চাচার পাঁ চালি- কৌশল by মাহবুব তালুকদার

Monday, February 24, 2014

চাচা বললেন, আমাদের জাতীয় সংসদ এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
কি সেই ইতিহাস? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

প্রথমত, এমন একটি সভ্য ভব্য বিনীত বিরোধী দল বিশ্বের আর কোন দেশের সংসদে পাওয়া যাবে না। এখানে বিরোধী দলের কাজ হলো সরকারের পক্ষে গুণকীর্তন করা। দ্বিতীয়ত, সরকার ইশারা দিলে সময়মতো কোনও কোনও বিষয়ে ‘না’ বলা। জাতীয় পার্টি এ দু’টি দায়িত্ব পালনে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছে।
তবে যে এরশাদ সাহেব বলেছেন, সরকারে জাতীয় পার্টির কোন মন্ত্রী না থাকলেই ভাল হতো।
এ কথা তিনি কখনও সংসদে দাঁড়িয়ে বলবেন না। চাচা মৃদু হেসে বললেন,
মন্ত্রীরা এরশাদের মন্ত্রী নয়, রওশনের মন্ত্রী। এ জন্যই এরশাদের এত দুঃখ। তিনি এক রাশ দুঃখ নিয়ে কথাগুলো বলেছেন।
কিন্তু আপনি বিরোধী দলকে ‘সভ্য ভব্য বিনীত’ আখ্যা দিলেন কেন?
আসলে তারা জাতীয় সংসদে কখনও অনাকাঙিক্ষত পরিবেশ সৃষ্টি করবেন না। সৌজন্যে বিনয়ে ভদ্রতায় ও আনুগত্যে তারা সংসদে বিরোধী দলের এক নতুন ধারার উদাহরণ সৃষ্টি করবেন। এদের কাছ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদীয় রীতিনীতির অনেক কিছু শেখার আছে। চাচা জানালেন।
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। তুমি নিশ্চয়ই দেখেছো সমপ্রতি ভারতে সংসদ সদস্যরা হাতাহাতি, মারামারি, মরিচের গুঁড়ো প্রতিপক্ষের চোখে ছুড়ে দেয়া ইত্যাদি কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে। তুরস্কের সংসদেও হাতাহাতি হয়েছে। এরকম ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পার্লামেন্টেও ঘটেছে। আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশের বর্তমান সংসদে এমন কিছু ঘটবে না। বরং সরকারি দল বিরোধী দলকে যেভাবে উঠবস করতে বলবে, তারা সেভাবেই তা করবে। চাচা আরও বললেন, ‘বশংবদ’ বলে বাংলাভাষায় একটি শব্দ আছে। সংসদে বর্তমান বিরোধী দল সম্পর্কে সেটা খুব মানায়।
চাচা! কথাটা আপনি বিরোধী দলের সাংসদদের পক্ষে বললেন, না বিপক্ষে বললেন?
পক্ষেই বললাম। ‘বশংবদ’ হওয়া কি খারাপ? চরিত্রের মধ্যে বিনয়, আনুগত্য, ‘জ্বি হুজুর’ মার্কা স্বভাব, ইত্যাদি মহৎ গুণাবলী না থাকলে কখনও বশংবদ হওয়া যায় না। দল বেঁধে এমন বশংবদ হওয়ার নজির তুমি বিশ্বের আর কোন দেশের সংসদে পাবে না।
চাচার কথায় আমি মাঝে মধ্যেই বিভ্রান্তিতে পড়ি। তার অনেক কথার দ্বৈত অর্থ থাকে। অনেক সময় তিনি যা বলেন, কথাগুলো বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়, আবার অনেক সময় কারও বিরুদ্ধে কিছু বললে মনে হয়, তার প্রশংসা করছেন, যাকে ব্যাজস্তুতি বলা যায়। এটা চাচার এক ধরনের স্বভাব।
আমি প্রসঙ্গান্তরে যেতে চাইলাম। বললাম, চাচা, নির্বাচন সম্পর্কে কিছু বলুন।
কোন নির্বাচন? জাতীয়, নাকি উপজেলা?
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়েছে। সে বিষয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি? উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। সে সম্পর্কে আপনার মতামত শুনতে চাই।
উপজেলা নির্বাচনে সরকার জিতেছে।
সরকার জিতেছে মানে? ৯৭টি উপজেলার মধ্যে ৫৫টি উপজেলায় বিএনপির জোট এবং ৩৪টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের জোট জয়লাভ করেছে। আর আপনি বলছেন কিনা-
চাচা বাঁধা দিয়ে বললেন, আমি আওয়ামী লীগের কথা বলিনি। সরকারের কথা বলেছি। বিএনপি যে এবার উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলো, এটাই তো সরকারের জয়। এর অর্থ বিএনপির শত অপপ্রচার সত্ত্বেও বোঝা গেল, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে।
আমি জানালাম, উপজেলার প্রথম পর্বের নির্বাচন সম্পর্কে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ (মন্ত্রী নয়) বলেছেন, ‘গত সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দেখলে বোঝা যায়, জনপ্রিয়তার একটা ধারাবাহিকতা আছে। গ্রামগঞ্জে আওয়ামী লীগের সমর্থন আছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো তারা হোয়াইট ওয়াশ হননি’ (প্রথম আলো, ২১শে ফেব্রুয়ারি সংখ্যা)।
চাচা ব্যাজার মুখে বললেন, হোয়াইট ওয়াশ হবে কি করে?
কোন উপজেলায় নির্বাচনকালে যাতে সাদা রঙ না পাওয়া যায়, প্রশাসনকে গোপনে তেমন নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া, তোফায়েল সাহেব স্পষ্টতই বলেছেন, গ্রামেগঞ্জে আওয়ামী লীগের সমর্থন আছে।
কিন্তু গ্রামেগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীরও সমর্থন আছে। সেটাই তো এলার্মিং। তারা ১২টি উপজেলায় জয়ী হয়েছে।
চাচার মুখ কালো হলো। বললেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হলে এমন ঘটনা ঘটতো না। সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিশ্চয়ই ওরা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভোটারদের ভোট দিতে বাধ্য করেছে। এব্যাপারে ইলেকশন কমিশন কিছু করতে পারতো।
ইসি এতে কি করবে?
ইসি এদের মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারতো।
এটা কি কোন কথা হলো! ইসি কি কারণে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করবে? কোন ক্ষমতাবলে?
ইসি’র হাতে কি ক্ষমতা কম? ইসি যদি মনোনয়ন প্রত্যাহারকারীদের প্রার্থিতা বাতিল না করে জাতীয় নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে পারে, তাহলে সামান্য উপজেলা নির্বাচনে কারও প্রার্থিতা বাতিল করার কোন কৌশল করতে পারতো না? ইসি না পারে কি?
চাচার কথায় ইসি’র করণীয় বিষয়ে আমি কোন কথা ভাবছি না। ভাবছি একটি সন্ত্রাসী দল হওয়ার পর হাজার হাজার নেতা-কর্মী জেনে যাওয়ার পর এবং বাকিরা পলাতক থাকার পরও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা উপজেলা নির্বাচনে পার হলেন কিভাবে? যদি ওদের জনসমর্থন না থাকে, তাহলে ওদের ভোট দিলো কারা?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে চাচা বললেন, কোন চিন্তা করো না। উপজেলা নির্বাচনের আগামী পর্বে জামায়াতে ইসলামীকে ঠেকাতে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কি ব্যবস্থা হবে?
এই মুহূর্তে তা বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে আমরা জাতীয় নির্বাচনকে হ্যান্ডেল করতে সেভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম, উপজেলা নির্বাচনে তেমন সচেতন ছিলাম না। জামায়াতে ইসলামীর যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী অভিযোগ আছে কিনা দেখলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।
চাচা, আরেকটা বিষয় ভাববার আছে।
কি সেটা?
উপজেলা নির্বাচনের এই পর্বে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কিন্তু একটা আসনও পায়নি।
তবে যে শুনেছিলাম তারা একটা আসন পেয়েছে।
যে একটি আসন পেয়েছে তা নাকি জাতীয় পার্টির এক বিদ্রোহী প্রার্থীর।
এটা কিন্তু ঠিক হলো না। আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি জাতীয় নির্বাচনের কলাকৌশলগুলো মোটেই কাজে লাগালো না। তখনকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দল ও বিরোধী দল কিছু আসন নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতে পারতো। তবে এখনও কিছু আশার আলো আছে।
আপনি আশার আলো দেখছেন কিভাবে?
দেখছি এ জন্য যে উপজেলা নির্বাচন তো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। অন্যান্য উপজেলাতে আগামী পর্বে নির্বাচন হবে। তখন যাতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মুখরক্ষা হয়, এমন ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
সেটা কিভাবে সম্ভব?
কিছু পছন্দের প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে আনা কি এমন কঠিন?
বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে সেটা হতে পারতো। আমি বললাম।
চাচা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি খুবই খারাপ কাজ করেছে। এটাকে গর্হিত বলবো না জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলবো, বুঝতে পারছি না।
চাচা, আপনি এমন কথা বলছেন কেন?
বলছি কি সাধে! খালেদা জিয়া জাতীয় নির্বাচনে এলেন না। তার কথা হলো, নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। এখন তো নির্দলীয় সরকার নেই। হাসিনার সরকার বহাল আছে। তাহলে খালেদা জিয়া কোন মুখে নির্বাচনে গেলেন? আসলে তার মুখের কথারই কোন ঠিক নেই।
বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে জিতেছে এবং জিতে যাচ্ছে বলেই কি আপনি গোস্‌সা করে এসব কথা বলছেন?
না, না। তা নয়। তবে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগের কোন বিকল্প নেই। আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় থাকে, যে কোন ভাবেই হোক, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
সেটা কি গায়ের জোরে করা হবে?
গায়ের জোর বলছো কেন? আসল কথা হলো কৌশল। সবাই জানে সরকারি দলের কৌশলের কাছে বিএনপি কেমন ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে। একটু থেমে চাচা মৃদু হাস্যে নিচু গলায় বললেন, তবে গায়ের জোরও একটা কৌশল বলা যেতে পারে। দেখলে, তো, সরকার এবার গায়ের জোরেই কেমন টিকে গেল!

কালের পুরাণ- বড় ধাক্কা খেল আওয়ামী লীগ by সোহরাব হাসান

Saturday, February 22, 2014

সব রাজনৈতিক দলেই কিছু নেতা থাকেন, কথা বলতে ভালোবাসেন। তাঁরা কাজ করেন কম। কথা দিয়েই কাজের ঘাটতিটা পূরণ করতে চান।
তবে সম্ভবত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এই নেতা-নেত্রীর সংখ্যাই বেশি। বিরোধী দলে এ রকম কথার রাজাদের কদর বেশি। কেননা, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিরোধী দলের একমাত্র কাজ হলো সরকারের সমালোচনা করা এবং সেই কাজটি যিনি যত জ্বালাময়ী ভাষায় দিতে পারেন, তিনি বড় নেতা হন। বাংলাদেশে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দেওয়া নেতার অভাব নেই। অভাব আছে দক্ষ প্রশাসকের। মন্ত্রীও যে একজন প্রশাসকও, সে কথাটি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতে ভুলে যান এবং নিজের মন্ত্রণালয় ছাড়া সব বিষয়ে পাণ্ডিত্য দেখান।

শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভার বয়স দেড় মাসেরও কম। গত মাসের ১২ তারিখে তাঁর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে। আজ ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ। এই এক মাস ১০ দিনের মধ্যে সরকার রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে যেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে তা হলো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সব উপজেলার মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, মেঘ না চাইতেই জল। সরকার হয়তো ভেবেছিল, প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে আসা জাতীয় নির্বাচনের এক-দেড় মাসের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন হলে বিরোধীরা বেকায়দায় পড়বে। কিন্তু প্রথম দফার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, বিরোধী দল নয়, সরকারি দলই বেকায়দায় পড়েছে। বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা হলো, দ্রুত বিচার আইনের মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানো। আগামী এপ্রিলে এই মেয়াদ শেষ হবে। আগে দুই বছর করে বাড়ানো হতো। এবার চার বছর বাড়ল।
তবে উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সরকারি দলের একটি সন্তুষ্টির জায়গা আছে সেটি হলো, শেখ হাসিনার আমলে সব নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, এটাই তার প্রমাণ। এ কারণে বাকি উপজেলা নির্বাচনগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেসব নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু হয় এবং বিরোধীদের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ নেতারা জোর দিয়ে বলতে পারবেন, ‘আমরা ভোট কারচুপি করি না।’ তাতে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হলেও নৈতিক অবস্থান পোক্ত হবে। আর যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয় এবং ক্ষমতাসীনেরা যেকোনো উপায়ে জয়ী হতে চায়, তাহলে আরও বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে। বিরোধী দল তখন সরকারকে সময় দিতে চাইবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় আছে।
গত দেড় মাসে মন্ত্রীরা কে কী কাজ করেছেন, হিসাব নিলে অনেকের জমা খাতার হিসাব মেলানো কঠিন। বেশির ভাগ মন্ত্রীর কথাবার্তা শুনে মনে হয়, মন্ত্রিত্ব করা তাঁদের কাছে ডাল-ভাত। তাঁদের একমাত্র কাজ হলো পরাস্ত বিএনপি-জামায়াতকে কোণঠাসা করা। বিএনপি-জামায়াত তো এখন সংসদে নেই, রাজপথেও নেই। কোনো কোনো মন্ত্রী জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে উপজেলা নির্বাচন করার জন্য বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে নাকে খত দিতে বলেছিলেন। সেই মন্ত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা, এখন কে নাকে খত দেবেন।
তবে আমরা নিশ্চয়ই সব মন্ত্রীকে এই বাকপটু দলে ফেলছি না। অনেক মন্ত্রীকে দায়িত্ব নিয়েই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তাঁরা নিজেদের গুরুত্ব দেশের মানুষ ও বিদেশি বন্ধুদের কাছে ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। যেসব মন্ত্রী আগের মন্ত্রণালয়ে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে পেরেছেন, স্বভাবতই তাঁরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। কিন্তু যাঁরা মন্ত্রিসভায় নতুন এসেছেন অথবা পুরোনো হলেও নতুন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁদের কাজটি বুঝতে তো কিছুটা সময় লাগার কথা। যদিও এসব মন্ত্রীর হাবভাব দেখে মনে হয়, মন্ত্রণালয় পরিচালনা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো বিএনপি-জামায়াতকে ঘায়েল করা। তাই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁদের কণ্ঠে সেই জিগিরই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কত খারাপ, কত গণবিচ্ছিন্ন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির না যাওয়া তাদের রাজনৈতিক ভুল ছিল বলে আমরাও মনে করি। এর অর্থ এই নয় যে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বরং উপজেলা নির্বাচনে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর আশাতীত ভালো ফল কেবল সরকারের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও অশনিসংকেত। অতীতে কোনো নির্বাচনে তারা এই ফল দেখাতে পারেনি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত দেড় মাসে সরকার এমন কিছু করে দেখাতে পারেনি যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়বে। এমনকি মার্কিন গবেষণা সংস্থা আরডিআই ও ডিআইএর জরিপে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমারই ইঙ্গিত দিয়েছে। অনেকে এ কথাও বলাবলি করছে যে সরকার ছাত্রলীগকেই সামাল দিতে পারছে না, সেই সরকার কীভাবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসবে। চট্টগ্রামে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীর অপহরণ ও উদ্ধারের ঘটনাটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে চাই, কেন মৃদুল অপহরণ হলেন, কারা তাঁকে অপহরণ করলেন, কেন অপহরণ করলেন, কীভাবে তিনি ছাড়া পেলেন?
আয়মান আল-জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা যায়। কিন্তু মৃদুল চৌধুরীর অপহরণকারীদের খুঁজে বের করা সত্যি কঠিন!
এত দিন সরকারি দলের নেতারা এবং সরকারের মন্ত্রীরা সব অপকর্মের দায় বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির ওপর চাপিয়ে বাহবা নিতে চাইতেন। দেশের যা কিছু অমঙ্গল, সবকিছুর জন্য বিরোধী দল দায়ী। কিন্তু এখন তাঁরা কী বলবেন? এখন তো বিরোধী দল ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না।
একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাংলাদেশে আল-কায়েদার এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেটি যদি সত্যি হতো, তাহলে মন্ত্রীর তথ্য উদ্ঘাটনের আগেই যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিত। তাঁর পরামর্শের অপেক্ষা করতেন না। তারেক রহমানের রাজনীতির বিরোধিতা করা এবং তাঁকে আল-কায়েদা বানানো এক কথা নয়। উপজেলা নির্বাচনে তারেক রহমানের দল আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি পদ পেয়েছে, জামায়াতকে ধরলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এখন কি মন্ত্রী মহোদয় বলবেন, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ আল-কায়েদার সমর্থক? মন্ত্রী মহোদয় হয়তো বলবেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যেহেতু আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তাকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বানানোর বলে দাবি করেছেন, সেহেতু তার পাল্টা একটি বক্তব্য দেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁকে মনে রাখতে হবে, দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত নয়। তাই দেশে যত অঘটন ঘটবে, তার দায়ও আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে অথবা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলতে হবে, ওরা অপরাধী। হাওয়ায় ছড়ি ঘোরালে হবে না।
বিরোধী দলে থাকলে নেতা-নেত্রীরা অনেক কিছু বলেন, বলতে পারেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা নেতাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করা। অবশ্যই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার বাইরে কার্যত কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে ২০০৮ সালে যেই প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটি সজ্ঞানে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আইনের শাসনের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রয়োজন ছিল না! এখন আছে। বিশ্ব দ্রুত সামনে এগোচ্ছে। আর আমরা ক্রমেই পেছনে চলে যাচ্ছি।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও আমরা শক্তিশালী বিরোধী দল পেয়েছিলাম বলে সেই সরকার ও সংসদে ভারসাম্য ছিল। অন্তত প্রথম দুই-আড়াই বছর। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেই ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি বলে দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রচর্চা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। আর ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই বলেই জনমনে ধারণা। ফলে এই ভারসাম্যহীন সংসদ ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতি উপহার দিতে পারবে কি না, সেটাই এখন ক্ষমতাসীনদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্যের সরকার মুখে বললেই হয় না, কাজে দেখাতে হয়। নির্বাচনী বৈতরণি পার হয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা এতটাই আস্থাশীল হয়ে পড়লেন যে উপজেলায় ১৪-দলীয় শরিকদের সঙ্গেও পদ ভাগাভাগি করতে রাজি হলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পথ ও পথের বিবেচনায় আওয়ামী লীগের যেমন কিছু সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধার দিকটি হলো, আওয়ামী লীগ বিপদে না পড়লে কখনো কারও সঙ্গে জোট বাঁধে না। বিপদে পড়লে খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও জোট বাঁধতে পারে। অন্য সময়ে একলা চল নীতিতে চলে দলটি। ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থী দিলে নিশ্চয়ই ক্ষমতার দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের কাছে এভাবে নাকানিচুবানি খেতে হতো না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

ভোটাররা সিদ্ধান্তে অনড় by সাজেদুল হক

Friday, February 21, 2014

তারা ছিলেন একদিনের বাদশা। পাঁচ বছরে একবার ব্যালটের মাধ্যমে জানান দিতেন নিজেদের ক্ষমতার। ৫ই জানুয়ারি তাদের কাছ থেকে সে ক্ষমতাও কেড়ে নেয়া হয়।
দেশের মালিকরা দেখলেন তাদের কোন কিছু জিজ্ঞেস না করেই সরকার গঠন হয়ে গেছে। তবে আবারও সুযোগ পেয়ে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিলেন অসহায় জনগণ। যদিও এক সহযোগী দৈনিকের ভাষায়, এই হলো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। ক্ষমতার কেন্দ্রে এ নির্বাচন কোন পরিবর্তনই আনবে না। তবুও আপাত অসহায়, পর্যুদস্তু ভোটাররা প্রমাণ করলেন, তারা নিজ সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের পর যে বিএনপি-জামায়াত জোটকে রাজনীতি থেকে আউট মনে হচ্ছিল উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বে সে জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলায় জয়ী হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে- বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ৪২, আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা ৩৪, জামায়াত সমর্থকরা ১২, জাতীয় পার্টি সমর্থকরা একটি উপজেলায় জয়ী হয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত জোট একসঙ্গে ৫৪টি উপজেলায় জয়ী হয়েছে। উপজেলা নির্বাচন একটি বার্তা পরিষ্কার করেছে, সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকা বিএনপিই এখন তৃণমূলে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। ৫ সিটি করপোরেশনের পর ৪০টি জেলার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনেও এটা প্রমাণ হয়েছে সুযোগ পেলে মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে। বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে কমপক্ষে ১০টি জেলায় আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করেছে। নির্বাচনে সরকারি দলের সরকারি ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে আবারও। জাল ভোট, অস্ত্রবাজি আর কেন্দ্র দখলের ঘটনাও ঘটে। এ কারণে নয়টি উপজেলায় বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেন। শক্তির প্রদর্শনীর ঘটনা না ঘটলে বিএনপি আরও বেশি উপজেলায় জয়ী হতেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও এ বিজয় বিএনপির রাজনীতির জন্য অক্সিজেন নিয়ে আসবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ই তৃণমূলে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ। তৃণমূলই ছিল দলটির সবচেয়ে বড় ভরসা। কিন্তু একের পর এক স্থানীয় নির্বাচনে পরাজয় প্রমাণ করে সে ভরসা নড়বড়ে হয়ে এসেছে অনেকখানি। বৃহস্পতিবারের উপজেলা নির্বাচনে ৯৭টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৪টিতে জয় পেলেও ২০০৯ সালের এসব উপজেলার নির্বাচনে প্রায় দ্বিগুণ আসনে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এবারের উপজেলা নির্বাচন সবচেয়ে বিস্ময় নিয়ে এসেছে জামায়াতের জন্য। এ দলের ১২ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন, যা বিস্ময়করই বটে। কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার আর সহিংসতাকে ঘিরে দলটি পুরোমাত্রায় কোণঠাসা। সংসদ নির্বাচনের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ দলটির নেতারা প্রায় সবাই পলাতক। এ অবস্থাতেও তারা জয়ী হয়েছেন, যে জয় রাজনীতির মাঠে তাদের ফেরার উপকরণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। আর তৃণমূলের রাজনীতিতে জামায়াত যে ক্রমেই প্রবেশ করছে এ ফল তারই প্রমাণ। অন্যদিকে, এ নির্বাচন মৃত্যু বার্তা নিয়ে এসেছে জাতীয় পার্টির জন্য। সংসদে কথিত প্রধান বিরোধী দল উপজেলা নির্বাচনে মাত্র একটি উপজেলায় জয়ী হয়েছে। অথচ যেসব উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে এসব এলাকায় একসময় জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল। সংসদ নির্বাচনে প্রভাবশালী দল হিসেবে আবির্ভূত ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন উপজেলা নির্বাচনে কোথাও জয়ী হয়নি। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে তোলে। প্রায় তিন মাস আগে আপলোড করা আল-কায়েদা নেতা আল-জাওয়াহিরির একটি কথিত অডিও বার্তা বাংলাদেশে আলোচনায় আসে উপজেলা নির্বাচনের আগে। ওই বার্তায় বাংলাদেশীদের জিহাদে যোগ দেয়ার ডাক দেন তিনি। এ বার্তা নিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনের আগে আবার ফিরে আসে জঙ্গি কার্ড। তবে এ কার্ড কোন সফলতা নিয়ে আসেনি। বরং বুমেরাংই হয়েছে। সরব না থাকলেও হেফাজত সমর্থকরা নীরবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। উপজেলা নির্বাচনের ফল কমপক্ষে দু’টি জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। যদিও এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও দেয়া সম্ভব। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের দু’টি জরিপে পরিষ্কার করে নির্বাচনে বিএনপির বিপুল জয়ের কথা বলা হয়েছিল। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই)-এর এক জরিপে বলা হয়, এখন ভোট হলে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। যদিও এ জরিপে প্রায় ১৪ ভাগ উত্তরদাতা কাকে ভোট দেবেন তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তারাই নির্বাচনে তুরুপের তাস হবেন বলে মানবজমিনে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল। উপজেলা নির্বাচন তার সত্যতা প্রমাণ করে। দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের জরিপেও এখন নির্বাচন হলে কম ব্যবধানে আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখানেও ১৪ দশমিক ৫ ভাগ উত্তরদাতা বলেন, তারা এখনও সিদ্ধান্ত নেননি কাকে ভোট দেবেন। মূলত এ ভাসমান ভোটাররাই বাংলাদেশের নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করে থাকেন। বহু মতের ভীতিহীন চর্চাই গণতন্ত্র। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বুকাননের ভাষায়, মুক্ত মানুষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির সবচেয়ে ভাল মাধ্যম ব্যালট। বাংলাদেশে ব্যালটের পরিবর্তে চলছে নির্মূলের রাজনীতি। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন এ বার্তাই দিয়ে গেল আপনি চাইলেও ভিন্নমতকে গণতন্ত্রের ক্লাব থেকে মাইনাস করতে পারবেন না।

স্থানীয় সরকার- উপজেলা নির্বাচন ও ইসির করণীয় by তোফায়েল আহমেদ

Wednesday, February 19, 2014

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের নির্দেশনা (ধারা ৫৯) অনুযায়ী অত্যন্ত প্রাচীন ও কার্যকর ‘প্রশাসনিক একক’ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার গঠন ও কার্যকর করা একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এ বাধ্যবাধকতা জেলা ও বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। দাবি করার আগেই তফসিল ঘোষণা। এখনো জাতীয় রাজনীতির বেদনাদায়ক স্মৃতি সবাইকে তাড়িত করছে। বিশেষ করে, ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক নানামুখী সহিংসতায় চাপা পড়ে আছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিতর্কিত অনেক বিষয়। অতীতে সব সামরিক শাসক ‘বিরাজনীতিকরণ’-এর অন্যতম কৌশল হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনকে ব্যবহার করেছেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা সাময়িকভাবে মুখ রক্ষার মতো সফলতাও পেয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনের টোপ দিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা প্রশমনের সাময়িক দম নেওয়ার ফুরসত সৃষ্টি করেছেন। জেনারেল আইয়ুব, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ—সবাই একই কৌশল ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রয়োগ করেছেন।

এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয় সরকারগুলো কিছুটা ব্যতিক্রম। স্থানীয় সরকারকে নিয়ে তাদের রাজনীতির কৌশলটা কখনোই ‘বুদ্ধিদীপ্তভাবে রাজনৈতিক’  ছিল না। এবারেই প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীনেরা জাতীয় রাজনীতির দাবার ছকে স্থানীয় সরকারের একটি বাস্তব অবস্থান দেখতে পেয়েছেন। ক্ষমতাসীন মহাজোট দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন বর্জনকারী অপর জোটের রাজনীতি মোকাবিলায় এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে। তবে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে ‘সকল ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার’ তত্ত্বটি বোধ হয় এখানেও প্রযোজ্য। বিরোধী জোটও পাল্টা কৌশল হিসেবেই এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এতে এক-দেড় মাস আগের অংশগ্রহণবিহীন যে নির্বাচনী চিত্র, তা পুরোপুরি বদলে গিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশন আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে বিষয়টি গ্রহণ করলে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু স্থানীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

এ নির্বাচনের ইতিবাচকতা: এ নির্বাচন একদিকে জাতীয় রাজনীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল, ভোটের হার ও প্রার্থীসংখ্যার বিচারে এ নির্বাচন রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ নিয়ে আসতে পারে। অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের ধারাবাহিকতা এ নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পর পর দুবার উপজেলা পরিষদ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলে এ পরিষদের কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা আসবে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের সব দলের স্থানীয় নেতৃত্বে সাংগঠনিকভাবে নিজেদের সংহত করার সুযোগ নিচ্ছে, পাচ্ছে এবং এ প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা জাতীয় রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ গুণগত পরিবর্তনের প্রধান দিক হবে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন এবং এ পরিষদের ধারাবাহিকতা রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের প্রশিক্ষিত নেতৃত্ব সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। সে হিসাবে জাতীয় নেতৃত্বকাঠামোয় ইতিবাচক ও গঠনমূলক নেতৃত্বের বিকাশ সম্ভব হবে। ঢাকামুখী ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৃণমূল থেকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।

গ্রামগঞ্জে জোটের বাতাস এখন প্রবল। প্রার্থী-সমর্থকদের উৎসাহ বিপুল। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা গেলে এ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর অংশগ্রহণ ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলো গুম, খুন, ধরপাকড়ের অভিযোগ করেছে। সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সরব ও সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে চাইবে সবাই।

নির্বাচন কমিশন ও সরকার: ৪৮৭টি উপজেলার তিনটি পদের নির্বাচন পাঁচ-ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপে ৯৭টি উপজেলায় ১৯ ফেব্রুয়ারি, একটি উপজেলায় ২৪ ফেব্রুয়ারি; দ্বিতীয় ধাপে ১১৭টি উপজেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, তৃতীয় ধাপে ৮৩টি উপজেলায় ১৫ মার্চ এবং চতুর্থ ধাপে ৯২টি আসনে ২৩ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আরও দুই ধাপে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সব উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হবে। একাধিক ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর চাপটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। তাই আশা করা যায়, আচরণবিধি মেনে চলা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি কম। তবে সর্বোচ্চ সতর্কতার বিকল্প নেই। আশা করি, সরকার ও নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের করণীয় সম্পর্কে জাতি এখনো সন্দেহমুক্ত হতে পারছে না। নিচের কয়েকটি বিষয়ে তাদের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

১. সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ করার জন্য এ পর্যন্ত নেওয়া পদক্ষেপগুলো নিয়ে কমিশন সরব ও সক্রিয় নয়। তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর ওপর প্রচার-প্রচারণা, ক্যাম্পেইন ইত্যাদি চোখে পড়ছে না, যা তাদের করা উচিত।

২. নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও একক প্রার্থী নির্ধারণের জন্য রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য কোনো কোনো প্রার্থীকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার শামিল, যা সুস্পষ্টভাবে নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন উদ্যোগী হচ্ছে না।

৩. মন্ত্রী, সাংসদেরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলে সেটি আচরণবিধির লঙ্ঘন কি না, সে বিষয়েও বক্তব্য নেই। কারণ, তাঁরা ‘প্রটোকল’ নিয়ে ওসি, ইউএনওসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান ও বিচরণ করছেন।

৪. নির্বাচন কমিশন কানে তুলা ও পিঠে কুলা বেঁধে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামাগুলো বেমালুম হজম করে আছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য এখনো তারা ওয়েবসাইটে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়নি। ইতিমধ্যে দেরিতে হলেও উপজেলা পরিষদের তথ্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এ কাজটি আরও দ্রুততার সঙ্গে হওয়া উচিত। না করা হলে তা আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ভোটারের অধিকার হরণ হিসেবে গণ্য হবে।

৫. উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েল অনুযায়ী, প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত হলফনামার তিন কপি নির্বাচন কমিশনে জমা করা আবশ্যক। এর মধ্যে এক কপি নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে কপি করে নেওয়ার জন্য প্রদান করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রথম দফা নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা পেতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তাই প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয় ও সম্পদের তুলনামূলক চিত্র প্রস্তুত করে সময়মতো ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। শুধু সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা নয়, তথ্যভিত্তিক ভোটার ক্ষমতায়নেও নির্বাচন কমিশনকে নেতৃত্ব দিতে হবে।

৬. নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট যেকোনো তথ্য ভোটারদের সময়মতো না পৌঁছানো তথ্য অধিকার আইনেরও লঙ্ঘন। এ বিষয়ে জাতীয় তথ্য অধিকারবিষয়ক কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ আশা করি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ নাগরিক সমাজ আশা করতে পারে।

ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।

নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- আওয়ামী লীগের মেজবান ও র‌্যাবের নতুন গল্প by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

Tuesday, February 18, 2014

লালদীঘির ময়দানে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিলেন, সন্ত্রাস-সহিংসতা-সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাতকানিয়া অভিমুখে লংমার্চ করবে আওয়ামী লীগ।
শুনে মনে হয়েছিল, এটা নেহাত পলিটিক্যাল স্টান্ট। কিন্তু সত্যি যেদিন (৮ ফেব্রুয়ারি) তাঁর নেতৃত্বে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমন্বয় পরিষদ’-এর ব্যানারে সাতকানিয়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করল কয়েক শ গাড়ির বহর, সেদিন একধরনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছে চট্টগ্রামের মানুষ। যদিও দক্ষিণ জেলা জামায়াতের নেতারা পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘লংমার্চে যাঁরা আসবেন, তাঁরা আমাদের মেহমান। আমরা তাঁদের স্বাগত জানাব। এ ছাড়া আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই।’

কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে আশ্বস্ত হতে পারেনি। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার দিন থেকে শুরু হয়ে গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে সাতকানিয়ায় যে ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় তাণ্ডব শুরু হয়। ওই সময় থেকে এযাবৎ এই অঞ্চলে খুনই হয়েছে নয়জন। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা-লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, শত শত গাছ কেটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক অবরোধ, বিদেশি পর্যটকের ওপর হামলা, পুলিশ-বিজিবির ক্যাম্প ঘেরাও করে বোমা নিক্ষেপসহ হেন কোনো দুষ্কর্ম নেই, যা এখানে সংঘটিত হয়নি। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যৌথ বাহিনীর অভিযানে সাতক্ষীরা, সীতাকুণ্ডের মতো গোলযোগপ্রবণ এলাকাগুলো অনেকটা শান্ত হয়ে এলেও সাতকানিয়ার জামায়াত কর্মীরা ছিলেন সক্রিয় ও আক্রমণাত্মক। সুতরাং দক্ষিণ জেলা জামায়াতের নেতারা যতই আশ্বাসবাণী প্রচার করুন যে লংমার্চের যাত্রীরা তাঁদের মেহমান, তাঁদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত তাঁরা, তাতে আশ্বস্ত হতে পারেনি এ অঞ্চলের মানুষ। বরং ‘স্বাগত’ জানানোর ধরনটি কী রকম হতে পারে, এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান হয়নি তখনো।
যা-ই হোক, মহিউদ্দিন চৌধুরীর লংমার্চের ঘোষণা যে জনমনে শঙ্কার সৃষ্টি করেছিল, তার বাস্তব ভিত্তি নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। অবশেষে যাবতীয় শঙ্কার অবসান ঘটেছে ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন নগর থেকে যাত্রা শুরু করে লংমার্চ পটিয়া ও দোহাজারীতে দুটি পথসভা করে সাতকানিয়ার কেরানীহাটে নির্ধারিত জনসভাস্থলে গিয়ে পৌঁছে বিকেলে। সেখানে নির্বিঘ্নে জনসভা সম্পন্ন করে লংমার্চ নগরে ফিরে আসে রাতে।
‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমন্বয় পরিষদ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এই লংমার্চ মূলত আওয়ামী লীগেরই একটি কর্মসূচি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই লংমার্চ থেকে কী পেল আওয়ামী লীগ?
সুদূরপ্রসারী লাভ-ক্ষতির হিসাবে না গিয়েও এ কথা বলা যায়, এই লংমার্চ দলীয় নেতা-কর্মীদের চাঙা করেছে। সর্বোপরি সাতকানিয়াকে জামায়াতের দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ প্রচারিত ছিল, সেই মিথকেও ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কেরানীহাটের জনসভায় মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা শান্তির বাণী নিয়ে এসেছি।’ তিনি জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘সাতকানিয়াবাসী বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। আপনারাও ব্যবসা করেন, লেখাপড়া করেন। কিন্তু সহিংসতা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ থেকে বিরত থাকুন।’ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, এই সহজ বক্তব্যের মধ্যে একধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি আছে। সাতকানিয়া জামায়াত-শিবির কর্মীরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নন, তাঁদেরও ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়ার জন্য অন্যত্র যেতে হয়, এ কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি প্রকারান্তরে সহিংসতার দায়ে অন্যত্র তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন বার্তাও দিয়ে রেখেছেন বলে মনে করেন মহিউদ্দিনের ঘনিষ্ঠজনেরা।
আপাতত শান্তিপূর্ণভাবে লংমার্চ শেষ করতে পেরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উদ্দীপ্ত। সেই উদ্দীপনাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যই কি না জানি না, সাতকানিয়া-লোহাগাড়াবাসীর জন্য এবার মেজবানের আয়োজন করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে এই মেজবান অনুষ্ঠিত হবে। সাংসদ ও শিল্পী মমতাজ এ অনুষ্ঠানে গান গাইতে আসবেন বলেও জানা গেছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার মানুষের সঙ্গে একটা দিন আমরা অন্যভাবে কাটাতে চাই। আমরা সাতকানিয়ার মানুষকে আস্থায় নিতে চাই, উদ্বুদ্ধ করতে চাই। যেন সহিংসতাকে সবাই রুখে দাঁড়ায়।’
চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী আপ্যায়নের প্রথা ‘মেজবান’। সহিংসতার বিরুদ্ধে এই ঐতিহ্যের ধারা কতটা কার্যকর হয়ে ওঠে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
র‌্যাবের নতুন গল্প
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও মানবাধিকারকর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যতই সোচ্চার হোন না কেন, সাধারণ মানুষের মনে এ নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। একসময় ‘ক্রসফায়ার’ ও সাম্প্রতিককালে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শিরোনামে যে গল্পগুলো র‌্যাব-পুলিশের বরাত দিয়ে প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে, তার অধিকাংশই যে বানানো, এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই দেশবাসীর। তবে ‘সন্ত্রাসী দমনে’র এই পদ্ধতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হয়তো উন্নতি হচ্ছে, এমন একটি আপাতস্বস্তিকর ধারণা থেকে ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ তা-ই পেয়ে আসছে র‌্যাব-পুলিশ। কিন্তু পুরো বিষয়টা যে ক্রমেই বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
র‌্যাব বন্দুকযুদ্ধের একই গল্প পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে, এমন অভিযোগ উঠেছে সংবাদমাধ্যমগুলোয়। সেই বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে কি না জানি না, চট্টগ্রামে সম্প্রতি নতুন একটি গল্পের অবতারণা করেছে তারা।
১১ ফেব্রুয়ারি সকালে অফিসে যাওয়ার পথে মৃদুল চৌধুরী নামের একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে র‌্যাবের সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেছে তাঁর পরিবারের লোকজন। পরিবারের অভিযোগ, র‌্যাবের বিরুদ্ধে একটি মামলা করার কারণেই এই পরিণতি হয়েছে তাঁর।
অপহূত মৃদুলের ভাই জানান, গত বছরের ৩ অক্টোবর র‌্যাব-২-এর মেজর রকিবুল আমিন এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৮০ ভরি স্বর্ণ কেড়ে নেন। এ ঘটনায় মৃদুল চৌধুরী ঢাকার মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে মামলা করেন রকিবুল আমিন, র‌্যাবের সোর্স ফাহাদ চৌধুরী ও গাড়িচালক বাবুল পালের বিরুদ্ধে।
মেজর রকিবুল আমিন যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং মৃদুল চৌধুরীকে তিনি চেনেন না বলেও জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম থেকে বিপুল চোরাই তেল উদ্ধার করেছে র‌্যাব। সেই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেজর রকিবুল আমিন। এর পর থেকেই একটি চক্র তাঁর পেছনে লেগে আছে। সোনা কেড়ে নেওয়া ও ব্যবসায়ী অপহরণের ঘটনাটি সাজানো বলে তিনি জানান।
গল্পটি নতুন। এখন অপহরণের ঘটনাটি ‘সাজানো’ নাকি র‌্যাবের গল্পটি ‘বানানো’—এটি প্রমাণের দায় র‌্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বর্তায় না?
অপহূত হওয়ার ছয় দিন পর গতকাল সোমবার ভোরে কুমিল্লার কংসনগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে। জীবন ফিরে পেয়েছেন তিনি; তবে স্বর্ণ ফিরে পাবেন কি না, জানি না। এ ব্যাপারটি এখানেই শেষ হলে প্রকৃত রহস্যের জট কিন্তু খুলবে না।


বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

ফখরুলের উদ্দেশে হানিফ- ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না

আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির অডিও বার্তার সঙ্গে বিএনপিসহ যাঁদের সম্পর্ক পাওয়া যাবে, তাদের বিচার হবে বলে হুঁশিয়ার করলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

‘যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করেত আওয়ামী লীগ আল-কায়েদার সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছে’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে হানিফ বলেন, ‘আপনার কথা শুনে মনে হয় ‘‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’’। অস্বীকার করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। জঙ্গিদের রাষ্ট্রীয় মদদ দিয়েছেন এটা প্রমাণিত। আপনার দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন আপনার দলের বড় নেতা দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে দুবাইয়ে বৈঠক করেছেন। মুফতি ইজহারুলকে আপনারাই প্রশ্রয় দিয়েছেন। গ্রেনেড হামলা হয়েছে। তাই শুধু জঙ্গিদের বিচার করা হবে না, এর সঙ্গে যারই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিচার করা হবে।’

সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘কয়েক দিন আগে বিএনপির নেতারা যেভাবে লাদেনের মতো ভিডিওবার্তা পাঠিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উত্সাহিত করতেন; ঠিক সেভাবে আয়মান আল জাওয়াহিরি একটি অডিও বার্তা দিয়েছেন। এর সত্য-মিথ্যা এখনো অনুসন্ধান করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এ কথা ভাবার অবকাশ নেই যে বাংলাদেশে আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক নেই। মুফতি ইজহারুল আফগানিস্তান থেকে ফিরে এসে লিখলেন ‘ঘুরে এলাম স্বপ্নের আফগানিস্তান’। সুতরাং তাঁদের মতো অনেকেই এ দেশে থাকতে পারে।


হানিফের দাবি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনবার জাওয়াহিরি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে বলে তিনি জানান। তিনি দাবি করেন, ‘শুধু জামায়াতই জঙ্গিবাদের মদদ দেয়নি; বিএনপিও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। বিএনপির সঙ্গে সন্ত্রাসের যোগসূত্র নতুন নয়। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্যই তাদের এই জঙ্গি কানেকশন। তবে আল-কায়েদা ও লস্কর-ই-তৈয়বা যে হুমকি দিক না কেন, বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের চারণভূমি হতে দেওয়া হবে না। জঙ্গিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা হবে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইতিহাস সংরক্ষণ প্রকল্প আয়োজিত অনুষ্ঠানে ১৩ জনকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বদরুল আলম স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য নাজু, সাহসিকতার জন্য ঝর্ণা বেগম, তাজুল ইসলাম, কিশোর বেলাল, সেবায় জয়নাল আবেদিন, ভাষাসৈনিক আফজালুন্নেসা, ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ, ডা. সাঈদ হায়দার, ড. আহমদ রফিক, বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ডা. চৌধুরী হাফিজুল আহসান, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, রাফিদ আহমেদ ও জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুকে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয়।
বিশিষ্ট চিকিত্সক মির্জা মাজহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী।

ভারতের নির্বাচন- কংগ্রেস, বিজেপি না তৃতীয় জোট? by এম সাখাওয়াত হোসেন

Saturday, February 15, 2014

প্রায় দুই সপ্তাহ ভারতের দক্ষিণের তিনটি রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং আমাদের পশ্চিম সীমান্তের রাজ্য পশ্চিম বাংলায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। নিছক বেড়ানো হলেও চেষ্টা করেছিলাম ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনের হালহকিকত বুঝতে।
কারণ, ভারতের রাজনীতি এখন সরগরম, বিশেষ করে আসন্ন ১৬তম লোকসভার নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে। যদিও ভারতের রাজনৈতিক উত্তাপ এবং আসন্ন নির্বাচনের হাওয়া বড় বড় শহর ছাড়া তেমন উপলব্ধি করা যায় না, তথাপি ছোট শহরগুলোর দেয়াল আর লাইটপোস্টগুলোতে সাঁটানো এবং ঝুলন্ত পোস্টারগুলো মনে করিয়ে দেয় যে নির্বাচন আসন্ন। দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি একেবারেই নেই। এমনকি ভোটারদের মধ্যেও আগ্রহ কম। বিগত কয়েক দশকে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে গড় ভোটের হার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। প্রধান কারণ, ভারতের সাধারণ ভোটারদের কাছে দুই বৃহৎ জোট আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে।

অনেকেই মনে করেন, এ কারণেই দিল্লির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ‘আম আদমি পার্টির মতো স্বল্পপরিচিত দল রাজ্য সরকার গঠন করতে পেরেছে। ‘আম আদমি পার্টিও (এএপি) তাদের সাফল্যের বিস্তৃতি ঘটাতে তৎপর। অপরদিকে হঠাৎ গর্জে ওঠা এই পার্টির বিস্তার ঠেকাতে উভয় জোট নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে বলে এএপি অভিযোগ তুলছে। এপিপির অভিযোগে বলা হচ্ছে যে বিজেপি দিল্লি সরকারকে উৎখাত করতে প্রায় ২০ কোটি রুপি খরচ করছে। শুধু এএপিই নয়, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার নেতৃত্বে সম্ভাব্য তৃতীয় জোট গঠনের আগেই বিজেপি বিরোধিতায় নেমেছে। তৃতীয় জোট গঠনে দক্ষিণের আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দল এআইএডিএমকে ঘিরে সম্ভাবনা গড়ে উঠছে কংগ্রেস এবং বিজেপি বিরোধী জোটের। এ জোটে হয়তোবা শামিল হতে পারে উত্তর প্রদেশের শাসক দল বহুজন সমাজ পার্টি। অপরদিকে পশ্চিম বাংলার তৃণমূল কংগ্রেসের দিকেও নজর রয়েছে সম্ভাব্য এই জোটের। তবে এই জোট নির্বাচন-পূর্ব, না পরবর্তী সময় গঠিত হবে, তা নিয়ে দক্ষিণের দলগুলোর মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। যদিও বহুজন সমাজ পার্টি নেতা মুলায়ম সিং এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেতা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো পক্ষেই প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য এখন পর্যন্ত দেননি। এই জোটের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হতে পারেন জয়ললিতা, সে ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মুলায়ম সিং যাদব কতখানি উৎসাহ দেখাবেন, তা দেখার বিষয়। এই জোট যদি নির্বাচন-পূর্ব সময় গড়ে ওঠে, তা দুই বৃহৎ জোটের বৃহৎ শরিক বিজেপি ও কংগ্রেসের জন্য কত বড় চ্যালেঞ্জ হবে, তা হয়তো মাস খানেকের মাথায় দৃশ্যমান হবে।

দুই
আসন্ন নির্বাচন আগামী মে মাসে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে বৃহৎ দলগুলো এপ্রিল মাসে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছে। এ বিষয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশন মতামত দেয়নি। অঙ্কের হিসাবে আগামী লোকসভা নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। ক্রমেই আগাম নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বেশ কিছুদিন থেকে মাঠে গড়িয়েছে বিভিন্ন রাজ্য ও শহরগুলোতে দুই বড় দল তথা জোটের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীদের বিশাল বিশাল জনসভার মাধ্যমে। এতে অগ্রগামী রয়েছেন বিজেপির নেতা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী, যদিও রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী কি না, তা নিয়ে খোদ কংগ্রেসের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে। অপরদিকে বিজেপির তথা জোটের প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদির সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। যতটুকু দৃশ্যমান তাতে মনে হয়, এযাবৎ বিজেপির পাল্লাই বেশ ভারী।
যদিও ১৯৯৪ সালে ভারতের গুজরাটের দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসের অভিযোগের ও প্রচারণার জবাবে পুনর্জীবিত হয় ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর ১৯৮৪ সালে শিখ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পৃক্ততার অভিযোগ। ১৯৮৪ সালে সবচেয়ে বড় দাঙ্গা হয় দিল্লির রাজনগরে। আগামী নির্বাচনে ওই দাঙ্গার বিষয়টি বেশ বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়াতে এই দাঙ্গা নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। এ বিতর্ক কংগ্রেসকে ক্রমেই কোণঠাসা করছে। এই বিতর্কে যোগ দিয়েছে দিল্লির এএপি সরকার। ইতিমধ্যে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং কেবিনেট ১৯৮৪ সালের দাঙ্গার ওপরে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) গঠনের সিদ্ধান্ত দিল্লির লে. গভর্নরের কাছে সুপারিশ আকারে পাঠিয়েছে। লে. গভর্নরের অনুমোদনের পর প্রায় এক বছর লাগবে তদন্ত সমাপ্তির। বিষয়টি এএপি এবং কংগ্রেসের মধ্যে দূরত্বের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিজেপি শুধু পালে হাওয়া দেওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। প্রসঙ্গত দাঙ্গা ঘটার ৩০ বছর পার হলেও বিচার হয়নি।
শুধু ১৯৮৪ সালের দাঙ্গাই নয়, কংগ্রেসকে নিয়ে নতুন করে বিতর্ক হচ্ছে ১৯৮৪ সালের ৩ থেকে ৮ জুন অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির অভিযান ‘অপারেশন ব্লুস্টার’-এ অত্যধিক শক্তি ব্যবহারে ব্যাপক প্রাণহানি এবং ওই সামরিক অভিযানে ব্রিটেনের সম্পৃক্ততা নিয়েও স্মরণযোগ্য যে, ওই অভিযানের জের হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শিখ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হন। ব্রিটেন অবশ্য সক্রিয় সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে শুধু পরামর্শের কথা বলে জানিয়েছে যে ভারত ব্রিটেনের পরামর্শ গ্রহণ না করে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল। বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনার আশা রাখি। এসব বিতর্ক কংগ্রেসকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেছে। তার ওপরে রয়েছে বিগত ১০ বছরের দুর্নীতি আর অব্যবস্থার। বিজেপি এসব বিষয়কেই তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অনেকেই মনে করেন।

তিন
বিজেপি এবার বেশ চাঙা অবস্থাতেই রয়েছে বলে মনে হয়। এরই প্রেক্ষাপটে নরেন্দ্র মোদি ক্রমেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। নরেন্দ্র মোদি এখন বিজেপির সম্মুখ সিপাহসালার, যে কারণে মোদি সারা ভারত চষে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন রাজ্যের সমর্থন আদায়ের প্রয়াসে। নজর রয়েছে উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিম বাংলার দিকে। বিজেপির টার্গেট ২৭২ আসন অথবা ততধিক যে অঙ্কটি এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না, আগামী নির্বাচনে ভারতের কেন্দ্রে একক দল হিসেবে কোনো দল সরকার গঠনের মতো সমর্থন পাবে। সে কারণেই কংগ্রেস ও বিজেপিকে আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। এ কারণেই বিজেপির টার্গেট অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে লোকসভার ৪৪ আসনের পশ্চিম বাংলার দিকে।
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের আগাম প্রচারণা হিসেবে কলকাতায় এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। বিভিন্ন মিডিয়া এবং তথ্য অনুযায়ী কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে বিজেপির জনসভায় প্রায় ১ দশমিক ৫ লাখ (এক লাখ পঞ্চাশ হাজার) লোকের সমাগম ঘটে। ওই জনসভায় মোদি বামপন্থীদের ৩৪ বছরের শাসনের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, উন্নয়নধারাকে আরও জোরদার করতে হলে কেন্দ্রে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বাংলা-দরদি লোকের প্রয়োজন। ওই সভায় মোদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করেননি, যদিও এর আগে একই স্থানে অন্য এক জনসভায় মমতা মোদিকে ইশারা করে বলেছিলেন যে তিনি দিল্লিতে ‘দাঙ্গার মুখ’ দেখতে চাইবেন না। তথাপি মমতা মোদির ভাষণের প্রতিবাদ করেননি। মোদি তাঁর ভাষণে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিম বাংলাকে অবহেলা করার অভিযোগ বারবার উত্থাপন করেন। এমনও অভিযোগ করেন যে বাংলার সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদকেও কংগ্রেস উপেক্ষা করেছে। তিনি বলেন যে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেসের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা থাকলেও ‘দাদা’কে ওই পদ না দিয়ে বাংলার প্রতি একধরনের অন্যায় করেছে। মোদি কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে পারলে মমতাকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করে বাংলার চেহারা পাল্টানোর অঙ্গীকার ওই সভায় একাধিকবার করেছেন। এত তুষ্টির পরও তৃণমূল অথবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
অপরদিকে বিগত বাম সরকারের কঠোর সমালোচনা করাতে সিপিএম সহজে মোদিকে গ্রহণ করছে না। সিপিএমের মতে, মোদি-মমতার কোনো ধরনের সমঝোতা হলে তাতে মমতার ক্ষতিই হবে। কারণ পশ্চিম বাংলায় প্রায় ২৪ শতাংশ ভোট রয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিমদের। মোদির ‘দাঙ্গা মুখ’ ওই ভোটারদের মমতাবিমুখ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিপিএম মমতার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া উঠতে পারে। অবশ্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিল্লির সমীকরণে এক বড় ফ্যাক্টর, তা সব জোট বা ভারতের বড় দলগুলোর ধর্তব্যের মধ্যে রয়েছে। বাংলায় মোদির গ্রহণযোগ্যতা এবং মমতা-মোদি নির্বাচন-পূর্ব বা পরবর্তী সমীকরণ কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠনের জন্য এক বড় ফ্যাক্টর হয়ে থাকবে। আর যদি তৃতীয় জোট গঠিত হয় সেখানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠবেন অপরিহার্য। যেভাবেই হোক, পশ্চিম বাংলার তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী সরকার গঠনে বড় ফ্যাক্টর। তাই, মমতা রয়েছেন ফুরফুরে মেজাজে।

চার
ভারতের আসন্ন লোকসভার নির্বাচন যে কংগ্রেস ও বিজেপির কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার আলামত বিভিন্নভাবে প্রতীয়মান। তবে ওই নির্বাচনে কংগ্রেসের তথা শাসক জোটের অবস্থা যে তেমন ভালো নয়, তা বেশ দৃশ্যমান। এককভাবে না হলেও বিজেপি জোটবদ্ধভাবে ভারতের পরবর্তী শাসক জোট হতে যাচ্ছে, তেমনটাই প্রতীয়মান। নরেন্দ্র মোদিই যে ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন না অনেকেই। মোদি তাই তাঁর অতীত ছবি পরিবর্তনে সংখ্যালঘুদের ভোট অর্জনের সব চেষ্টা করেছেন। ব্রিগেড ময়দানের ভাষণে মোদি তথাকথিত অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ভারত থেকে বিতাড়িত করবেন বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা অবশ্যই আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়।
মোদির এ দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানে যে পরিবর্তন হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
শুধু এ কারণেই নয়, বহুবিধ কারণে বাংলাদেশের কাছে ভারতের আগামী নির্বাচন যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে।

এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

কালের পুরাণ- বিএনপিকে মাঠে নামাতে মন্ত্রীদের উসকানি! by সোহরাব হাসান

কূটনীতিকেরা বিএনপিকে দুই বছরের মধ্যে আন্দোলন না করার পরামর্শ দিয়েছেন বলে গতকাল একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ খবরের সত্যাসত্য সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই।
তবে বিএনপির নেতাদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা দুই বছর না হলেও আন্দোলনের জন্য সরকারকে কিছুটা সময় দিতে চান। এর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের আগে দল গোছানোর কথা বলেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি এ কথাও জানিয়ে দেন যে তাঁরা খুব বেশি দিন অপেক্ষা করবেন না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের ভেতরেও যে আন্দোলনে নামা না-নামা নিয়ে চাপান-উতোর চলছে, নানা সূত্রে তারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু এক মাস বয়সী সরকারের কতিপয় মন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলটিই চাইছে না বিএনপি বেশি দিন আন্দোলনের বাইরে থাকুক। মাঠ গরম না হলে এই শেষ শীতের দিনে তাঁদের ভালো লাগে না।
গত বৃহস্পতিবার শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ কেন নিচ্ছে, সে জন্য বিএনপির কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন। এ নিয়ে মন্ত্রীর আত্মশ্লাঘার কিছু নেই। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণেই তো আমির হোসেনের মতো আরও অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার তৃতীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে যিনি প্রথমে মন্ত্রীই হতে পারেননি। কেননা, তিনি বিএনপির একজন নবীন নেতার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পরে টেকনোক্র্যাট কোটায় খাদ্যমন্ত্রী হন এবং উপনির্বাচনে ইলেন ভুট্টোকে হারিয়ে সাংসদ হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার ইলেন ভুট্টোই নির্বাচিত হন। হেরে যান আমির হোসেন আমু।
সে ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে না আসায় তাঁর অন্তত সুবিধাই হয়েছে। বিএনপির কাছে কৈফিয়ত না চেয়ে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারতেন।
আর নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করে থাকলে সে জন্য জনগণ তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইবে। এখন যদি বিএনপি ভুল বুঝতে পেরে উপজেলা নির্বাচনে শরিক হয়েও থাকে, সে জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে কেন?
আমির হোসেন আমুরা যেহেতু নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মনে করেন, তাঁদেরই উচিত জনগণের কাছে কৈফিয়ত দেওয়া। এক মাসের বেশি সময় হলো, তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। এই সময়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ে কী কাজ হয়েছে, সেটি জানার অধিকার দেশবাসীর আছে। এত দিন সব দুর্গতির জন্য তাঁরা বিরোধী দলের সংঘাত-সংঘর্ষ, হরতাল-অবরোধের অজুহাত দিতেন। এখন তো সেসব নই। তাহলে কেন শিল্পকারখানায় উৎপাদন বাড়ছে না? কেন কারখানাগুলোতে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না? কেন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলোর লোকসান বাড়ছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমির হোসেন আমু শিল্পবহির্ভূত বিষয় নিয়ে কথাবার্তাই বেশি বলছেন।
আরেক মন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন একই দিন ফরিদপুরে ছাত্রলীগের কর্মী সম্মেলনে বিএনপির উদ্দেশে বলেছেন, তাদের আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তাঁর এ কথাটি পত্রিকায় পড়ে দুই দশক আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য মনে পড়ে। সে সময় বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন চলছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন, বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে ছাত্রদলই যথেষ্ট। আমাদের দেশে ক্ষমতা বদলায়, দল বদলায়, ক্ষমতাবানদের চরিত্র বদল হয় না।
কঠিন সত্য হলো, খালেদা জিয়ার ছাত্রদল বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা করতে পারেনি। তাঁকে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের দাবি মেনে নিতে হয়েছিল। আর এখন তো বিরোধী দল আন্দোলনই করছে না। সংসদের ভেতরে যাঁরা বিরোধী দলের আসনে বসেছেন, তাঁরা নিষ্ক্রিয়, নির্জীব। একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলেও আছেন। দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন না করেও সাংসদ হয়েছেন, বিশেষ দূত হয়েছেন। রওশন এরশাদ নির্বাচন করে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন। তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ এখন সংসদেও গড়িয়েছে। রঙ্গভরা বঙ্গদেশে আরও কত কিছু দেখতে হবে।
আর সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি ভোটে পরাজিত না হলেও রাজনৈতিক কৌশলে পরাজিত হয়ে এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। কর্মীদের অভিযোগ, নেতাদের কারণে আন্দোলন সফল হয়নি। এই অবস্থায় বিএনপির নেতারা যখন শিগগিরই আন্দোলনের চিন্তা করছেন না, তখন মন্ত্রীদের উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতির কী যুক্তি থাকতে পারে?
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। দেশে আন্দোলন নেই, হরতাল-অবরোধ নেই এটি সম্ভবত মন্ত্রীদের ভালো লাগছে না। এ কারণেই কি মন্ত্রীরা উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন? তবে গত মন্ত্রিসভার সদস্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে নব্য মন্ত্রীদের শিক্ষা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। সেই মন্ত্রিসভায় যাঁরা বড় বড় কথা বলতেন, তাঁদের অনেকেই এখন মন্ত্রিসভার বাইরে। পাঁচ বছর তাঁরা বিএনপি তথা বিরোধী দলকে গালমন্দ করে নিজেদের সফল মন্ত্রী হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। দিনের শেষে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। কেননা, শেষ বিচারে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার দায় শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।
বর্তমানে বিএনপি নাজুক অবস্থায় আছে, মানি। এর অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগ খুব ভালো অবস্থায় আছে। বিএনপি নির্বাচন করেনি, তাই সংসদে বা সরকারে তার কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, ভালোমন্দের দায়ও তাদের নিতে হবে। কে কীভাবে নেন সেটাই দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে মন্ত্রী পদমর্যাদার চিফ হুইফ সাহেব এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। দলের নেতা-কর্মীদের কাছে ক্রেস্ট না দিয়ে ক্যাশ নিয়ে আসার জন্য হুকুম দিয়েছেন। বিগত সরকারের ক্যাশ আদায়কারীরা এখন দুদকের সন্দেহ ও তদন্তের আওতায়।
আমরা জানি না, উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মন্ত্রীরা বিরোধী দলকে মাঠে নামাতে চাইছেন কেন? দেশে শান্তি আছে, এটি তাঁদের পছন্দ নয়? আবার কি মন্ত্রীরা ৫ জানুয়ারির আগের অবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে নিতে চান?
শেখ হাসিনার তৃতীয় সরকারের মেয়াদ মাত্র এক মাস কয়েক দিন। এই কয়েক দিনে নিশ্চয়ই সরকার টের পেয়েছে, বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কৌশলে হারানো যত সহজ, দেশ চালানো তত সহজ নয়। এই এক মাস সময়ের মধ্যেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, এই এক মাস সময়ের মধ্যেই দাম না পেয়ে কৃষকেরা আলু রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। এই সময়ের মধ্যেই জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি-সুবিধা সহজে ফিরিয়ে দিচ্ছে না।
প্রায় প্রতিদিনই সরকারপ্রধানকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি সাধ্যমতো সেগুলো সমাধানেরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ মন্ত্রীই সম্ভবত সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আর সে কারণেই বিরোধী দলকে রাজপথে নিয়ে আসার জন্য উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। এটি থামানো প্রয়োজন।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

চাচার পাঁচালি- নব্য গণতন্ত্র by মাহবুব তালুকদার

চাচা বললেন, ছাত্রলীগের মিডিয়া কানেকশন বিশেষ ভালো নয়। সে কারণে বারবার 
তাদের খেসারত দিতে হচ্ছে।
আমি বললাম, এ কথার অর্থ কী?
অর্থ খুব সোজা। মিডিয়া ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
মিডিয়া তো রিপোর্ট করা ছাড়া আর কিছুই করছে না।
সেটাই বলতে চাচ্ছি। সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতার পিস্তল হাতে ছবি ছাপা হয়েছে। এ রকম একপেশে রিপোর্ট বা ছবি ছাপার নাম কী সাংবাদিকতা?
কিন্তু একপেশে রিপোর্ট হলো কীভাবে?
আরে ভাই! জামায়াতে ইসলামীর ক্যাডাররা যখন প্লাস্টিক বোমা ছোড়ে, তাদের কী কোনো ছবি আজ পর্যন্ত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে? হয়নি। অথচ ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা যখন আত্মরক্ষার্থে পিস্তল হাতে নেয়, ফলাও করে সেটা ছাপা হয়, যা দুরভিসন্ধিমূলক।
চাচা কোনো বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে গেলে আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করেন। এটা নতুন কিছু নয়। আমি বললাম, ক’দিন আগে জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী সেলিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিবির রগ কাটে, ছাত্রলীগ কবজি কাটে, মাথা কাটে।’ এ কথার জবাবে ছাত্রলীগ লিখিতভাবে প্রতিবাদলিপিতে জানিয়েছে, হাজী সেলিম একজন ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ লোক। কিন্তু এটা কী হাজি সেলিমের কথার জবাব হলো?
ঠিকই বলেছে ওরা। চাচা জানালেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা যেহেতু ছাত্র, সেহেতু তাদের চোখে ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ হাজী সেলিমের অপরাধ হচ্ছে ‘শিক্ষিত’ ও ‘বিদ্বান’ ছাত্রদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুখ খোলা। সংসদ সদস্য হয়েছেন বলে সংসদে দাঁড়িয়ে সমাজের শিক্ষিত অংশের বিরুদ্ধে গায়ে পড়ে মন্তব্য করা হাজী সেলিমের উচিত হয়নি। ছাত্রশিবির আর ছাত্রলীগ কি এক বিষয় হলো যে তাদের তুলনা করা হবে? ‘অশিক্ষিত’ আর ‘মূর্খ’ না হলে হাজী সেলিম এটা করতে পারতেন না।
আমি বললাম, চাচা! ছাত্রলীগ সম্পর্কে আরো অভিযোগ আছে। ক’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল থেকে ৯৭ জন শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ নেতারা বের করে দিয়েছে। ওই ৯৭ ছাত্রের অপরাধ হলো তাদের কাছে স্থানীয় ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রত্যয়নপত্র নেই। তাদেরকে জানানো হয়েছে, তারা শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না এবং ছাত্রলীগ করত- এ রকম প্রত্যয়নপত্র যার যার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে আনতে হবে। এটা কেমন কথা?
কী আশ্চর্য! এতে অভিযোগের কী আছে? চাচা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ছাত্রলীগ স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি যাতে আসন পেতে ঘাঁটি বানাতে না পারে, তা দেখা নিশ্চয়ই অন্যায় কিছু নয়। তাতে প্রয়োজনে ৯৭ জন কেন, ৯৭০ জনকে হলে থাকতে না দেয়ার অধিকার ছাত্রলীগের রয়েছে।
কিন্তু ছাত্রলীগ তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। হলে স্থান পেতে ছাত্রদের যার যার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতার প্রত্যয়নপত্রইবা আনতে হবে কেন?
তুমি ব্যাপারটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছ কেন? ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাহায্য করছে বলেই তাদের এটা করতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এককভাবে আবাসন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না বলেই ছাত্রলীগ এ ব্যাপার হ্যান্ডেল করছে। ওরা যদি অন্যায় কিছু করত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাতে বাধা দিতো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি কিছু বলেছে?
না। তারা তো ছাত্রলীগের পক্ষে।
তাহলেই বুঝতে পার, ছাত্রলীগ কোনো অন্যায় করছে না। তুমিও দেখছি হাজী সেলিম হয়ে গেলে।
চাচার কথায় আমি রীতিমতো বিচলিতবোধ করলাম। হাজী সেলিম ঢাকার একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হননি। আওয়ামী লীগের আরেক প্রখ্যাত নেতা ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনকে নির্বাচনে পরাজিত করে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। ভবিষ্যতে তিনি মন্ত্রীও হতে পারেন। যদি তাই হয়, তাহলে তিনি হবেন ছাত্রলীগের ভাষায় দেশের প্রথম ‘অশিক্ষিত’ ও ‘মূর্খ’ মন্ত্রী। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে যা বলেছেন, আমি তা সমর্থন করিনি। তাহলে আমি তার সঙ্গে তুলনীয় হলাম কী করে?
আমি প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘোষণা করেছেন, আগামী ২০১৯ সালের ২৮শে জানুয়ারির পূর্বে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মেয়াদ শেষে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এটা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার প্রমাণ। চাচা বললেন, বিএনপি যাতে এ সময়ের মধ্যে নিজেদের তৈরি করে নিতে পারে, এজন্যই সৈয়দ আশরাফ সময়টি অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছেন।
চাচা! নির্বাচন কী বিগত নির্বাচনের মতোই হবে?
অবশ্যই। চাচা বললেন, দু-একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশ আমাদের নির্বাচন মেনে নিয়েছে। সবাই বর্তমান নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তাছাড়া, বাংলাদেশের বিগত নির্বাচন একটা মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ মডেলটিকে গ্রহণ করবে। সুতরাং, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রক্ষা করে একই পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু এটা তো বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন!
কেন? জাতীয় সংসদে বিরোধী দল তো আছে। বেগম রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা।
উনি কি সত্যি বিরোধীদলীয় নেতা?
তোমার এসব অহেতুক প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না। বেগম রওশন এরশাদ একজন অসাধারণ রাজনীতিবিদ। তিনি একদিকে তার স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছ থেকে দলের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন, অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে ভারসাম্য রক্ষা করছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন উদাহরণ আর এক পিস পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
আমি চুপ করে চাচার কথা শুনলাম। জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না। গত নির্বাচনে এরশাদের নির্দেশে ১৮৬ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। বাকিরা নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেন। বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির ৩৪ জন সদস্য রয়েছেন। এরশাদ নিজেও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এরপর তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। অন্যদিকে তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ দলের যে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে স্বামীকে ক্ষমতাহীন করেছেন, তা ফিরে পেতে এরশাদ সমপ্রতি দলের নেতাকর্মীদের এক সম্মেলনে গান গেয়েছেন? ‘আয় খোকা আয়!’ তবে দলের ৩০ জন সংসদ সদস্য তার ডাকে সাড়া দেননি। আসলে দলের খোকারা বুঝতে পারছেন না কার কাছে যাবেন? ক্ষমতাবান রওশন এরশাদের কাছে, না ক্ষমতাহীন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছে?
আমি আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, চাচা! উপজেলা নির্বাচনে তো দেখছি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন আছে, অথচ কাগজপত্রে সবই নির্দলীয়। নির্বাচনে একক প্রার্থী দেয়ার জন্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়?
তোমার কাছে তো সবই অদ্ভুত। তবে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ কেন?
বিএনপি তলে তলে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে বলে। বর্তমান সরকারকে বিএনপি অবৈধ সরকার বলছে, আবার এ সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এটা কেমন নৈতিকতাবিরোধী কথা?
নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নেই বলেই বোধহয়। আমি বললাম।
আওয়ামী লীগের উচিত ছিল এবারও কৌশল করে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। চেষ্টাও করা হয়েছিল। তবে তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন একটা ভিন্ন কৌশল দেখা যাচ্ছে।
কি কৌশল?
এবার উপজেলা নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর তেমন আস্থা রাখা যায়নি বলেই এ ব্যবস্থা। চাচা বললেন।
এভাবে নির্বাচন করে কি গণতন্ত্র রক্ষিত হতে পারে?
গণতন্ত্রের তুমি বোঝটা কী? চাচা বিরক্তিস্বরে আমাকে বললেন, তুমি কি মনে করো নির্বাচনে কেবল দেশের মানুষেরা ভোট দেয়, বিদেশীরা কিছু করে না?
তা করে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব সুজাতা সিং সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। জাতীয় পার্টি যাতে নির্বাচনে যায়, তার জন্য এরশাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।
কথাটা ফাঁস করা এরশাদের মোটেই উচিত হয়নি। চাচা গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললেন, গণতন্ত্রের পুরোনো ধারণা এখন আর নেই। নির্বাচন ছাড়া কিংবা নামকা-ওয়াস্তে নির্বাচন করেও গণতন্ত্র রক্ষিত হতে পারে। এর নাম হচ্ছে নব্য গণতন্ত্র।
নব্য গণতন্ত্র!
আঁতকে উঠলে যে! এটা অবশ্য আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্র নয়। বর্তমান নব্য গণতন্ত্র সময়ের প্রয়োজনে ও সংবিধান রক্ষার্থে গণতন্ত্রের ভিন্নতর রূপ। এটা ওয়েস্ট মিনস্টার গণতন্ত্রের আদল থেকে আলাদা। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ নব্য গণতন্ত্রের বিকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সেটা কী রকম? আমি প্রশ্ন করলাম।
মিসরের দিকে তাকিয়ে দেখ। মিসরের সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। ফিল্ড মার্শাল সিসি বিগত নির্বাচনে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনক্ষমতা দখল করেন ও মুরসিকে জেলে দেন। মিসরের এবারের নির্বাচনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফিল্ড মার্শাল সিসিকে প্রকাশ্যে অগ্রিম সমর্থন দিয়েছেন। আমি শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, মিসরের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফিল্ড মার্শাল সিসি জয়যুক্ত হবেন।
কিন্তু এতে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? আমি প্রশ্ন করলাম।
তুমি গণতন্ত্রের পুরোনো ধ্যানধারণার বিষয়টা ভুলে যাও। চাচা বিগলিত হাসি মুখে বললেন, নব্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে কোনো একটা নির্বাচন হলেই হলো। কিভাবে কী নির্বাচন হলো, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা হবে না।

সুস্থ বিবেকের বিদ্রোহ by উইলিয়াম বি মাইলাম

Wednesday, February 12, 2014

মন্দের জয়ের জন্য শুধু যা প্রয়োজন তা হলো ভাল মানুষের নীরব ভূমিকা। কথাটি এডমান্ড বার্কের মুখনিঃসৃত বলে বহুল প্রচলিত হলেও তিনি আদৌ এমন কিছু বলেছেন তেমন সম্ভাবনা কম। তবে চরম সত্য হলো, এ শব্দগুলো গত ৩২৫ বছরের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানকে ঘিরে রেখেছে।
এ সময়ের মধ্যে, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে উত্থান হয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থার। মানব ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়ই প্রচলিত ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসন। ১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ রাজনৈতিক রূপান্তরের সূত্রপাত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাজা ও দেশের কর্তৃত্বের ওপর ওই বছর সংসদীয় সীমারেখা দেয়ার অবধারিত কারণ ছিল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা। সমাজের অভিজাতরাই ছিলেন তার রূপকার। কিন্তু বৃহৎ কিছুর সূত্রপাত হয় ক্ষুদ্র। ক্ষমতার ওপর অভিজাতদের শক্ত হাতকে নড়বড়ে করার জন্য আর তাদের ক্ষমতাকে ভাগাভাগি করার জন্য শতকের পর শতক ধরে নানা দেশের ভাল মানুষরা শাসক দলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তাদের সফলতার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সার্বিকভাবে সমগ্র সমাজের স্বার্থ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বমূলক ভূমিকা পালন করেছে। অন্য কথায়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অভিজাত সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিই নয়, অন্তর্ভুক্ত থেকেছেন সমাজের অন্য অংশের প্রতিনিধিরা। যারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় মতপ্রকাশের দাবি করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সামাজিক ঐক্যবদ্ধতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। ১৬৮৮ সালের পর রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ঘটনা অনেকটা নিয়মিত হয়ে যায়। বার্ক ১৭৬৫-১৭৮৩ সালের মার্কিন অভ্যুত্থানকে পছন্দ করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ পরিশেষে অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক এক সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে, তিনি ফরাসি অভ্যুত্থান পছন্দ করেননি। একভাবে বা অন্যভাবে সেখানে কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত ছিল। এটাই হয়তো তার অপছন্দের কারণ। প্রায় ৮০ বছর শোষণমূলক শাসনব্যবস্থা থাকার পর ফ্রান্সে অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বার্কের লেখায় বুদ্ধিবৃত্তিক নানা বিসদৃশের আধিক্য থাকলেও আমি মোটামুটি নিশ্চিত, তিনি বিংশ শতাব্দীর তথাকথিত অভ্যুত্থানকে তিরষ্কার করতেন। ১৯১৭ সালের রাশিয়ান অভ্যুত্থান এবং ২০ ও ৩০-এর দশকে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থানগুলো ধীরে ধীরে ঘটেছিল পর্দার অন্তরালে। এসব অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে সংখ্যালঘুরা। সেটা কখনও নির্বাচনের পর হয়েছে, কখনও বা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাচীন শাসনব্যবস্থার পতনের পর। আর জনপ্রিয় সমর্থনের অভাবে তারা তাদের অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে বক্তৃতাবাজি, দমননীতি, ভাবাদর্শিক অনুশাসন এবং বিকৃত ইতিহাস দিয়ে। প্রায়ই এ প্রক্রিয়ায় বলির পাঁঠা হয়েছে নির্দিষ্ট কোন গ্রুপ। তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে তারা প্রায়ই গণহত্যা পরিচালনা করতো। গণতন্ত্র নিয়ে বার্কের দ্ব্যর্থকতা সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক লেখার মধ্যে অন্তর্নিহিত একটি ধারা বিদ্যমান- সব অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে তিনি সর্বাধিক বিপজ্জনক যে দিকটি লক্ষ্য করেছেন, সেটা হলো বেপরোয়া ক্ষমতার অধিকারী কর্তৃত্ববাদী, দমনমূলক কোন সরকার উত্থানের আশঙ্কা। ১৭৭০ সালে বার্কের একটি গবেষণামূলক আলোচনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল, ‘আমাদের বর্তমান অসন্তোষের কারণগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা’ (থটস অন দ্য কজেস অব আওয়ার প্রেজেন্ট ডিসকনটেন্ট)। এতে তিনি রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতার বিষয়ে শক্ত সীমারেখা নির্দিষ্ট করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন এবং সরকারের ক্ষমতা অপব্যবহার প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, যখন অসাধু ব্যক্তিরা একত্রিত হয়, তখন সততাপরায়ণ ব্যক্তিদের মধ্যেও ঐক্য গড়ে ওঠা উচিত। তা না হলে তারা সবাই একের পর এক ঝরে পড়বে, যা হবে অবজ্ঞার এক সংগ্রামে করুণার অযোগ্য ত্যাগ। এ শতাব্দীতে বিপ্লব ঘটেছে প্রধানত ইসলামি দুনিয়ায়। এসব বিষয়ে বার্ক-এর অনুভূতি কেমন হতো তা বলা কঠিন। তবে আমাকে এটা আহত করে, নিচু স্তর থেকে উঠে আসা এসব মানুষকে প্রথমেই তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। যখন গণজাগরণ শুরুর বিষয়টিকে দৃশ্যত কিছু সুসংগঠিত, আদর্শপুষ্ট গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা করে তখন নিশ্চিতভাবে তাকে উদ্বিগ্ন হতে হয়। পাশাপাশি দেখা দেয় অভিজাত শ্রেণীর কিছু থারমিডোরিয়ান প্রতিক্রিয়া। (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লবে এ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল)। সুসংগঠিত গ্রুপগুলো প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে রয়েছে।
পর্দার আড়ালে বিপ্লব ঘটানোর বিষয়ে তিনি অধিক উদ্বিগ্ন হতেন- এটা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এ ক্যাটিগরিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়ে। দৃঢ়ভাবে বলা যায়, এটি একটি নিখুঁত কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। একদলীয় একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একদলীয় রাষ্ট্র। প্রধান বিরোধী দল একই সঙ্গে বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতায় বিশৃঙ্খল। তাদের বিশৃঙ্খল করতে ভূমিকা রেখেছে বিরোধী দল, ভিন্নমতাবলম্বী ও বলির পাঁঠা হওয়া ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়ন। সুশীল সমাজ বিভক্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত। সংঘাতের মধ্য দিয়ে জন্ম হওয়া এ দেশটির ইতিহাস নতুন করে লিপিবদ্ধ করেছে সরকার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। অবশ্যই এটা একটি বার্কিয়ান পরিস্থিতি। সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি একজনের পর একজন ঝরে পড়তে না চান, তাদের অবশ্যই একত্রিত খারাপ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিদের থামাতে একত্রিত, সংগঠিত হতে হবে। ইসলামিক বিশ্বে একসময় রাজনীতি ও সামাজিকতাকে আধুনিকায়ন করার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু সেই বাংলাদেশ এখন দুর্নীতি, বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রের তালিকায় যোগ হবে। এমন কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রের তালিকায় স্থান পাওয়া দেশ অনেক। যদি সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ অলস থাকেন তাহলে বাস্তবিকই আধুনিকায়ন হারিয়ে যেতে থাকবে।
উইলিয়াম বি মাইলাম বাংলাদেশ, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি ওয়াশিংটনে উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার-এর সিনিয়র পলিসি স্কলার। তিনি ক্যারিয়ারের দিক থেকে একজন কূটনীতিক। ২০০১ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি অবসরে যান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে। ফের ১১ই সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানে পুনর্গঠনে তার ডাক পড়ে। তিনি লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।

 (নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাকিস্তানি সংস্করণ দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত উইলিয়াম বি মাইলামের লেখা ‘দ্য গুড ওয়ানস রিভোলটেড’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ। গতকাল এটি প্রকাশিত হয়।)

সরল গরল- কমনসের বাংলাদেশ বিতর্ক by মিজানুর রহমান খান

বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে নির্বাচন ইতিবাচক বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দাবি সংসদে করেছেন, তা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশে যখনই বৈধতার সংকট নিয়ে কেউ সরকারে বসেন, তখন তাঁরাই বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ে সচেষ্ট হন।

বিভিন্ন সরকারের আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন বার্তাবিষয়ক তথ্য এবং সেসব দেশের পার্লামেন্টের নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরা নির্বাচন ও সরকার সম্পর্কে যে অভিমত দিচ্ছেন, তার মধ্যে পার্থক্য আসমান ও জমিনের। বিদেশি সাংসদেরা সংসদের ফ্লোরে কীভাবে দেখছেন তা আজ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হবে এই নিবন্ধে। আজ হাউস অব কমনস। কাল ইইউ পার্লামেন্টের ভাষ্য।
হাউস অব কমনসে তিন সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে তিন দফা আলোচনা হয়েছে। মার্কিন সিনেটেও অল্পসময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের ওপর তৃতীয় শুনানি হচ্ছে। বাংলাদেশবিষয়ক প্রস্তাব আনার কারণটা চিহ্নিত করে সাইমন ড্যানজুক বলেন, অবশ্যই এমন উদ্বেগ রয়েছে যে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে এবং কালক্রমে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটতে পারে। মিসেস মেইন বলেন, আমাদের ভাবতে হবে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ব্রিটিশ সাহায্য দেশটিতে কী কাজে লাগবে। প্রকৃত সুফল দেবে কি দেবে না। আমার মনে হয় মার্কিন সিনেটে ১১ ফেব্রুয়ারির শুনানিতে একই প্রশ্ন আলোচিত হবে।
১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নতুন ইউএসএইড প্রধান ইয়ানিনা ইয়ারুজেলস্কি বলেছেন, ‘মার্কিন সহায়তা চলতে থাকবে।’ আমরাও তা চাই। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখব, বহু দেশের ঘোর অমানিশাতেও তারা এমনটাই বলে থাকে। তবে একই সঙ্গে তিনি প্রকারান্তরে গণতন্ত্র ও সুশাসন কর্মসূচির অর্থ প্রত্যাহারের ঘোষণাও দিয়েছেন। ইয়ানিনা সৌজন্য করে বলেছেন, ওই কর্মসূচির টাকা না কমিয়ে অন্য কর্মসূচিতে সমন্বয় করবেন। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের চেয়ারম্যান চিঠি লিখে সরকারের প্রতি পরোক্ষ অথচ স্পষ্ট অনাস্থা ব্যক্ত করেছিলেন।
বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিটেনের দুই প্রধান দলের প্রতিনিধি মিসেস মেইন ও সাইমন কমনসে যৌথভাবে প্রস্তাব আনেন। রানা প্লাজা ধসের পরে তাঁরা সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলেন। ১৪ জানুয়ারিতে ঠিক হয়, ১৬ জানুয়ারির ব্যাকবেঞ্চ প্রহরে বাংলাদেশ আলোচিত হবে। এই আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বেশ ভালোই তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে একা মিসেস মেইনই যুক্তি দিয়েছিলেন। তবু তাঁর মন্তব্য, ‘দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ একধরনের তলাবিহীন ঝুড়িতে রূপান্তরিত হতে চলেছে।’ বহু বছর বাদে কিসিঞ্জারের এই বিষাদগ্রস্ত উক্তিটির প্রতিধ্বনি কানে এল।
এই যখন অবস্থা তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে বলেন, ‘অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান দশম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন।’ আমরা সংসদ ও সরকারের পার্থক্য রাখি না, বুঝতেও চাই না। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিশ্ব তো পার্থক্য বজায় রাখে। এটাই ওদের গৌরব। দীর্ঘকাল ধরে দেশে দেশে চোখে পড়ে অগণতান্ত্রিক বা জবরদখলকারী সরকারের তোয়াজকারী আমলারা ‘অভিনন্দন’ জোগাড় করতে উতলা হন। দেখলাম ওআইসির মতো অগণতান্ত্রিক ক্লাবের মহাসচিবের অভিনন্দনও ঘটা করে রটানো হচ্ছে।
বিশ্বের তিনটি বিশিষ্ট পার্লামেন্টের (মার্কিন কংগ্রেস, ব্রিটেনের হাউস অব কমনস ও ইইউ) পক্ষ থেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে না বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীন দল ও তার মিত্ররা ‘হাই হ্যালো’ ধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচারমণ্ডিত অভিনন্দনে পুলকিত হবেন নাকি জনগণের নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের দ্বারা সংসদের ফ্লোরে সরাসরি তিরস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।
১৬ জানুয়ারি মিসেস মেইন অকপটে বলেন, আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি যে ২০০৬ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো উন্নতি ঘটেনি। কিন্তু তিনি বা তাদের কেউ সেদিনের বিতর্কে ভেঙে বলেননি, ’৯০-এ সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পরে কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা করা হয়নি। প্রায় সব কটি প্রতিষ্ঠান সুনামি কি সিডরের শিকার।
গত ১১ জানুয়ারি গণতন্ত্র খাতে ৬৭ মিলিয়ন পাউন্ডের সাহায্য বন্ধের খবর দিয়েছিল টেলিগ্রাফ। একে অযথাযথ খবর চিহ্নিত করে মেইন বলেন, প্রায় ৭০ ভাগ ব্রিটিশ সাহায্য এনজিওর মাধ্যমে খরচ হয়। তবে বাকি যে ৩০ ভাগ সরকারের হাতে দেওয়া হয়, সেটা ‘যে সরকার জনগণের সব অংশকে আস্থায় নেয় না, তাকে ওই সাহায্য দেওয়া উচিত নয়’ বলে তিনি সাফ সুপারিশ করেন। এ ধরনের মন্তব্যে বিএনপি খুশি হবে। কারণ, তারা বিদেশিদের কাছে কেবল তেমন চাপই আশা করে। বিরোধী দল এতে অপমান দেখে না, সার্বভৌমত্বের হানি দেখে না, কমনস যদি বাংলাদেশ শাসকদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপশাসনের জাঁতাকলটি ভাগাড়ে ফেলার শর্ত দিত, তাতে তাদের মন ভরত না।
১৬ জানুয়ারি রক্ষণশীল এমপি মার্ক ফিল্ড সোজা কথা সোজা করে বললেন, সাত বছর ধরে দেশটিতে এই লক্ষণই ফুটে উঠেছিল যে এটি সামরিক শাসনের কবলে পড়ে কি না। একাত্তরে পাকিস্তান ভাগ থেকে এ পর্যন্ত অস্থিতিশীলতার জন্য ‘বর্তমানের বাংলাদেশি রাজনীতিকদের দায়দায়িত্ব’ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত প্রকাশ পেলেও মিশ্র মতামতও এসেছে। রক্ষণশীল এমপি রেহমান চিশতী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রতি গভীর আস্থা ব্যক্ত করে বলেন যে, পাকিস্তানসহ আরও অনেক দেশে এটা ভালোভাবে কাজ করছে। এটা বাতিল করা ‘সম্পূর্ণ ও গুরুতর ভুল’। মিসেস মেইন অবশ্য মনে করেন, এটা সঠিক পদ্ধতি ছিল না। তাঁর যুক্তি, এটা বদলে ফেলতে সংবিধানের আওতায় আওয়ামী সরকারের অধিকার ছিল এবং তারা সেটা করেছে। আমরা মেইনের কোনটা নেব? ম্যান্ডেট তত্ত্ব নাকি তলাবিহীন ঝুড়ি বলাটা?
কমনস কার্যবিবরণীতে লেখা আছে, বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় গ্রুপকে বলেছেন, ‘আমি এটাকে মর্মভেদী মনে করেছি। একটাই বড় সত্য যে রক্তপাত ও বিরোধ ছাড়া বাংলাদেশ কখনো নির্বাচন দেখেনি।’ তার মানে কি ওটা ফেলে দেওয়ার দর্শন ছিল এই যে, রক্তই যখন ঝরবে তখন ঝরুক! ওই প্রশ্নে বাংলাদেশি রুশনারা আলী সতর্কতার সঙ্গে বলেছেন, কমনসের উভয় পক্ষের সদস্যরা সুষ্ঠু নির্বাচনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছেন। অনেকেই বলেছেন, এই ব্যবস্থা অতীতে সুফল দিয়েছে।
লিবারেল ডেমোক্র্যাটদলীয় মার্টিন হরউড উল্লেখ করেছেন, শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপই নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বহু বিষয়ে আওয়ামী লীগের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার রয়েছে। তবে তিনি নিরেট সত্যটা বলেননি যে, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের কৈফিয়তের ঊর্ধ্বে তুলেছে।
মার্টিনের কথায়, ওই ব্যবস্থা বাতিল টেকনিক্যালি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কারণ, সেখানে ব্রিটিশ সরকারের সমর্থিত একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওটা বাতিল করায় স্পষ্টতই নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবাধ নির্বাচনে আস্থা নষ্ট হয়েছে। মার্টিনের এই মন্তব্য খুবই যুক্তিসংগত। কারণ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট নিরঙ্কুশভাবে টেকনিক্যালটির ওপর দাঁড়িয়ে ওটা বাতিল করেন। কিন্তু রাজনীতি টেকনিক্যাল নয়।
রেহমান চিশতী মার্টিনকে প্রশ্ন করেছিলেন, ওই ব্যবস্থা যদি পাকিস্তানে চলে, বাংলাদেশেও চলতে পারে? তখন মার্টিন যথার্থ মন্তব্য করেন, এটা ‘টেকনিক্যাল মেরিটের’ প্রশ্ন নয়। অথচ আমাদের সরকার ও তার মিত্ররা ওই ব্যবস্থা বাতিল প্রশ্নে যে আদর্শগত ভুয়োদর্শন তুলেছেন, তা শতকরা ১০০ ভাগই টেকনিক্যাল মেরিটের। মার্টিন চমৎকার যুক্তি দেন, এটা হলো রাজনৈতিক দলব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি ও মতৈক্য সৃষ্টি করার বিষয়। একজন বাংলাদেশি আজ সকালেই আমাকে একটি মিষ্টি উপমা দিলেন। বললেন, ওই ব্যবস্থা থাকল বা গেল, তা কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দুই নারীর হাতেই বাঁধা। সাইমন ড্যানজুক এ সময় বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা উচিত। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এটা বলেছিলাম। কিন্তু স্পষ্টতই তিনি এটাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। গত ২৩ বছরের মধ্যে এই প্রথম দেশটির সংসদে কোনো রাজনৈতিক বিরোধী দল নেই।’
রক্ষণশীল রিচার্ড ফুলারের কাণ্ডজ্ঞান প্রখর। কমনসের উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া, এই মন্তব্যের পর তিনি বলেন, এটা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য যথার্থই বৈধ যে, তারাই ঠিক করবে কীভাবে তারা তাদের নির্বাচন করবে। তাই কমনসের এটা অন্য কোনো দেশকে বলা উচিত হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি যা বলেন, সেটা বাংলাদেশের রাজনীতিকদের বুঝতে হবে। ফুলারের কথায়, ‘এ কথা বলা হাউস অব কমনসের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যে গণতন্ত্র উন্নয়নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কতটা কার্যকর। কারণ, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী আমাদের স্বার্থ রয়েছে।’
বাংলাদেশ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল হোক—এ রকম প্রস্তাব কমনসে পাস হয়নি, পাস হওয়ার কথা নয়। তবে ফুলার তথ্য প্রকাশ করেন যে ব্রিটেনের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বলেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল করতে। কিন্তু একগুঁয়েভাবে সরকারি দল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ফুলারের সঙ্গে দ্বিমত করা যায় না, যখন তিনি বলেন, দুই বছর আগেই বোঝা গেছে, বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে। সুতরাং দায়টা বর্তমান সরকারের কাঁধেই বর্তায়।
লিবারেল ডেমোক্র্যাট জন হ্যামিং ফুলারের কাছে প্রশ্ন রাখেন, তাহলে আপনি একমত যে অবাধ নির্বাচন চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবেই? এর উত্তরে জিম ফিটজপ্যাটরিক বলেন, নতুন নির্বাচনের কথা বলা এখন অপরিপক্ব। তাড়াতাড়ি নির্বাচন হওয়া মানেই গত নির্বাচনে যারা নাশকতা করেছে, তাদের হাত লম্বা করা। তবে জিমের মতো অনেকেই বলবেন, ‘আমি মনে করি আওয়ামী লীগ পুরো পাঁচ বছর মেয়াদে সরকারে থাকতে পারবে না। কারণ, সেটা হবে কমনসের উচ্চারিত গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধাচরণ।’
কমনস যা কিছু আলোচনা করেছে তা আমার বিচারে বাংলাদেশিদের প্রয়োজনের তুলনায় অন্তঃসারশূন্য না হলেও গতানুগতিক ও আনুষ্ঠানিক। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যে ভেঙে পড়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচনই তা নিরাময়ের একমাত্র ধনন্তরি চিকিৎসা নয়, কমনসের, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সেটা স্বীকার করা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

অজানা গন্তব্যের পথে বাংলাদেশ by কাউসার মুমিন

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশটির গত দু’ দশকের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অর্জনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে এক অজানা গন্তব্যের পথে হাঁটছে। বাংলাদেশ নিয়ে যথেষ্ট শংকিত হওয়ার কারণ রয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন  ছিল মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ, বিতর্কিত।
এখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যতদ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন প্রয়োজন। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বাংলাদেশের ওপর শুনানিতে এসব কথা বলা হয়েছে। পাঁচ ইস্যুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে শুনানি। এগুলো হলো: একটি নতুন নির্বাচন, জিএসপি প্রসঙ্গ, বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গ্রামীণ ব্যাংক ও ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। পররাষ্ট্র বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটিতে ওই শুনানি অনুষ্ঠিত হয় সিনেটর মেনেন্দেজের সভাপতিত্বে। এতে প্যানেল সদস্যরা বলেন, বাংলাদেশে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ছিল মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। এতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য নতুন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতাপূর্ণ সংলাপ আয়োজনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে আরও বেশী চাপ দিতে ওবামা প্রশাসনকে আহ্বান জানায় সিনেট। জিএসপি সুবিধা প্রসঙ্গে বলা হয়, জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে বাংলাদেশকে যেসব শর্ত পূরণ করতে দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে কিছুটা অর্জিত হয়েছে। তবে তাদেরকে এখনও অনেক কিছু করতে হবে। শ্রমিকের অবস্থা উন্নয়নে প্রতিশ্রুতির অনেকটাই এখনও পূরণ হয় নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেয়ার শামিল। সিনেটর ডারবিন বলেন, আমরা জানি এ সরকার মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীন ব্যাংকের সঙ্গে কি করেছে। এটা যে অন্যায় সেটা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝানোর জন্য আমরা কি করতে পারি? এটা তার দেশের জন্য ভুল, ওই মানুষটির প্রতি অন্যায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যকার পারস্পরিক সুসম্পর্কের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

শুনানিতে বলা হয়, বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। তবে তাদের হারানোরও আছে অনেক। গতকালের শুনানি প্রসঙ্গে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেন, বাংলাদেশ একটি সঙ্কটজনক অবস্থানে। তাই এই শুনানি সময়োপযোগী এবং এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়া হবে যে, বাংলাদেশ যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গতকাল সকাল ১০টায় এ শুনানি হয়। দু’পর্বে শুনানি হয়। প্রথম পর্বে প্যানেল সদস্য ছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক এসোসিয়েট ডেপুটি আন্ডারসেক্রেটারি এরিক আর বিয়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম বিষয়ক বাণিজ্য সহকারী লুইস কারেশ। এছাড়া শুনানিতে অংশ নেন সিনেটর ডারবিন। নিশা দেশাই তার শুনানিতে বলেন, আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছি। বাংলাদেশের রয়েছে একটি সাফল্যের কাহিনী। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে মূল তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন তা হলো বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের খাদ্য। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, উন্নয়ন করেছে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় কাজ করেছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এক কান্তিদায়ক রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। ৫ই জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে তা ছিল মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। এতে প্রধান দু’ রাজনৈতিক দলের একটি অংশ নেয় নি। ফলে জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বাকিরা নামমাত্র বিরোধিতা মোকাবিলা করেছেন। এ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিশ্বাসযোগ্য প্রকাশ ঘটেনি। এতে বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। নিশা দেশাই বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা কড়া উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সরকারি বিবৃতি দিয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে সরকারি ও বিরোধী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে আমি প্রথম ওই অঞ্চল সফরে যাই নভেম্বরে। তখন আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের পন্থা বের করার আহ্বান জানাই। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ যে ভূমিকা গ্রহণ করে তাতে আমরা সমর্থন দিয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলো সে উদ্যোগ সফল হয় নি। নির্বাচনের পর পরই আমরা কড়া বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিই যে, এ নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, এতে জনগণের মতের কোন প্রতিফলন ঘটেনি। একই সঙ্গে নতুন একটি নির্বাচনের জন্য সংলাপের আহ্বান জানাই। তিনি বলেন, নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে সমপ্রতি বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও গুমের যেসব রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। অবিলম্বে এসব নির্যাতন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমরা সহিংসতার নিন্দা জানাই। গণতন্ত্রে এটা কোন কৌশল হতে পারে না। ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন কর্মকর্তা, স্টাফ, নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সরকার তদারক করছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সঠিক পদক্ষেপ নেবেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃবৃন্দ। শুনানিতে সিনেটর ডারবিন বলেন, ২০ বছর আগে আমি প্রথম বাংলাদেশ সফর করি। তারপর অনেকবার গেছি। আমি যা দেখেছি তাতে আমি অভিভুত হয়েছি। আমি এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হই যিনি আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে ওঠেন। আমার দেখা মতে তিনি সব থেকে বেশি অনুপ্রেরণা সঞ্চারকারী ব্যক্তিত্ব। আমি বলছি মুহাম্মদ ইউনুসের কথা, যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। ুদ্র ঋণ তার প্রাথমিক ধারণা ছিল না। কিন্তু তিনি দরিদ্র থেকে হত দরিদ্রদের মাঝে ঋণ পৌঁছে দিয়েছেন। তার এ প্রচেষ্টাকে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা বিশ্বে কোথাও দেখা যায়নি। তিনি তার এ উদ্যোগের জন্য শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান।  সিনেটের পক্ষ থেকে তাকে কংগ্রেশনাল মেডেল প্রদানের অংশ হতে পেরে আমি খুশি। আমার বিশ্বাস এ পদক পাওয়া তিনি প্রথম মুসলিম। পদক দেয়ার সময় হলভর্তি সমর্থক উপস্থিত ছিলেন। নানা ধর্ম বর্ণের। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে আমি উদ্বিগ্ন। তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া এবং গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আমার কাছে মনে হয়, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাকে কোন না কোনভাবে শাস্তি দেয়া- দুঃখজনক হলেও যা লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেয়ার সামিল। যারা জীবনধারনের জন্য এ ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল। আশাহত নারীদের মধ্যে আশা জাগিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক।
এ বিষয়ে তিনি প্রশ্ন রাখেন নিশা দেশাইয়ের কাছে। জবাবে নিশা দেশাই বলেন, আপনি যেভাবে আপনার স্পষ্ট অনুভূতি উপস্থাপন করেছেন আমি তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে চাই। যতবারই আমার তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছে, এটা সত্যিকার অর্থে অনুপ্রেরণাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল। মানবতার প্রতি তার নিষ্ঠা বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে গেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সক্ষমতা এবং স্থিতিশীলতার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।  এটা বাংলাদেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ অর্জন। তারপরও বাংলাদেশে এটা এখন হুমকির মুখে। বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ব্যাংকের পরিসর দিনে দিনে বৃদ্ধি এবং আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউএসএআইডি প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছে। এর আগে ইউএসএআইডিতে কর্মরত থাকাকালীন আমার ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। গ্রামীণ সামাজিক ব্যবসা প্রকল্প আরও শক্তিশালী করে এবং বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ নারীদের কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের সেবা পৌছে দেয়ার সক্ষমতা দৃঢ় করে তোলার লক্ষ্যে আমরা কাজ করেছিলাম। আমি মনে করি গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং আমরা গ্রামীণ ব্যাংককে সমর্থন এবং তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করা অব্যাহত রেখেছি। যেটা আমার কাছে হুমকিস্বরূপ মনে হয় সেটা হলো, গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী নারীদের সাহায্য অব্যাহত রাখার সক্ষমতা।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলবিহীন ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের ল্যে গতকাল মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চক সিনেটের ‘সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশনস’ আয়োজিত বাংলাদেশ বিষয়ক এক শুনানিতে অংশ নিয়ে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্যগণ তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এতে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সীমাবদ্ধ সুযোগ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম, শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিক নিরাপত্তার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এই সকল ইস্যুতে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি কতটা কার্যকর এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রাখার পরও এখনও কেন বাংলাদেশে এই সকল ইস্যুতে গ্রহণযোগ্য উন্নতি হচ্ছে না, এতে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে সিনেট সদস্যগণ শুনানিতে অংশ নেয়া প্রত্যেকের নিকট পৃথক পৃথকভাবে বিস্তারিত জানতে চান। এ ছাড়া শ্রমিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের পথে বাংলাদেশকে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের জিএসপি ইস্যুতে আগামী মে মাসে একটি শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনেন্দেজ বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার ব্যক্তিগত ভূমিকা, বাংলাদেশের উভয় নেত্রীর নিকট সংলাপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিঠি, সংলাপ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপর্যুপরি আহ্বান ইত্যাদি উল্লেখ করে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের কাছে জানতে চান ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের গন্তব্য কোথায়?’ সিনেট শুনানির দ্বিতীয় প্যানেলে আলোচনায় অংশ নেন ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম মি. স্কট নোভা, বাংলাদেশ শ্রমিক নিরাপত্তা জোট-এর বোর্ড অব ডিরেক্টর্স-এর চেয়ারম্যান এলেন ট্যাশার এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার।

খালেদা, প্রণব এবং ওরা তিন জন by অমিত রহমান

খালেদা জিয়া জানার চেষ্টা করছেন। কেন তার ঘনিষ্ঠ ‘তিনজন’ প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতে বারণ করেছিলেন। কি ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তারা কি দলের স্বার্থে না অন্যদের স্বার্থে খেলছিলেন তা-ও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
সময় যত যাচ্ছে ততই তার মধ্যে সন্দেহ জাগছে, এটা হয়তো কোন ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। দলের লোক, দেশী-বিদেশী শুভার্থীরা বলছেন, এটা ছিল অশোভন, অগ্রহণযোগ্য। শিষ্টাচারবহির্ভূত। তাদের যুক্তি হচ্ছে, খালেদা ভারত সফরে গেলেন। সম্পর্ক উন্নয়নের নয়া দিগন্তের সূচনা হলো। নজিরবিহীন না হলেও অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেয়া হলো। খালেদা নিজেও বিস্মিত হলেন। ঘনিষ্ঠদের বললেন, তার ধারণার বাইরে সৌজন্য দেখালো ভারত। তিনি নিজেই ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জিকে আমন্ত্রণ জানালেন ঢাকা সফরের জন্য। প্রণব এলেন। কিন্তু খালেদা নেই। অকার্যকর এক হরতালের অজুহাতে নির্ধারিত সৌজন্য বৈঠক বাতিল করলেন এক ই-মেইল বার্তা পাঠিয়ে। কি কারণ ছিল তা নিয়ে অনেকদিন গবেষণা করে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ঝুঁটি বাঁধেন এমন দু’জন তাত্ত্বিক এবং একজন পেশাজীবী এক সকালে গিয়ে বললেন, ম্যাডাম সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রণব বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন না। গেলেই বিপদে পড়বেন। হরতালের মধ্যে অন্য কোন শক্তি হামলা চালিয়ে আপনার যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া ১৮ দলের শরিক জামায়াতের হরতালের মধ্যে আপনি যদি সোনারগাঁও হোটেলে যান তখন সরকার বলবে হরতাল ভঙ্গ করে আপনি ভারতের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের আরও যুক্তি, ভারত আপনাকে চায় না। এর পেছনে যে মানুষটি সক্রিয় ভূমিকায় তিনি হচ্ছেন প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশ বিষয়ে সব নীতি তিনিই গ্রহণ করেন। সুতরাং, তাকে বোঝানো উচিত বাংলাদেশ একচেটিয়া তার বা তাদের পক্ষে নয়। এখানেও ভিন্নমত রয়েছে। খালেদা গিলে ফেললেন প্রস্তাবটি। উল্লিখিত তিনজন এমনভাবে কথা বলেন, মনে হবে তারা ছাড়া বিএনপির পক্ষে আর কেউ নেই। যুক্তিতে তারা পারদর্শী। এর মধ্যে একজন তাত্ত্বিক। হালে চরম দক্ষিণপন্থি। নানা লেনদেনের সঙ্গেও জড়িত। টেলিভিশন টকশোর একটি মন্তব্য নিয়ে মাঝখানে তাকে নিয়ে শোরগোল তুললেন শাসক সমর্থিত নাগরিক সমাজের কেউ কেউ। গ্রেপ্তারের দাবিও তুললেন। কিন্তু এক রহস্যজনক কারণে তা থেমে গেল। হেফাজতের সমাবেশের আগে খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম দেয়ার ক্ষেত্রেও এই ভদ্রলোকের অবদান ছিল। ভিন্ন এক বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়ে খালেদাকে দিয়ে বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন তিনি। বিএনপি মহলেই এ নিয়ে ভিন্ন মূল্যায়ন চালু আছে মেলাকাল থেকে। আরেক ভদ্রলোক অপেক্ষাকৃত তরুণ। বামপন্থি ছিলেন শুরুতে। এখন জাতীয়তাবাদী ভূমিকায়। চাঞ্চল্যকর সব খবর দেন ঘনিষ্ঠ মহলে। বলেন, তার সঙ্গে নাকি ‘উত্তরে’র ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। কাল হবে, পরশু হবে, দিন-তারিখও বলেন এমনভাবে শুনে যে কেউ চমকে উঠতে পারেন। খালেদা জিয়ার কাছেও মাঝেমধ্যে পৌঁছে যান। অথবা দূত মারফত এমন খবর দেন, দরকার নেই আন্দোলন বেগবান করার। এমনিতেই আন্দোলন গতি পেয়ে যাবে। শাসকেরা হাওয়ায় মিইয়ে যাবে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন দু’দিন কর্মীদের সহায়তা বন্ধ করেছিলেন খালেদা জিয়া। তাকে বলা হয়েছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এখন খালেদা নিজেই ঘনিষ্ঠদের বলছেন, ওরা আসলে অনুপ্রবেশকারী। হেফাজতের সঙ্গেও ওরা যোগাযোগ স্থাপন করে ভিন্ন বার্তা দিয়েছে। যে কারণে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার আর মাদরাসার আর্থিক সহায়তার টোপ দিয়ে সরকার মাঝপথে থামিয়ে দেয় হেফাজতের কাফেলা। হেফাজত প্রধানের ছেলের ভূমিকাও বেশ রহস্যজনক। খালেদার তৃতীয় ব্যক্তি বেশ শক্তিশালী। চার দেয়ালে বন্দি থাকার পরও প্রভাব অনেক বেশি। তিনি কিছু বললে বারণ করতে পারেন না খালেদা। এমনকি নিজের স্বার্থও না। উল্লিখিত তিনজন কাদের পরামর্শে খালেদা জিয়াকে সোনারগাঁও হোটেলে না যেতে বলেছিলেন তা নিয়ে দলের মধ্যে নানারকম মুখরোচক খবর চালু আছে। পাঠকদের মনে রাখার কথা, যে সময়টায় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদার সাক্ষাৎ করতে আসার কথা ছিল, প্রায় একই সময় হোটেলের উত্তর পাশে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছিল। যে খবর ভারতীয় মিডিয়া দ্রুত প্রচার করেছিল। এটা যে পূর্ব পরিকল্পিত ছিল এখন বিএনপি নেতারা বুঝলেও তখন আমলেই নেননি। এমন কি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শমসের মবিন চৌধুরীও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রশ্ন না তুলে ই-মেইল বার্তা টাইপ করেছিলেন। সম্পর্ক মেরামতে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুকের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লি গিয়েছিল প্রণবকে বোঝাতে। দুঃখ প্রকাশও করা হয় তাদের পক্ষ থেকে। তখন পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। প্রণব বাবু সহজে নিলেও ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এটাকে অপমান বলেই দেখেছেন। ভারতীয় প্রেসিডেন্ট যখন দিল্লিগামী প্লেনে ওঠেন তখন সফরসঙ্গী ভারতীয় সাংবাদিকরা তাকে সরাসরি প্রশ্ন করেন। বলেন, প্রণব বাবুকে নয়- গোটা ভারতবাসীকে অপমান করলেন বিরোধী নেত্রী। ধীরস্থির প্রণব বাবু কূটনৈতিক জবাব দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি নিজেও উপলব্ধি করেন এটা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। ভারতের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ বরাবরই বিএনপির ঘোর বিরোধী। তারা সুযোগ খুঁজছিলেন। তাদের হাতে অস্ত্রটা তুলে দেন খালেদা নিজেই। জামায়াতের সঙ্গে প্রেম দেখাতে গিয়ে নিজেকে অসহায় করে তোলেন। তার ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপরও সুযোগ এসেছিল। সময়মতো পদক্ষেপ নেননি। যে কারণে ভারত একতরফাভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে যায়। অনেকে অবশ্য বলেন, খালেদা সাক্ষাৎ করলেও ক্ষমতা পেতেন না। নানা কারণে ভারত খালেদাকে আস্থায় নিতে পারে না। তারপরও সাধারণ ভদ্রতা বলে কথা। খালেদা সব সময় সিদ্ধান্ত নেন বিলম্বে। পেট্রল বোমা আর গানপাউডার দিয়ে মানুষ কতল করা হচ্ছে অথচ খালেদা নীরব। একবারও নিন্দা জানালেন না। পাগলও জানে কারা এগুলো করেছে। যখন বিএনপি মহাসচিব কথা বললেন, এটা তাদের কাজ নয়, তখন দুনিয়াব্যাপী চাউর হয়ে গেছে আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। মনে রাখতে হবে এটা হাসিনার শাসন। তিনি ফুলটাইম রাজনীতি করেন। আর খালেদা করেন মাত্র চার ঘণ্টা। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় কাজ হয়েছে সকাল আটটা থেকে বেলা ২টার মধ্যে। এই সময়টা ঘুমিয়ে কাটালে ফল যা পাওয়ার তা-ই পাওয়া যাবে। বাড়তি যা পাওয়ার তা বোনাস। মানুষ সরকারের ওপর বিরক্ত। শত ভুলের মধ্যেও মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে এখনও আকুতি করছে। তাছাড়া সবাইকে অবিশ্বাসের পাল্লায় তুলে বিচার করলে কোনকালেই ভাল কিছু পাওয়া যায় না। শেখ হাসিনা একদিন যাদের অবিশ্বাস করতেন, দল ও মন্ত্রিসভায় স্থান দেননি, তারা এখন মূল শক্তি। মতিয়া চৌধুরীরা দূরে বসে ভাবছেন এ কি হলো। এটাই তো রাজনীতির খেলা। ভারতও এক সময় সংস্কারপন্থিদের সমর্থন দিয়েছিল জরুরি জমানায়। পরিণতিতে শেখ হাসিনা বিরক্ত হয়ে সংস্কারপন্থিদের ক্ষমতার বাইরে রেখেছিলেন। প্রণব বাবু নিজে অন্তত তিনবার অনুরোধ করে হাসিনার মন গলাতে পারেননি। বিরোধীদের আন্দোলনে শেখ হাসিনার সাজানো সংসার যখন ভেঙে পড়ছিল তখন প্রণব বাবুর পরামর্শে চিহ্নিত সংস্কারপন্থি আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, মোহাম্মদ নাসিম, আসাদুজ্জামান নূরকে দলে ফিরিয়ে নেন। এরাই এখন হাসিনার প্রথম সারির সৈনিক। আর খালেদা এখনও সন্দেহ আর অবিশ্বাস থেকে বের হতে পারেননি। রাজনীতি কি এতটাই সহজ!

আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে : ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ

Tuesday, February 11, 2014

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেছেন, আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান রাজনীতিকরা ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছেন। এটাই প্রমাণ করে তারা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে।
মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একের পর এক বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে বিচারবহির্ভূতভাবে। আর বলা হচ্ছে এরা সবাই সন্ত্রাসী। আসাদুজ্জামান নূর তো এখন সত্যি সত্যিই বাকের ভাই হয়ে গেলেন। আমাদের নামেও তো বোমা মারার অভিযোগে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা আছে। আমাদেরও তাহলে সন্ত্রাসী বলে হত্যা করে ফেলুক। তাদের চিন্তাচেতনায় গণতন্ত্র নেই এটা তারই প্রমাণ। ১৯ দলের তরুণ এ নেতা বলেন, সংবিধান বলছে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস হলো জনগণ। আর এখন প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী জোটের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্দোলন তো শেষই হয়নি। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে বিরোধীদলীয় নেতাকে তার বাড়িতে অবরোধ করে রাখার পর এটা স্পষ্ট হয়েছিল, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকাই আওয়ামী লীগের বড় বিষয়। ওই দিন কর্মীরা রাস্তায় নামলে অনেকগুলো প্রাণ হারাতো। বিরোধী দল রাস্তায় না নেমে অনেকগুলো জীবন বাঁচানো গেছে। এমন একটা সরকার গঠন করেই খেলা শেষ মনে করছে আওয়ামী লীগ। আসলে খেলা তো শেষ নয়। সামনে আন্দোলনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে অহিংস আন্দোলন করে কোন সরকার পতনের আন্দোলন সফল হয়নি। আমরা কোন সহিংসতা সমর্থন করি না, কিন্তু সহিংসতা হচ্ছে তা দেখতে হবে। তিন বছর ধরে দেশে আর লাঠিচার্জ বলে কিছু নেই। এখন সিনিয়র নেতাদেরও রাস্তায় নামলেই গুলি করে দেয়া হচ্ছে। কঠোর আন্দোলন শুরু হলে আর কিছু বলার থাকবে না কারও। তিনি বলেন, যারা জনগণের ইচ্ছার কথা চিন্তা করে না তাদের সঙ্গে তো লড়াই করা মুশকিল। তারা তো ভোটের কথা চিন্তাই করে না। জনগণের কাছে তো তাদের জবাবদিহির ভাবনা নেই। তারা যা খুশি করতে পারে। আমরা তো পারি না। আমাদের জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-শান্তির বিষয় ভাবতে হয়। বারবার পাঁচ বছর থাকার কথা বলে আওয়ামী লীগ নেতারা স্পষ্ট করছেন তাদের পাঁচ বছর থাকার বৈধতা নেই। বিদেশী কোন বাধা নেই- এ কথা বলেই তারা প্রমাণ করছেন বিদেশীদের চাপে সরকার বিব্রত। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে পুতুল প্রার্থীদের দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক এ সংসদ সদস্য বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয় এটা প্রমাণ হয়েছে। আমাদের আন্দোলন এখনও শেষ হয়নি। সরকার এখন নানাভাবে মিডিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। একটা মিডিয়া বন্ধ করে ১০০টা মিডিয়াকে নার্ভাস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসলে সরকার নিজেই চাপে আছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন যে ব্যর্থ এটা মিডিয়ার মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়েছে। আমরা বুঝি যে, মিডিয়া অনেক চাপের মধ্য দিয়ে কৌশল করে চলছে। কিছু কিছু ডিজিটাল বিটিভি আছে যারা সম্পূর্ণ সরকারের তোষামোদী করছে। তা ছাড়া সবাই সাহসী ভূমিকা রাখছে।

সন্ত্রাস- ছাত্রলীগের ‘আত্মরক্ষা’ ও নিষ্ক্রিয় আইন by মশিউল আলম

Saturday, February 8, 2014

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ‘যতজনের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে, তারা সবাই ছাত্রলীগের নয়’—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এই কথা বলেছেন।
এর মানে দৃশ্যমান অস্ত্রধারীদের কয়েকজন ছাত্রলীগের। তাহলে ছাত্রলীগের এই অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের যারা, আমরা তাদের বহিষ্কার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ বহিষ্কার মানে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার। এটা রাষ্ট্রের কোনো আইনি পদক্ষেপ নয়, সাংগঠনিক ব্যবস্থামাত্র। তাঁরা যে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, সে বিবেচনায় এটি নিতান্তই এক লঘু পদক্ষেপ, যা লোক দেখানো বলে কেউ ধরে নিলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া আমরা জেনেছি, বহিষ্কৃত হয়েছেন সেদিনের অস্ত্রধারীদের মধ্য থেকে মাত্র দুজন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে অন্তত ছয়জন অস্ত্রধারীর ছবি ছাপা হয়েছে, যাঁরা ছাত্রলীগের নেতা। বাকি চারজনকে কেন বহিষ্কার করা হয়নি? তাঁদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে?

ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ‘আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’—প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি তথ্য না আশ্বাস, তা আমরা জানি না। কিন্তু কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার খবর এখনো পাওয়া যায়নি। বরং যাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাঁরা কেউই ছাত্রলীগের নন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিতেই ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী কোনো নেতাকে আসামি করা হয়নি। আসামি করা হয়েছে ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের, যাঁরা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে বর্ধিত ফি ও সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন করছেন।
আর ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে—এটা কোনো খবর নয়। কারণ, এটা যে করা হবে, তা আগে থেকেই সবার জানা। মামলা দায়েরের আগেই সরকারের একাধিক নেতা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, গোলাগুলি করেছেন আন্দোলনকারীদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা শিবিরের কর্মীরা। কিন্তু রহস্যজনক ব্যাপার হলো শিবিরের কোনো অস্ত্রধারীর ছবি কেউ তুলতে পারেনি। এমনকি আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কোনো অস্ত্রধারী শিবিরের কর্মীকে দেখেছেন, এ রকম খবরও পাওয়া যায়নি। শিবিরের কর্মীরা সম্ভবত নিজেদের অদৃশ্য রেখে অস্ত্রচালনার কায়দা রপ্ত করেছেন কিংবা তাঁরা এমন মন্ত্র জানেন, যা পড়ে ফুঁ দিয়ে তাঁরা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ফোটাবেন কিন্তু কেউ তাঁদের দেখতে পাবে না। শুধু অ্যাকশনের সময় অদৃশ্য থাকা কেন? অ্যাকশন শেষ করার পরও তাঁরা বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়ার কায়দা জানেন। নইলে পুলিশ তাঁদের একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারল না কেন? শিবির কি ছাত্রলীগ যে আইনের হাত তাঁদের স্পর্শ করার হিম্মত রাখে না?
না, ছাত্রলীগের কেউ অপরাধ করলে আইন তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না—এমন সাধারণীকরণ সঠিক নয়। দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচারে ছাত্রলীগের ২২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তিনি বলেছেন। আদালতের রায়ে ১৪ জনের ফাঁসির রায়ের সংবাদ ইতিমধ্যে সুবিদিত এবং প্রশংসিত। কিন্তু স্মরণ না করে পারা যায় না যে বিশ্বজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, হত্যাকারীদের কেউই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী নন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও বলেছিলেন একই ধরনের কথা। কিন্তু হত্যাদৃশ্যের ভিডিও ফুটেজ সম্প্রচারমাধ্যমে বারবার প্রচার, পুরো সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা এবং দেশব্যাপী ধিক্কার উঠেছিল। জনমতের প্রবল চাপের ফলে ঘটনার দুদিন পর কোতোয়ালি থানার পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন যে তাঁরা বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামি। কিন্তু ওই দিনই ঢাকা মহানগরের পুলিশ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি, যাঁদের গ্রেপ্তারের কথা বলা হচ্ছে তাঁরা কেউ বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এ রকম কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে পরস্ফুিট হয়েছিল একটিই বিষয়: সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আইনের আওতায় নিতে চায় না, পার পাইয়ে দিতে চায়। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যম দিনের পর দিন লেগে না থাকলে যে বিচার শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা পাওয়া যেত কি না সন্দেহ।
কিন্তু সে জন্য বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার করার জন্য সরকারের যে ধন্যবাদ ও প্রশংসা প্রাপ্য তা অস্বীকার করা যায় না। ধন্যবাদ আমরা দিয়েছি, প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করিনি। এবং আমরা চাই আইন প্রয়োগের এই দৃষ্টান্ত বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে না থেকে যেন সরকারের সাধারণ প্রবণতা হয়ে ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ১৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে, ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে যেতে পারে না, তাদের রগ কেটে দেওয়া হয়—প্রধানমন্ত্রীর এসব অভিযোগের প্রতিকার করার দায়িত্ব সরকারের, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের, ছাত্রলীগের নয়।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমাদের ছেলেদের কি জীবন বাঁচাবার অধিকার নেই?’ সরকারপ্রধানের কণ্ঠে এমন কথা উচ্চারিত হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহারে আরও উৎসাহিত হবেন। এমন কথা তিনি এর আগেও বলেছেন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এবার এ কথাও বলেছেন, ‘তবু সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই, সন্ত্রাসীদের বরদাশত করা হবে না।’ কিন্তু তার পরেই আবার ‘আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে’—এ কথাও বলেছেন। ফলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে যেতে পারে যে ‘আত্মরক্ষার্থে’ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করার পক্ষে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সায় আছে।
কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করলে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য থাকে না। ইসলামী ছাত্রশিবির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় বলে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি ক্রমেই প্রবলতর হয়েছে। তারা তাদের রগকাটা কুখ্যাতি অতিক্রম করে পেশাদার দুর্বৃত্তদের মতো চোরাগোপ্তা হামলাকারী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষত গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তাদের ব্যাপারে আপত্তি শুধু দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের প্রতি প্রচণ্ড নাখোশ। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে নয়, বরং তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে।
সন্ত্রাসের কারণে ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুললে একই কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও যুক্তি পেয়ে যায়। কিন্তু কার যুক্তি কে মানবে, কে মানে এই দেশে? সন্ত্রাসী আচরণের কারণে ছাত্রলীগকে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তুলনা করলে তার প্রতিবাদে এই যুক্তি উত্থাপন করা হতে পারে যে ছাত্রলীগ আক্রমণ করে না, আত্মরক্ষার তাগিদে প্রতিক্রিয়া করে মাত্র। আত্মরক্ষার অধিকার তো ছাত্রলীগেরও আছে। কিন্তু ছাত্রলীগের অভিভাবক দল আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বলে আত্মরক্ষা কিংবা যে প্রয়োজনেই হোক, ছাত্রলীগ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারসহ সহিংসতায় লিপ্ত হলে সরকারের এমন বেকায়দা হয় যে মন্ত্রীরা দিশাহারা হয়ে অসত্য-অর্ধসত্য কথা বলেন। সংবাদমাধ্যম সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। এভাবে ছাত্রলীগ গত পাঁচ বছরে অজস্রবার সরকারকে ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কিন্তু সরকার এটা সহ্য করে কেন?
‘সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই, সন্ত্রাসীদের বরদাশত করা হবে না’—প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি আন্তরিক হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেদিন যে ছয় অস্ত্রধারী ছাত্রলীগের নেতাকে দেখা গেছে, যাঁদের সশস্ত্র ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেককে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হোক। তাঁদের আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে এক গন্ডা মামলা দায়ের করে শত শত শিক্ষার্থীর গায়ে ফৌজদারি আসামির ছাপ্পড় মেরে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। আর ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরাই যদি সব সন্ত্রাসের হোতা হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের একজনকেও পুলিশ এখন পর্যন্ত অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ পাকড়াও করতে পারল না কেন, এই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া দরকার।
শান্তিপূর্ণভাবে যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁদের মামলার আসামি করা ঠিক হয়নি, বাম ধারার ছাত্রসংগঠন করা আইনের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ নয়, আসামির তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া উচিত। শত শত শিক্ষার্থীকে আসামি করে তাঁদের মাথার ওপর একাধিক ফৌজদারি মামলা ঝুলিয়ে রাখলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা কাটবে না, পড়াশোনার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরবে না। কিন্তু এখনকার প্রধান বিবেচনা হওয়া উচিত, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরতে হবে।

মশিউল আলম: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু