জাতীয় সংসদ- অনুগত বিরোধী দলের অবিচল আস্থা by আলী ইমাম মজুমদার

Friday, February 7, 2014

দশম সংসদের উদ্বোধনী দিনে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সরকারের প্রতি অবিচল আস্থার কথা বলেছেন তাঁর সূচনা বক্তব্যে।
তাঁর নেতৃত্বে বিরোধী দল স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেয়নি। ‘হ্যাঁ’ ধ্বনি তুলে সমর্থন জানায় সরকারি দল-প্রস্তাবিত প্রার্থীদের। তাঁরা নির্বাচিত হলে টেবিল চাপড়ে উল্লাসও করেন সরকারি দলের সঙ্গে। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, কোনো দল না এলে তাদের জন্য নির্বাচন থেমে থাকতে পারে না। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার জন্য নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। এটা সম্পন্ন করতে পারার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানান। সরকারে তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন তাঁর দল থেকে। আছেন মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তাঁরা আসন নিয়েছেন ট্রেজারি বেঞ্চে নয়, বিরোধী দলের সারিতে। বিরোধী দলের নেতা এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মতোই ‘নিউ কনসেপ্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন। আরও বলেছেন, এভাবেই তিনি সরকারকে সহযোগিতা আর আবশ্যক হলে সমালোচনা— উভয়টাই করতে সক্ষম হবেন। সেটা কীভাবে কতটা পারেন, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী। কৌতূহলী অনেকেই।

এটা অনেকটাই অচেনা আর ব্যতিক্রমী এক সংসদ। প্রথমত বলতে হয়, এ সংসদের অধিকাংশ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এটা অভূতপূর্ব। বাকি আসনগুলোয় খুব কম ক্ষেত্রেই কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’ চলছে ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াকওভার। দেশের বৃহত্তর দুটো দলের একটির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সুতরাং, ভোট দেওয়ার উৎসাহ ছিল খুব কমসংখ্যক লোকেরই। তদুপরি, ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছে, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে। হতাহত অনেক। ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চার শতাধিক কেন্দ্রে। ভোটকেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয় আগের রাতে। ভোটকর্মী নিহত হয়েছেন একাধিক। সুতরাং, একে ব্যতিক্রমী একটি সংসদ বলা যেতেই পারে।

তারপর আসছে বিরোধী দলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে। রওশন এরশাদ সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিমালা অনুসারে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার আসন বিন্যাসে তাঁর পাশাপাশি বসছেন সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত এ দলের সদস্যরাও। কিন্তু তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতাও বটে। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য অনুসারেই এটা ‘নিউ কনসেপ্ট’। তাই আমাদের অনেকের কাছেই অচেনা ঠেকছে। এমনকি সরকারি দলের কারও কারও কাছেও। সে দলের একজন প্রবীণ সাংসদের (যিনি গেল মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন) মতে, জাতীয় পার্টির এ আচরণ গাছেরটি খাওয়া আর তলারটি কুড়ানোর মতো। কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এ নিউ কনসেপ্টের ভবিষ্যৎ আমাদের অজানা। তবে আপাতত আমরা সংসদে সক্রিয় বিরোধী দলের অবস্থান থেকে বঞ্চিত হলাম।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের পর পালাক্রমে সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তাদের যখন যারা বিরোধী দলে ছিল, তারা সংসদীয় দায়িত্ব পালন করেনি বললেই চলে। অথচ বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। উপভোগ করেছে মর্যাদা। সংসদ বর্জন একটি স্বাভাবিক সংস্কৃতি হয়ে পড়েছিল। বর্তমান বিরোধী দল হয়তো তা করবে না। কিন্তু তারা প্রকৃত বিরোধী দল কি না, সেটা নিয়েই সংশয় রয়েছে। তদুপরি যারা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সংসদের বাইরে রইল, তারা কিন্তু এ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশীদার নয়। অংশীদার নয় তাদের সমর্থক জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আপাতত পরিস্থিতি শান্ত। একে স্থিতিশীল রাখতে হলে সংলাপের মাধ্যমে প্রধান দলগুলোকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশীদার হতে হবে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘ক্রসফায়ার’ সাময়িক সমাধান দিলেও স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে না। তবে দলমত-নির্বিশেষে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারি পদক্ষেপের আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি ব্যতীত কেউ নৈরাজ্য সমর্থন করে না। তবে এর নামে বিরোধী দল দমনও সমর্থনযোগ্য নয়। এ কার্যক্রম পক্ষপাতহীন হলে ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া যাবে।

সংসদের বর্তমান বিরোধী দল সব জাতীয় সমস্যাতেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে বলে জানিয়েছে। এটাই হওয়ার কথা এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও তাই হয়। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যোগাযোগ হয়। হয় না শুধু আমাদের এ দুর্ভাগা দেশে। বর্তমান বিরোধী দলের নেতার এ মনোভাব গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হতো, যদি তিনি প্রকৃতই বিরোধী দলে অবস্থান নিতেন। এ ছাড়া তাঁর দলটি ব্যাপক জনসমর্থিতও নয়। ভাগাভাগির নির্বাচন না হয়ে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এ দলের আসন সংখ্যা বর্তমানের ধারে-কাছেও আসবে না বলে অনেকে মনে করেন। তাই তাদের সহযোগিতার প্রস্তাবটি শিষ্টাচারের বিবেচনায় প্রশংসনীয় হলেও রাজনৈতিকভাবে তেমন মূল্য বহন করে না। এতে উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণও লক্ষণীয় হয় না।

দলটি ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দ্বৈত নীতি নিয়ে চলছে। এমনকি ক্ষমতায় থাকাকালেও প্রধান দুটো দলকে বিপরীতমুখী রাখতে সদা সচেষ্ট ছিল। সেটা যখন সম্ভব হয়নি, তখনই ক্ষমতা হারায়। শুরুতে তাদের পতিত স্বৈরাচার বলত উভয় প্রধান দল। সে পতনের দিনটিও উদ্যাপন করত। দুমুখো নীতির জন্য দলটির এখন কিন্তু বেশ কদর। বড় শরিকেরা এখন ‘পতিত’ আর ‘স্বৈরাচার’ শব্দগুলো মুখেও তোলে না। অবশ্য গেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি আরেক দফা ভেঙেছে। যেটুকু আছে, সেখানেও নেতৃত্বের মেরুকরণ লক্ষণীয়। শেষতক কোথায় দাঁড়ায়, এটাও দেখার বিষয়।

এ দেশ ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দেখেছে। দেখেছে এ বছরের জানুয়ারির নির্বাচন। প্রতিটি নির্বাচনের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত রয়েছে। তবে মাত্রার হেরফের হলেও কোনোটিই জনসমর্থিত এমন দাবি করা যাবে না। এখানে ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’-এর জন্য জাতীয় পার্টিকে নেওয়া হয়েছে। আর তারা যখন গেছেই, শুধু বিরোধী দলের নেতার পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার কথা নয়। মন্ত্রিত্ব আর বিশেষ দূতের পদও চেয়েছে। পেয়েছেও। তাই তাদের কোনো নেতা সরকারের সমালোচনা করলেও তা ‘ফ্রেন্ডলি’ হবে। তির্যক হবে না—এটা অন্তত বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জোর দিয়ে বলা যায়।

সরকারের কাছে এ বিরোধী দলের নেতার কদর কিন্তু অনেক। নির্বাচন নিয়ে এরশাদ যখন একপর্যায়ে বিগড়ে যান বা তা করার ভান করেন, তখন হাল ধরেন এ নেতাই। এরশাদ ‘র‌্যাবের সহায়তায়’ সিএমএইচে ভর্তি হন। মাস খানেক তথায় থাকেন। মাঝেমধ্যে খেলেন গলফ। জনৈক মুখপাত্রের মাধ্যমে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাতে থাকেন। তখন রওশন এরশাদ নির্বাচনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, এরশাদের নির্দেশেই তা করা হচ্ছে। তাই সরকারি দল তাদের একজন প্রবীণ নেতার আসন ছেড়ে দেয় তাঁকে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসেন তিনি।
ওই প্রবীণ নেতাকেও টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করে সব দিক সামাল দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের নেতার পদ ছাড়াও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি আর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে নিয়োগ দলটিকে ক্ষমতার অংশীদার করেছে। সুতরাং, সরকারের প্রতি তাঁর আস্থা অবিচল থাকারই কথা।

এরশাদ বর্তমান প্রধান দুটো দলের সঙ্গেই সময়ে সময়ে জোট করেছেন। কখনো তারা তাঁকে ঠকিয়েছে। কিংবা তিনি তাদের। কারাবাস করেছেন দুটো দলের সরকারের সময়েই। তাঁর দলের মধ্যেও এ দুই দলের প্রতি চিহ্নিত অনুরাগী কয়েকজন নেতা আছেন। হুমকি-ধমকি যা-ই দিক, একা তাঁরা এগোতে পারবেন না। এটা এরশাদ ও রওশন এরশাদ উভয়ই ভালোভাবে বোঝেন। বোঝেন দলের অন্যরাও। তাই যখন যেদিকে সুবিধা, সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন। অতীতের অবজ্ঞা, অবহেলা আর কথা না রাখার বিষয়গুলোও উপেক্ষা করেন নিজেদের গরজেই। আর তা করতে গিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য ও বন্ধু নিত্যানন্দ রচিত একটি গানের কলি হয়তো বা স্মরণে আনেন। সে গানের কলিটি হচ্ছে:

মেরেছিস কলসির কানা,

তাই বলে কি প্রেম দেব না?

চৈতন্য মহাপ্রভু আর তাঁর শিষ্য সেই প্রেম বিলিয়েছিলেন নিছক সদিচ্ছায়। আর আমাদের বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের প্রেম কিন্তু অনেক চড়া মূল্যে কেনা।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

majumder234@yahoo.com

দশম জাতীয় সংসদ- কেন বিরোধী দল জরুরি? by আলী রীয়াজ

Friday, January 31, 2014

দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে আজ ২৯ জানুয়ারি। দিনটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সংসদীয় ইতিহাসের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন বলে আমাদের বিবেচনা করা দরকার।
সেটা কেবল এই কারণে নয় যে এই সংসদে আসন নেবেন এমন সাংসদের অর্ধেকেই প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হননি। কেবল এই কারণেও নয় যে এই নির্বাচন বিতর্কিত। এই কারণে যে এই সংসদে কোনো বিরোধী দল থাকবে না। গতকালের আলোচনায় আমরা দেখেছি, কেউ কেউ এই যুক্তিতে একে সমর্থন করছেন যে গত সংসদের বিরোধী দল বিএনপি তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো রকম ভিন্নমত না পোষণ করেও বলা যায়, ১৯৯১ সালে থেকেই সংসদে বিরোধী দল তার ভূমিকা পালনে সফল হয়নি।

তার পরেও আমরা কেন সংসদে বিরোধী দল থাকার ওপর জোর দিতে চাই?
সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভবের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের এ কথা অজানা নয় যে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে সাংসদেরা যদি তাঁদের ব্যক্তিগত, স্থানীয় কিংবা বিশেষ ধরনের ক্ষোভের বাইরে কিছু বক্তব্য দিতেন, তবে তাঁর পরিণতি হতো ভয়াবহ। রাজার বিরোধিতা, উত্তরাধিকারের অধিকার, পররাষ্ট্রনীতি বা ধর্মের মতো জাতীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে কারাবাস ছিল নিশ্চিত, প্রাণহানির আশঙ্কা কোনো কল্পিত বিষয় ছিল না। তার অর্থ হলো, পার্লামেন্ট সদস্যরা রাজার বিরোধী হতে পারবেন না; ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাঁরা সংসদে নির্বাচিত হননি। তাঁদের কাজ বড়জোর আলাদাভাবে ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের ভোটারদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
ইতিহাসবিদেরা এও জানান যে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত ইংল্যান্ডেও বিরোধী দলের ধারণার উত্থান হয়নি। বিরোধী দলের ধারণার উদ্ভবের আগে ‘বিরোধী’দের প্রধান ভূমিকা কী, সেটা স্পষ্ট রূপ লাভ করতে শুরু করে। বিরোধীরা কেবল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা করবে তা-ই নয়, তাঁরা বিকল্পও উপস্থাপনও করবে, সামগ্রিকভাবে রাজ্য শাসনের বিকল্প। এই বিকল্পের প্রশ্নেই ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে; অন্যথায় সপ্তদশ শতকের গোড়ায়ও ‘দলাদলি’ এবং ‘পার্টি’কে কলঙ্কজনক বলেই মনে করা হতো। এ শতকেই আমরা দেখতে পাই, এই ধারণা সুস্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করেছে যে ক্ষমতাসীন শক্তির বিরোধিতা করার বিষয়টি কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, তার জন্য সংগঠিতভাবে দল গঠন এবং আদর্শিক ও ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার মধ্য দিয়েই সরকারের বিকল্প উপস্থাপন করা যেতে পারে। যে দেশে ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে বলাকে বিবেচনা করা হতো রাষ্ট্রদ্রোহ বলে, সেখানে ক্ষমতাসীনেরাও বিরোধীদের দল গঠন এবং জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নে তাদের অবস্থানকে বৈধ এবং সংগত বলে মনে করতে থাকে। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে রাজার উত্তরাধিকারের প্রশ্নকে, বিশেষত রাজা দ্বিতীয় জেমসের ক্ষমতায় আরোহণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্কেই দল হিসেবে টোরি এবং হুইগ পার্টির আবির্ভাব ঘটে। রাজসিংহাসনে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন সামনে নিয়েই সাংগঠনিকভাবে সংসদীয় বিরোধী দলের আবির্ভাব ঘটেছে।
জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৫৯ সালে অন লিবার্টি বইয়ে লিখেছেন, সুস্থ রাজনীতির জন্য যেমন দরকার স্থিতিশীলতার পক্ষের দল, তেমনি দরকার প্রগতিশীলতার বা সংস্কারের পক্ষের দল। বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনার এবং আদর্শের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমাজে উপস্থিত থাকলে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাব রাজনীতিতে সংসদে এবং সংসদের বাইরেও। আধুনিক অর্থে রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের প্রশ্নটি গণতন্ত্রের সঙ্গেই জড়িত, সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার যে কারণে রাজনৈতিক দলকে ‘গণতন্ত্রের সন্তান’ বলে বর্ণনা করেছেন। গণতন্ত্রের একটা প্রধান লক্ষণ হচ্ছে যে এই ব্যবস্থা জনসাধারণকে পছন্দের সুযোগ দেয়; বিভিন্ন বিকল্পের মধ্য থেকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার নিশ্চয়তা কেবল গণতন্ত্রই দিতে পারে। একই সঙ্গে গণতন্ত্র সেই ভুল সংশোধনের সুযোগও উন্মুক্ত রাখে। রাজনীতিতে সেই সুযোগ দেওয়ার অবকাশ থাকে কেবল বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দলের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। কেবল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় একত্র মানুষের গোষ্ঠীকেই আমরা রাজনৈতিক দল বলে বিবেচনা করি না এই কারণে যে রাজনৈতিক দল গঠনের পেছনে আদর্শের প্রশ্নটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সে কারণে রাজনৈতিক দলকে জনগণের প্রতিনিধিত্বের দাবি করতে হলে আদর্শিকভাবে তার অবস্থানকে তুলে ধরতে হয় এবং ক্ষমতাসীনের বিপরীতে তাদের নীতিকে তুলে ধরতে হয়। একইভাবে তা ক্ষমতাসীন দলের জন্যও প্রযোজ্য, তাকে দেখাতে হয় যে সে কেন বিরোধীদের থেকে শ্রেয়।
তাহলে আমরা দেখতে পাই যে রাজনৈতিক দল এবং সংসদীয় বিরোধী দলের প্রধান কাজ হচ্ছে জবাবদিহির দাবি তোলা এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের প্রধান কাজই হচ্ছে সেই নির্বাহী বিভাগের ওপরে নজরদারি করা। কিন্তু ১৯৯১ সালের পরে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সেই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে করে আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে যে ধরনের সংসদ তৈরি হতে দেখেছি, তাতে যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তারা সংসদকে তাদের প্রতিশ্রুত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে পারেনি কিংবা চায়নি।
১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের পেছনে দলনির্বিশেষে যে ঐক্য হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল এই যে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, তাতে করে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং শাসন হয়ে পড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই ব্যবস্থা ব্যক্তিকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। সেই বিবেচনায়ই সংসদের কাছে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহির ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেটাই হলো সংসদীয় ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কাজ। আর সেখানে সরকারি দলকে তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় বিরোধী দলের ওপর। মনে রাখতে হবে, তার আগে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত। কিন্তু স্বল্প সময়ের সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে দেশের রাজনীতিবিদেরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেননি। বিজয়ী দল হিসেবে বিএনপি তাদের ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থার কথা থাকা সত্ত্বেও জনমত এবং বিরোধী দলের যুক্তিসংগত সংসদীয় চাপের মুখে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংবিধানের যে দুটি সংশোধনী সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের যে কারণ, সেই জবাবদিহির ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সরকারি দল এবং সংসদ দুই-ই ব্যর্থ হয়েছে। তাতে করে আমরা দেখতে পেয়েছি, সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং তার উপর্যুপরি অপব্যবহার হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদেরা কার্যত এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছেন। সেটা কোন দল ক্ষমতায় থাকল, তার ওপর নির্ভর করেনি। বাংলাদেশের প্রায় সব দলের ভেতরেই গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং দলের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা রাজনীতিতে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থাকেই যখন তিরোহিত করে ফেলেছে, সে সময়ে সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে গোটা সংসদই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আর তা কোনো অবস্থাতেই ১৯৯১-পূর্ববর্তী জবাবদিহির ঊর্ধ্ব বিরাজমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। শুধু তা-ই নয়, এ ক্ষেত্রে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক এবং সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতা হবে সীমাহীন, সেহেতু তার প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগের প্রভাব হবে গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি।
আলী রীয়াজ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

দশম জাতীয় সংসদ- বিরোধী দলবিহীন সংসদ by আলী রীয়াজ

বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে এবং ২৯ জানুয়ারি যার অভিষেক হতে চলেছে, তাতে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই।
জেনারেল এরশাদ বা রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে গেজেট প্রকাশ করে বিরোধী দলের আসনে অভিষিক্ত করার পরেও একে সরকারি-বিরোধী দল বা বিরোধী-সরকারি দল বলেই আমরা জানব। কবি হলে জাতীয় পার্টির অবস্থানকে আমরা ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি’ বলে বর্ণনা করতে পারতাম। সংসদীয় ব্যবস্থার ইতিহাসে বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কোনো ইতিহাস না থাকলেও আমরা এখন এক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তার আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। তার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে আমরা কতটুকু জ্ঞাত এবং চিন্তিত?

১৯৯০ সালের স্বৈরশাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে গঠিত পঞ্চম সংসদে সব দলের সম্মতিতে সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং একটি গণভোটের মধ্যে যাতে নাগরিকদের সম্মতি নেওয়া হয়েছিল, তার মর্মবাণীই কি এখন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে? এই বিষয়টি আরও বেশি করে বিবেচনার দাবি করে এই কারণে যে আজকে বিকাশমান এই অবস্থায় তৎকালীন স্বৈরশাসকের ছায়া নয়, তাঁর এবং তাঁর দলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি দেখতে পাই। প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সংসদ, যাতে অধিকাংশ নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ ছিল না, তার গঠনই এখন সংসদের মূল দায়িত্ব থেকে সরে এসে কী ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশের সূচনা করতে চলেছে, তার প্রতিক্রিয়া কী, সেটা গভীরভাবে ভাবা দরকার।
এই নতুন পরিস্থিতিতে যাঁরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের অনেকে এই কথা বলার চেষ্টা করছেন যে যেহেতু গত পাঁচ বছরে সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপি কার্যত কোনো ভূমিকা পালন করেনি, সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল থাকা না-থাকায় আদৌ কিছু যায়-আসে না। তাঁদের এই কথার পেছনে তাঁরা যে তথ্যগুলো হাজির করেন, সেটা অবশ্যই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। নবম জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বিএনপি ৭৪ শতাংশ অধিবেশন বর্জন করেছে এবং কার্যত কোনো ধরনের বিতর্কে অংশ নেয়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ৪১৮টি বৈঠকের মাত্র ১০টিতে উপস্থিত ছিলেন। এটি দল হিসেবে বিএনপির এবং সাংসদ হিসেবে খালেদা জিয়ার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা বললে সামান্যই বলা হবে। যাঁরা এখন সংসদে বিরোধী দলের না থাকাকে বড় কিছু নয় মনে করছেন, তাঁরা এখানেই আলোচনাটি শেষ করতে চাইবেন।
কিন্তু এই তথ্য আমরা কি অতীতে, ১৯৯১ সালে থেকে যত সংসদ বহাল থেকেছে, তার থেকে আলাদা করে বিবেচনা করব? প্রথমেই যেটা স্মরণ করা দরকার তা হলো ১৯৯৬ সাল থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সংসদে বিরোধী দলের আকার ছোট হয়ে আসছে। ১৯৯১ সালে সংসদে বিরোধী দলের আসন ছিল ১৩৯টি, ১৯৯৬ সালে তা হয় ১২০টি, ২০০১ সালে ৭৮টি এবং ২০০৮ সালে ৩৪টি। যদিও এসব আসনসংখ্যা সরকারি ও বিরোধী দলের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না কিন্তু বিরাজমান নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশের জনগণ সেটাকে অনিবার্য বলেই ধরে নিয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এও মনে রাখা দরকার, ১৯৯১-৯৬ সালে বিরোধী দল অনুপস্থিত থেকেছে ৩৪ শতাংশ অধিবেশন, ১৯৯৬-২০০১ সালে এই অনুপস্থিতির হার ছিল ৪৩ শতাংশ এবং ২০০১-০৬ সালে ছিল ৬০ শতাংশ। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ১৯৯১-৯৬ সালে ৪০০ বৈঠকের ১৩৫টিতে যোগ দেন, ১৯৯৬-২০০১ সালে খালেদা জিয়া যোগ দেন ৩৮২ বৈঠকের ২৮টিতে, ২০০১-২০০৬ সালে শেখ হাসিনা যোগ দেন ৩৭৩ বৈঠকের ৪৫টিতে। এই তথ্যগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় বাংলাদেশের দুই প্রধান দল, যারা পালাক্রমে সরকার ও বিরোধী দলের আসনে বসেছে, তারা সরকার চালাতে যতটা উৎসাহী হয়েছে, বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালনে ততটাই অনুৎসাহী হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, সংসদে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে কমেছে। খুব সোজা ভাষায় বললে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল হিসেবে সব দলই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই প্রবণতার সঙ্গে ক্রমহ্রাসমাণ বিরোধী দলের আসনের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না এবং সরকারি দলের আকার বিরোধী দলের প্রতি তাদের আচরণকে প্রভাবিত করেছে কি না,
সেটা বাংলাদেশের রাজনীতির গবেষকেরা খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বলে চোখে পড়েনি।
এই যোগসূত্র খোঁজার বদলে, তার কারণ অনুসন্ধানের বদলে আমরা কি এই শিক্ষা নেব যে বিরোধী দলেরই দরকার নেই? আমরা কি তাহলে ধরে নিচ্ছি যে আজকে যারা ক্ষমতাসীন, তাদের আর কখনোই বিরোধীদের আসনে বসতে হবে না? এই রকম ধারণার ইঙ্গিতই দেশে একদলীয় ব্যবস্থার আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে আসছে। বিরোধী দলের দরকার নেই এই কথা মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার পরামর্শের মতোই শোনায়। মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার সমাধান যত সহজ শোনায় তার পরিণতি ততটাই ভয়াবহ।
বরং আমাদের এখন বিবেচনা করা উচিত যে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল কেন তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয় এবং এই বৃত্তচক্র ভাঙার পথ কী হতে পারে? সমাধান এটা হতে পারে না যে বিরোধী দলের ধারণাকেই সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে দিতে হবে। ২০০১
সালে বিএনপি যদি এই যুক্তি হাজির করত, তা যেমন অগ্রহণযোগ্য হতো, আজকে যাঁরা এই কথাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন, তাঁদের বক্তব্যও ততটাই অগ্রহণীয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের প্রয়োজন কেন, সেটা আমাদের বুঝতে হবে সংসদীয় ব্যবস্থার এবং
সুস্থ রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এবং সংসদ এবং রাজনীতিতে দলের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে।

আলী রীয়াজ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

সময়চিত্র- অদ্ভুত সংসদ, অনিশ্চিত যাত্রা by আসিফ নজরুল

দশম জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে ২৯ জানুয়ারি। এমনিতে সংসদের উদ্বোধনী দিনটিকে ঘিরে থাকে নানা আগ্রহ আর উদ্দীপনা।
এ দিন রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণ নিয়ে বিরোধী দল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। পত্রিকায় তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিশদ আলোচনা হয়। প্রথম দিনেই বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে সাধারণত। ওয়াকআউটের আগে গরম কিছু বাক্যবিনিময় হয় সংসদে। টিভির সামনে এসব দেখে আমরা নানা আলোচনায় জড়িয়ে পড়ি। সংসদের কার্যকারিতার জন্য আসলে কী কী করা দরকার, তা নিয়ে আশাবাদ আর হায়-হুতাশ চলে। সংসদীয় কমিটিগুলো কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও চলে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এবার তার অনেক কিছু নেই। এই সংসদে প্রকৃত বিরোধী দল নেই, এতে এমনকি প্রকৃত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার বহু কারণ রয়েছে।

সংসদ আইন তৈরি, সংশোধন আর সরকারের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রতিষ্ঠান। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে সংসদ। একমাত্র এর প্রতিনিধিরা হন জনগণ কর্তৃক সরাসরিভাবে নির্বাচিত। সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক এই বৈশিষ্ট্যই এবার সংসদে অনেকাংশে অনুপস্থিত। এই সংসদে এমন বহু প্রতিনিধি রয়েছেন, যাঁদের জেতার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, যাঁদের এলাকার মানুষ চেনে না, কেউ
কেউ এলাকায় যান কদাচিৎ। এমন বহু প্রতিনিধিও আছেন, যাঁরা আসলে নির্বাচিতই হয়ে আসেননি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৫১টি আসনে জয়। একটিমাত্র ভোট পড়ার আগে, নির্বাচনের দিন আসার আগেই দশম সংসদে তার চেয়ে বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়ে গেছেন ‘জনপ্রতিনিধিরা’। এই সংসদের আইনগত, নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এই সংসদ যদি শুধু সংবিধান রক্ষার নির্বাচন হয়ে থাকে, তাহলে এর আয়ু যত কম হবে, তত তা মঙ্গলজনক হবে দেশের জন্য।

২.
দশম সংসদ নিয়ে তবু আমাদের অনিশ্চয়তা কাটছে না। এই সংসদ পাঁচ বছরই থাকবে, এমন কথা বলার অনৈতিক ও অযৌক্তিক মনোভাব দেখাচ্ছেন সরকারি দলের কিছু নেতা। ইতিপূর্বে দেশে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে এ ধরনের একতরফা নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ দুটি নির্বাচনকেই অবৈধ আখ্যায়িত করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে তাকে সম্পূর্ণভাবে অমান্য করতে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী এরশাদের লাজলজ্জা আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কম ছিল। তিনি জোর করে দুই বছর পর্যন্ত থাকতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আত্মগ্লানি ছিল। তাই নির্বাচনের আগেই বিএনপি সেটি শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য, এমন ঘোষণা দিয়েছিল। নির্বাচনের দেড় মাসের মাথায় নতুন নির্বাচনের জন্য সংসদ ভেঙে দিয়েছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাংসদ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার হিসাবে ২০১৪ সালের নির্বাচন ১৯৮৮ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের চেয়েও বেশি অগ্রহণযোগ্য ও একতরফা। কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে অদ্ভুত ও নজিরবিহীন এক সংসদ গঠন করার পর এটিই পাঁচ বছরের জন্য বিরোধী দল ও জাতিকে মেনে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে এখন।
দশম সংসদের পক্ষের লোকদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে এই সংসদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। এটি ঠিক যে আমাদের সংবিধান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন নিষেধ করেনি। কিন্তু অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টিকেও আমাদের সংবিধান অনুমোদন করেনি। যে দেশে কোনো স্কুলের অভিভাবক সমিতি বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি আসনে বহু লোক দাঁড়িয়ে যান, সেখানে সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কেউ না দাঁড়ানোই একটি চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রমাণ। ১৯৯০ সালের পর কোনো নির্বাচনে একটি আসনেও এমন ঘটনা ঘটেনি, শুধু ১৯৯৬ সালে ৪৮টি আসনে এটি ঘটেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে তাই আমরা অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলি, একই বিবেচনায় ২০১৪ সালের নির্বাচন বহুগুণ বেশি অস্বাভাবিক।
অস্বাভাবিকতা এক অর্থে বৈধতার সংকটের ইঙ্গিতবাহী। সরকারি কাজে যখন একটিমাত্র টেন্ডার প্রদানের ঘটনা ঘটে, তখন আমরা এটি অস্বাভাবিক বলে ধরে নিই। কোনো সন্ত্রাসী বা মাস্তানের ভয়ে অন্যরা টেন্ডার প্রদানে বিরত থাকে, এমন রিপোর্ট পত্রিকায় বের হয়, টেন্ডার বাতিল করা হয়। তখন কি আমরা বলি, আইনগতভাবে একটি টেন্ডার পড়লে সেটিই বৈধ ধরে নিতে হবে? বলি না। কারণ, আইন মানে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে অন্যকে অংশ নিতে বাধা দিয়ে বা নিরুৎসাহিত করে নিজের স্বার্থোদ্ধার নয়।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, নতজানু নির্বাচিত কমিশন ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তা গত ৩০ বছরে আমরা আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে বলতে শুনেছি। এবারের নির্বাচনে তা জোরালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন কিছু নজিরবিহীন কাজ করেছে, যা আইনের চোখেও অবৈধ। নির্বাচন কমিশন সময় পার হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও দলের প্রার্থীরা নিজেরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করার পরও কমিশন তা গ্রহণ করতে অসম্মতি জানিয়েছে। কমিশন যেভাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের নিষেধ সত্ত্বেও দলটির প্রার্থীদের লাঙল প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাও, যাঁর ভূয়সী প্রশংসা আওয়ামী লীগ বহু সময়ে করে থাকে।
এমন একতরফা নির্বাচনেও ভুয়া ভোট পড়েছে, কেন্দ্র দখল হয়েছে এবং প্রশাসন নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিয়েছে—এমন সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি, সন্ত্রাস ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে হারে নির্বাচনের দিনই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা-ও ছিল নজিরবিহীন।
দশম সংসদের বৈধতার সংকট রয়েছে আরও বহু ক্ষেত্রে। এই নির্বাচন যে সরকারের অধীনে হয়েছে, তা থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করা, নবম সংসদ থাকা অবস্থায় দশম সংসদের শপথ গ্রহণ, একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির অবস্থান গ্রহণ বৈধ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের যৌক্তিক-অযৌক্তিকতা নিয়ে নানা তর্ক হয়তো তবু সম্ভব। কিন্তু আমরা কি এই নিরেট সত্যকে অস্বীকার করতে পারি যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে দশম নির্বাচনের ফলাফল এ রকম হতো না? এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমনকি জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি বা বিএনএফ যেভাবে বিজয়ী হয়েছে, তা কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সম্ভব হতো না।

৩.
২০১৩ সালের স্থানীয় নির্বাচনসমূহ ও দেশি-বিদেশি সব জরিপ অনুযায়ী দশম নির্বাচনে বিরাট ব্যবধানে বিজয়ী হওয়ার কথা ছিল বিএনপির। তারা নির্বাচন বর্জন করায় সমালোচনা রয়েছে সমাজে। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপির অনুপস্থিতির মধ্যেও সরকার, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন যে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা রেখেছে, তাতে নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে বিএনপির আশঙ্কা প্রমাণিত হয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতাও তাতে ফুটে উঠেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সকেও তাই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিতে দেখেছি এই নির্বাচনের পর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধকে আমরা ছোট করে এনেছিলাম গত বছরের ডিসেম্বরে তারানকোর সফরকালে। প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে নির্বাচনকালে জাতীয় সরকারের একটি মডেল কি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি আগামী নির্বাচনের জন্য? নির্বাচনকালীন সরকার শুধু কেন, পুরো মেয়াদের জন্যই কি প্রধানমন্ত্রীর সর্বগ্রাসী ক্ষমতা কমিয়ে অন্তত ভারতীয় মডেলের একটি ভারসাম্যমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা আমরা ভাবতে পারি? বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের জন্য সহায়ক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনার উদ্যোগ কি এই সংসদ গ্রহণ করতে পারে না?
আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’। দশম সংসদের জন্ম যেভাবেই হোক, ভালো কাজ করার সুযোগ তো তার রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দশম সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি বা পেলেও ভোট দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বেদনা, হতাশা, বঞ্চনাবোধ দূর করার আশু পদক্ষেপ এই সংসদকে নিতে হবে।
জনসমর্থনহীন ও বৈধতার সংকটে জর্জরিত সরকারকে টিকে থাকতে হয় জনগণকে নিষ্পেষিত করে, চরম অত্যাচার আর অনাচার করে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। আমরা চাই না এমন উদাহরণ বাংলাদেশে তৈরি হোক স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের হাতে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তৃতীয় মত: অলঙ্কারিক সংসদ by মাহফুজ আনাম

সংসদ জনগণের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। জাতিকে দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী গঠন করা হয় সংসদ। যারা তাদের নির্বাচিত করেন সে জনগণের স্বার্থে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
যেখানে গণতন্ত্র পূর্ণমাত্রায় কাজ করে সেখানে ধারণা, আদর্শ এবং মতবিনিময়ের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সংসদ এমন একটি জায়গা যেখানে গঠনমূলক বিতর্কের মাধ্যমে জাতীয় পরিকল্পনা গৃহীত হয়। যেখানে ব্যক্তির ক্ষমতা পরাভূত হয় সমষ্টিগত ইচ্ছার কাছে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের ভাগ্য এত ভালো নয়। আমাদের প্রারম্ভিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে। এরপর ১৬ বছর চলে যায় সামরিক সরকার এবং সেনা নেতৃত্বাধীন সরকারের মাধ্যমে। যখন জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য সতিক্যর অর্থে সংসদের কোন অস্তিত্বই ছিল না।
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর একটি কার্যকর এবং স্পন্দনশীল সংসদই ছিল আমাদের সর্বোচ্চ চাওয়া। কিন্তু আমাদের সে চাওয়া পূরণ হয়নি। এরশাদের পতনের পর প্রথম নির্বাচনে পরাজয় আওয়ামী লীগ কখনোই প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেনি। প্রথম দিন থেকেই আক্ষরিক অর্থেই তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। প্রতিনিয়ত ওয়াকআউট, সংসদ বয়কটের মাধ্যমে সংসদের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা, সর্বোপরি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তারা সদলবলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপি যখন বিরোধী দলের আসনে বসে তখন তারা আওয়ামী লীগকে আরও রুক্ষতা এবং রুঢ়তার সঙ্গে ওই আচরণ ফেরত দিয়েছিল। ২০০১ এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সামনে বিরোধী দলের আচরণ পরিবর্তনের সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগানোর পরিবর্তে আমরা তাদের মধ্যে সংসদের ভেতরে-বাইরে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে দেখলাম।
২৩ বছরের সংসদের এমন ইতিহাসের পর বুধবার যে দশম সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছে এ সংসদের কাছে আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি। এ সংসদে এখন পর্যন্ত ২৯৮ আসনের মধ্যে ২৩২ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা রয়েছেন, যা মোট আসনের ৭৭ শতাংশ। জাতীয় পার্টির আসন ৩৪টি বা ১১%, ওয়ার্কার্স পার্টির (মেনন) ৬টি বা ২%, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) ৫টি বা ২%, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) ২টি, তরিকত ফেডারেশনের ২টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১৬টি বা ৫.৩%। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৭৭% আসনের তথ্যটিও পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বাকি দলগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে এবং আওয়ামী লীগের সমর্থনেই সংসদে প্রবেশ করেছে। শুধু তাই নয়, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন, যা ছাড়া নির্বাচনে জয়লাভ তাদের পক্ষে আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব হতো।
কিছুদিনের মধ্যেই যখন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচিত হবেন তখন আওয়ামী লীগ পাবে আরো ৩৬টি আসন অর্থাৎ মোট ৩৫০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পাবে মোট ২৬৮টি আসন, পরে আরো দুটি আসন যোগ করা হতে পারে। স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী ১৬ সংসদ সদস্যও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, তারা যেকোন সময় সরকারি দলে ঢুকে যেতে পারেন। জাতীয় পার্টি, যাদের সংসদে ৩৫টি আসন রয়েছে তারাও তা পেয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চুক্তি করে। এ অবস্থায় তাদের বিরোধী দলে থাকা হবে কেবই কাগুজে। এটা কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন যখন সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল তখন ভালো কী হয়েছে, তখনতো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বছরের পর বছর সংসদ বয়কট করেছে। এটা সত্য হলেও সংসদীয় কমিটিগুলো বহুক্ষেত্রেই সঠিক কাজ করেছে। মার্জিনাল হলেও তারা কিছু ভালো কাজ করেছে। বুধবার সংসদে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের দেয়া ভাষণ যদি মানদণ্ড হয় তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, দশম সংসদের বহু সময় ব্যয় হবে প্রধানমন্ত্রীর নীতির প্রশংসায়। প্রেসিডেন্টের ভাষণের  কোথাও আগের কোন ভুলভ্রান্তির কথা উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি গত ৫ই জানুয়ারি বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন প্রসঙ্গেও কিছু বলা হয়নি। এর পরিবর্তে এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এবং সব দোষ চাপানো হয়েছে বিরোধীদের ওপর। অন্য অর্থে এ ভাষণ সরকারের নীতিরই প্রতিফলন।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রাথমিক গুণ যদি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে থাকে, উন্নত শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি যদি ভারসাম্যতা হয়ে থাকে এবং জনগণের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতির কথা বলা হয়, তার কোন কিছুই এখন বাংলাদেশে বিদ্যমান নেই। বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছেÑ কিভাবে আমরা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারি এবং বিলুপ্তির পথে থাকা জবাবদিহিতা প্রক্রিয়াকে পুনরুদ্ধার করতে পারি। কিন্তু দশম সংসদ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কোন পথতো দেখাচ্ছে না এমনকি এব্যাপারে কোন দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে না।

(মাহফুজ আনাম: ডেইলি স্টার সম্পাদক, পত্রিকাটিতে শুক্রবার প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)

ছন্দহীন এক পার্লামেন্ট : সরকারি আর বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার

Wednesday, January 29, 2014

ছন্দহীন এক পার্লামেন্টের যাত্রা শুরু হলো। সরকারি আর বিরোধী দল মিলেমিশে একাকার এই সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী এমপিরাও এসেছেন নজির সৃষ্টি করে। তাদের ১৫৪ জন নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
১৪৬ জন এমপি হয়েছেন কম ভোটের রেকর্ড গড়ে। সরকারে আছেন বিরোধী দলের সদস্যরা। বিরোধী দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এমনই এক ছন্দহীন অবস্থায় সূচনা হয়েছে দশম সংসদের। দীর্ঘ ২৬ বছরের মধ্যে এই প্রথম দেশের অর্ধেক ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী দল বিএনপির অংশগ্রহণ নেই এই সংসদে। ভোট বর্জন করা বিরোধী জোট শুরু হওয়া সংসদকে আখ্যায়িত করেছে সাংবিধানিক গোঁজামিলের সংসদ হিসেবে। এদিকে উদ্বোধনী ভাষণে প্রেসিডেন্ট মো. হামিদ সমঝোতায় আসতে আলোচনার জন্য বিরোধী জোটের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। ব্যতিক্রমী এ সংসদে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা, সংসদ উপনেতা গুরুত্বপূর্ণ এ চার পদে দায়িত্ব পালন করছেন চার নারী। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সংসদে দেয়া ভাষণে নতুন সংসদকে নতুন কনসেপ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সরকারি ও বিরোধী দল সমস্যার সমধান করবে। তবে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বক্তব্য রাখার সময় একবারের জন্যও রওশন মুখে আনেননি তার দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম।

ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর সভাপতিত্বে গতকাল সন্ধ্যা ৬ টায় অধিবেশন শুরু হয়। এসময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, জাতীয় পার্টি  (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ সরকার ও বিরোধী দলীয় এমপিরা উপস্থিত ছিলেন। ৫ই জানুয়ারি ভোটের পর ৮ই জানুয়ারি নবনির্বাচিত এমপিদের নামে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। ৯ই জানুয়ারি এমপিরা শপথ নেন। এরপর ১২ই জানুয়ারি নতুন মন্ত্রি সভা গঠিত হয়। এ পর্যন্ত দশম সংসদের সদস্য হিসেবে ২৯৮ জন এমপি শপথ নিয়েছেন। এরমধ্যে টাঙ্গাইল ৮ আসনের সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহানের মুত্যুতে ওই আসন শূন্য রয়েছে। এ হিসেবে ২৯৭ জন এমপি নিয়ে দশম জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হলো। এবারই প্রথম সংসদে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এবার ১৬ জন এমপি স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদে যোগদান করেছেন। এবারই প্রথম স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে আলাদা জোট হয়েছে। ১৫জন স্বতন্ত্র এমপিকে নিয়ে গঠিত এ জোটের সভাপতি হয়েছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হাজী মোহাম্মদ  সেলিম।
সমঝোতার আহবান প্রেসিডেন্টের
সংঘাত ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসার জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, রাজনীতির নামে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা দমন করতে হবে। জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। গত ৫ বছর শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হেঁটেছি সে পথেই বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস হিংসার রাজনীতি কখনও দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে অন্ধকারাছন্ন করে তোলে। প্রেসিডেন্ট বলেন, মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ২০০৯ সালে কতিপয় বিরোধী রাজনৈতিক দল অসহযোগিতা ও সংঘাতের পথ গ্রহণ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে। তারা ক্রমাগতভাবে সংসদ বর্জন, সংবিধান সংশোধনের কাজে সহযোগিতা করেনি।  বিএনপিবিহীন নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচন প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।  ভোট বর্জনের ডাক দিয়ে সহিংসতা এবং নির্বাচন পরবর্তী হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর হামলার সমালোচনাও করে তিনি বলেন, রাজনীতির নামে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির এ ধরনের অপচেষ্টা দমন করতে হবে। জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি। বিরোধী জোটের উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট বলেন, সরকারে সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে সাহায্য করুন। রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাত অবসানের মাধ্যমে সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখুন। ভাষণে প্রেসিডেন্ট গত পাঁচ বছরে মহাজোট সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।
স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন: ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী আবারও স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন। ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন এডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতেই   বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সর্বসম্মতিক্রমে তারা নির্বাচিত হন। রংপুর-৬ আসনের সদস্য শিরিন শারমিনের নাম প্রস্তাব করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার প্রস্তাব সমর্থন করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। পরে প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিতে পাস হয়। এরপর ডেপুটি স্পিকার পদে গাইবান্ধা-৫ আসনের সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়ার নাম প্রস্তাব করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তার প্রস্তাব সমর্থন করেন চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। এই প্রস্তাবটিও সর্বসম্মতিতে পাস হয়। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখের সংসদ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিদায়ী ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। ভাষণে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে উল্ল্যেখ করেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিকল্প কেবলই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই এটা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো এবং গণতন্ত্রের ভিতকে আরও মজবুত করতে নিরলসভাবে কাজ করার জন্য সকল সংসদ সদস্যের প্রতি আহ্বান জানান। এর আগে অধিবেশনের শুরুতে তিনি বলেন, দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে আমি আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রথমেই সফল নেতা শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা নির্বাচিত হওয়ায় আমি আনন্দিত ও গৌরবান্বিত বোধ করছি। আমি সকল সংসদ-সদস্যের পক্ষ থেকে তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি দশম সংসদের সব সংসদকে অভিনন্দন জানান। এরপর তিনি ২০ মিনিটের জন্য সংসদ অধিবেশন মূলতবি করেন। এসময় নবনির্বাচিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার শপথ গ্রহণ করেন। সংসদ ভবনের ৭ম তলায় প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে তাদের শপথ পাঠ করান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। শপথ শেষে স্পিকার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ বিজয় বাংলাদেশের সব নারীর। বিরতি শেষে পুনর্নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে আবারও অধিবেশন শুরু হয়।
নতুন কনসেপ্টের সংসদ- বিরোধী দলীয় নেতা: এদিকে স্পিকারকে ধন্যাবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বিরোধী দলীয় নেতাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের বেশ কয়েক নেতা। রওশন এরশাদ তার বক্তব্যে বর্তমান সংসদ একটি নতুন কনসেপ্ট বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিরোধী দল হিসেবে সরকারে থাকা এবং সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা এবং ভাল কাজের প্রশংসা আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর মতো একটি নতুন কনসেপ্ট। বক্তব্যের শুরুতে রওশন এরশাদ স্পিকার শিরিন শারমিনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মাননীয় স্পিকার, আপনার মতো একজন প্রফেশনাল একাডেমিক ট্যালেন্ট, ফেয়ার অ্যান্ড পারফেক্ট লেডি পুনরায় স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় আমরা গর্বিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, জাতির জনক যদি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন না দেখতেন, তাহলে এই সংসদও হতো না এবং আমরাও সদস্য হতে পারতাম না। জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, তার অবদানের কথা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু তার রাজনৈতিক দল দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্বাচনে আসেনি। এটা দুঃখজনক। কিন্তু কোন দল নির্বাচনে আসবে না বলে নির্বাচন হবে না, এটা হতে পারে না। বিরোধীদলীয় নেতা দেশের সকল প্রয়াত ও জীবিত কীর্তিমানদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান। রওশন এরশাদ বলেন, আমাদের দেশের মূল সমস্যা হলো রাজনৈতিক হানাহানি। আমরা কখনও দেখিনি আমাদের বিরোধী দল এবং সরকারি দল জাতির প্রয়োজনে এক সঙ্গে কাজ করেছে। বর্তমান সংসদ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেকেই বলছে এটা গৃহপালিত বিরোধী দল। কিন্তু আমরা সরকারে অংশ নিলেও প্রকৃত বিরোধী দলের মতো সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা করবো এবং খারাপ কাজের সমালোচনা করবো। রওশন এরশাদ স্পিকারের প্রতি আহবান রেখে বলেন, আমাদের প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে যথেষ্ট সময় দেবেন এবং দৃষ্টি রাখবেন বলে আশা করি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আমরা সরকারের খারাপ কাজে সমালোচনা এবং ভাল কাজে প্রশংসা করবো। এটা হবে আমাদের ব্যতিক্রম প্রচেষ্টা। জাতীয় পার্টি যেন ইতিবাচক রাজনীতি উপহার দিতে পারে আমি সেই দোয়া কামনা করবো। এ জন্য জন্য দেশের মানুষকে বলবো, আপনারা দেখবেন বিরোধী দলেও থেকে জাতীয় পার্টি তার দায়িত্ব ভালভাবে পালন করবে। জনগণকে এক্যবদ্ধ রাখা এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিতকতা রক্ষায় শত প্রতিকূল অবস্থা ছিন্ন করে জাতির কাছে এই সংসদ উপহার দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান রুহুল আমিন হাওলাদার। নতুন স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় শিরিন শারমিন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
অধিবেশন কক্ষের খণ্ডচিত্র: সন্ধ্যা ৬টায় অধিবেশন শুরুর নির্ধারিত সময় থাকলেও ২০ মিনিট আগেই কক্ষে প্রবেশ করেন জাতীয় পার্টির চেযারম্যান এইচএম এরশাদ। তার সঙ্গে আসেন দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। সংসদের রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার পাশের আসনে বসেন উপনেতারা। নবম সংসদের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনে বসেন সরকারি দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তবে বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের পাশে বসেন এরশাদ। যদিও দলটির পক্ষ থেকে এখনও কাউকে উপনেতা নির্বাচিত করা হয়নি।
এদিকে অধিবেশন কক্ষে এরশাদকে আগে থেকে বসা দেখে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের বেশ কয়েক নেতা তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ তালিকায় প্রথমে ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি প্রায় ৫ মিনিট এরশাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই আসেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এ সময় এরশাদকে কিছুটা বিমর্ষ দেখা গেছে। এদিকে প্রায় আধা ঘণ্টা পর সংসদ কক্ষে প্রবেশ করেন প্রথমবারের মতো বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। পাশে বসে থাকলেও এরশাদ-রওশনের মধ্যে কোন কথা হয়নি। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর অধিবেশন ২ মিনিটের জন্য মুলতুবি করা হয়। এরপরই আসন থেকে উঠে যান এরশাদ। এর ৫ মিনিট পর সংসদ লবিতে গিয়ে বসেন রওশন।
তথ্যমন্ত্রীর ব্রিফিং: এইচ এম এরশাদের সঙ্গে ৫ মিনিট কুশল বিনিময়ের পর অধিবেশন কক্ষে দায়িত্বরত বিটিভি ও সংসদ টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানদের কাছে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এ সময় তিনি তাদের বেশ কিছু সময় ব্রিফিং করেন। হাতের ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দেন ক্যামেরা কাদের দিকে তাক করতে হবে। সুষ্ঠু প্রচারণার স্বার্থে তিনি এ ব্রিফিং করেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সামনের সারিতে বিরোধী দলের ৬ আসন: রওশন এরশাদের নেতৃত্বে থাকা জাতীয় পার্টির জন্য সামনের প্রথম সারিতে ছয়টি আসন দেয়া হয়। বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসেন রওশন এরশাদ। পরের আসনে এইচএম এরশাদ। এরপর বসেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। সামনের সারির পরের চারটি আসনে যথাক্রমে বসেন হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও ফজলে হোসেন বাদশা। এদিকে আগের সংসদের মতোই এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনে বসেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। এরপর যথাক্রমে বসেন বেগম মতিয়া চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু (৯ম সংসদে তিনি ছিলেন মাঝের সারিতে), সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও এডভোকেট রহমত আলী। এদিকে সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদকে এবার দেয়া হয়েছে মাঝের সারির দ্বিতীয় সারিতে। এর আগে অধিবেশন শুরুর ৫ মিনিট আগে সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে সংসদে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় উপস্থিত এমপিরা টেবিল চাপড়ে তাকে স্বাগত জানান। এর দুই মিনিট পর অধিবেশন কক্ষে আসেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। ৬টা ১০ মিনিটে চেয়ারে বসেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দশম জাতীয় সংসদের অভিযাত্রা।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনীত: স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে সংসদ কার্য পরিচালনার জন্য ৫ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচন করা হয়। স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী তাদের নাম ঘোষণা করেন। এ তালিকায় রয়েছেন আবুল কালাম আজাদ, এইচএন আশিকুর রহমান, বেগম সাহারা খাতুন, নুরুল ইসলাম সুজন ও একেএম মাইদুল ইসলাম।
শোক প্রস্তাব উত্থাপন: চলতি সংসদের সদস্য শওকত মোমেন শাজাহানসহ সাবেক এমপি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুতে অধিবেশনের প্রথম দিনে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই তালিকায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, সাবেক আইন পরিষদের সদস্য মমতাজ আহমেদ, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের বেশ কয়েক নেতা তাদের স্বরণ করে বক্তব্য দেন। পরে এক মিনিট নীরবতা পালন করে প্রয়াতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছেন স্পিকার: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন পুনর্নির্বাচিত স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় তাদের সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে সকাল ৭টায় ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে পুষ্পস্তাবক অর্পণ করবেন তিনি। এ সময়ে তার সঙ্গে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজসহ পাঁচ হুইপ থাকবেন বলে সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সাংবিধানিক গোঁজামিলের সংসদ: বিএনপি
দশম সংসদ অধিবেশনকে ‘সাংবিধানিক গোঁজামিলে’র সংসদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, প্রহসন, নাটক ও গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছে। এখন সাংবিধানিক গোঁজামিলের মধ্য দিয়ে সে সরকার সংসদ গঠন করেছে। এটা হলো ‘সং’দের সংসদ। এ সংসদের কোন কর্তৃত্ব নেই। গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, গত ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়ে গেল তাতে ১৫৩ জন কুশীলব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭ আসনের এমপিরা মাত্র ৫ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন।  গণতন্ত্রকে হত্যা করে, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে যে সংসদ গঠিত হয়েছে তার কোন কর্তৃত্ব নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মাত্র যে ৫ ভাগ ভোটে নির্বাচিত হয়েছে তাতে শুধু আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যায়। এতে কোন কর্তৃত্ব নেই। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। মির্জা আলমগীর বলেন, আবারও প্রমাণ হয়েছে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাদেরকে আজ অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, সমপ্রতি সারা দেশে যে পরিমাণ ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এখন যেখানে-সেখানে বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পল্লবীতে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিরোধী দলকে নির্মূল করতেই এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। গুম, খুনের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মির্জা আলমগীর বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা আমাদের সঙ্গে  যোগাযোগ করেছে। দুই-একদিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হবে। তা বিএনপি চেয়ারপারসনই করতে পারেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যের সমালোচনা করে মির্জা আলমগীর বলেন, ইনু সাহেব যে ভাষায় কথা বলছেন তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। এটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বহির্ভূত। তিনি অতীত ভুলে গেছেন। অতীতে হত্যা, সন্ত্রাস ও মানুষ খুনসহ সহিংস ঘটনার সংস্কৃতি ইনু সাহেবই শুরু করেছিলেন। এসব ঘটনার কারণে তার নাম ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে। কারণ, তিনি গণবাহিনী তৈরি করেছিলেন এবং আজকে যাদের সঙ্গে ক্ষমতায় আছেন তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। তথ্যমন্ত্রীকে তার অতীতের কথা স্মরণ করে বিএনপি চেয়ারপারসন সম্পর্কে কথা বলার আহ্বান জানান মির্জা আলমগীর। বিএনপি কতদিন কঠোর কর্মসূচি এড়িয়ে চলবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সচেতনভাবে সব সময় সংঘাত ও সংঘর্ষ এড়িয়ে চলছি। আমরা কথা বলার সুযোগ চাই। তবে, সময়  বেঁধে দিয়ে আন্দোলন হয় না। তা সরকারের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন দমন, নির্যাতন বন্ধ হয়নি। বিএনপির কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা হতাশ নয় বরং উজ্জীবিত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জানা মতে, কোন রাষ্ট্র সরকারকে বৈধতা দেয়নি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারেক রহমানের শাশুড়ির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয়ার নিন্দা জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, আমরা এই মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছি। তারেক রহমানের শাশুড়ি হওয়ায় নোংরা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে দুদক এই মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন মামলার রায় কি হবে। রায় না দেয়ার আগেই তারা বলতে পারবে কি রায় দেয়া হচ্ছে। রায় না হওয়া পর্যন্ত এই বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি, আসাদুল করিম শাহিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপ কবে জানতে চায় কানাডা

Wednesday, January 22, 2014

পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ‘সংলাপ’ প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের ইতিবাচক মনোভাবের প্রশংসা করেছে কানাডা। দেশটির ঢাকাস্থ হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন এবার জানার চেষ্টা করছেন,
কাঙ্ক্ষিত ওই সংলাপ কবে নাগাদ শুরু করতে চায় সরকার। নবগঠিত সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে গতকাল কানাডা দূতের এক ঘণ্টা বৈঠকের মুখ্য আলোচ্য ছিল এটি। বৈঠক সূত্রের দাবি, অত্যন্ত খোলামেলা ও প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে দু’জনের মধ্যে। বৈঠকে ক্রুডেন ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তার দেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ভোট গ্রহণের পর কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ‘হতাশা’ ব্যক্ত করেছেন তারও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, বেশির ভাগ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোট না হওয়ায় তারা হতাশ হয়েছেন। ভোটের আগে-পরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় সংখ্যালঘু সমপ্রদায় যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে তাতে কানাডা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর আরেকটি নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতার জন্য প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপের যে তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার প্রশংসা করেছেন হাইকমিশনার। বিরোধী জোটের হরতাল, অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূূচি থেকে সরে আসা, বিরোধী দলকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া এবং কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ সম্পন্ন হওয়া সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টিতে ‘ইতিবাচক’ ও ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ বলে মনে করছেন তিনি। একই সঙ্গে তার দেশ আশা করে, উভয় পক্ষের ইতিবাচক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে এক গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান বিরোধী জোটসহ বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের কৌশল গ্রহণ ঠিক হয়নি বলেও মনে করেন কানাডিয়ান হাইকমিশনার। তার সব জিজ্ঞাসার জবাবে নয়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অবশ্য আরেকটি নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পুনরুল্লেখ করেছেন। বলেছেন, সহিংসতা ও জামায়াতকে ত্যাগ করলে সরকারের পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শনের ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হবে। সরকারের ভেতরে বা বাইরে যে যাই বলুল না কেন- প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটাই ‘বটম লাইন’ বলে জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। দীর্ঘ ওই বৈঠকে সরকারের ১০০ দিনের পরিকল্পনা প্রসঙ্গেও জানতে চেয়েছেন প্রভাবশালী ওই দূত। জবাবে শাহরিয়ার আলম এমপি বলেছেন, গত ৫ বছরে অভিজ্ঞতার আলোকেই তার দল একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। পর্যায়ক্রমে সেটি বাস্তবায়নে তারা সচেষ্ট থাকবেন।

সরল গরল- দশম সংসদ বৈধতা পাবে না by মিজানুর রহমান খান

Friday, January 3, 2014

বৈধতার প্রশ্ন উঠেছে এবং ৫ জানুয়ারির পরে কেবল রাজনৈতিক বৈধতা নয়, সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নও উঠবে। ইতিমধ্যে দিল্লিতে গত ৩১ ডিসেম্বর ভারতীয় সাংবাদিকেরা তাঁদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের কাছে বৈধতার প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রশ্নটি সরল, কিন্তু উত্তর গরল। তাই মুখপাত্র এর উত্তর দেননি। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘জনাব, ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে নির্বাচন হচ্ছে। এখন এটা স্পষ্ট যে বিরোধী দল অংশ নিচ্ছে না। এই নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নে আমাদের কি কোনো মন্তব্য রয়েছে?’ মুখপাত্রটি প্রবাদের ‘গরু রচনা’ মুখস্থ বলেছেন। জবরদস্তি গরু টেনে নদীতে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, দুই দেশের ভালোমন্দে পরস্পরের বৈধ স্বার্থ রয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আবারও বলেন, ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই নির্বাচন হচ্ছে। সরে যাওয়ার উপায় নেই।’
জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করা হয়েছিল। এবারও তা করা সম্ভব। অনেকে বলছেন, ঘড়ির কাঁটা ৫ জানুয়ারি পেরোলেই কেল্লা ফতে। বিএনপি বা অন্য কেউ নির্বাচন বাতিলের কথা মুখে আনতে পারবে না। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের সাংবিধানিক চেতনা বিবেচনায় নিই, যদি মনে রাখি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ছাড়াও দেশে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ বিচারপতি ছিলেন এবং আছেন, তাঁদের লেখা রায়গুলোও প্রজাতন্ত্রের প্রচলিত আইন, তাহলে অন্তত আর যা-ই হোক, আমাদের সংবিধান দেখানো হবে না। আমাদের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের ভয় দেখানো হবে না।
১ জানুয়ারি সজীব ওয়াজেদ জয় বৈশাখী টিভির এক প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘এই নির্বাচন সংবিধানের চেতনার বিরুদ্ধে যায় না।’ এটা সর্বৈব অসত্য। এর আগেও নির্দিষ্টভাবে বলেছি, দরকার হলে আরও অনেক রায় দিয়ে প্রমাণ করতে পারি, এই নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সপক্ষে ফেনা তোলা রায়গুলোরও পরিপন্থী।
জয় বলেছেন, বিএনপির জন্য সংবিধান সংশোধন কমিটি দুই বছর নাকি বসে ছিল। ধরে নিলাম সত্য। চাইলে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংবিধানের নতুন সংশোধনী আনা যাবে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন করে ফেললেও এতে কোনো বাধা সৃষ্টি হবে না। সংবিধানে আরও ঘাপলা আছে। সংবিধান রক্ষা নিয়ে ফেনা তুলছে অথচ তারা একটি সংশোধনী আনতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। নবনির্বাচিতদের শপথ পড়ানো নিয়ে সংবিধানে সংঘাতপূর্ণ বিধান আছে। ৫ জানুয়ারির পরে তারা চাইলে একটা সংশোধনী আনতে পারে। অন্যথায় বশংবদ ইসির আনুকূল্যে নবনির্বাচিতরা সংঘাত মাড়িয়ে শপথ পড়বেন।
‘সংবিধান অনুযায়ী’ কথাটা যদি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মিত্রদের শর্ত ছাড়াও যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে মানতে হবে নির্বাচন কমিশন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরও গোটা নির্বাচন বাতিল করার এখতিয়ার রাখে। এর আগে দেখিয়েছি, কী করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করে আগামী এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করা যায়। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ১ জানুয়ারি চ্যানেল আইয়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের জটিলতার কথা বলেছেন। কিন্তু এটাকে এখন জটিল বলা যাবে না। উতরানো সম্ভব।
যাক এবার বলি, ৫ জানুয়ারির পর কী হবে? নির্বাচন কমিশন ওই দিন বা তার পর যেকোনো দিন নির্বাচন বাতিল করতে পারবে। আমরা এটাও মনে রাখব, তারাও নির্দিষ্টভাবে বেআইনি কাজ করেছে। বর্তমান তফসিল সেই বিচারে অবৈধ। ঋণখেলাপিদের টাকা জমা দেওয়া ও তাঁদের মনোনয়নপত্র দাখিলের মধ্যে সাত দিন সময় রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তারা তা খেয়াল করেনি। নির্বাচন কমিশনের সবারই এটা জানা। কিন্তু চুপচাপ আছে।
২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দশম সংসদের কাউকেই সংসদ সদস্য বলা যাবে না। ২৫ জানুয়ারির আগে তাঁরা কেউ কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না। এটা নির্দিষ্টভাবে বলা আছে। তাই এই বিধান অমান্য করা যাবে না। তাই প্রধানমন্ত্রীকে দশম সংসদের নেতা হতে হলে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
এটা পরিহাস যে, সামরিক শাসকদের দ্বারা ডকট্রিন অব নেসেসিটি দিয়ে এ দেশ চলেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বলে দিলেন, এই মতবাদটা কেবল সামরিক শাসকের নয়, এটা বেসামরিক শাসকেরাও ব্যবহার করতে পারেন।
আমরা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লিখেছি, ‘আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ’। দশম সংসদ নির্বাচনের সদস্যরা চক্ষুলজ্জা ঝেড়ে বড় গলায় কি ওইভাবে বলতে পারবেন যে, আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ?
দশম সংসদের নির্বাচিতদের ম্যান্ডেট কী? তাঁরা পাঁচ বছর কোন নৈতিকতা ও কর্তৃত্বে দেশ চালাবেন? আমরা জানি না। জেনারেল ইয়াহিয়াও কার্যত বলেছিলেন, একসঙ্গে দুটি দিতে পারব না। একটি নিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিকদের একটি বড় অংশ নিশ্চয় মুজিবকে ঠকিয়ে নিজেদের বড় বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ভেবেছিল। তারা আসলে গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে ‘স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব’কে অর্জন ভেবেছিল। তারা ভাবতেও পারেনি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এটা পৃথক করা যায় না। পানি দুই ভাগ করা যায় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো খণ্ডন, রদ, স্থগিত কিংবা সাহাম (ন্যায্য অংশ) চলে না।
ক্ষমতাসীনেরা বলছেন, দশম সংসদ নিয়ে আর সংলাপ চলে না। একাদশ সংসদ নিয়ে সংলাপ হতে পারে। শাসকগোষ্ঠী এক মুখে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার’ কথা বলছে। অন্য মুখে আবার আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছে। কতক্ষণ বলছে, এখন আর সংসদ ভেঙে ৯০ দিন সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সংবিধান তা সমর্থন করে না। তাই এখন আর সমঝোতার জন্য কান্নাকাটি বৃথা। সমঝোতা নয়, সংবিধান বড়।
সম্প্রতি কারাবরণকারী বিএনপির একজন নেতা আমাকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে ভারতীয়দের কথা হয়েছে। তিনি ১৯৯৬-এর মডেলে সমাধানের আভাস দিয়েছেন। এরপর খালেদা জিয়াকেও সেই আভাস দিতে শুনলাম। তিনি নিয়মরক্ষার নির্বাচন হিসেবে মেনে নেওয়ার স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পাঁচ কোটির বেশি ভোটারের এই অধিকার অগ্রাহ্য করে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকেই বড় করে তুলেছেন।
পিপলস ইউনিয়ন ফর লিবার্টিস মামলায় ভারতীয় বিচারপতি ধর্মাধিকারী বলেছেন, ‘কোনো নির্বাচনে একজন নাগরিকের অংশগ্রহণ এবং তার পছন্দের প্রার্থীকে বাছাই করা এমন একটি অধিকার, যা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে দেওয়া তার ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে ভিন্ন।’ অথচ ৫ জানুয়ারি সংবিধান চুলোয় দিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ নিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন।
কুলদীপ নায়ারের মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, ‘বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সংসদ সদস্যদের কেবল প্রত্যক্ষ ভোটেই বেছে নেওয়া হয়।’ অন্তত স্বীকার করুন দেশটা গণতান্ত্রিক নয়। তার পরে নির্বাচন করুন।
ভারতের প্রধান বিচারপতি পি সত্যশীবম, বিচারপতি রঞ্জন প্রকাশ দেশাই, বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ২৭ সেপ্টেম্বর অভিমত দেন যে, ‘গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এটা অপরিহার্য যে দেশের যথাযথ শাসনের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য ভালো লোককেই জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে।’
বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের আনা অভিযোগের বিরোধিতা না করেও এটা মানতে হবে যে ক্ষমতাসীন দল ও ইসি ভালো লোককে বাছাই করার রক্ষাকবচ দিতে পারেনি। তাই সংবিধানের গান গাওয়া আর গণতন্ত্রকে বাঁচানো এক নয়।
সংসদের বৈধতার প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি দূরদর্শী উক্তি করেছিলেন। সংবিধান সংশোধন কমিটির সভায় শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি বলেছিলেন, ‘আমি দুটি সংসদ অবৈধ ঘোষণার সুপারিশ করি। কারণ, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৫ শতাংশ লোকও ভোট দেয়নি। এ দুটি বাতিল করলে ওই সংসদের করা সব সংশোধনী অটোমেটিক্যালি বাতিল হবে।’ অর্থাৎ, এটা মানলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হতো। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে যা করা হলো, তার তুলনায় এটা ছিল উত্তম সুপারিশ। তিনি এটা কেবল সভাতেই বলেননি, ২০১০ সালের ৮ আগস্ট চিঠি লিখেও কমিটিকে জানিয়েছিলেন।
এটা অগ্রাহ্য করা হয়েছে, কারণ শাসকের শঠতাপূর্ণ আঁতাত দুই নেত্রী টলাতে চান না। তাই মুহিত-ফর্মুলা উপেক্ষিত হয়েছিল। সে কারণেই বিএনপির নেত্রী অত সহজে দশম সংসদকে ‘নিয়মরক্ষার’ নির্বাচন হিসেবে মেনে নেওয়ার উপায় বাতলাতে পারেন। তাই তারা ক্ষমতায় গেলে দশম সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করবে না। কিন্তু গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে নিতে হলে সত্যিকারের নির্বাচিত সংসদকেই কোনো না কোনো দিন উপযুক্ত পরিবেশে এটা করতে হবে। আমরা ১৯৮৮ ও ১৯৯৬-এর সংসদকে অবশ্যই অবৈধ মনে করি। ৫ জানুয়ারির সংসদও বৈধতা পাবে না।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু