তৃতীয় মত: অলঙ্কারিক সংসদ by মাহফুজ আনাম

Friday, January 31, 2014

সংসদ জনগণের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। জাতিকে দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী গঠন করা হয় সংসদ। যারা তাদের নির্বাচিত করেন সে জনগণের স্বার্থে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
যেখানে গণতন্ত্র পূর্ণমাত্রায় কাজ করে সেখানে ধারণা, আদর্শ এবং মতবিনিময়ের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সংসদ এমন একটি জায়গা যেখানে গঠনমূলক বিতর্কের মাধ্যমে জাতীয় পরিকল্পনা গৃহীত হয়। যেখানে ব্যক্তির ক্ষমতা পরাভূত হয় সমষ্টিগত ইচ্ছার কাছে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের ভাগ্য এত ভালো নয়। আমাদের প্রারম্ভিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে। এরপর ১৬ বছর চলে যায় সামরিক সরকার এবং সেনা নেতৃত্বাধীন সরকারের মাধ্যমে। যখন জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য সতিক্যর অর্থে সংসদের কোন অস্তিত্বই ছিল না।
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর একটি কার্যকর এবং স্পন্দনশীল সংসদই ছিল আমাদের সর্বোচ্চ চাওয়া। কিন্তু আমাদের সে চাওয়া পূরণ হয়নি। এরশাদের পতনের পর প্রথম নির্বাচনে পরাজয় আওয়ামী লীগ কখনোই প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেনি। প্রথম দিন থেকেই আক্ষরিক অর্থেই তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। প্রতিনিয়ত ওয়াকআউট, সংসদ বয়কটের মাধ্যমে সংসদের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা, সর্বোপরি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তারা সদলবলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপি যখন বিরোধী দলের আসনে বসে তখন তারা আওয়ামী লীগকে আরও রুক্ষতা এবং রুঢ়তার সঙ্গে ওই আচরণ ফেরত দিয়েছিল। ২০০১ এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সামনে বিরোধী দলের আচরণ পরিবর্তনের সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগানোর পরিবর্তে আমরা তাদের মধ্যে সংসদের ভেতরে-বাইরে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে দেখলাম।
২৩ বছরের সংসদের এমন ইতিহাসের পর বুধবার যে দশম সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছে এ সংসদের কাছে আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি। এ সংসদে এখন পর্যন্ত ২৯৮ আসনের মধ্যে ২৩২ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা রয়েছেন, যা মোট আসনের ৭৭ শতাংশ। জাতীয় পার্টির আসন ৩৪টি বা ১১%, ওয়ার্কার্স পার্টির (মেনন) ৬টি বা ২%, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) ৫টি বা ২%, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) ২টি, তরিকত ফেডারেশনের ২টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১৬টি বা ৫.৩%। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৭৭% আসনের তথ্যটিও পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বাকি দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে এবং আওয়ামী লীগের সমর্থনেই সংসদে প্রবেশ করেছে। শুধু তাই নয়, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন, যা ছাড়া নির্বাচনে জয়লাভ তাদের পক্ষে আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব হতো।
কিছুদিনের মধ্যেই যখন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচিত হবেন তখন আওয়ামী লীগ পাবে আরো ৩৬টি আসন অর্থাৎ মোট ৩৫০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পাবে মোট ২৬৮টি আসন, পরে আরো দুটি আসন যোগ করা হতে পারে। স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী ১৬ সংসদ সদস্যও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, তারা যেকোন সময় সরকারি দলে ঢুকে যেতে পারেন। জাতীয় পার্টি, যাদের সংসদে ৩৫টি আসন রয়েছে তারাও তা পেয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চুক্তি করে। এ অবস্থায় তাদের বিরোধী দলে থাকা হবে কেবই কাগুজে। এটা কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন যখন সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল তখন ভালো কী হয়েছে, তখনতো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বছরের পর বছর সংসদ বয়কট করেছে। এটা সত্য হলেও সংসদীয় কমিটিগুলো বহুক্ষেত্রেই সঠিক কাজ করেছে। মার্জিনাল হলেও তারা কিছু ভালো কাজ করেছে। বুধবার সংসদে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের দেয়া ভাষণ যদি মানদণ্ড হয় তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, দশম সংসদের বহু সময় ব্যয় হবে প্রধানমন্ত্রীর নীতির প্রশংসায়। প্রেসিডেন্টের ভাষণের  কোথাও আগের কোন ভুলভ্রান্তির কথা উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি গত ৫ই জানুয়ারি বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন প্রসঙ্গেও কিছু বলা হয়নি। এর পরিবর্তে এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এবং সব দোষ চাপানো হয়েছে বিরোধীদের ওপর। অন্য অর্থে এ ভাষণ সরকারের নীতিরই প্রতিফলন।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রাথমিক গুণ যদি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে থাকে, উন্নত শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি যদি ভারসাম্যতা হয়ে থাকে এবং জনগণের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতির কথা বলা হয়, তার কোন কিছুই এখন বাংলাদেশে বিদ্যমান নেই। বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছেÑ কিভাবে আমরা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারি এবং বিলুপ্তির পথে থাকা জবাবদিহিতা প্রক্রিয়াকে পুনরুদ্ধার করতে পারি। কিন্তু দশম সংসদ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কোন পথতো দেখাচ্ছে না এমনকি এব্যাপারে কোন দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে না।

(মাহফুজ আনাম: ডেইলি স্টার সম্পাদক, পত্রিকাটিতে শুক্রবার প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)

পাতানো নির্বাচন এবং একব্যক্তিক রাষ্ট্রের প্রশ্ন by মাহফুজ আনাম

Saturday, January 18, 2014

১৯৪৯ সালে জন্মের পর থেকে আওয়ামী লীগ তার সব কর্মকাণ্ডে জনগণের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করেছে। অথচ সেই দলটি নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচন হাইজ্যাক করেছে এবং শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনগণের ভোটের অধিকারকে অস্বীকার করেছে।
এ নির্বাচনে তথাকথিত বিজয় ছিল পূর্বনির্ধারিত। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে- ৩০০টির মধ্যে ১৫৩ আসনে প্রার্থী জয়ী হওয়ার জন্য একটি ভোটেরও প্রয়োজন হয়নি। এটা যদি পূর্বনির্ধারিত না হয় তাহলে কি? এসব এ নির্বাচনকে পাতানো এবং ফলাফলকে বল প্রয়োগের বিজয়ের খেতাব এনে দিয়েছে। এরপর নতুন সরকার গঠনের বিষয়টি আসে, যা যে কোন নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্যে। এ সরকারও গঠন হয়েছে ভোটারদের কোন ধরনের অংশগ্রহণ ছাড়া।

আব্রাহাম লিঙ্কনের সংজ্ঞা যদি আমরা বিশ্বাস করি তবে গণতন্ত্র হচ্ছে, জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। তাহলে ৫ই জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার জনগণের সরকার নয়, জনগণের দ্বারা গঠিতও নয়। এ সরকার  জনগণের জন্য কিনা তাও কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারবে।

শেখ হাসিনা যাই করুন না কেন, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেননি। যদিও তিনি সব সময় দাবি করে থাকেন গণতন্ত্রের জন্য তিনি সংগ্রাম করছেন। সাংবিধানিক ধারাবাহিতকতার নামে তিনি এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, অফিসিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী যে নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট পড়েছে ৩৯ শতাংশ। যা গত নির্বাচনে ৩০০ আসনে পড়া ৮৭ শতাংশ ভোটের তুলনায় অনেক কম। এবারের নির্বাচনে ভোট পড়ার যে হারের কথা বলা হয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভোটের দিন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় যে চিত্র দেখা গেছে তাতে ভোটের হার কিছুতেই ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি হতে পারে না।

৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জনগণের বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যাওয়া। গত দুই যুগ ধরে তাদের যে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, প্রতি ৫ বছর পর পর তারা কোন ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের মত প্রকাশ করতে পারবেন। এখন এ বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। এটাও প্রমাণ হয়েছে, আমাদের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের অধীনে কোন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তা আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি-ই হোক।

এখন আমরা একটি মৌলিক সাংবিধানিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন কি এক ব্যক্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি। সমালোচক হিসেবে নয়, বরং গণতন্ত্রের বন্ধু হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে তার হাতে থাকা অসীম ক্ষমতার ব্যাপারে সতর্ক করছি। লর্ড অ্যাকটিন এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন, ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়।

আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ- নির্বাহী বিভাগ, সংসদ এবং বিচার বিভাগ। আজকের দিনে শেখ হাসিনা প্রশ্নাতীতভাবে এবং কার্যকরভাবে দু’টি স্তম্ভ নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণভাবে রীতি অনুযায়ীই আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইন প্রণয়নকারী বিভাগ-সংসদের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বিরাট প্রভাব রয়েছে। যদিও সর্বশেষ নির্বাচনের পর নতুন অগ্রগতিও হয়েছে। এমনকি এখন বিরোধী দলও প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিরোধী দলের একটি অংশ মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে, আরেকটি অংশ রয়েছে বিরোধী দলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে। আমরা সবাই জানি, কিভাবে বিরোধীদলীয় নেতা তৈরি করা হয়েছে। এবং তথাকথিত বিরোধীদল কিভাবে সরকারের মন্ত্রিসভায় আরও স্থান পাওয়ার জন্য দরকষাকষি করছে। এই পরিস্থিতিতে সংসদের ওপরও প্রধানমন্ত্রীর পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বাকি থাকে বিচার বিভাগ। ঐতিহ্যগতভাবেই বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে থাকে। উচ্চ আদালতের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাবের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না।

আমরা এখন এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আছি যেখানে সরকারের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভারসাম্য নেই। সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাসের ওপরই সুশাসন নির্ভর করে। রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভের হাতে বেশি ক্ষমতা চলে গেলে তা সরকার ব্যবস্থার জন্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। সরকার ব্যবস্থায় ভারসাম্য নীতির অভাব আরও অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে।

সাধারণ পরিস্থিতিতে কোন দলের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয়কর হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপের ইতিহাস রয়েছে। তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নিয়ন্ত্রণাধীন বিরোধী দল, ভারসাম্যহীন ক্ষমতার অধিকারী নেতার আবির্ভাব এবং এমন কোন প্রতিষ্ঠান না থাকা যা তাকে দায়বদ্ধ করতে পারে, এ অবস্থায় লর্ড অ্যাকটিনের ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হওয়ার বড় ঝুঁকি রয়েছে। এটা রেকর্ডে থাক যে, সর্বপ্রথম সতর্কঘণ্টা আমরাই বাজিয়েছিলাম।

সিইসি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন- প্লিজ, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন বন্ধ করুন by মাহফুজ আনাম

Saturday, December 28, 2013

কেন ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত নয়? কারণ তা আমাদের সংবিধানে বর্ণিত নির্বাচন ধারণার পরিপন্থি, কারণ তা এখনও পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের যে আস্থা আছে তা ধ্বংস করে দেবে। কারণ, এ নির্বাচন সামনে দিনগুলোতে আরও মৃত্যু ও সহিংসতার কারণ হবে,
তা অর্থনীতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এরই মধ্যে এ নির্বাচনের কারণে অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তার বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে, বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপিত করবে। আরও সহিসংতা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, গার্মেন্টের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে। চলমান অস্থিরতা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করবে এবং আইনশৃঙ্খলা আরও ভেঙে পড়বে।

আমরা এখন যেসব সঙ্কট মোকাবিলা করছি ৫ই জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন কি তার কোনটির সমাধান করবে? এ নির্বাচন কি হরতাল-অবরোধ, রাজপথের সহিসংতা বন্ধ করবে? তা কি দারিদ্র কমাবে? এ নির্বাচন কি হত্যা এবং অগ্নিসংযোগ বন্ধ করবে? আমরা সবাই জানি তা বন্ধ হবে না। সুতরাং, কেন আমরা এমন কিছু করবো যা কোন সঙ্কটরেই সুরাহা করবে না। এবং তা শুধু জনগণের দুর্ভোগই বাড়াবে। অন্য অনেকের চেয়ে শেখ হাসিনা ভালো জানেন, যখন সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে তখন জনগণ সরকারকেই দায়ী করবে। সুতরাং, অস্থিরতা অব্যাহত থাকলেও তিনি আরও কিছু হারাবেন। তিনি জনসাধারণের এ ধরনের আচরণ থেকে লাভবান হয়েছিলেন যখন তিনি বিরোধী দলে ছিলেন।
নির্বাচন বিষয়টি আসলে কি? এটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা, যা প্রতি পাঁচ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ভোটাররা অংশ নেন অথবা না নেন? এটা কি শুধু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ভোটারদের অংশ নেয়া না নেয়ার ব্যাপারে কোন দায়িত্ব নেই। এটা কি ভোটারদের সঙ্গে খেলা শুধু লিগ্যাল গেইম, যাতে এমনকি ভোটারদের ভোটদানের সুযোগ না দিয়েও কেউ নিজেদের এমপি হিসেবে নির্বাচিত করতে পারে? যদি এগুলো সত্য হয় তাহলে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে।


অন্যদিকে, নির্বাচন যদি জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশ হয়, যদি তা একটি প্রক্রিয়া হয় যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রকাশ ঘটান, যদি তা একটি ইভেন্ট হয় যার মাধ্যমে জনগণ নতুন সরকার পছন্দ করে, যদি তা একটি প্রক্রিয়া হয় যার মাধ্যমে জনগণ কিছু পলিসি অনুমোদন করেন যা তাদের নতুন সরকারের দ্বারা তারা কার্যকর দেখতে চান, যদি একটি প্রক্রিয়া হয় যার মাধ্যমে জনগণ যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা যারা দুর্নীতিবাজ তাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। তাহলে কি ৫ই জানুয়ারি একটি হাস্যকর তামাশা হতে চলছে যা গণতন্ত্র থেকে একেবারেই দূরবর্তী। এটা অর্থগত, উদ্দেশ্যগত এবং চেতনাগত দিক থেকে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বড় যুক্তি দেখান, বাংলাদেশ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা শাসিত হতে পারে না। আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর এ যুক্তি মেনে নিই তাহলে স্বাভাবিকভাবেই নতুন সংসদ এবং সরকার গঠনের ক্ষেত্রে নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী নতুন সংসদ ও সরকার গঠিত হয় জনগণের রায়ের মাধ্যমে, প্রাপ্ত বয়স্করা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এ রায় দিয়ে থাকেন। এটাই আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা।
অন্যদিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হবেনÑ তা কখনও আমাদের সংবিধানের চেতনা নয়। এরই মধ্যে ৩০০ আসনের বিপরীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বাকি ১৪৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নামমাত্র। শেখ হাসিনা ১৫তম সংশোধনী আনার ব্যাপারে বারবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা বলে থাকেন। ওই রায়েই প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। একই রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, জনগণের নির্বাচিত ছাড়া অন্য যে কোন ধরনের সরকার ব্যবস্থা সংবিধান ঘৃণা করে। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক। গণতন্ত্রের মত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনও গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের প্র্যাকটিসের কোন সুযোগ নেই। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে সংসদের কোন আইনগন ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের সংসদ সার্বভৌমও নয় এবং এ ধরনের সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্বও নেই। বিচারপতি মিঞা আরও লিখেছেন, সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত নির্বাচন বলতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকেই বুঝানো হয়েছে। যদি প্রার্থীরা শক্তি, অর্থ এবং সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচিত হন, তবে ওইসব সংসদ সদস্যকে জনগণের প্রতিনিধি বলা যায় না এবং সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদের আলোকে এ ধরনের সংসদকে সংসদ বলা যায় না। এ ধরনের সংসদ আমাদের পূর্বপুরুষ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আশা-আকাক্সক্ষারও পরিপন্থি।
সুতরাং, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে কি ধরনের সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠা হবে। কত সংখ্যক মানুষের সমর্থন তাদের প্রতি রয়েছে। এর বৈধতা কি? জনগণের কি ধরনের প্রতিনিধিত্ব এতে রয়েছে। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের মাধ্যমে খুবই সামান্য কিছু অর্জন করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ যাই বলুক না কেন ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ১৪৬ আসনে নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী সংসদ সদস্যদের জন্য গঠিত সংসদ কখনওই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের মতো বৈধতা দাবি করতে পারে না। কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার শুধু তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আর খ্যাতি হারাতে পারে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফর্মুলা শুধুমাত্র সময়ের অপচয় এবং তা মানুষের দুর্ভোগ ও অর্থনীতির ক্ষতির মাত্রাই শুধু বাড়াবে। আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প হচ্ছে সত্যিকার অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। এটা দেশ এবং দেশের বাইরে আওয়ামী লীগের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে।
সুতরাং, আমরা দু’টি প্রধান দলকে গণতন্ত্র রক্ষায়, রক্তপাত ও অর্থনীতির ধবংস এড়াতে নিম্নের প্রস্তাবগুলো দিচ্ছি:
১. নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীন দলের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করা উচিত। সত্য হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না। ১৫৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকাই দশম সংসদের বিশ্বাসযোগ্যতা ধবংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনের এটা ভাবনায় নেয়া প্রয়োজন যা হতে চলেছে তা বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণের সঙ্গে গণতন্ত্রের নামে প্রতারণা।
২. শেখ হাসিনার উচিত নবম সংসদের অধিবেশন আহ্বান করা এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা খুঁজে বের করা। এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। এটা প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার ধারণার মধ্যেই হতে পারে। একমাত্র কঠিন বিষয়টি হলো কে হবেন ওই সরকারের প্রধান? আমরা মনে করি প্রেসিডেন্ট জাতিকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে পারেন যদি সবাই তাকে অনুরোধ করেন। প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমন- স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপনও প্রেসিডেন্টের কাছে থাকতে পারে। নবম সংসদ পরবর্তী নির্বাচন ও সরকার গঠনের জন্য ৯০ দিন সময় বেঁধে দিতে পারে।
৩. যদি নবম সংসদের অধিবেশন আহ্বান করা হয় তবে বিএনপির উচিত হবে কোন ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই সংসদে যোগ দেয়া এবং সবধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করা। একই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সমঝোতা প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া উচিত।
৪. জামায়াতের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি হাইকোর্টের রায় পূরণের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ, গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি রক্ষায় রাজনৈতিক সমঝোতাই সবচেয়ে জরুরি। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আমরা বলতে চাই, আমাদের ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোন অধিকার আপনাদের নেই। বিরোধী দলকে আমরা বলতে চাই, আমাদের হত্যা, অগ্নিদগ্ধ এবং আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার কোন অধিকার আপনাদের নেই। আমাদের নিজেদের আমরা বলতে চাই, আমাদের রাজনীতিবিদরা যখন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছেন এবং দেশকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে চলছেন তখন আমরা সাইড লাইনে বসে থাকতে পারি না। আপনার উদ্বেগ শোনা ও বিবেচনায় নেয়ার জন্য আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করুন।

 (ডেইলি স্টারে শুক্রবার প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনামের লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)

একটি ছবি ও একটি ট্রেন- আমরা এই রাজনীতির তীব্র নিন্দা জানাই by মাহফুজ আনাম

Friday, November 29, 2013

আজ আমরা এমন এক ছবির কথা লিখছি, যা ছাপতে পারিনি। লিখছি এমন এক ট্রেনের কথা, যে ট্রেনের ৫০০ জন যাত্রী হয় মারা পড়তেন, নয় তো মারাত্মকভাবে আহত হতেন। ছবিটি আমরা ছাপতে পারিনি। এটি ছিল খুব হূদয়বিদারক, অতি জীবন্ত আর বড় বেশি সামঞ্জস্যহীন।
এটা ছিল আনোয়ারা বেগমের (৪০) ছবি। সরাসরি তাঁর মাথা লক্ষ্য করে ছোড়া ককটেলের আঘাতে মগজের কিছু অংশ উড়ে যায়। আমাদের প্রতিবেদক জায়মা ইসলাম ওই দৃশ্যের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘চিকিত্সকেরা যখন আনোয়ারার মাথায় পেঁচানো কাপড় সরালেন, অনুধাবন করলেন তাঁর মাথা থেকে গলগলিয়ে বের হতে থাকা রক্ত বন্ধ করাটাই যথেষ্ট কাজ নয়, তাঁর খুলিটা রক্ষা করা হবে আসল কাজ। অস্ত্রোপচারের টেবিলে আনোয়ারা চাঁদির হাড়ের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, বের হয়ে ছিল তাঁর মগজের উপরিভাগ। ক্ষত থেকে বের হচ্ছিল গান পাউডারের উগ্র গন্ধ।’

আনোয়ারা বেগম সাধারণ মানুষ। একটি ব্যাংকে রান্নাবান্নার কাজ করতেন। সেদিন কাজ শেষে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে বিরোধী দলের মিছিল দেখে এক পাশে সরে দাঁড়ান তিনি। তখনো জানতেন না আর মাত্র কয়েক গজ দূরেই তাঁর মৃত্যু। দেশে যা ঘটছে, এর সঙ্গে যার কোনো সম্পর্কই নেই, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এমন একজনকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়া হলো কেন, তা বোধগম্য নয়। এখানে শুধু একটা জিনিসই বোঝা যায়, একজন মানুষকে হত্যার লক্ষ্য হচ্ছে আতঙ্ক সৃষ্টি।

সাবেদ আলী নামের একজন সিএনজি অটোরিকশা চালকের গাড়ি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছোড়া হলে তিনি আগুনে দগ্ধ হন। এতে তাঁর মুখমণ্ডল ও শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায়। তার বাম হাতের মাংস হাড় পর্যন্ত পোড়ে।

রুবেল নামের আরেক সিএনজি অটোরিকশা চালকের গল্পও একই। ককটেল বিস্ফোরণে তাঁর গাড়িতে আগুন লাগে। তাঁর বেলায় যা ঘটেছে, দুর্বৃত্তরা প্রথমে অটোরিকশা উল্টে দেয়। এতে ভেতরে আটকা পড়েন তিনি। এর পর ককটেল ছোড়া হয়। হামলাকারী যে তাঁকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, এখানে তা পরিষ্কার। একজন সাহসী পথচারীর চেষ্টায় রক্ষা পান তিনি।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিএর দুজন কর্মী পরস্পরের দিকে ফুটন্ত পানি ছুড়ে মারেন। এ পানি গায়ে পড়ে সাত বছরের শিশু রাকিবের। শরীরের ১৫ শতাংশ ঝলসে যায় তার।

গত মঙ্গল ও বুধবাররের সহিংসতায় ১৬ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে বুধবারই মারা গেছেন সাতজন। গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন ২৯০ জন। একই সময়ে দুই শিশু নিহত হয় এবং ১৪ বছরের মনিরসহ ১৯ জন গুরুতর আহত বা দ্বগ্ধ হয়েছে। বাবার সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছিল মনির। ৪ নভেম্বর রাস্তার পাশে রাখা বাবার ভ্যানগাড়িতে ঘুমিয়ে ছিল মনির।  এ সময় ওই গাড়িতে লাগানো আগুনে দগ্ধ হয় সে।

চট্টগ্রামগামী মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনে ৫০০ জন যাত্রী ছিল। চাঁদপুর ও লাকসামে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল। দুই কৃষক সময় মতো সতর্ক করে দেওয়ায় ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। শেষ রাতে ওই রেলপথের ৬০ ফুট উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এতে ভোর পাঁচটার দিকে রওনা হয়ে যাওয়া ট্রেনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতো।  আকাশে ওড়ার সময় পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে একটি বিমানের যে ক্ষতি হয়, রেললাইন উপড়ে ফেলার ভয়াবহতাও একই রকম। এটা কীভাবে আমাদের নিয়তি হতে পারে? দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যেসব সাধারণ মানুষ জড়িত নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের হত্যার পরিকল্পনা কীভাবে করতে পারে দেশের নাগরিকদের একটি অংশ?

যে রাজনীতির লক্ষ্য মানুষ হত্যা করা, তা কখনো জনগণের রাজনীতি হতে পারে না। আজকাল ভেবেচিন্তেই মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। যেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নামে কিছু খুনিকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য হত্যা করা, যানবাহন ও দোকানে আগুন দেওয়া। অন্য কথায় বলতে গেলে, তাদের কাজ হলো সর্বোচ্চ ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো।

তা নাহলে যাত্রী সেজে হিউম্যান-হলারে আগুন দেওয়ার ঘটনার ব্যাখ্যা কী দেব? তারা চালকের পালানোর পথ বন্ধ করার চেষ্টা চালায়, যাতে তিনি পুড়ে মরেন। এ ধরনের সাধারণ যাত্রী সেজে গণপরিবহনে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা উঠে পড়ে। গান পাউডার ছিটিয়ে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নামার শেষ মুহূর্তে জ্বলন্ত দেশলাই কাটি ছুড়ে মারে।

এটি কীভাবে অবাধ নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হতে পারে?

বাংলাদেশে আজ বিরোধীদলের কর্মীরা দেদার মানুষ মারছেন। এখানে একজন পথচারী মারা পড়েন তো সেখানে মারা যাচ্ছে একজন স্কুলছাত্র, আরেক জায়গায় হত্যা করা হচ্ছে কোনো সিএনজি অটোরিকশা চালককে। এসব হত্যার ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পূর্বপরিকল্পিত হত্যার হিসেবে অবশ্যই নিন্দনীয়।

এ বছরের শুরুতে রাজনৈতিক আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেওয়ার পর থেকে যাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাদের রক্ত স্পষ্টতই খালেদা জিয়ার হাতে লেগে আছে। আমরা বিশেষত এ ব্যাপারে তাঁর দোষ ধরতে পারি যে নিরীহ পথচারীদের মৃত্যুতে তিনি কখনো নিন্দা জ্ঞাপন করেননি, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনায়, যারা কোনোভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়।  এতগুলো মৃত্যুর ঘটনায় তিনি কখনো সামান্য সহানুভূতি বা সমবেদনা জানাননি।

যাই হোক, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি বলতে পারবেন এসব ঘটনার জন্য তাঁর কোনো দায়দায়িত্ব নেই? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি মীমাংসিত প্রশ্ন নতুন করে তাঁর তুলে ধরাটাই কি বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মূল কারণ নয়? তিনি কি সর্বান্তকরণে বলতে পারবেন, বিরোধী দলকে আলোচনায় আনতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছেন? একটি সমাধানের লক্ষ্যে সরকার ও শাসক দলের পক্ষ থেকে যে যথেষ্ট নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, খতিয়ে দেখতে গেলে এই দাবি কি টিকবে? প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপক সাফল্যের সব দাবি যদি আমরা মেনেও নিই, তিনি যে বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় (অনেকে বলেন এ মনোবৃত্তি তাঁর কখনো ছিল না) পৌঁছাতে এবং স্বাধীনতার উত্সব বলে পরিচিত নির্বাচনমুখী শান্তির পথ এনে দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ, এর প্রমাণ রয়েছে।

আবারও বলছি, এ বছর ৪৮ দিনের হরতালে মারা গেছে ২৯০ জন। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর-নভেম্বরেই মারা যান ৩৪ জন। এ ছাড়া দুই শিশু নিহত ও ১৯ জন আহত হয়।

কারা এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী?

আমরা এখানে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, রাজনৈতিক কারণেই এ সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এটি জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা। বিরোধী দল গণআন্দোলনের পথে যাওয়ার বদলে সহিংসতা ও হত্যার পথ বেছে নিয়েছে। শুরু তারা গণআন্দোলন গড়ার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়েছে। রাজপথে কোনো গণসমাবেশ নেই, নেতা-কর্মীরা মাঠে নেই, আছে কেবল সন্ত্রাসীরা, যাদের কাজই হলো মানুষের শরীরে ও সম্পত্তিতে আগুন লাগানো।

মানুষের হূদয় ও মনকে জয় করার কোনো চেষ্টা চলছে না, চলছে কেবল মানুষকে সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা। তারা ৪৮ ঘণ্টার ‘অবরোধ’ কর্মসূচির সময়  যেভাবে বাড়াল, এতে জনগণকে নিয়ে না ভাবার বিষয়টি বরং জোরালো হয়ে ওঠে। ‘অবরোধের’ চরিত্র হরতালের মতো হওয়ার কথা নয়। শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো শহুরে নাগরিকদের বিচরণের কিছু বিষয় এ ধরনের আন্দোলনের আওতামুক্ত থাকার কথা। তবে শহরের ভেতরে চলাফেলা করলেই বেপয়োরা হামলার শিকার হয়েছে মানুষ। যেসব বিদ্যালয় খোলা রাখ চেষ্টা চলেছে, তাদের প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

এসব ঘটনায় মৃত্যুর জন্য যদি বিরোধীদলকে দায়ী করা হয়, তবে একইভাবে এর দায়ভার সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ওপরও বর্তায়। এ পরিস্থিতির সমাধানে ক্ষমতাসীন দল সত্যিকার অর্থে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।  সংলাপের জন্য জনগণের যে দাবি, তা পূরণে বিরোধীদলের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো সত্যিকার পদক্ষেপ  নিতে দেখা যায়নি। সংলাপের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও একের পর এক অবমাননাকর মন্তব্য সমঝোতার সম্ভাবনাকে নস্যাত্ করে দিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জামিন নামঞ্জুর ও রিমান্ডে পাঠানোর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়, ক্ষমতাসীন দল সফল কোনো সংলাপ চায় না, বরং পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।

সহিংসতা ও মৃত্যুর জন্য আমরা বিরোধী দলকে এককভাবে দায়ী করার পাশাপাশি সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকেও দায়ী করব। কারণ তারা সমাধানের বদলে আমাদের রাজনীতিকে আরও সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এ লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন খবর পেলাম, গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শিশুপার্কের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে চারজন নারীসহ ১৯ যাত্রী দগ্ধ হন। গান পাউডার দিয়েই হোক আর পেট্রোল বোমা মেরেই হোক, হামলাটি যেভাবে চালানো হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অবরোধের চরিত্র কী হবে—এ বিষয়ে বিরোধী দল সচেতনভাবে অস্পষ্টতা জিইয়ে রেখেছে। এটি কখনো হরতালের মতো হবে না।

আমরা এ রাজনীতির নিন্দা জানাই এবং এর প্রতি তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা ও চরম বিরক্তি প্রকাশ করছি। আমরা রাজনীতির নামে সহিসংতা ও মৃত্যুর এ উন্মত্ততার অবসান চাই। এই অনৈতিক, কুরুচিপূর্ণ, নৃশংস, স্বার্থান্বেষী ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির প্রতি আমাদের ধৈর্য এখন শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে এবং আমরা এর মূলনীতির প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। এটা গণতন্ত্র হতে পারে না।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক, ডেইলি স্টার

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু