাট ভূমিকা রেখেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা শুধু রাজনীতিকদের সৃষ্ট নয়, অগণিত অজানা সাংস্কৃতিক কর্মীর অবদান তাতে সবচেয়ে বেশি।
আমরা আজিমপুর শেখ সাহেব বাজার এলাকায় ছিলাম বলে দেখেছি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাবগাম্ভীর্য। সেই পরিবেশ এখন বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তখন মানুষের বাহারি কাপড়চোপড় ছিল না। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকেই নেমে আসত সারা দেশে শোকের ছায়া—কৃত্রিম নয়, আসল শোক। পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকেই সারা দেশের অফিস ও দোকানপাটের সাইনবোর্ডের যেগুলো ইংরেজিতে লেখা তার ওপর হয় কাগজ সেঁটে দেওয়া হতো, নয়তো কাপড়ে বাংলায় লেখা হতো। সেটা করা হতো শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে।
বিশে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পর থেকে নগর এক নতুন রূপ ধারণ করত। ফজরের আজানের সময় থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়সনির্বিশেষে নারী-পুরুষ খালি পায়ে যেত আজিমপুর শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে। কোনো শব্দ নেই, ধাক্কাধাক্কি নেই, পিঁপড়ার মতো লাইন ধরে সবাই যাচ্ছে আজিমপুর কবরস্থানে। সেখান থেকে শহীদ মিনারে। তখন ফুলের চাষ হতো না। শহরে ফুল বিক্রি হতো অল্প কয়েকটি জায়গায় এবং খুবই সামান্য। আমরা ফুল জোগাড় করতাম বড়লোকদের বাড়ির বাগান থেকে। সেদিন তাঁরাও উদারভাবে উদ্যান উন্মুক্ত করে দিতেন। যাঁরা শহীদ মিনার বা কবরস্থানে যেতেন না, তাঁরাও রাস্তায় বের হতেন খালি পায়ে—তা তিনি যত সম্ভ্রান্ত ও বিত্তবানই হোন। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে খালি পায়ে হাঁটার যে সুখ, তা এখনকার মানুষদের বোঝানো সম্ভব নয়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সবার জামায় ও শাড়িতে এক টুকরা কালো কাপড় সাঁটা থাকত। আজ শহীদ মিনারে ভিড় হয় বেশি, গাম্ভীর্য কম।
আশির দশক থেকে এক নতুন উপসর্গ শুরু হয়েছে। ফেব্রুয়ারি এলেই দৈনিকগুলোর এক কোনায় এক কলামে ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’ বা ‘মোদের গরব মোদের আশা’ জাতীয় শিরোনামে একুশে ফেব্রুয়ারির বৃত্তান্ত বর্ণনা। সেই একই ব্যাপার। ঘটনাটিই প্রাধান্য পায়—চেতনা নয়। এর মধ্যে ‘ভাষাসৈনিক’ অভিধাটি উদ্ভাবিত হয়। শুরু হয় তাঁদের জনা কয়েকের স্মৃতিচারণা ও সাক্ষাৎকার। সেকালের কাগজপত্রে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত ভাষার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন তাঁদের নাম রয়েছে। তাঁরা কেউ নন, সেকালের যাঁদের কাগজপত্রে নাম ছিল না, স্মৃতিচারণায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায় তাঁদের। আটটি বছর বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের জন্য যাঁরা নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছেন, তাঁদের নাম আমরা ভুলে গেছি। এখনকার মানুষ দেখতে পাচ্ছে, বাংলা ভাষার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন মাত্র কয়েকজন।
অনেক লড়াই-সংগ্রামের পর পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা স্বীকৃতি পায়। সংবিধানের ২১৪(১) অনুচ্ছেদে লেখা হয়: ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ও বাংলা’। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ আইয়ুব খান যে সংবিধান প্রবর্তন করেন, তার ২১৫(১) অনুচ্ছেদে লেখা হয়: ‘পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা বাংলা ও উর্দু’; কিন্তু এই অনুচ্ছেদকে অন্য কোনো ভাষা ব্যবহারের প্রতিবন্ধকরূপে কাজে লাগানো যাবে না, বিশেষত ইংরেজি-ভাষা পরিবর্তনের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এই ভাষা সরকারি ও অন্যান্য উদ্দেশ্য প্রতিপালনের জন্য ব্যবহূত হতে পারবে।’
আজ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কৃতিত্ব নেওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু একটি বিষয় আমরা আড়াল করে রাখছি। বাংলাকে অন্যতর সরকারি ভাষা করার জন্য লেখক-বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি ও আলোচনা করছিলেন। তাঁদের সে ভূমিকার মূল্য রয়েছে। কিন্তু আলোচনার বিষয়কে একটি আন্দোলনের বিষয়ে পরিণত করেন শ্রমজীবীরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যখন পোস্টাপিস প্রভৃতির বিভিন্ন কর্মে ইংরেজির সঙ্গে উর্দু লেখা হলো তখনই চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীরা বুঝতে পারেন উর্দু না জানলে তাঁদের চাকরি থাকবে না।
ঢাকার ইডেন বিল্ডিং বা প্রাদেশিক সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাই প্রথম সরকারি কাগজে উর্দু ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন এবং সূচনা ঘটান ভাষা আন্দোলনের। তাঁদের সেই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বাইরের শিক্ষিত বেকার যুবসমাজ। আন্দোলন একটি মিলিট্যান্ট রূপ নিতে থাকে। কেন বুদ্ধিজীবীরা নন, শ্রমজীবী ও ছাত্র-যুবসমাজ আন্দোলন শুরু করেন? কারণ বিষয়টি শুধু সাংস্কৃতিক নয়, অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। শুধু উর্দু সরকারি ভাষা হলে অল্প শিক্ষিত বাঙালিরা সরকারি চাকরি পাবেন না, সব চাকরি পাবেন উর্দুভাষী মোহাজেররা। একুশের শহীদদের শ্রেণীচরিত্র দেখলেই ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব।
ভাষা আন্দোলন জাতিকে উপহার দিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা, যা থেকে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। কিন্তু ভাষা আন্দোলন যে বলিষ্ঠ জাতি গঠনের দীক্ষাও দিয়েছিল, সে দীক্ষার সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। আমরা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আটকে রেখেছি ঘটনাকে। খুব বড় অনুষ্ঠানের মধ্যে ঘটা করে একুশকে উদ্যাপন করছি দেশের মধ্যে শুধু নয় দেশের বাইরেও, কিন্তু একুশের চেতনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ অতি কম। যদিও চেতনাই প্রধান।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সময়চিত্র- বইমেলা, বাংলা ভাষা এবং কিছু প্রশ্ন by আসিফ নজরুল

Saturday, February 15, 2014

বইমেলার সঙ্গে আমার প্রজন্মের মানুষের পরিচয় আশির দশক থেকে। ১৯৮৮ সাল থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমি চাকরি করার সুবাদে এই পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
বিচিত্রার শাহরিয়ার কবির, মঈনুল আহসান সাবের, মাহমুদ শফিক, শামীম আজাদ তখনই ছিলেন খ্যাতিমান লেখক। বিচিত্রায় যাঁরা লিখতেন, তাঁদের আরও অনেকের বই বের হতো তখন। কাজেই বইমেলা আসার বহু আগে থেকে এর তোড়জোড় টের পাওয়া যেত সেখানে। প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, প্রুফ রিডার আসতেন, গল্প করার জন্য আসতেন বড় লেখকেরা, প্রচারের জন্য নবীন লেখকেরা। বিচিত্রা তখন প্রভাবশালী সাপ্তাহিকী ছিল বলে বইমেলার দিনগুলোতে সাহিত্য পাতার সম্পাদক মঈনুল আহসান সাবেরের টেবিল ঘিরে থাকত নানা ধরনের সাহিত্যানুরাগী মানুষ।
বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বহু নতুন ধারার জনক ছিলেন। বিচিত্রাই বাংলাদেশে খুব বিস্তৃতভাবে বইমেলা কাভার করা শুরু করেছিল, ফেব্রুয়ারিতে লেখকদের নিয়ে বিভিন্ন প্রচ্ছদ-কাহিনিও। শওকত ওসমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক আর হুমায়ূন আহমেদকে বিচিত্রার কাভারে দেখতাম আমরা, সশরীরে দেখতাম বিচিত্রা অফিসে। সে সময়ের বহুল আলোচিত একটি প্রচ্ছদ-কাহিনি ছিল সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আলাপচারিতা। সৈয়দ হক হুমায়ূন আহমেদকে প্রশ্ন করেন: আপনি ছয় ফর্মায় উপন্যাস লেখেন কী করে? হুমায়ূন আহমেদের পাল্টা প্রশ্ন ছিল: আপনি ছয় লাইনে কবিতা লেখেন কেমন করে? আমরা বইমেলায় গিয়ে দেখতাম সেখানে বড় একটি আলোচনা ছিল বিচিত্রার এসব প্রচ্ছদ-কাহিনি আর বইমেলার সংবাদকে ঘিরে।
আমার ঔপন্যাসিক হওয়ার সূচনাও বিচিত্রা থেকে। সে সময়ের একজন জনপ্রিয় লেখক ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অদ্ভুত এক উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানে ছাত্রনেতারা মাথায় ফেট্টি বাঁধেন, হাতে থাকে তাঁদের হকিস্টিক আর হূদয়ে শুধু নারীর ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। অথচ আমাদের চেনা ছাত্ররাজনীতি ছিল তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন, এরশাদবিরোধী সময়ে ছাত্রনেতাদের জীবনযাপনও ছিল আরও অনেক অগ্রসর। খুব বিরক্ত হয়ে হয়ে আমি নিজেই লিখে ফেলি একটি উপন্যাস নিষিদ্ধ কয়েকজন। বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় তা ছাপা হওয়ামাত্র সবিস্ময়ে দেখি কয়েকজন প্রকাশক এসে হাজির অফিসে, আমার বই বের করতে চান বইমেলায়। পিএইচডি করতে লন্ডনে যাওয়ার আগে এর পরের চার বছরে বইমেলাই হয়ে ওঠে আমার সবচেয়ে প্রিয় প্রাঙ্গণ। তখনকার সময় বহু মানুষ ঈদ-পূজা-জন্মদিন, আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল খেলা বা নাটক-যাত্রার মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করত। আমরা করতাম একুশের বইমেলার জন্য। বইমেলার নতুন বইয়ের গন্ধ, নবীন লেখকের লাজুক গাম্ভীর্য, বইমেলা চত্বরের দুমড়ানো ঘাস, হঠাৎ বাতাসে ছিটানো ধুলোকণা—সবকিছুর জন্য। বইমেলার বিকেল আর সন্ধ্যা কেন সর্বদাই অস্তগামী আর বইমেলার মাস কেন দ্রুতগামী, এই আফসোস কখনো শেষ হতো না আমাদের।
একুশের বইমেলা এখন বহুগুণ বড় হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে এখন তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল পরিসরে সম্প্রসারিত হয়েছে। দৈনিক পত্রিকা আর টিভিতে বইমেলা প্রধান সংবাদ হচ্ছে, প্রতিদিন নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে, বইয়ের বিজ্ঞাপনে রঙে ঢেকে যাচ্ছে অসুস্থ খবরের বিষাদ। উপন্যাস আর লেখা হয়নি, এই দুঃখে বইমেলা থেকে আমি দূরে আছি বহু বছর। তবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি নতুন বইয়ের খবর, দূর থেকে আরও নিবিড়ভাবে অবলোকন করার চেষ্টা করি বইমেলার মাহাত্ম্য আর বিশালত্ব। অনুভব করার চেষ্টা করি বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে ধারণ আর বেগবান করার ক্ষেত্রে এর অবদান। কিন্তু আমি একই সঙ্গে বিচলিত হই মধ্যবিত্ত আর নব্য ধনিক শ্রেণীর ওপর সারাটা বছর ধরে ভিনদেশি ভাষার ক্রমবর্ধমান আধিপত্যেও। ভাবি বইমেলার মর্মবাণীকে, বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে আসলে কতটা অর্থবহ করতে পেরেছি আমরা এই স্বাধীন বাংলাদেশে?
ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তার রাজনীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞান ও উপলব্ধি খুব সীমিত। তবু এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বইমেলা শুধু বাংলা ভাষায় বই প্রকাশের অনুষ্ঠান নয়, এটি বাংলাকে প্রাণের ভাষা হিসেবে উদ্যাপন, বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয় ধারণ ও প্রকাশ করার এক স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন। ফেব্রুয়ারির বইমেলা আমাদের অনিবার্যভাবে নিয়ে যায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় স্মৃতিচারণায়। বাংলাকে তখন শুধু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি, ধর্মসর্বস্ব এক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্ত করাও হয়েছিল এই অঞ্চলের মানুষের মনোজগৎকে। বাংলাদেশ যে কখনো পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ যে কখনো সাম্প্রদায়িক নয়, এই দেশের মানুষের ইতিহাসবোধ আর কৃষ্টির শুরু যে ১৯৪৭ সালের বহু যুগ আগে থেকে, তার জোরালো ও দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার লড়াইয়ে বিজয়ী না হলে এত তাড়াতাড়ি আমরা পাকিস্তান নামক কূপমণ্ডূক রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ পেতাম না, বইমেলাও হয়তো তখন হতো না এমন প্রাণের মেলা!
আমাদেরই তাই সবচেয়ে ভালো করে জানার কথা যে নিজ ভাষা মানে শুধু স্বাতন্ত্র্য নয়, এর মানে স্বাধীনতা, জাতিসত্তা, আত্মমর্যাদাবোধ এবং আত্মপরিচয়। নিজ ভাষাকে জীবনযাপনে, আচার-অনুষ্ঠানে আর সব সামাজিকতায় তাই আত্মস্থ করতে হয়। কিন্তু আমরা কি আসলে তা পারছি আর? বইমেলার এক মাস আমাদের নিজ ভাষার সবচেয়ে শৈল্পিক প্রকাশ আর সৃজনশীল আত্মপরিচয়ের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু ভাষাভিত্তিক এই সংস্কৃতিবোধ বারো মাসের আকাশ সংস্কৃতির দাপটে কি দূষিত হওয়ার হুমকিতে পড়েনি? আমাদের একদল শিশু কি বাংলা শেখার আগে কিংবা বাংলার চেয়ে ভালো করে বলতে শিখছে না হিন্দি কিংবা ইংরেজি? পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে রক্ত দিয়ে লড়াই করে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার সময় আমরা কি এমন একটি সময়ের প্রত্যাশা করেছিলাম?
অন্য ভাষা শেখা বা বলায় আমার কেন কারোরই আপত্তি থাকার কথা না। আমি ইংল্যান্ড আর জার্মানিতে পড়াশোনা করার সময় দেখেছি সেখানকার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী একাধিক বিদেশি ভাষা জানেন। ফ্রান্সের মানুষ অনর্গল বলতে পারছে চীনা ভাষা, কিংবা জাপানের মানুষ বলছে স্প্যানিশ, এটা খুবই সাধারণ এমনকি প্রত্যাশিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে গোলাকায়নের এই যুগে। কিন্তু আমার জানামতে, এই ভাষাশিক্ষা মূলত জ্ঞানচর্চা বা জীবিকার প্রয়োজনে। ঠিক সে ধরনের সচেতন সিদ্ধান্ত থেকে আমরা যেকোনো ভাষা শিখতে পারি। কিন্তু ভিনদেশি ভাষা শিক্ষা যদি হয় বাধ্য হয়ে, আকাশ সংস্কৃতির কাছে নিজের অজান্তে সমর্পিত হয়ে, তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ আছে।
অন্য ভাষা জানার প্রয়োজন কী, এটি কেন চর্চা করা হচ্ছে, সেটিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। ইংরেজি পৃথিবীর সবচেয়ে কমন ভাষা বলে আমাদের ইংরেজি জানতে হবে, ভারতে পড়তে গেলে হিন্দি বা কোরিয়ায় পড়তে গেলে কোরিয়ানও। কিন্তু বিদেশি ভাষা যদি আমাদের সামাজিক জীবনযাপন এবং আচার-অনুষ্ঠানকে গ্রাস করে, বাংলার স্থান দখল করে ফেলে—আমার আপত্তি সেখানেই। বিয়ে, জন্মদিন, যেকোনো উদ্যাপনে কেন আমরা দেখব বিদেশি গান আর নাচের অনুকরণ সংস্কৃতি? ছাব্বিশে মার্চ বা ষোলোই ডিসেম্বর কেন পাড়ার ক্লাবেও আনন্দ করে বাজানো হয় হিন্দি এমনকি উর্দু গানও? যিনি ভারতীয় সিরিয়াল দেখবেন তিনি হিন্দিতে তা দেখুন, কিন্তু স্পোর্টস চ্যানেল বা এইচবিও হিটস-এ ছবি দেখতে গেলে কেন আমাকে শুনতে হবে হিন্দি!
অন্য ভাষা যখন প্রাত্যহিক জীবনযাপন আর সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের রিংটোনে প্রবেশ করে, তখন নিজস্ব সামাজিক সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র্যবোধ আর আত্মমর্যাদাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বল হয়ে গেলে ভিনদেশি ভাষা-সংস্কৃতির হাত ধরে আসে ভিনদেশি পণ্য এমনকি ভিনদেশি রাজনীতির আধিপত্য। বাংলা বইমেলায় এক মাসের অনুষ্ঠানের সময়ে হলেও আমরা কি কখনো ভেবে দেখছি তা? একবারও কি আমরা আলোচনা করছি নিয়ন্ত্রণহীন আকাশ সংস্কৃতি কীভাবে গ্রাস করছে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি আর স্বাধীন সত্তাকে? কীভাবে তা বেসুরো হয়ে আছে বইমেলা, একুশে আর পয়লা বৈশাখের আবেদনের সঙ্গে?

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আশা হতাশার বয়ন by সিলভিয়া নাজনীন

Wednesday, June 8, 2011

শিল্পীর সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে শিল্প। শিল্পের গঠন, গড়ন ও গভীরতার স্তরে স্তরে বীজের মতো ছড়িয়ে থাকে নানাবিধ সুপ্ত কথকতা। পরিশুদ্ধ আত্মার অনুনাদ ধ্বনিত হয় মহৎ শিল্পের পরম্পরায়। শিল্পীকুলের অভিলক্ষ সেই মহাসারণি। ‘কনটেমপ্লেশন’ শিরোনামে মুর্শিদা আরজু আল্পনার একক প্রদর্শনী। চলছে ধানমন্ডির ঢাকা আর্ট সেন্টারে। বার্লিন প্রবাসী শিল্পী আল্পনা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, নানা বিচ্ছিন্ন অনুভূতিকে একত্র করেছেন তাঁর চিত্রকর্মে।

শিল্প বিশ্লেষিত হয় শিল্পের সৌন্দর্য, রং, ব্যঞ্জনা, ইতিহাস, ভাষা এবং উপস্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আল্পনার চিত্রকর্মে সৌন্দর্যবোধ উজিয়ে জীবনদর্শন প্রকট হয়ে উঠেছে। ঢাকায় বেড়ে ওঠা এবং জার্মানিতে দীর্ঘ সময়ের জীবনযাপন—এই সময়কে তিনি নতুন দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর প্রতিটি ক্যানভাসে। তাঁর চিত্রপটে টেক্সটের ব্যবহার দর্শককে আরও একাত্ম হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়। প্রদর্শনীর অধিকাংশ শিল্পকর্মই শিল্পীর আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ।
মাধ্যম নিয়ে শিল্পীর বিশেষ কোনো ভাবনা নেই বলেই মনে হয়। ভাবের স্ফুরণই মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর ক্যানভাসে। অ্যাক্রেলিক, পেনসিল, কালি, চারকোল, জলরঙের ব্যবহারে বক্তব্য ফুটিয়ে তোলাই তাঁর মোক্ষ। ব্যক্তিগত গণ্ডির বাইরে তাঁর ভাবনার বলয়কে ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি গল্পের মতো বর্ণনা করেন তাঁর চাওয়া-পাওয়া, নারীসত্তার সংকট, প্রেম-বিরহ, স্মৃতি-বিস্মৃতির বহুস্তরিক আখ্যান। তাতে শিল্পগুণ পুরোপুরি রক্ষিত হয়, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
শিল্পী আল্পনার কাজ নারীবাদী চেতনায় ঋদ্ধ। নারীর দৈনন্দিন সংকট, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বিবিধ বর্ণনায় চিত্রতলে মূর্ত হয়ে ওঠে বর্তমান সময়ের বৈরী বিশ্বব্যবস্থা। বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে তাঁর কাজ প্রতিবাদের অভিব্যক্তিতে উচ্চকিত। সারফেসকে নানা ধরনের অসংগতিপূর্ণ বিভাজনের মাধ্যমে এবং বর্ণ প্রয়োগের অমার্জিত পদ্ধতিতে তাঁর কাজে তৈরি হয় অসামঞ্জস্য এবং ভাসমানতার অনুভূতি, যা দর্শকের অস্বস্তিকে প্রকট করে তোলে।
শিল্পী তাঁর আত্মজৈবনিক অভিঘাতে উন্মুল। তৃতীয় বিশ্ব, নারী প্রশ্ন, বর্ণবৈষম্যের অভিশাপ এখনো ছোবল মারার জন্য প্রস্তুত। দেশ-কাল-সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পের ভূমিকা কতটুকু তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শিল্পীর ব্যক্তি অনুভূতির একান্ত প্রকাশের চেয়ে শিল্পে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক উপস্থিতিই বিবেচনার বিষয়। শিল্পী বলেন, তাঁর চিত্রপটে পাশ্চাত্যের বড় শহরে বসবাস ছাপ রেখেছে। প্রতিনিয়ত নানা প্রশ্নের উদ্রেক, রহস্যময়তা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, মর্মপীড়া, উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ফ্যান্টাসি, ট্যাবু প্রভৃতির সমাবেশ ঘটেছে।
অভিব্যক্তিবাদী শিল্পধারার সঙ্গে তাঁর কাজের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ইমেজের আপাত বিচ্ছিন্ন উপস্থিতি, রঙের পাতলা পর্দা গলিয়ে বেরিয়ে আসা ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব শিল্পী আল্পনার শিল্পকর্ম বস্তুত সময়ের অস্থির পাণ্ডুলিপি।

সৃজনে নবযাত্রার প্রয়াস by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

Friday, February 11, 2011

ফ্রেমের সামনে দাঁড়াতেই দর্পণে নিজের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। কাচের গায়ে কাচ জোড়া দিয়ে কাজী রকিব তৈরি করেন স্থাপনাশিল্পের আদলে শিল্পকর্ম। বর্গাকৃতির কাচের গায়ে আঁচড় কেটে তৈরি করেছেন বৃষ্টির অবয়ব। প্রথাগত রং লেপনের প্রক্রিয়ার বাইরে নতুন শিল্পভাষা নির্মাণ আমাদের শিল্পে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা।

শিল্পচর্চায় নিবিড় মনোযোগী হয়ে কাজ করছেন এবং সৃষ্টিকর্মে বৈচিত্র্যপূর্ণ নিরীক্ষায় সফল যাঁরা, তাঁদের কাজের অষ্টম আয়োজন সৃজনে ও শেকড়ে শুরু হয়েছে গত ৪ জানুয়ারি বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে। ১০ জন শিল্পীর ৪০টি শিল্পকর্ম নিয়ে স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
সত্তর এবং আশির দশকের শিল্পীদের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছে নব্বই ও শূন্য দশকের শিল্পীদের এ প্রদর্শনীতে। আমাদের সমৃদ্ধ লোকঐতিহ্য, প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষী জীবনযাত্রার নানা ঘটনাপ্রবাহকে বিষয় করে শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। প্রদর্শনীর জ্যেষ্ঠ শিল্পী মোহাম্মদ মোহসীন চারটি অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা বিমূর্ত ছবিতে প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের মনোমুগ্ধকর রঙের উপস্থাপন করেছেন। শীতের ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালকে নীল ও সবুজাভ নীলের ব্যবহারে প্রকৃতির বিমূর্ততা প্রকাশ করেছেন ‘ইমেজ অব উইন্টার মরনিং’ ছবিতে। মোমিনুল ইসলাম রেজা ক্যানভাসে স্পর্শকাতর তিনটি রঙের ব্যবহার করেছেন। সবুজ, লাল ও নীল এই তিনের ব্যবহার রঙের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এনেছে। লাল জমিনে কালো চতুর্ভুজের উপস্থাপন সবুজের মাঝে অপেক্ষাকৃত কম লালের ব্যবহার দৃষ্টিকে বন্দী করে এক কেন্দ্রে। প্রথাবিরুদ্ধ সৌন্দর্য নির্মাণ মোমিনুলের কাজের বৈশিষ্ট্য। কাগজের গায়ে খোদাই চিত্রের আদল তৈরি, বিন্দুর পাশে বিন্দুর গড়ন মোহাম্মদ ফকরুল ইসলামের শিল্পভাষা। নতুন ভাবনা ও কৌশলকে প্রয়োগ করে নিবিড়ভাবে সৃষ্টি করেন শিল্পকর্ম। সেপিয়া ও ধূসর কালো রঙের কাগজের গায়ে তেল প্রয়োগের পর সুচালো উপকরণের সাহায্যে বিন্দু সৃষ্টি করে কখনো বৃত্তাকার, চৌকোনা, বর্গাকৃতির ক্যানভাস সৃষ্টি করেন শিল্পী। প্রদর্শনীর সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী মাকসুদা ইকবাল। মৌলিক রঙের ওপর স্তরে স্তরে রঙ চড়িয়ে বুনট সৃষ্টি করেছেন ‘সারফেস’ শিরোনামের ক্যানভাসগুলোতে। যা প্রকৃতিতে ছড়ানো রঙের বিন্যাসকে ব্যক্ত করে। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া ১০ জন শিল্পী মোহাম্মদ মোহসীন, ইফফাত আরা দেওয়ান, মোমিনুল ইসলাম রেজা, কাজী রকিব, ফারেছা জেবা, মোহাম্মদ ফকরুল ইসলাম, লায়লা শারমিন, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, আনিসুজ্জামান, মাকসুদা ইকবাল নীপা। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ১৩ ফেব্রুয়ারি।

কালের যাত্রা by পীষূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

Monday, February 7, 2011

পোশাক শ্রমিকদের গানের প্রতিযোগিতামূলক একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। অনুষ্ঠানটির নাম গর্ব। একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং বিজিএমইএ_এই দুটি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজক। শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ ও গীতিকার আসিফ ইকবালের মিলিত উদ্যোগে এবং গানচিলের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান এবং অনুজপ্রতিম বিশ্বজিৎ ও আসিফের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে আমি যখন অনুষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত হই তখন প্রতিযোগিতার কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ৩০ হাজার আগ্রহী পোশাক শিল্পীর ভেতর থেকে ততদিনে বাছাই করা হয়েছে প্রথমে ১৮৩ এবং পরবর্তী সময়ে ৪৩। এই বাছাইয়ের কাজটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে শেষ করেছেন দেশের বেশ কয়েকজন গুণী সংগীতজ্ঞ। শুধু বাছাই নয়, প্রতিযোগীদের পরিচর্যা ও পরিশীলন এবং বড় আসরের প্রতিযোগিতার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে দেশের ৯ গুণী সংগীতজ্ঞ যেভাবে নিরলস শ্রম, অভিজ্ঞতা আর মেধা খরচ করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসা করার মতো। বাণিজ্য-সংস্কৃতির এখনকার সময়ে এই কাজটিকেই বলে 'গ্রুমিং'। শুনতে বেশ আধুনিক লাগে। স্মার্টও লাগে বোধ হয়। আমি যুক্ত হয়েছি প্রতিযোগিতা যখন ৪৩ জনের মধ্যে এসে নেমেছে তখন। আগেই শুনেছিলাম, কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে কি বুঝতাম যে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষগুলো কী অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী! গান শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কী উদাত্ত তাদের কণ্ঠ! গায়কী, মেজাজ আর আত্মবিশ্বাস দেখে কে বলবে যে তারা স্বভাবশিল্পী। মনে হলো দীর্ঘদিন ধরে বুঝি গানের চর্চা আর সাধনা করে আসছেন। তালিম নিয়েছেন বিখ্যাত কোনো গুরুগৃহে। কিন্তু না। এরা কেউই প্রথাগত তালিম নেওয়ার সুযোগই পাননি। প্রত্যেকেই জন্মেছেন পল্লীগ্রামে। বেড়েও উঠেছেন পল্লীর খোলামেলা উদোম আবহে। যেখানে নদীর এ পাড়ে বসে গান শোনাতে হয় ওই পাড়কে। প্রত্যন্ত গ্রামের জীর্ণ মসজিদে মোয়াজ্জিন হয়ে যেখানে খালি গলায় আজান দিয়ে শতেক লোককে নামাজের আহ্বান জানাতে হয়। বয়স্ক মানুষ, মুখে মেহেদী মাখা শ্মশ্রু, সফেদ পোশাক। জিজ্ঞাসা করলাম, মসজিদের মোয়াজ্জিন হয়ে গান গাইতে সমস্যা হয় না? সবাই অন্য চোখে দেখে না? চোখে-মুখে ঈর্ষণীয় সরলতা ছড়িয়ে উত্তর দিলেন, আমি তো গানে গানেই আল্লাহকে ডাকি, নবীজিকে পেতে চাই। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে। খুব একটা লেখাপড়া করেননি। অথচ এই জনপদের হাজার বছরের ঐতিহ্যিক জীবনদর্শন যেন মূর্ত হয়ে উঠল ভদ্রলোকের সহজিয়া উত্তরে। সত্যই তো, এটাই তো চিরকাল জেনে এসেছি যে ভাটি অঞ্চলের হাজার বছরের বহতা সমাজে সংগীত অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গান শোনা আর গাওয়াতে পাপ নেই। আনন্দ-বিষাদ, জন্ম-মৃত্যু, উপাসনা, উৎসব-পার্বণ, লোকজ ক্রীড়া ইত্যাদি সবখানেই সংগীত। মাঝি পাল তুলতে তুলতে, রাখাল গরুর পাল মাঠে নিয়ে যেতে যেতে গান করেন। এবড়োখেবড়ো মেঠোপথে চাকায় ক্যাচোর ক্যাচোর শব্দ তুলে ধুলো উড়িয়ে দূরে চলে যায় মহিষের গাড়ি। সব শব্দ ছাপিয়ে অতিদূর থেকে ভেসে আসে গাড়োয়ানের গান।
একজন প্রতিযোগী, এক সময় সিনেমা হলের প্রজেক্টর মেশিন চালাতেন, এখন ঢাকার কাছাকাছি এক পোশাক শিল্পকারখানায় চাকরি করেন। গান অন্তপ্রাণ। হারমোনিয়ামের সুরে গলা সেধে নয়, তিনি গান করতেন প্রজেক্টর মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দের সঙ্গে। গলা তো দরাজ হবেই। একজন প্রায় পড়ন্ত বয়সী পোশাকশিল্পী, নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেন। সংসারের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ভ্যানগাড়িও চালান। শান্তির জন্য গানকেই বেছে নিয়েছেন প্রধান অবলম্বন হিসেবে। একজন প্রতিযোগী, একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। কী অবলীলায় তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে হারিনি, সংগীত সাধনাতেও হার মানব না। মহান মুক্তিযুদ্ধ ভদ্রলোককে আত্মবিশ্বাসী করেছে, হার না মানার দীক্ষায় সাহসী করেছে। সেই সঙ্গে জীবনদর্শনে ধারণ করেছেন সততা আর সৎ মানুষ হওয়ার শিক্ষা। মহান বিজয়ের পর কেটে যাওয়া ৪০ বছরে আর ১০ জনের মতো তিনি লোভী হননি, অনৈতিক পথে পা বাড়াননি। নইলে পড়ন্ত বয়সে তাঁকে পোশাক কারখানায় শ্রমজীবী হতে হবে কেন! এ রকম কত যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে গানের এই প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে। কত যে শিখছি, কত কিছুই না জানছি। বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথানত হচ্ছে তৃণমূল থেকে উঠে আসা লড়াকু শিল্পীদের কাছে। ঘরে দারিদ্র্যের কষ্ট, পিতা হারানোর বেদনা, পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী মাতা, স্বামীর দুর্ব্যবহার, নদীতে লুট হয়ে যাওয়া একমাত্র বসতভিটা ইত্যাদি নানারকম শোক-দুঃখ ভুলে থাকতে এসব স্বভাবশিল্পী কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন গান। ভাগ্যিস তাঁরা এই প্রতিযোগিতায় গান গাইতে এসেছিলেন! নইলে কে চিনত তাঁদের! তবে আমি জানি, দেশের পল্লীমায়ের কোলজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন কত না তৃণমূল শিল্পী। অনাদরে, অবহেলায় বুকভরা অভিমান নিয়ে বেঁচে আছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকেরই মাথার ওপর এক টুকরো চাল আছে, কিন্তু ঘরে রান্নার চাল থাকে না। শরীরে রোগের বাসা, চিকিৎসার সাধ্য নেই। স্থানীয় লোভাতুর ক্ষমতাধরদের থাবায় চলে গেছে বংশগত ঠিকানা। তারপর শুরু হয়েছে নতুন উপদ্রব টেলিভিশন-সিনেমা এবং অডিও ক্যাসেটের পরগাছা গান। এতসব দানবের বহুমুখী চাপে টিকে থাকাই তো ভীষণ কষ্টের। তৃণমূল স্বভাবশিল্পীর মৌলিক গান লুট করে এনে নাগরিক সমাজে এখন হচ্ছে কত যে জনপ্রিয় গায়ক! তারা হয়তো জানেই না, শত বছরের পরম্পরায় অনেক কষ্টে টিকিয়ে রাখা গানগুলোর উৎস কি! মৌলিক গানগুলোর সঙ্গে কিভাবে এবং কতখানি জড়িয়ে আছে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য! এসব ক্ষেত্রে করার আছে অনেক কিছু। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কাজের কাজ কিছুই করে না। গৎবাঁধা প্রোগ্রামের বাইরে কার্যকর কিছু করার মতো সদিচ্ছা বা মেধাসম্পন্ন নেতৃত্ব কোথায়! বঙ্গবন্ধু কিন্তু শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৃণমূল শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা, বাংলার চিরায়ত লোকজ শিল্পের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ, বিশ্বমাঝে বাংলার গর্বের সংস্কৃতিকে যথার্থভাবে প্রচার করার জন্য। শুরুতে সেই ভাবেই কাজ হচ্ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে যা কিছু হয়েছে তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কোনো সম্পর্কই নেই। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন, অথচ দৃশ্য আগে যা ছিল এখনো তাই। খুব একটা বদল হয়নি।
কালের যাত্রা আজ এ পর্যন্তই।

আদালতের সব বিচারকাজ বাংলায় চালাতে হবে by আবদুল মতিন

Friday, February 4, 2011

ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালে আমি ছিলাম ২২ বছরের টগবগে যুবক। ১৯৪৮ সালে বিএ পাস করেছি। ওই বছরই আমি কনভেনশনে যাই। কনভেনশনে জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন, ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান, অ্যান্ড নো আদার ল্যাঙ্গুয়েজ।’ আমরা বললাম, আমরা এটা মানি না।

আপনার মতো একজন চরম পরাক্রমশালী ব্যক্তি এ কথা অকপটে বলছেন! আপনি যখন অকপটেই বলছেন, তখন আমাদেরও অকপটেই বলতে হয়, আপনার এই কথা আমরা গ্রহণ করব না। ‘নো নো নো’ বলে উত্তর দিলাম। আবুল হাশিম ডায়াসের ওপর ছুটে গিয়ে জিন্নাহ সাহেবকে বললেন, ‘এই দরজাই আপনার দরজা। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করছি, ওই আপনার সাদা গাড়ি, আপনি সাদা গাড়িতে উঠুন। আর আমাদের গাড়ি রেডি আছে। আপনার পেছনে পেছনে গার্ড দিয়ে আপনাকে দিয়ে আসব।’
বিজয় তো আর অত সহজে আসে না। এভাবেই আমরা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এভাবে না বলে বরং বলা ভালো, আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। আমি বলি, ভাষা আন্দোলন একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ফল। পাকিস্তানি নেতারা কথা রাখার লোক ছিলেন না। একবার বললেন, ‘লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হব।’ এ কথা রাখলেন না। এমনকি তাঁরা বললেন, ‘ইট ওয়াজ অ্যা প্রিন্টিং মিসটেক।’ লাহোর প্রস্তাব নাকি একটা ভুল কথা! ছাপার ভুল। সুতরাং, আমাদের কিছু করণীয় নেই। আবুল হাশিম তখন মুসলিম লীগের সেক্রেটারি। তিনি বললেন, ‘আপনি জলজ্যান্ত একটা মিথ্যা কথা বললেন। আমরা সবাই বলেছি সেটা ছাপা হয়েছে এবং সেটা ভারতব্যাপী বিলি হয়েছে। আর আপনি এখন বলছেন সেটা ছাপার ভুল?’ তিনি আবারও বললেন, ‘ইট ওয়াজ অ্যা প্রিন্টিং মিসটেক।’ আবুল হাশিম বললেন, ‘তাহলে একটা কপি নিয়ে আসেন। আর্কাইভসে আছে।’ জিন্নাহ বললেন, ‘নিয়ে আসো আর্কাইভস থেকে।’ কিছুক্ষণের মধ্যে আর্কাইভস থেকে নিয়ে আসা হলো। জিন্নাহ বললেন, ‘তা তো লেখা নেই।’ আবুল হাশিম বললেন, ‘আপনি পড়েন। পড়েই বলেন আছে কি না। আপনারা বললেন, প্রিন্টিং মিসটেক। কিন্তু প্রিন্টিং মিসটেক তো না। পরিষ্কার লেখা আছে। পরিষ্কার লেখা আছে, দেয়ার শ্যাল বি টু স্টেটস।’ এইভাবে লাহোর প্রস্তাবটা আমরা অবশেষে পেয়ে গেলাম। পাকিস্তান হলো। পাকিস্তান হওয়া মানে বাংলাদেশ আবার ভাগ করবে। বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে পশ্চিম বাংলা-পূর্ব বাংলা হয়ে গেল। কিন্তু তারা জবাব দেবে না। তারা মনে করল, পাকিস্তান তো হয়ে গেছে। মেনে নাও তোমরা। আবুল হাশিম বললেন, ‘আমরা মানছি না। আপনাদের এটার সঙ্গে আমরা একমত না। আমাদের পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।’ তাঁরা দিলেন না। ১৯৭১ সালে আমরা তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করলাম।
আমি মনে করি, একুশকে ঘিরে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনাই উল্লেখযোগ্য। সে সময়ের একটা স্মৃতির কথা বলছি। মনে পড়ে, ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্র“য়ারি নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে যখন মিছিল বের হলো, সেদিন নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, ‘আমি জিন্নাহ সাহেবের কথার পুনরুক্তি করছি, এটা কিন্তু আপনারা মনে রাখবেন। এটা আমার কথা না, জিন্নাহ সাহেবের কথা। পাকিস্তানের উন্নতি হবে না, যদি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা না করা হয়। সুতরাং আমি মনে করি, সেটা হওয়া উচিত।’ তখন তাঁর বিরুদ্ধে বিরাট মিছিল হয়ে গেল। যে মিছিলে ৫০-৬০ হাজার ছাত্রছাত্রীর সমাবেশ হয়েছিল। আমাদের ওপর সেদিন পুষ্পবৃষ্টি হয়েছিল। উপস্থিত সবাই বলল, ‘তোমরাই হলে আমাদের আশা-ভরসা।’ এরপর ২০ তারিখ ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। কুর্মিটোলা, তেজগাঁওসহ চারদিক থেকে ধরপাকড় শুরু হলো। তিন হাজারের মতো লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমরা ২টার সময় মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছাই। সেখান থেকে বেরুনোর সময় গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। এতে বহু লোক আহত এবং নিহত হয়। আমরা তাদেরকে নিয়ে আসি। এরপর বাগানের মধ্যে বসে বসে ভাবছিলাম, এত প্রাণ শেষ হয়ে গেল! ওদের মৃত্যুর কথা ভেবে তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। মাথা নিচু করে কেঁদেছিলাম! ছাত্তার বলল, ‘মতিন ভাই, আপনি এখানে! এদিকে আপনাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।’ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন নাকি?’ আমি বললাম, এত মানুষ মারা গেছে, তা সহ্য করা যায়! ছাত্তার বলল, ‘না না, আমাদের এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাদের দাঁড়াতেই হবে।’ আমি বললাম, ঠিক আছে, আমাদের অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। বলো, এখন কী করব? আমরা কি কর্মসূচি দেব? ছাত্তার বলল, ‘সাধারণ ছাত্ররা চাইছে এই হত্যার প্রতিবাদে কালকে প্রতিবাদ দিবস পালন করব।’ আমি বললাম, এই সিদ্ধান্ত যথাযথ। ছাত্তার বলল, ‘এখন কী করব?’ আমি বললাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের কাছে যেতে। সঙ্গে আমিও গেলাম।
কাজী গোলাম মাহবুব ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁর বক্তব্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও পরবর্তী কর্মসূচি মিছিলকে ভুল এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা হঠকারীদের সাথে রাজনীতি করব না। আমরা আগেই বলেছিলাম, ১৪৪ ধারা ভাঙা উচিত না।’ আমি বললাম, এত ছেলে মিছিল করল এবং মারা গেল, অথচ আপনারা বলছেন, হরতাল দেবেন না! এটা কি হঠকারিতা নয়? পরোক্ষভাবে এটা কি সারেন্ডার নয়? যদি বলি, আপনারা পরোক্ষভাবে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন! আর আপনি বলছেন, আমরা হঠকারী! এসব তর্কবিতর্ক চলল। আমাদের সিদ্ধান্তে তাঁরা সই দিলেন না। এরপর তাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক রাখতে অস্বীকৃতি জানালেন। অবশ্য এতে আমরা থেমে থাকিনি। তখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগ এবং নেতৃত্বের ফলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হই। আমার স্বাক্ষরে লিফলেট ছাপা হয়। ওই লিফলেট ছাত্রজনতার মাঝে বিলি হয়। মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গুলিতে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের গায়েবি জানাজা হলো। জানাজায় সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীরা শামিল হয়েছিলেন। অথচ তাঁদের সেদিন নোটিশ ছিল, ‘যাঁরা সেক্রেটারিয়েটে অনুপস্থিত থাকবেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। সুতরাং, আপনারা বুঝে-শুনে কাজ করবেন।’ তখন তাঁরা এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ছেলেপেলেরা আন্দোলন করে মরবে, আর আমরা অফিস করব! এটা হতে পারে না। আমরা যাব।’ ২১ ফেব্র“য়ারির আন্দোলন সফল হয়েছিল মূলত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত এবং ছাত্রদের সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীদের অংশগ্রহণে গায়েবি জানাজায় শরিক হওয়ার কারণে। জানাজাস্থল থেকে আমরা মিছিল নিয়ে বের হয়েছিলাম। সেই মিছিলেও গুলি করা হয়েছিল। এতে অনেকে হতাহত হয়েছিল। কিন্তু এর ফল হয়েছিল বিপরীত। এতে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। এভাবেই সরকার পরাজিত হয়েছিল। আমাদের জয়ের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল।
কিন্তু ভাষা আন্দোলন হলেই কি সব অর্জিত হয়ে যায়? না, আমাদের মোটেই তা হয়নি। আমরা সবাই ইংরেজির দিকেই ছুটছি। অনুকরণের তো চূড়ান্ত করে ছাড়ছি আমরা। বীর শহীদরা এ জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল! এসব দেখার জন্যই কি বেঁচে আছি!
এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা করা দরকার। হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সব বিচারকাজ বাংলায় চালাতে হবে। এ ব্যাপারে তরুণদেরই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। অবশ্য এসব কথা বলতে বলতে আমি ৮৫ বছরের বৃদ্ধ হয়ে গেছি। তবুও আমি হতাশ নই। সচেতনতার কথা বলে যাবই।
অনুলিখন : শরীফা বুলবুল

স্বপ্নভাষার অনুধাবন by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

Monday, January 31, 2011

য়নরত মানুষের আবক্ষ শরীর দুই হাতে ধরা বই। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েন বই পড়তে পড়তে আর চলে যান স্বপ্নের দেশে। এভাবেই আয়ারল্যান্ডের শিল্পী এরিন কুইন তাঁর স্বপ্ন বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। নানান দেশের স্বপ্নবান শিল্পীরা তুলে ধরেছেন তাদের বিষয়গুলোকে এভাবে।

দৃক আর পাঠশালা ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফির আয়োজনে নগরীর সাতটি ভেনু্যতে এ প্রদর্শনী একযোগে চলছে। বিশ্বের ২৯টি দেশ এ আয়োজনে অংশ নিয়েছে। এবারের ছবি মেলার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়_'স্বপ্ন'।

মানব মনের বিচিত্র ভাবনা, নানান দেশের মানুষের চেতনা, প্রকৃতি, পরিবেশ, সংগ্রাম, সাহসী মানুষের মুখ উঠে এসেছে এ প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশ, মেক্সিকো আর নাইজেরিয়ার তিন আলোকচিত্রী প্রয়াত নাইবউদ্দিন আহমদ, পেদ্রো মেয়ার এবং জে ডি ওখাইওজেইকেরেকে আজীবন সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে প্রদর্শনীর যাত্রা শুরু হয়।

আয়ারল্যান্ডের শিল্পী এরিন কুইন তাঁর স্বপ্ন ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন এভাবে_যখন কোনো ব্যক্তি বেঁচে আছেন কিন্তু ঘুমন্ত তখন তার স্বপ্ন বিছানায়_শান্ত হয়ে বিশ্রামরত। বাহুবন্দি হাতের নিচে তখন আপন স্বপ্ন তার জন্য অপেক্ষা করে। বিভিন্ন বয়সী মানুষের শয়নরত অবস্থানকে স্বাপি্নক একরঙা উপস্থাপনে শিল্পীর স্বপ্নের প্রকাশকে ব্যক্ত করে। আবছা আলোয় ঢেকে যায় শিশুমুখ। লরেন্স লেবলানক এসেছেন ফ্রান্স থেকে স্বপ্নকে এভাবে নিয়ে। স্বপ্ন বলতে ধূসরতা মনে হলেও তিনি ভেবেছেন প্রকৃতিতে মানুষের পাশাপাশি আকাশ, গাছ, মাটি, প্রকৃতির তাবৎ অনুষঙ্গও স্বপ্নে জড়িয়ে পড়ে। তাঁর দেশের প্রকৃতিকে সব সময়ই ভাবনায় রাখতে চান। স্বপ্ন নিয়ে তার ভাবনা একেবারেই অন্যরকম জীবন আর মৃতু্য দুয়ের স্বল্প পরিক্রমাকে তিনি উপলব্ধি করেন গভীরভাবে।

প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফ 'নোনা পানির আহাজারি', দেবাশীষ সোমের 'ঢাকা : আমার স্বপ্ন আমার বাস্তবতা' শীর্ষক ছবিগুলো পানিহীন নাগরিকের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, ঢাকার জনজীবনের দুর্ভোগ মুক্তির স্বপ্ন উঠে এসেছে নান্দনিকরূপে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, দৃক গ্যালারি, অলিয়ঁস ফ্রাসেজ, চারুকলা ইনস্টিটিউট লিচুতলা, ব্রিটিশ কাউন্সিল, গ্যেটে ইনস্টিটিউট, এশিয়াটিক গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে একযোগে শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

শিল্পশিক্ষার আনন্দযজ্ঞ

Saturday, January 29, 2011

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নতুনত্ব সৃষ্টি এবং মানসিক উৎকর্ষ সাধনে বহুমাত্রিক চিন্তার প্রয়োগের উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে চলছে শিল্পশিক্ষার এক আনন্দযজ্ঞ। ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) অংশ হিসেবে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সপ্তাহব্যাপী চিত্রকলার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলো।

দুই বাংলার চারুশিল্পের প্রসিদ্ধ শিক্ষক ও শিল্পীদের সমাগম ঘটেছে বাংলাদেশে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ণ, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প—এই পাঁচটি বিভাগ মিলে এ আয়োজন। ২০১০ সালের শেষ দিকে নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুজন শিক্ষক বিশ্বভারতীতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু করেছেন। পরে শান্তিনিকেতন থেকে ১২ জন শিক্ষক-শিল্পী এ দেশে এসেছেন। গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী এবং চারুকলা অনুষদের শিক্ষকদের সমন্বয়ে শুরু হয়েছিল দুই দিনের একটি কর্মশালা। ভারতীয় শিল্পের পুরোধা কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ এই কর্মশালা উদ্বোধন করেন একটি ক্যানভাসে ছবি এঁকে। শুধু ছবি আঁকা নয়, ছিল শিল্পবিষয়ক নানা মতবিনিময়, সেমিনার এবং মুক্ত আলোচনা। প্রথম দুই দিন ভারতীয় শিল্পী এবং এ দেশের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ ঘটেছে ছাত্রছাত্রীদের। পরবর্তী চার দিন ভারতীয় শিল্পীরা বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের শিল্পকর্ম-শিল্পভাবনা বিনিময় করেছেন। সেমিনারে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সচিত্র উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিল। এ ক্ষেত্রে কলা ভবন এবং নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, বাংলাদেশের লোকশিল্প, বাংলাদেশের মূলধারার শিল্পকলা—এ রকম নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে প্রতিদিন। দুই দেশের শিল্পের তাত্ত্বিক বিষয়াবলির পর্যালোচনা নতুনভাবে উঠে এসেছে।
বিশ্বভারতীর কলা ভবনের অধ্যক্ষ পঙ্কজ পাঁওয়ার এই শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নানা দেশের এ ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তা বাড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময় বেশি। এ ধরনের কার্যক্রমে বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়; সম্ভব হয় প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতাকে দূর করা।
গতানুগতিক ধারার বাইরে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা-চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিনিকেতন। পাশ্চাত্যের শিল্প-শিক্ষাকে গ্রহণ না করে নিজস্ব সমৃদ্ধ কৃষ্টি-শিল্প-সংস্কৃতির বৈভবকে আত্তীকরণ করেছে শান্তিনিকেতন। পঙ্কজ পাঁওয়ার মনে করেন, শিল্পের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কারণেই সাধারণের চেয়ে আলাদা হয় শিল্পীরা। তার কাজ মানুষের জীবনকে করে তোলে আরও অনুভূতিশীল ও আনন্দময়। বাংলাদেশের শিল্পীদের শিল্পের প্রতি আগ্রহ তীব্র। তাদের শিল্পকর্মে একটা তাগিদ অনুভব করা যায়। এ দেশের শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের উষ্ণ আতিথেয়তায় আমরা অভিভূত।
শিল্পী সঞ্চায়ন ঘোষ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, এই শিক্ষা কার্যক্রম কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা নির্ভর করছে এর পরিকল্পনার ওপর। শিল্প-শিক্ষায় শিক্ষার্থীর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়; একটা পদ্ধতি শিখে তা অনুশীলন, চর্চা এবং নতুন কী সৃজন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শুধুই তাকে নানা পথের সন্ধান দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ভাবনাকে প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ না করে বিস্তৃত করে দিতে পারে।
ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) প্রথম অংশে অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান শিল্পী ফরিদা জামান গিয়েছিলেন। তিনি জানালেন, পরবর্তী সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম নিয়ে তাঁরা ভাববেন। এ ছাড়া এই ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর্থিক সমস্যাও রয়েছে; এবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আর্থিক-সহায়তা সাময়িক সমাধান দিয়েছে।
আয়োজকদের একজন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে আমাদের শিক্ষা বিনিময়ের এই উদ্যোগ সফল হয়েছে শিল্পী রফিকুন নবীর মাধ্যমে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। এই কার্যক্রমে ব্যবহারিক বিষয়ের বাইরে তত্ত্বীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং জাদুঘরে ভ্রমণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় শিল্পীরা হলেন—নন্দদুলাল মুখার্জি, দিলীপকুমার মিত্র, সুমিতাভ পাল, ঋষি বড়ুয়া, সলিল সাহানি, অর্পণ মুখার্জি, প্রবীরকুমার বিশ্বাস, প্রসুনকান্তি ভট্টাচার্য, সৌমিক নন্দী মজুমদার, পঙ্কজ পাঁওয়ার, সঞ্জয়কুমার মল্লিক, সঞ্চায়ন ঘোষ প্রমুখ।
শিল্প পৃথিবীকে অনুভব করার আবেগময় কৌশল। শিল্পী সর্বদা চেষ্টা করেন তাঁর স্পন্দিত অনুভূতিকে শিল্পকর্মে প্রকাশ করতে। বাংলার শিল্পকলার এই বিভাজন রাজনৈতিক; একই ভাষা, একই অনুভূতি, একই মানুষ, একই প্রকৃতির মেলবন্ধন এবং শিল্প ও ভাব বিনিময় আমাদের নিজেদের চিনতে সাহায্য করবে।

তিন বিভাগে একযোগে শিশু চলচ্চিত্র উৎসব

Sunday, January 16, 2011

বার বড় পরিসরে হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব। চতুর্থবারে এসে এ উৎসব একযোগে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হবে। উৎসবে বাংলাদেশসহ মোট ৪০টি দেশের ২৩৩টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখানো হবে। শিশু নির্মিত চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায়ও এবার ব্যাপক সাড়া মিলেছে।

৯৮টি চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে চূড়ান্ত বিচারের জন্য ৪৮টিকে মনোনীত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান উৎসব পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বরাবরের মতো এবারও উৎসবের স্লোগান হচ্ছে, 'ফ্রেমে ফ্রেমে আগামী স্বপ্ন'। ২২ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে উৎসব উদ্বোধন করবেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর ১৪টি মিলনায়তনে দর্শকরা এসব ছবি উপভোগ করতে পারবে। প্রতিটি ছবিই শিশুদের জন্য উন্মুক্ত। তবে বড়রা ৩০ টাকার দর্শনীর বিনিময়ে ছবি দেখার সুযোগ পাবেন। ছবিগুলোর মধ্যে থাকছে পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, অ্যানিমেশন ও প্রামাণ্যচিত্র। উৎসব চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত।
সংবাদ সম্মেলনে উৎসব উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান মুস্তাফা মনোয়ার, ড. ইয়াসমীন হক, চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বক্তব্য দেন।
উৎসবের মূল ভেন্যু সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার। এর বাইরে ঢাকার শিশু একাডেমী, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজ (ধানমণ্ডি ও উত্তরা), রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, খিলগাঁও মডেল স্কুল, কলেজ অব লেদার টেকনোলজি (হাজারীবাগ)। চট্টগ্রামে উৎসব হবে থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। এর বাইরে কয়েকটি বিদ্যালয় ও মাঠে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। রাজশাহীতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তন এবং জেলা পরিষদ মিলনায়তনে উৎসবের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে।
প্রমা অবন্তির ওড়িশি নৃত্যের মোহনীয় সন্ধ্যা : নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তি ও তাঁর দলের ওড়িশি, বটু, চতুরঙ্গ নৃত্য মুগ্ধ করল রাজধানীর দর্শক-শ্রোতাদের। শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় গতকাল সন্ধ্যায় ওড়িশি অ্যান্ড টাগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার পরিবেশন করে অপূর্ব সব ধ্রুপদী নৃত্য।
প্রথমে ছিল বটু নৃত্য। ওড়িশি নৃত্যের শুদ্ধ পদ্ধতি মেনে নিয়ে সুর, তাল ও ছন্দের মার্গীয় সুধা ও লয়ে এটি পরিবেশিত হয়। এ নৃত্যে মোহনীয় ভঙ্গিতে শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন মন্দির গাত্রের ভাস্কর্য কিংবা ভাস্কর্যপ্রতিম অঙ্গসঞ্চালন। একতাল ও কলাবতী রাগে প্রমার দল এ নৃত্য পরিবেশন করে। দ্বিতীয় পর্বে প্রমা পরিবেশন করেন চতুরঙ্গ।
রণেশ দাশগুপ্তের শততম জন্মদিন উদ্যাপন : রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। তিনি তাঁর সাহিত্য, শিল্প ও কর্মের মাধ্যমে গণমানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। তাঁর আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি উদীচী, প্রগতি লেখক সংঘের মতো প্রগতিশীল সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তৈরি করেছেন অসংখ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তের শততম জন্মদিনে এভাবেই তাঁকে স্মরণ করলেন বিশিষ্টজনরা। গতকাল শনিবার মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে রণেশ দাশগুপ্তের শততম জন্মদিন উদ্যাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উদীচী।
১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি রণেশ দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আগামী বছর রণেশ দাশগুপ্তের জন্মশত বার্ষিকী উদ্যাপনে উদীচীর উদ্যোগে শুরু হলো বছরব্যাপী আয়োজন।

সংস্কৃতির বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

Saturday, January 15, 2011

থাটা ফ্রেড জেমিসনের: ইতিহাস তা-ই যা ব্যথা দেয়। ইতিহাস পপুলার মাইণ্ড থেকে গরহাজির, এই বিলাপ উচ্চতর একাডেমিগুলিতে, এই বিলাপ বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের এবং তাদের নির্মিত রাষ্ট্রে। ডান রাজনীতিতে এই বিলাপের শেষ নেই, বাম রাজনীতিতে আছে এই বিলাপের ধ্বনি।

এই অর্থে কি ইতিহাস ব্যথা দেয়? না বোধ হয়। বাংলাদেশে পপুলার সংস্কৃতি একদিকে ডান প্রভাবিত এবং বাম প্রভাবিত সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করছে, অন্যদিকে প্রান্তিক সংস্কৃতিগুলো আত্মস্থ করে শক্তিশালী হচ্ছে। ডান সংস্কৃতি মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে মতাদর্শিক সাহায্য পাচ্ছে এবং ধর্মজ বোধের মাধ্যমে এই সংস্কৃতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। রক্ষণশীলতা কিংবা নব্য রক্ষণশীলতা ধর্মজ আখ্যান দিয়ে দেশের অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতিগুলির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। দেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে রাষ্ট্র হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতিগুলি হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের স্মৃতি : তেভাগা থেকে হাজং, নানকার থেকে জিরাটিয়াসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনের স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে একই সঙ্গে রাষ্ট্র হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং কৃষক আন্দোলনের লড়াইয়ের ডকুমেন্টেশন। এ সকল অভিজ্ঞতাকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করেছে ধর্মজ বোধের মাধ্যমে ধর্মজ আখ্যান দিয়ে নব্য রক্ষণশীলতা। মুক্তিযুদ্ধ কি ধর্মজ আখ্যান? মুক্তিযুদ্ধ কি সেকু্যলার সমাজতান্ত্রিক আখ্যান? মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দুই বিরোধী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের যে-লড়াই হয়েছে (সোভিয়েত মতাদর্শ বনাম চিনা মতাদর্শ), তার স্থান কি যুদ্ধের মধ্যে এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পড়েনি? যেসব কৃষক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা ডানপক্ষভুক্ত নন কিংবা বামপক্ষভুক্ত নন, কিংবা বাম প্রভাবিত সোভিয়েতপন্থী অথবা চিনাপন্থী নন, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়েছেন, তাঁরা বর্িিভন্ন ধরনের পপুলার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সমাজ পরিব্রাজন করেছেন, তাঁরা কিন্তু ফর্মাল পলিটেক্সে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের অংশগ্রহণ এক ধরনের টেক্স যুদ্ধ নামক অ-বিদ্যায়নিক টেক্সটের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের প্রকাশ করেছেন পূর্বপুরুষের লড়াইয়ের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে। এসব স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা একদিকে পাকিস্তান কলোনিয়াল রাষ্ট্র অবদমিত করেছে, এবং অন্যদিকে যুদ্ধ নামক ফর্মাল পলিটিক্স ব্যক্তিগত এবং পাবলিক জীবনাচরণ সামনে আসতে দেয়নি। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে শ্রেণী এবং সংস্কৃতি উদ্ভাসিত হয়েছে, গণসংস্কৃতি সম্পাদিত হয়েছে ফর্মাল পলিটিক্স একপাশে ঠেলে, এভাবেই ডানের সংস্কৃতি কোণঠাসা হয়েছে। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন যোদ্ধার নিজস্ব জীবনচালিত, ফর্মাল পলিটিক্সের বাইরে প্রতিরোধের জটিল উৎস।

পপুলার সংস্কৃতির মধ্যে একটা ইউটোপিয়ান ডিমেনশন আছে। এই ডিমেনশন আছে বলেই পপুলার সংস্কৃতির পক্ষে সমকালীন ক্ষমতা সম্পর্কের ক্রিটিক করা সম্ভব। পপুলার সংস্কৃতি, এদিক থেকে, সমকালীন ক্ষমতা সম্পর্ক ছিঁড়েখুঁড়ে খায়, কংক্রিট আকার দেয় পলিটিক্সকে (যেমন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা এই কাজটা করে চলেছেন সাহসের সঙ্গে)। এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক আখ্যান, ফর্মাল পলিটিক্সের বাইরে তারা ভবিষ্যতের ইতিহাস এবং রাজনীতি সফল করে চলেছেন।

একে কি অর্জিত ইউটোপিয়া বলা যাবে? অর্জিত বিপস্নব? আমার তো মনে হয় এভাবে আমরা ইউটোপিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, এক পা দুই পা করে বিপস্নবের ভূমি দখল করে নিচ্ছি। এখানেই বামের অন্তদর্ৃষ্টি লুকানো, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া। যে দেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে (যেমন, রাশিয়া সমাজতন্ত্র বিট্রে করছে কিংবা চিন ধনতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে), সে দেশ সমাজতন্ত্রের মনোপলি তৈরি করে সমাজতন্ত্র থেকে সরে আছে। পপুলার সংস্কৃতি এদিকটা সম্বন্ধে সজাগ।

পপুলার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, এভাবে প্রান্তিক সেনসিবিলিটি কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস এবং সংস্কৃতিক সাহস পরীক্ষার ভূমি। বিভিন্ন কণ্ঠ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা মানুষকে সহনশীল করে তুলেছে, যারা গতকাল প্রান্তিক ছিলেন, তারা আগামীকাল কেন্দ্রে এসে যাচ্ছেন। মার্জিনাল সংস্কৃতি এই প্রক্রিয়ায় পপুলার সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে, স্টাবলিশমেন্টের রাজনীতি (বাম এবং ডান) ভয় পাচ্ছে। এই ভয় পাওয়া বৈধতা দিচ্ছে প্রান্তিক সেনসিবিলিটিকে, শক্তিশালী করে তুলছে প্রান্তিক মানুষগুলোর ক্ষমতাকে, (পোশাক শিল্পের কর্মীদের, ফুটপাতের ফেরিওয়ালাদের, নিঃস্ব কৃষকদের কিছুতেই হটানো যাচ্ছে না), তারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন, তারা ইতিহাসের দিক থেকে কমিউনিটির বীর। তাদের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কবর দেয়া, গ্রুপ আইডেন্টিটির আখ্যান প্রতিরোধের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। ধানের লড়াই, ভাতের লড়াই, বাসস্থানের লড়াই, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখার লড়াই_এ সবই পপুলার সংস্কৃতির ইতিহাস, বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস। সাধারণ মানুষ এভাবেই নিজেদের মবিলাইজ করছে বিপস্নবের জন্য।

জীবনের অঙ্ক জনমাঙ্ক by অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

Tuesday, January 11, 2011

বিশ্বায়নের ব্যাপ্তির কথা বলতে গিয়ে বলাটা সংকীর্ণ গণ্ডিতে হবে না কি উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে হবে, সেটি একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন। মীমাংসিত সমাধান একটিই আর তা হলো, আধার অনুপাতে ধারণক্ষমতা। জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক চলচ্চিত্রে দেখতে পাই, ডুবন্ত জাহাজযাত্রীদের বাঁচানোর লাইফবোটে প্রথম জায়গা পায় শিশু।

তারপর নারী এবং অবশেষে অবশিষ্ট বোটে পুরুষ। পক্ষান্তরে পদাতিক নাট্য সংসদের সদ্য প্রযোজিত নাট্যকার নাসরীন মুস্তাফা রচিত, মীর মেহবুব আলম নাহিদ নির্দেশিত নাটক 'জনমাঙ্ক'তে দেখতে পাই, সমুদ্রতীরবর্তী মানুষের সমুদ্রের গ্রাসের হাত থেকে বাঁচতে, বাঁচার অবলম্বন সমুদ্রে নারীর বিসর্জন। পুরুষ নারীর ঊধর্ে্ব উঠে মানবের মধ্যে মনুষ্যত্বের জাগরণের নাটক জনমাঙ্ক মঞ্চস্থ হলো গত ৮ নভেম্বর শিল্পকলা একাডেমীর এঙ্পেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে।
নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, সমুদ্রবেষ্টিত এক জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা। সমুদ্রের কড়াল গ্রাসের হাত থেকে বাঁচতে তাদের পরম নির্ভরতা সমুদ্রের দেবতায়। জনপদবাসীর কাছে বিপন্ন সময়ে নারীরা যে কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ তা বোঝা যায় তখন, যখন সমুদ্রের গ্রাসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া খণ্ডভূমিতে বাঁচতে মরিয়া পুরুষ-নারীর স্থানাভাবে ডুবিয়ে মারা হয় নারীদের। দুর্বল নারীদের ওপর আঘাত হেনে সবল পুরুষরা বেঁচে যায় নিজেদের মতো করে। পোয়াতি বউকে বাঁচানোর প্রশ্নে স্বামী করুণ মিনতি জানালে পোয়াতি বউকে ঠিকই বাঁচানো হয়। কিন্তু নৃশংস পুরুষ ডুবিয়ে মারে স্বামীটিকে। বিপন্ন সময় পার হলে জনপদবাসীর একমাত্র চাওয়া ভাবী সন্তান যেন কন্যা হয়। তবেই অস্তিত্বে বেঁচে রবে ভগি্ন, প্রিয়া, মায়ের ভাবী সম্ভাবনা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, মা জানায় সন্তানটি তার পুত্র। শুধু পুরুষ নিয়ে কি জনপদ বাঁচে। লোকচক্ষুর আড়ালে মায়ের বুকে লালন-পালনে বেড়ে ওঠা সন্তানটি যে আসলে পুত্র না কন্যা, সেটি প্রকাশিত হয় ভূমিষ্ঠের ১২ বছর পর। পুরুষের লেলিহান লোলুপ দৃষ্টির হাত থেকে কন্যাকে বাঁচাতেই মায়ের এই মিথ্যা আশ্রয়। পুরুষ লোকের হাত থেকে নারীকে বাঁচাতে সক্ষম হলেও সমুদ্র পুরুষ দেবতার হাতে কন্যা হয় বলিদান। জনপদবাসীকে বাঁচাতেই পুরুষ সমুদ্রের দেবতার কাছে এই কন্যা বলিদান।
কন্যার বলির মধ্য দিয়ে জনপদবাসী যে শুধু সুরক্ষিত হয় তা নয়, বরং সমুদ্র দেবের আশীর্বাদে মাতৃজঠরে আসে নতুন ভ্রূণ। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ায় জনপদবাসী। ভবিষ্যৎ সমুদ্র গ্রাসের মুখে সুনিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হলেও কোনো নারীকেই যে জনপদবাসী আর সমুদ্রে বিসর্জন দেবে না, সেই দীপ্ত প্রত্যয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাট্যকার নাসরীন মুস্তাফা রচিত জীবনের অঙ্কের উত্তর মেলানোর নাটক 'জনমাঙ্ক'।
আলো জ্বাললেই যে আঁধার কেটে যায়, এই সহজ কথাটা জানা না থাকলে অনেক সময় ধরেই সম্ভব আঁধার দিয়ে আঁধার সরানো। নাট্যকার নাসরীন মুস্তাফা পুরো নাটকে পুরুষের নৃশংসতা আর নারীর লাঞ্ছনা-বঞ্চনা দেখাতে যত দৃশ্য, সংলাপ রচনা করলেন তাতে স্পষ্ট নাট্যকার আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও মান্ধাতা আমলের বিশ্বাসে বিশ্বাসী। অন্য দেশ তো দূর অস্ত, এক বাংলাদেশের প্রশাসনে, অফিসে, ক্রীড়াঙ্গনে, ব্যবসায় এমনও বহু নারী আছেন, যাঁদের ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো পুরুষের পক্ষে বলা অসম্ভব, 'আমি নারী স্বাধীনতা চাই কি চাই না।' আমেরিকান পটভূমিতে নাট্যকার নাটক শিখলে সেখানে তিনি হয়তো দেখাতেন, ডেমোক্র্যাট থেকে হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলেন না। কারণ, তিনি নারী। কিন্তু মেজরিটি মানুষ বিশ্বাস করে, সক্ষমতার জোরেই, বর্ণ-গোত্রের ঊধর্ে্ব উঠে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পুরুষ হওয়াটাই একমাত্র যোগ্যতা নয়।
বাংলার লোক আঙ্গিকে নাটকটি উপস্থাপনায় নির্দেশক মীর মেহবুব আলম নাহিদ যত্নবান, কল্পনাপ্রবণ, বহুমাত্রিক_কিন্তু সব মিলেমিশে গতানুগতিক। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গতিশীল করেছেন, দৃশ্যের ভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আলো-আঁধারির ব্যবহার এনেছেন, সরাসরি আবহ সংগীতে অবস্থাকে বিশ্বস্ত করেছেন। জনপদের নাম না বলে জনপদবাসীকে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষ বোঝাতে চেয়েছেন, পক্ষান্তরে ধুতি-শাড়ি পরিয়ে নির্দিষ্ট কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বও করিয়েছেন। প্রপসের প্রয়োগ (মোরগ, শিয়াল...) যতটা প্রয়োজনীয়, সেটের প্রয়োগক্ষেত্র বিশেষ আরোপিত। জনমাঙ্ক নাটকটি দেখে একটাই অনুভূতি, পল্লবিত বৃক্ষকে দেখা যায়, কিন্তু মাটির তলে থাকা শিকড় দেখা যায় না। অথচ কে না জানে, শিকড়ই বৃক্ষের প্রাণভোমরা। নাট্য প্রযোজনা পল্লবিত বৃক্ষের মতো। প্রযোজনার প্রাণভোমরা নাটক তথা নাট্যকারের লেখা। সেই লেখাই কিভাবে শত-সহস্র মানুষকে শত-সহস্র অবস্থান থেকে এনে এক বিন্দুতে এক করে দিতে পারে, সেটাই হোক আপাত একমাত্র আত্মজিজ্ঞাসা।

নাট্যকার আতিকুল হক চৌধুরীর জন্য শুভাশীর্বাদ by খান সারওয়ার মুরশিদ

দেশের প্রখ্যাত নাট্যকার, সংস্কৃতিজগতে বিশেষ করে মিডিয়ার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল তারকা, আমার পরম স্নেহভাজন আতিকুল হক চৌধুরী ৮০ বছরে পদার্পণ করেছেন_এ কথা ভাবতে আমার বিশেষ আনন্দ হচ্ছে বৈকি। খুশি লাগছে ওর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ধরে সেই পঞ্চাশের দশকে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতার সেই সুন্দর দিনগুলোর দিকে আজ আবার নতুন করে তাকাতে পারছি বলে।
রমনার সবুজ ছড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পুরনো বিল্ডিংটা আর্টস বিল্ডিং মেডিক্যাল কলেজের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। লম্বা লাইব্রেরি ঘর, করিডর, সিঁড়ি। সামনে মাঠ। আমগাছ। মধুর ক্যান্টিন।
বই হাতে কত ছাত্রছাত্রীর মধুর কলবর। টার্নার, মুনীর চৌধুরী, আবু রুশদ, মতিন উদ্দিন সেদিনের আরো কত শিক্ষক বন্ধুরা আমার! তখন আমরা এখনকার মতো এত জটিল ও বিষাক্ত পৃথিবীতে বোধ করি বসবাস করতাম না। এখন পৃথিবী কত বদলেছে। মানুষ বদলেছে। তবে এই কয়েক যুগে আকাশের রং বদলায়নি। পাতাবাহারের হলুদ কালো ছিটে রং বদলায়নি। কৃষ্ণচূড়ার লাল রং বদলায়নি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গেটের সামনের রাস্তায় বড় বড় সেই কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো আর আগের মতো দাঁড়িয়ে নেই। সেদিনের অনেক কিছুই আজ আর নেই। কিন্তু স্মৃতিগুলো অমলিন। কী একটা অপার শান্তির সচ্ছলতার মাঝে আমরা বসবাস করতাম। চাহিদা ছিল কম। সুযোগ-সুবিধা আর প্রাপ্তির সুযোগও ছিল কম।
কিন্তু সম্ভাবনা ছিল। মেধা ও মনন বিকাশের সম্ভাবনা। এখনো যেন স্পষ্ট দেখতে পাই পুরনো আর্টস বিল্ডিংয়ে ইংরেজি সাবসিডিয়ারি ক্লাসে ডান দিকের বেঞ্চে একটি সুদর্শন ছেলে বসে আছে। কালো চশমা চোখে। আমি ইংরেজি কবিতা পড়াচ্ছি। কিটস্। বায়রন। শেলি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ।
ছেলেটি ক্লাসের মধ্যে কোনো কথা বলছে না। কানে কানেও না। বড় বড় চোখ তুলে গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে আমার কথা শুনছে। খাতায় হয়তো টুকটাক লিখছেও বা। ক্লাসের বাইরে এই ছেলেটির সঙ্গে আমার কথাবার্তা যে হতো না তা নয়। হতো। তবে কম। মনে আছে, আমাকে একদিন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ও জিজ্ঞেস করেছিল, 'স্যার ঙফব ঃড় রসসড়ৎধষরঃু-তে ডড়ৎফংড়িৎঃয যে ঈবষবংঃরধষ ষরমযঃ সবধহ করেছেন, আসলে এটা কী খরমযঃ?' আমি বোধ করি বলতে চেয়েছিলাম, 'এই আলো আসলে খরমযঃ ঙভ ঞযব ঝড়ঁষ. খরমযঃ ঋৎড়স ঐবধাবহ, যা এই ধূলিধূসরিত পৃথিবীতে বসবাস করতে করতে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় পবিত্র শিশুর মুখাবয়ব থেকে।'
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার স্নেহময়ী অপূর্ব সুন্দরী মায়ের মুখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে আলো আমি দেখেছি, তা ছিল চিরন্তন মহিমায় অম্লান।
সেই জ্যোতির্ময় আলোর পথের দিকে তাকালে আজ মনে হয়, একটি আলোর রেখা যেন চলে গেছে কোথায় কত দূরে।
পঞ্চাশের দশকে আমার বেশ কয়েকজন ছাত্রের মতো সেদিনের আতিকের মধ্যেও কোথায় যেন একটা আলো দেখেছিলাম। সেই আলোই উজ্জ্বল হতে হতে ওর সামগ্রিক জীবনকে যে আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছে, এটা একজন শিক্ষক হিসেবে অবশ্যই আজ আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। পঞ্চাশের দশকের আমার ছাত্র আতিকুল হক চৌধুরী আজ দেশের এক বরেণ্য নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব_এটা অবশ্যই আমার কাছে, আমাদের সবার কাছেই একটি সুসংবাদ।
আতিকুল হক চৌধুরীর নাট্যজীবন বোধ করি শুরু সেই ষাটের দশকে বেতারে। তারপর একটানা টেলিভিশনে, এখন পর্যন্ত। একদম নড়াচড়া নেই। আমার ছাত্রদের মধ্যে আতিকুল হক চৌধুরীই বোধ হয় এখনো গণমাধ্যমে একটানা চাকরিরত। চাকরি থেকে অবসর নেয়নি। নিজেকে গুটিয়ে রাখেনি কোনো কর্মকাণ্ড থেকে। আতিক সক্রিয়। ব্যাপকভাবে সক্রিয়। একেবারে যেন এঁটেসেঁটে বসে আছে তার নিজ স্থানে। নাট্যকার ও নাট্যশিক্ষক আতিকুল হক চৌধুরী, মিডিয়াব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী একজন সজ্জন, নিরহংকার, সদা হাস্যময়, শিক্ষকের কাছে এখনো সদা অবনত আতিকুল হক চৌধুরী_কোনটা যে তার বড় পরিচয়, তা কখনো পরিমাপ করে দেখিনি।
ভাবতে অবাক লাগে, দীর্ঘ নাট্যজীবনে আতিক রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তলস্তয়ের এত সব গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে তার সফল প্রযোজনা করার দুঃসাহস অর্জন করল কোথা থেকে, কী করে? নিজেই বা এত কালজয়ী সাহসী নাটক লিখল কিভাবে? সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা পরিহার করে যে মানুষটি নানা প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে এখনো একজন আধুনিক মানুষ, একজন মুক্তচিন্তার মানুষ, প্রগতিশীল মানুষ; যে সুরুচি ও নান্দনিকতার সঙ্গে কোনো আপস করেনি সারা জীবনে, তার শুভ জন্মদিনে নাট্যপ্রাণ আতিকুল হক চৌধুরীর ৮০ বছরে পদার্পণে, তার শিক্ষক হিসেবে আমার সবটুকু আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা রইল ওর জন্য। ঊষার শুকতারা আজীবন ওকে সব আঁধারের মধ্যে সত্যের পথে ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করুক_এই প্রার্থনা।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু