‘সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষীর মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ১২ বছর’

Tuesday, January 28, 2014

মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দায়ের করা আপিলের শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থান শুরু করেছেন তার আইনজীবী।
প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির বেঞ্চে মঙ্গলবার এ যুক্তিতর্ক শুরু হয়। এসময় সাঈদীর আইনজীবীর এস এম শাহজাহান বলেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষার সনদ অনুযায়ী প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মাহবুব আলম হাওলাদার ১৯৫৯ সালের ২০শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাহলে একাত্তরের মে মাসে তার বয়স ছিলো ১২ বছর দুই মাস। এত কম বয়সী একজন বালকের সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। এছাড়া দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবিন ঘটনার সময় এলাকায় ছিলেন না। পরে বুধবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়। গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে তার বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয় বলে বলা হয়। এরমধ্যে দু’টি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পরপরই সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম এ সহিংসতায় একশ’ এর বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

প্রসঙ্গ জামায়াত- আওয়ামী লীগের উস্কানি বিপদে বিএনপি

Sunday, January 26, 2014

বিএনপির কারাবন্দি জ্যেষ্ঠ নেতা মওদুদ আহমদ ইঙ্গিত করেছেন যে, ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে ‘আওয়ামী লীগের উস্কানিতেই’ জামায়াতকে বিপদে ফেলেছিল।
আবার তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই জেনারেল এরশাদকে গুলশানের সাব-জেল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছিল। অথচ আওয়ামী লীগ পরে এই দু’টি দলকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির নির্বাচিত সরকার উৎখাতের আন্দোলনে শরিক হয়েছিল।

২০১২ সালে মওদুদ আহমদের বইটি প্রকাশ করেছে ইউপিএল। ‘বাংলাদেশ এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস’ শীর্ষক বইয়ে মওদুদ আহমদ জামায়াত-বিএনপি সমঝোতা এবং তা ভঙ্গ হওয়ার নেপথ্য ইতিহাস বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। মওদুদের বর্ণনা মতে, জেনারেল মোহাম্মদ নুর উদ্দীন খান খালেদা জিয়া ও গোলাম আযমের মধ্যে দূতিয়ালি করেন। স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর বাসভবন। এখানে বেগম খালেদা জিয়া, গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর মধ্যে বৈঠকটি হয়। সে সময় ১৮ আসনধারী জামায়াত ওই বৈঠকের পর প্রেসিডেন্টকে লিখিতভাবে বিএনপিকে সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয়।
মওদুদ লিখেছেন, ‘কি করে সমঝোতা রদ হলো সে প্রশ্নটি কোন আদালতের মামলার বিষয় ছিল না। কিংবা তার নাগরিকত্বের কারিগরি দিক নিয়েও ছিল না। এমনকি অধ্যাপক গোলাম আযম একজন কোলাবরেটর ছিলেন কি ছিলেন না কিংবা এই প্রশ্নও ছিল না যে বাংলাদেশ থেকে তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি ছিল না।’
এরপর মওদুদ বলেন, ‘কিন্তু এই প্রশ্নটি এক বিশাল বিস্ময়ের সঙ্গে তোলা যেতে পারে যে কি করে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে গঠিত সরকার তাদের আমীরকেই কারাগারে পাঠিয়েছিল? সেটা কেবল দুই নেতার মধ্যকার সমঝোতার লঙ্ঘন নয় সেটা রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটি ঘোরতর প্রতারণাও বটে। যদি জামায়াত ও অধ্যাপক  গোলাম আযম পাাকিস্তানি দখলদার সরকারের সহযোগীই হয়ে থাকবেন, তাহলে বেগম জিয়া কেন সরকার গঠনে ১১ বামপন্থি সংসদ সদস্যের সমর্থন নিলেন না?’ তিনি ইঙ্গিত দেন যে, ওই বামেরা যাদের কেউ কেউ এখন মহাজোটে সক্রিয় তারা খালেদা জিয়াকে সমর্থন দিতে চেয়েছিলেন।
মওদুদ আরও লিখেছেন, গোলাম আযম দেশের ভেতরে ও বাইরে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় অংশ নেন বলে বিএনপি সরকারের পক্ষে আদালতে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়। ১৯৭১ সালের পর গোলাম আযম পাকিস্তানের নাগরিক হন। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ তিনি নেননি। জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডাররা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয় কেবল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতেই। গোলাম আযম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজাকার, আলবদর এবং আল-শামসের মতো বাহিনী গঠনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বর্বর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে তাকে দেখা যায়। অধ্যাপক আযমকে লিবিয়ায় একটি সম্মেলনে যোগ দিতেও দেখা যায়। সেখানে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি আবেদন জানান। মুজিব সরকার গোলাম আযমসহ ৩৮ জনকে তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে।
মওদুদ আহমদ তথ্য প্রকাশ করেন যে, ‘জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে গোলাম আযমের নিয়োগ এবং তার নাগরিকত্ব ফেরত দান ছিল সমঝোতার শর্ত। মওদুদ আহমদ পরোক্ষ মন্তব্য করেন যে, সেদিন প্রকারান্তরে জামায়াতের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করা হয়েছিল। নাগরিকত্ব ও আমীরত্ব না দিয়ে বরং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গোলাম আযম কারাগারে ছিলেন পুরো রমজান মাস।
এরশাদ ও জাপা: মওদুদ মনে করেন, ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরের পর জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি ও তার নেতাকর্মীদের প্রতি বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতি অনুসরণ করে। তার ভাষায়, ‘অভিযোগ রয়েছে যে জামায়াতে ইসলামীর মতোই জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধেও বিএনপি প্রতিহিংসামূলক নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। আর তাতে আওয়ামী লীগ অনেকটাই উস্কানি দিয়েছিল। এর ফলে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের সঙ্গে দেশের প্রধান ধারার দল এবং শক্তিশালী মিত্রদের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি করে।’
মওদুদ আহমদ স্মৃতিচারণ করেন যে, ‘সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, এরশাদ কেন কূটনৈতিক এলাকার বিলাসবহুল বাড়িতে থাকবেন? এরপরই খালেদা জিয়া তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। আবার গোলাম আযমের ক্ষেত্রেও দলটি একই সুর তোলে। বলে যে, বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও গোলাম আযম কেন আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে থাকবেন? দেশের একটি রাজনৈতিক দলের আমীর হবেন? তখন বিএনপি সরকার অমনি তাকে দ্রুত দেশের বাইরে পাঠাতে তোড়জোড় শুরু করে। অথচ সময় গড়ালে দেখা গেল জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের অসম্মানজনক গদিচ্যুতি নিশ্চিত করেছিল।’

রাষ্ট্র ও রাজনীতি- বিএনপির ঘাড়ে সিন্দবাদের বুড়ো by আবদুল মান্নান

Wednesday, January 22, 2014

আরব্য রজনীর গল্পে আছে, সিন্দবাদ সাতটি সমুদ্রযাত্রা করেছিল। প্রতিটি যাত্রায় তার যত সব রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। সিন্দবাদের পঞ্চম যাত্রার গল্পে আছে, তার কাঁধে এক বুড়ো সওয়ার হয়েছিল।
বুড়ো আবার কাঁধে এমন প্যাঁচ কষে বসেছিল যে সিন্দবাদ বস্তুতপক্ষে বুড়োর ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল। শেষে সিন্দবাদ বিশেষ সুরা তৈরি করে বুড়োকে পান করিয়ে তাকে হত্যা করে। সিন্দবাদ তো বুড়ো থেকে নিস্তার পেতে একটা উপায় বের করেছিল। কারণ, সে বুড়োর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিএনপির ঘাড়ে জামায়াত নামের যে বুড়ো বা দৈত্যটি গেড়ে বসেছে, সবার প্রশ্ন, তার কী হবে? কারণ, বিএনপি নামের সিন্দবাদ তো এই দৈত্যটিকে বধ করতে নারাজ।

বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান সম্পর্ক অনেকটা দুজন দুজনার মতো। অবশ্য এর আগে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত একই মায়ের পেটের দুই ভাই। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাম্প্রতিক কালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির যে রাজনৈতিক বিপর্যয়, তার প্রধান কারণ জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আর দেশ ও সম্পদ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, যা দেড় বছর ধরে চলে আসছে। আন্দোলনের নামে তাদের মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো ভয়ানক অমানবিক কর্মকাণ্ড বিএনপির অনেক গোঁড়া সমর্থককেও বিএনপিবিমুখ করেছে।

কদিন আগে দায়িত্বশীল বিএনপি ঘরানার এক সরকারি কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, জামায়াতের খপ্পরে পড়ে বিএনপি নিজের পাকা ধানে মই দিয়েছে। নির্বাচনের আগে অনেকে তাদের ধারণা দিয়েছিল, নির্বাচনে অংশ নিলে ভালো করবে, এমনকি হয়তো সরকারও গঠন করতে পারে। কিন্তু জামায়াত নির্বাচনে যাওয়া থেকে বিএনপিকে বিরত রাখতে পেরেছে। কারণ, বিএনপির ‘আন্দোলন’ আর জামায়াতের ‘আন্দোলন’ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বিএনপি চাইছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন আর জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো উপায়ে মহাজোট সরকারকে উৎখাত করে বিএনপির সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচাল করা। এই দুটি দলই আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।

আওয়ামী লীগের অনেক অক্ষমতা আর দুর্বলতা আছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের এখনো একটি রাজনৈতিক চরিত্র আছে আর আছেন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা। অনেকেই আওয়ামী লীগের মতাদর্শের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বিএনপির তেমন রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই। তারা বুঝতে পারে না, সাধারণ মানুষ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি সচেতন। লক্ষ করলে, বেগম জিয়ার চারপাশে, যাঁরা তাঁকে সব সময় ঘিরে থাকেন, তাঁরা প্রায় সবাই সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা। তাঁরা গুলশানের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের আলো-আঁধারে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিএনপির এই নেতারা মিডিয়ার সামনে এলে, আধো ইংরেজি আধো বাংলায়, যা জনমানুষের কাছে দুর্ভেদ্য, তেমন ভাষায় কথা বলেন। আর সরকার অফেন্সিভে গেলে আত্মগোপন করেন। নির্বাচনের আগে তাঁরা ভিডিওবার্তার সাহায্যে আন্দোলন পরিচালনা করার নতুন সংস্কৃতি চালু করেছেন। শুধু দেশের ভেতর থেকেই আন্দোলনের এমন আহ্বান আসছে, তা-ই নয়, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকেও আন্দোলনের এমন বার্তা পাঠাচ্ছেন। যে রাজনৈতিক দল এমন নেতাদের ওপর ভর করে সরকারবিরোধী রাজনীতি করতে চায়, তারা বোকার স্বর্গে বাস করে।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সমালোচকেরা তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেন, কিন্তু তারা যে একটি সন্ত্রাসী দল, তেমন অভিযোগ একটাও নেই। মিছিল করে যাওয়ার সময় তারা দু-চারটি গাড়িতে আগুন দেয়, পুলিশের সঙ্গে মারদাঙ্গায় লিপ্ত হয় অথবা কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ছাত্রশিবিরের মতো বলা যাবে না তারা গণহারে প্রতিপক্ষের রগ কাটে, গলা কেটে মানুষ হত্যা করে অথবা নির্বিচারে সংখ্যালঘু আর আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়ি বা গ্রামে আগুন দেয়।

এযাবৎ ছাত্রশিবির যত সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল ছাত্রদলের সঙ্গে। আমার আগের কর্মক্ষেত্রে জিয়া পরিষদের সভাপতি ড. এনামুল হকের ছেলে মুসাকে তো ওরা পিটিয়েই মেরে ফেলেছিল। ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আবদুল হামিদ ছাত্রদল ছেড়ে এরশাদের ছাত্রসমাজে যোগ দিয়েছিল। তাঁর হাতের কবজি কেটে কিরিচের মাথায় গেঁথে শিবির ভরদুপুরে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছিল। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি শিবিরের রাজনীতির একজন বড় বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। ড. কাজী আহম্মদ নবী মনেপ্রাণে জিয়ার আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর একমাত্র ছেলে মুসফিক প্রগতিশীল রাজনীতিতে নতুন দীক্ষা নিয়েছেন। এক গুলিতেই তাঁকে শেষ করে দিল শিবিরের সন্ত্রাসীরা। হেলালি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ছাত্রদলের নেতা। তাঁকে ১০ জনে টেবিলের ওপর চেপে ধরে চোখ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সময়মতো শিক্ষকেরা সেখানে হাজির না হলে হেলালি এখন অন্ধ হয়ে হয়তো বেঁচে থাকতেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপির মনোনয়নে সংসদ নির্বাচন করেছেন। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যখন শিবির ছাত্রদলের ওপর হামলা করে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল, তখন ক্ষমতায় বেগম জিয়া। তিনি কিন্তু তাঁর দলের আহত সদস্যদের একবারও দেখতে যাননি, গিয়েছিলেন সে সময়কার সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। দুই নেত্রীর মধ্যে এটাই তফাত।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেগম জিয়ার অনেক সমর্থক আর উপদেষ্টা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, একটি শক্তিশালী দেশের এক কূটনীতিককে বাংলাদেশে তাঁদের রাজনৈতিক চালের বিপর্যয়ের কারণে নিজ দেশ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ২০০৬ সালেও ঠিক তেমনটি ঘটেছিল। বিদেশিরা এখন বলছে, বেগম জিয়াকে জামায়াতের সংস্পর্শ ছাড়তে হবে। এত দিনে তারা উপলব্ধি করেছে, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এই দেশগুলোই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল, ‘জামায়াত একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল’। কিন্তু তারা বললেই তো আর বেগম জিয়া বা বিএনপি জামায়াতকে ছাড়তে পারবে না। অদৃশ্য কারণে বিএনপির রাজনীতি জামায়াতের কাছে বাঁধা রয়েছে বলে বিশ্বাস।

সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনসভা করল। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, এটি ১৮ দলের জনসভা। পরে জানা গেল, এটি বিএনপির জনসভা। জামায়াতকে নাকি সভায় আসতে নিষেধও করা হয়েছিল। জামায়াত এসেছিল, কিন্তু ব্যানার ছাড়া। সঙ্গে ছিলেন হেফাজতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। মঞ্চেও জামায়াতের নেতারা ছাড়া শরিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রামেও অনুরূপ একটি সমাবেশ হয়েছিল এবং সেখানে মঞ্চে জামায়াতের নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মঞ্চে জামায়াতকে দেখে আর মঞ্চে ওঠেননি। নিচে বসে তাঁর ছাত্রদের বলেছেন, এখনো যদি বিএনপির বোধোদয় না হয়, তাহলে তাদের ভবিষ্যতে ভালো তো কিছু দেখি না।

বেগম জিয়ার সব উপদেষ্টা হিসেবে সামরিক-বেসামরিক আমলা ছাড়াও আছেন বেশ কিছু আইনজীবী নতুবা বাস্তব জীবন-জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু বুদ্ধিজীবী আর সুশীল ব্যক্তি। একজন আইনজীবী সেদিন জানান, সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে শতভাগ লাভ বিএনপির। কারণ, জামায়াতের সবাই কাতারবন্দী হয়ে বিএনপিতে যোগ দেবে। এই না হলে উপদেষ্টা। তিনি বুঝতে পারেননি অথবা বুঝতে চাননি, জামায়াত হচ্ছে একটি ভাইরাস। দেহে প্রবেশ করলে দেহটাকে ধ্বংস করে দেবে। জামায়াত যদি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয়, তাহলে বিএনপিও যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

কোনো কোনো বিএনপি-সমর্থক পেশাজীবী বিএনপিকে বাহবা দিচ্ছেন এই বলে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাকি মানুষ ৫ জানুয়ারি ভোট দিতে যাননি। তাঁরাও বিএনপির ৫ শতাংশ ভোট-তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। ৫ জানুয়ারি অনেক কেন্দ্রে ভোট কম পড়েছে সত্য, কিন্তু তা স্রেফ বেগম জিয়া বা বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘটেছে, তা বিশ্বাস করা চরম আহাম্মকি। যে মাত্রায় সহিংসতা নির্বাচনের আগের কয়েক দিন হয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবে মানুষ ভোট দিতে যাবে, তা তো আশা করা যায় না। বেগম জিয়ার এসব সর্বনাশা সমর্থক গোষ্ঠী তাঁকে মনে করিয়ে দেয়নি, নির্বাচনের আগের রাতে যদি ২০০ স্কুল, মাদ্রাসা আর কলেজ ভোটকেন্দ্র হওয়ার ‘অপরাধে’ জামায়াত-বিএনপির দুর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়, তাহলে সেসব কেন্দ্রে কোন ভরসায় ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন? ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এককভাবে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। নির্দয়ভাবে এখান থেকে ৫ থেকে ৭ শতাংশ ভোট ছাঁটাই করলেও আওয়ামী লীগের একেবারে ‘দলকানা’ ভোটার ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ। নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা সারা দেশে এই ভয়াবহ তাণ্ডব না চালালে আওয়ামী লীগ কমপক্ষে এই ভোটগুলো তো পেত।

যদি নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ৪০ শতাংশ হিসাব বিশ্বাস না করেন, তাই বলে ৫ শতাংশ বিশ্বাস করতে হবে কেন? বিএনপির কাঁধ থেকে জামায়াত নামের সিন্দবাদের সেই দৈত্য বা বুড়োটাকে তারা নামাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এককভাবে তাদের। কিন্তু দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে দেশে একাধিক সুস্থধারার রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। তেমনই একটি দল হিসেবে বিএনপি নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে। তাদের উপলব্ধি করতে হবে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে পাঁচ বছরের আগে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতা তাদের নেই। আওয়ামী লীগ অন্য চিন্তা করলে ভিন্ন কথা। বাস্তববাদী হওয়া মঙ্গল।

আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ by সাজেদুল হক

আপাতত রাজনীতি নেই এ কথা সত্য। তবে ৫ই জানুয়ারি পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছু নতুন সমীকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সম্পর্ক নতুন করে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের জন্য বিএনপির ওপর দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এরই পটভূমিতে সর্বশেষ ২০শে জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরোধী জোটের সমাবেশে জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাদের দেখা যায়নি। যদিও জোটভুক্ত অন্যান্য দলের নেতারা মঞ্চে ছিলেন। এ সমাবেশের পরই ১৮ দলীয় জোটে ভাঙনের কথা ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক সূত্রে জানা যাচ্ছে, এখনই এ জোট ভাঙার ঘোষণা না দিলেও কৌশলগত কারণেই জোটের ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত। কারণ বিএনপি ও জামায়াতের বুদ্ধিদাতা হিসেবে পরিচিত অনেকেই মনে করেন, বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ইসলাম যুক্ত আছে এমন কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের সম্ভাবনা খুবই কম। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ একেবারেই স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো প্রতিনিয়ত খোলামেলাভাবেই কথা বলছে বাংলাদেশ নিয়ে। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াতেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ সাবেক বাম বলয়ের দেশগুলো এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনসহ অনেক দেশ সরকারকে অভিনন্দিত না করলেও সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। যদিও এসব দেশ সবার অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচনের জন্য সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি পার্লামেন্টে সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এসব আলোচনায় সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এরই মধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ করবে। কোন সংলাপও হবে না।

এ অবস্থায় নিজেদের রাজনীতি রিভিউ করছে বিরোধী জোট। জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন পরিবর্তন নিয়ে চলছে আলোচনা। মূলত ভোটের পাটিগণিতের হিসাবেই ১৯৯৯ সালের ৩০শে নভেম্বর চারদলীয় জোট গঠন করা হয়। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত এবং ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে এ জোট গঠিত হয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি পরে জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও নাজিউর রহমান মঞ্জুরের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ জোটে থেকে যায়। ২০০১ সালে এ জোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জোটের ভরাডুবি ঘটে। এর পরও এ জোটে আরও কয়েকটি দলকে নিয়ে গঠন করা হয় ১৮ দলীয় জোট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনও করে জোটবদ্ধভাবে। এ আন্দোলনের দাবির যৌক্তিকতা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো স্বীকার করলেও আন্দোলনে সহিংসতারও সমান তালে নিন্দা জানান তারা। মিডিয়া এবং পর্যবেক্ষকদের অনেকে এ সহিংসতার জন্য জামায়াতকেই দায়ী করেন। যদিও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার এ জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, গণ-আন্দোলন অহিংস নাকি সহিংস হবে তার ট্রিগার সব সময়ই সরকারেরই হাতে থাকে। রাজনৈতিক বিরোধ সহিংস বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে দমন এবং তার পালটা প্রতিক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের সরকারি আচরণ থেকেই এখনকার সহিংসতার জন্ম। এ পরিস্থিতিতে একতরফা গণ-আন্দোলনের ধরন বিশেষত সহিংসতাকে নিন্দা করার একটাই অর্থ : ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানো, সাফাই গাওয়া। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের প্রস্তাবেও সহিংসতায় জড়িত সংগঠন নিষিদ্ধের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। যদিও ওই প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক আগাম নির্বাচন। সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদের জামায়াত এবং হেফাজতকে একসঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, এটা কৌতূহল উদ্দীপক যে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে জামায়াত-হেফাজতকে একই কাতারে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হেফাজত কোন ধরনের সহিংসতায় জড়িত থাকার কথা আমি শুনিনি এবং বিরোধী দলের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার কথাও শোনা যায়নি। কিছু আদর্শগত মিল থাকা সত্ত্বেও জামায়াত ও হেফাজত রাজনৈতিক মিত্র নয়। তাদের একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়তো ইউরোপীয় পার্লামেন্টের তথ্যগত ভুল।
নির্বাচন পরবর্তি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে সংলাপের পূর্ব-শর্ত হিসেবে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের কথা বলেছেন। অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ককে বর্ণনা করেছেন, কৌশলগত হিসেবে। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর সম্পর্ক নিয়ে চলছে নতুন পর্যালোচনা। জামায়াতের পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত একজন সাবেক সচিবের মতে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ বিএনপির জন্য ক্ষতির কারণই হবে। যদিও অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বিএনপি সবসময়ই একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া জামায়াতের প্রায় সব শীর্ষ নেতাই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত। এ অবস্থায় জোটের বাইরে যুগপৎ আন্দোলনই বিএনপির জন্য সুফল বয়ে আনবে। যদিও ইসলামপন্থীদের ভোট ব্যাংকের বিষয়টিও বিএনপিকে বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।

বিএনপি ছেড়ে দিলেও জামায়াতের আপত্তি নেই by আহমেদ জামাল

Monday, January 20, 2014

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বাড়ছে। সামপ্রতিক কিছু ঘটনায় জামায়াত নেতারা মনে করছেন বিএনপির সঙ্গে তাদের মিত্রতা ভেঙে যেতে পারে। তবে নিজ থেকে জামায়াত জোট ভাঙবে না।
জামায়াত নেতারা মনে করছেন রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন কিংবা  সুবিধা লাভের জন্য বিএনপি যে কোন উদ্যোগ নেয়ার এখতিয়ার রাখে। সে ক্ষেত্রে জামায়াতকে বাদ দিয়ে চলতে চাইলে চলবে। বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বকে ইতিমধ্যে এমন ইঙ্গিত দেয়াও হয়েছে। উভয় দল স্থায়ী কোন চুক্তিতে আবদ্ধ নয় বলেও মনে করেন জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরা। বিএনপি-জামায়াতের মিত্রতা নিয়ে সামপ্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে দলটির সর্বস্তরে এমন মনোভাব তৈরি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ‘জামায়াতের সঙ্গে জোট কৌশলগত’ ১০ই জানুয়ারি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের পর নড়েচড়ে বসে জামায়াত। তারা মনে করছেন বিএনপি যে কোন সময় জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে পারে। জামায়াত নেতারা বলেন, সত্যিকার অর্থে বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক কোন আদর্শিক নয়। রাজনৈতিক। এ ধরনের রাজনৈতিক সম্পর্ক নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ছিল। তবে পরে  আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড  আচরণসহ নানা কারণে সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। নতুন ঐক্য গড়ে ওঠে বিএনপি’র সঙ্গে। শিবিরের রাজনীতি ছেড়ে জামায়াতে যোগ দেয়া এক নেতা বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এ সরকারের পতন। তবে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত জামায়াত-শিবির সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি আছে কি নেই তা না দেখে নিজের প্রয়োজনে যে কোন কৌশলে সক্রিয় থাকবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সামপ্রতি সৃষ্ট দূরত্ব ও মান অভিমানের প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে রাজনীতির মাঠে। বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি’র মধ্যে দূরত্ব বাড়ার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় ২৯শে ডিসেম্বরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। ওই দিন রাজধানীর টিকাটুলি ও মালিবাগে মিছিল করে শিবির। মালিবাগে শিবিরের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শিবির নেতা মনসুর নিহত হন। ১৮ দল ঘোষিত এই কর্মসূচিকে পরে আরও একদিন বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু শরিক দলের তৎপরতা না দেখে শেষ দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় জামায়াত-শিবির। ১২ই জানুয়ারি নতুন সরকারের যাত্রা শুরুর পর শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানামুখী কাজে মনোযোগী হয় তারা। বিষয়টি স্বীকার করে দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে আত্মরক্ষা এবং সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত হওয়া ছাড়া জামায়াতের সামনে কোন পথ খোলা নেই। সংশ্লিষ্টরা জানায়, মার্চ ফর ডেমোক্রেসি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে হঠাৎ থমকে যায় জামায়াত-শিবির। চলমান আন্দোলনে দেশব্যাপী জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন দলটির শীর্ষ নেতারা। এই ক্ষয়ক্ষতি রোধে জরুরি বার্তা পাঠান দায়িত্বশীলদের কাছে। নির্দেশ দেন কৌশলী কর্মসূচি দিতে- যাতে নেতাকর্মীদের প্রাণহানির সংখ্যা আর না বাড়ে। সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতিও যেন আর না হয়। ইতিমধ্যে এই বার্তা পৌঁছে যায় দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে। সূত্র মতে, জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণা এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়ে জামায়াত। এই দুই ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় প্রায় দু’শ’ শিবিরকর্মীর প্রাণহানি ঘটে। তবে এসব সহিংসতার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুসহ চলমান আন্দোলনও যুক্ত ছিল। তবু নেতাকর্মীদের লাশের সারি আর বাড়তে দিতে চান না জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। তারা আইনজীবী এবং কারাগারে সাক্ষাতে যাওয়া নিকটজনের মাধ্যমে বার্তা দিয়েছেন নেতাকর্মীদের উদ্দেশে। বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের মামলায় আটক নেতাদের যা হওয়ার হোক। এ ক্ষেত্রে কেবল আইনি লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। সংঘাত-সহিংসতা নয়। নয় আর কোন প্রাণহানি। সংশ্লিষ্টদের মতে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের এই বার্তার দ্রুত প্রতিফলন দেখা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনে। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি পালনের প্রথম দিন ২৯শে ডিসেম্বর রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের গুলিতে এক শিবির নেতা নিহত হন। ওই ঘটনার পর থেকে কৌশলী ভূমিকায় মাঠে থাকছে জামায়াত-শিবির। তারা যতটা সম্ভব ঝুঁকিমুক্ত থেকে বিক্ষিপ্ত মিছিল করছে। তবে যৌথ বাহিনীর অভিযানের কারণে হতাহতের ঘটনা এড়াতে পারছে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি’র সঙ্গে শুরু হয় টানাপড়েন, মান অভিমান। বিষয়টি স্বীকার করে শিবিরের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, চলমান আন্দোলনে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি। সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারও করেছি। কিন্তু সহযোগী ছাত্র সংগঠনের জোরালো ভূমিকা না থাকায় তেমন সুফল পাওয়া যায়নি। তবু আমাদের নেতাকর্মীরা হতোদ্যম নয়। তারা শেষ পর্যন্ত অর্পিত দায়িত্বপালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শিবিরের এই কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কিছু পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে না। তাদের সংগ্রাম ত্যাগ আল্লাহর রাস্তায়। এদিকে চলমান প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে এ মুহূর্তে রক্ষণাত্মক কৌশলে মাঠে থাকতে চায় জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে এমন কৌশল নিচ্ছে বিপর্যস্ত দলটি। কারাবন্দি শীর্ষ নেতারাও এমনটি চান বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানায়। যুদ্ধাপরাধ সন্ত্রাসবাদসহ নানা ইস্যুতে একেবারে খাদের কিনারে ১৮ দলের শরিক দলটি। যে কোন সময় রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে এ দলের কার্যক্রম। সামপ্রতিক আন্দোলনে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি তারা। এ অবস্থায় আত্মরক্ষামূলক কর্মসূচির দিকে ঝুঁকছে জামায়াত।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু