বিশ্বায়নের কাল- বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন by কামাল আহমেদ

Saturday, February 22, 2014

বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন। ইংরেজিতে ‘ব্রিটেন অ্যাজ বাংলাদেশ’ শিরোনামটা আমার নয়, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় এবং রক্ষণশীল দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার একটি সংবাদভাষ্যের।
ব্রিটেনের সাম্প্রতিক রেকর্ড সৃষ্টিকারী বন্যা এবং তার দুর্ভোগের ফলে যে জাতীয় বিতর্ক চলছে, তার তুলনা খুঁজতে গিয়ে পত্রিকাটির শিরোনাম রচয়িতার মনে হয়েছে যে এ ক্ষেত্রে একমাত্র তুলনীয় রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ।

ব্রিটেনে যে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেল, তার ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য কয়েকটি তথ্য এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। আবহাওয়ার এই বিরূপ ছোবল এক দিন বা কয়েক দিনের নয়, এটি চলেছে প্রায় দুই মাস ধরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের সময় শুরু হওয়ার পর তা আড়াই মাস ধরে বারবার ফিরে এসেছে। আধুনিককালের কারখানাগুলোতে কনভেয়ার বেল্টে যেভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলো আসতে থাকে, সেভাবেই একের পর এক নিম্নচাপ এসেছে। মোট কতবার তা বলা মুশকিল। তবে লন্ডন শহরকে বন্যা বা প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য টেমস নদীতে নির্মিত বন্যারোধক বা ফ্লাড ব্যারিয়ারকে এ সময়ে মোট ২৮ বার নামাতে হয়েছে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যতবার নামাতে হয়েছে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হয়েছে গত দুই মাসে। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর যে বায়ুপ্রবাহের (জেটস্টিম) প্রভাবে এসব বৃষ্টি এবং জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, এই উপর্যুপরি আঘাতের কারণে ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমে একে ‘কনভেয়ার বেল্ট ওয়েদার ফেনোমেনন’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
একটি হিসাবে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে যখন থেকে বৃষ্টির হিসাব রাখা শুরু হয়েছে, সেই ১৭৭৬ সালের পর এ বছরই বৃষ্টির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। মাটির পানি শোষণ এবং তা ধরে রাখার ক্ষমতা অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় বন্যার পানি সরে যাওয়ারও কোনো জায়গা ছিল না। ফলে, আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বন্যার পানি সরতে সময় লাগছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন কবে তাঁদের ঘরবাড়িতে ফিরতে পারবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। মারা গেছেন অন্তত তিনজন। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক শ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না। বিমা কোম্পানিগুলো বলছে যে শুধু ঘরবাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১০০ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে যাবে। রেলপথ, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক সপ্তাহ।
তবে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর শিরোনামে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসার কারণ বন্যাপীড়িত ব্রিটিশদের দুর্ভোগের বিষয় নয়, বরং বন্যার দুর্ভোগের কারণটি। বাংলাদেশে বন্যা একটি বার্ষিক অনুষঙ্গ এবং বাংলাদেশিরা বন্যার সঙ্গে নিজেদের জীবনকে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন বা চেষ্টা করছেন। বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, বাংলাদেশের জন্য তার সংস্থান করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, বাংলাদেশে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণ ও সম্পদহানি রোধে উঁচু স্থানে আশ্রয়শিবির নির্মাণ, সতর্কবাণী প্রচার, সম্ভাব্য বিপদের সময় বসতবাড়ি ছেড়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা, স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তুতি—এগুলোর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম ধনী রাষ্ট্র ব্রিটেনে বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলার একটি বড় অংশ হচ্ছে বন্যানিয়ন্ত্রণ।
১৯২৮ সালের বন্যায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ঐতিহাসিক স্থাপনা, ওয়েস্টমিনস্টার ভবন এবং লন্ডনের পাতালরেল প্লাবিত হওয়ার পর লন্ডনকে রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় এবং সত্তরের দশকে টেমসের ফ্লাড ব্যারিয়ার নির্মাণ শুরু হয়, যা সম্পন্ন হয় ১৯৮২ সালে। এই দ্বীপরাষ্ট্রের উপকূলীয় শহরগুলোর প্রায় সব কটিতেই রয়েছে উঁচু শহর রক্ষাবাঁধ। কোথাও কোথাও তা শত বছরের পুরোনো, কোথাও কোথাও কয়েক দশকের। আবার, কোথাও কোথাও উপকূল থেকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে বসতি গড়া হয়েছে অনেকটা ভেতরে, যাতে মাঝখানের জায়গাটি পানি ধরে রাখতে পারে। নদীগুলোর নাব্যতা বজায় রাখার জন্যও সময়ে সময়ে ড্রেজিং বা পলি অপসারণের কাজটাও করা হয়। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর বিশেষ করে সমারসেট এলাকার নদীগুলোতে কোনো ড্রেজিং হয়নি। ২০০৭ সালে ওই এলাকায় যে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল, সেই বন্যার পর ড্রেজিংয়ের জন্য দাবি উঠলেও সরকার তার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ দিতে পারেনি। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং পরবর্তী সময়ে টোরি পার্টির কৃচ্ছ্র কর্মসূচি তার অন্যতম কারণ। আর, বন্যানিয়ন্ত্রণে অক্ষমতার মধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
অবশ্য বলে রাখা ভালো, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর উদ্দেশ্যটা এ ক্ষেত্রে মহৎ নয়, বরং তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাববিষয়ক বিতর্ককে আড়াল এবং নাকচ করার উদ্দেশ্যেই বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টিকারী রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বৈশ্বিক পরিসরে মিডিয়া মোগল হিসেবে খ্যাত রুপার্ট মারডকের মালিকানায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর মতোই। ব্রিটেনের এই সাম্প্রতিক বন্যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন এবং বিরোধী নেতা এড মিলিব্যান্ডের প্রায় অভিন্ন অবস্থানকে পত্রিকাটি যেভাবে তিরস্কার করেছে, তাতে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়ও উপর্যুপরি তুষারপাতে জনজীবন অচল হয়ে যাওয়ার চিত্র ওই সব দেশের রাজনীতিকদের কিছুটা বিচলিত করে তুলেছে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আশার কথা এই যে সাম্প্রতিক ‘কনভেয়ার বেল্ট ওয়েদার ফেনোমেনন’ আটলান্টিকের উভয় তীরে যে জনভোগান্তির জন্ম দিয়েছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার কমানোর বিষয়টিতে এসব শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোকে এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে কিছুটা সক্রিয় হতে হবে। গত সপ্তাহান্তে তাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি চীন ও ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার কমাতে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য ওই দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

দুই.
‘বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন’ শিরোনামটি অবশ্য আমি অন্য আরেকটি ক্ষেত্রেও আংশিকভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করি। আর সেই ক্ষেত্রটি হচ্ছে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক সংকীর্ণতার তাড়নায় গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কতিপয় বাংলাদেশি ‘যেকোনো উপায়ে পরাজয় এড়ানোর’ যেসব কৌশল ব্রিটেনে আমদানি করেছে বলে অভিযোগ উঠছে, তার পটভূমিতেই এ কথা বলা চলে (সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশির ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্য নয়)।
ব্রিটেনের নির্বাচন কমিশন গত ৮ জানুয়ারি এক রিপোর্টে বলেছে যে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী—বিশেষ করে পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি ব্রিটিশদের মধ্যে ভোট জালিয়াতির ঝুঁকি বেশি। শুধু ইংল্যান্ডের ১৬টি পৌর এলাকাকে চিহ্নিত করে কমিশন বলেছে যে তারা এসব এলাকায় ভোট জালিয়াতির ঝুঁকির বিষয়টি বিশেষভাবে খতিয়ে দেখছে। এলাকাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিপ্রধান টাওয়ার হ্যামলেটস ছাড়াও বার্মিংহাম, ব্ল্যাকবার্ন, কভেন্ট্রি, ওল্ডহ্যাম, ব্রাডফোর্ড, স্পাও, পিটারবরার মতো পৌর এলাকা রয়েছে, যেসব জায়গায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করে। ভোট জালিয়াতির অন্যতম প্রধান একটি উপায় হচ্ছে ডাকযোগে ভোট। অভিযোগ রয়েছে, একটি এক বা দুই শয়নকক্ষের বাসাতেও ১৫-২০ জন ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা হয়, যাঁদের অধিকাংশই ভুয়া অথবা অন্য এলাকার বাসিন্দা। তাঁদের ভোটগুলো প্রার্থীদের পক্ষে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেই ভোটের ঝুলিটা বাড়ানো যায়।
ব্রিটিশ নির্বাচন কমিশন ডাকযোগে ভোট বন্ধ করার দাবিটি গ্রহণ না করলেও আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় স্থানীয় সরকার এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগেই ভোটার রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কমিশন একই সঙ্গে সুপারিশ করেছে যে ভোট দেওয়ার সময় ভোটারদের পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা হোক। সরকার কমিশনের সুপারিশকে স্বাগত জানানোয় ধারণা করা হচ্ছে, এই সুপারিশের আলোকে সরকার হয়তো নতুন আইন তৈরি করবে, তবে তা আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে সম্পন্ন হবে কি না, বলা মুশকিল।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিবিসিসি) দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। বণিক সমিতি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটেনে খুব যে প্রভাবশালী সে কথা বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশে তাদের গুরুত্বই আলাদা। বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগ বাড়ার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আরও বাড়ছে বলেই মনে হয়। কিন্তু সেখানেও কোটারি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে সফল হিসেবে খ্যাত ইকবাল আহমেদ ও বিইসহ (প্রবাসী ব্যাংক-এর উদ্যোক্তা চেয়ারমান) ছয়জন পরিচালক ২ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি একটি কোটারি স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র না মেনে স্বেচ্ছাচারের মাধ্যমে কয়েকজন সহযোগীর সদস্যপদ স্থগিত করেছে।
স্থানীয় বাংলা সংবাদমাধ্যমকে বিবিসিসির কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে নির্বাচনের আগেই সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু সর্বশেষ খবর হচ্ছে, সমস্যা নিরসন ছাড়াই অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

বিশ্বায়নের কাল- অঘটন-উত্তর বোধোদয়, নাকি রাজনীতি? by কামাল আহমেদ

Thursday, January 23, 2014

ব্রিটেনে ইংরেজি শব্দ ‘হাইন্ডসাইট’ একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। বিশেষ করে রাজনীতিকদের কাছে। যখনই কোনো কৈফিয়তের প্রশ্ন আসে, তখনই তাঁরা এই শব্দটি ব্যবহার করে ‘কী করিলে কী হইত’-এর বিভিন্ন সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরে তাঁদের নিজেদের অক্ষমতা বা না পারার যৌক্তিকতা ব্যাখা করে থাকেন।
বাংলা একাডেমির অভিধান এবং গুগল-এর অনুবাদ অনুযায়ী এর অর্থ হচ্ছে ‘সংঘটনের পর বোধোদয়’। এটি বাংলা প্রবাদ ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’র অনুরূপ। বাংলাদেশেও রাজনীতিক ও বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবিদার গোষ্ঠীগুলো ক্রমেই

এই অঘটন-উত্তর বোধোদয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তা না হলে বছর খানেক ধরে যে অঘটনের আশঙ্কা সবাই করছিলেন, তা ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই কেন হয়নি? বরং মনে হয়, রাজনীতির খোরাক হিসেবে এই অঘটনকে পুঁজি করার জন্য এঁদের অধিকাংশই অপেক্ষায় ছিলেন।

সাংবাদিকদের কলম অথবা ক্যামেরায় দেশের নানা জায়গায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার যেসব চিত্র উঠে এসেছে, তাতে কোথাও তো এসব ক্ষমতাধর রাজনীতিক, আমলা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাউকে নিপীড়িত-নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অথচ, এখন তাঁরাই ডজন ডজন ক্যামেরার সামনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে সাহায্য দেওয়ার আয়োজন করছেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুষছেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বেশ কিছু সরেজমিন প্রতিবেদন দেখছি। আর দেখছি মানববন্ধন, লংমার্চ এবং বক্তৃতা-বিবৃতি, যেগুলোর সবই অঘটনোত্তর প্রতিক্রিয়া।

অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য নির্বাচনকালীন মৌসুম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের ওপর হামলার বিষয়টি চরমে পৌঁছায় ২০০১ সালে। এর পর একমাত্র ব্যতিক্রম ২০০৯। এ ধরনের একটি সর্বজনবিদিত ঝুঁকি প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় রাজনীতিকদের উপেক্ষা করার কারণ নেই। অথচ সে রকমটিই ঘটেছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এসব বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তেমন একটা চোখে পড়ছে না। হামলাকারী দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হলেও নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের, তাদের ব্যর্থতা কিংবা গাফিলতি অথবা সম্ভাব্য কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির বিষয়গুলো অনুসন্ধানে কারও কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। প্রধান দুই দল বা জোট বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করতে যতটা আগ্রহী, তার কারণ অনুসন্ধান, অপরাধীদের বিচার এবং ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি রোধের শিক্ষা গ্রহণে ততটাই উদাসীন। সুতরাং, এসব হামলার বিষয়ে ইউরোপীয় জনপ্রতিনিধিরা কিংবা বহির্বিশ্ব থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের যেসব আহ্বান জানানো হয়েছে, সেগুলো কেউ কানে তুলছেন না। রাজনৈতিক কারণ না থাকলে এ ধরনের তদন্তে সরকারের অনাগ্রহের কোনো কারণ থাকার কথা নয়। নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর গণতদন্ত কমিশনের মতো বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণেও তো কোনো বাধা দেখি না।

তদন্তে মাঠপর্যায়ে হামলাগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে অন্য যেসব বিষয় নজর দেওয়া প্রয়োজন সেগুলো হলো—নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, অন্তর্বর্তী সরকার এবং মানবাধিকার কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা।

১. নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশ্নবিদ্ধ। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন স্পষ্ট করেই বলেছেন যে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, অন্য কারও নয় (‘নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে পারে না’, প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি)। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক। অতীতে সচিবের দায়িত্ব পালনের কারণে বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের ধরন, রীতিনীতি, প্রটোকল তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। কমিশনারদের মধ্যে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাও আছেন, যাঁর ব্রিগেড পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং, জাতীয় নির্বাচনের মতো একটা বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় অনুশীলন করেননি এমনটা ভাবা দুষ্কর। যেকোনো নির্বাচন আয়োজনের আগে সেই নির্বাচনে সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ধারণের একটি বিষয় থাকে। স্বভাবতই তাই প্রশ্ন উঠছে যে কমিশন কি সেসব ঝুঁকি নির্ধারণ করেছিল, নাকি সেগুলো উপেক্ষা করেছে? নাকি ঝুঁকি নির্ধারণের পর তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে? কমিশনের তরফ থেকে সংখ্যালঘুদের বিপদ এবং তা মোকাবিলার বিষয়ে কী ধরনের প্রস্তুতি বা নির্দেশনা ছিল? আর, প্রশাসনের ওপরই বা কমিশন কতটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল?

২. মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব যেহেতু পুলিশের, সেহেতু তাদের ভূমিকাও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। জানা দরকার যে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে পুলিশের প্রতি কী ধরনের নির্দেশনা ছিল? সংখ্যালঘুদের বসতিগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না থেকে থাকলে কেন ছিল না? পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে মোতায়েনের সময় তাদের অপারেশনাল গাইডলাইন কি দেওয়া হয়েছিল? কে বা কারা এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন? অপারেশনের নিয়ন্ত্রণ কার কাছে ছিল? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নাকি নির্বাচন কমিশনের কাছে? নাকি পুলিশ নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে তা পরিচালনা করেছে? সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য ছিল কি না? এসব নির্দেশনা নথিভুক্ত থাকার কথা। সেগুলো পর্যালোচনা করলেই জানা সম্ভব যে তাদের প্রতি এমন কোনো নির্দেশনা ছিল কি না যে নির্বাচনবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাল দিতে হবে, অথবা প্রার্থী ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেওয়াই তাদের প্রধান কাজ। বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিরোধের ঘোষণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল এ কথা সত্য। কিন্তু সেই কারণে সমাজে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠী, যাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিদেশিরাও আগাম সর্তকবার্তা দিয়েছে, তারা কীভাবে উপেক্ষিত হলো তা বোঝা মুশকিল।

৩. এরপর মাঠ প্রশাসনের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে যেসব জেলায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে সাতক্ষীরা, যশোর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও রংপুরের কথা বলা যায়, যেসব জেলায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর থেকেই জামায়াত-শিবির একধরনের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। নির্বাচনের মতো বড় আয়োজনের প্রাক্কালে জেলা পর্যায়ে একাধিক প্রশাসনিক প্রস্তুতি সভা হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি নামক একটি কমিটিরও সভা হয়ে থাকে। সেসব সভায় সংখ্যালঘুদের ঝুঁকি এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছিল? নাকি তা উপেক্ষিত থেকেছে? কেন্দ্রীয়ভাবে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কী ধরনের নির্দেশনা ছিল? এসব নির্দেশনা কোত্থেকে এসেছে? নির্বাচন কমিশন নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কাছ থেকে?

৪. নির্বাচনকালীন সরকারের যেসব প্রকাশ্য কার্যকলাপ দৃশ্যমান ছিল, সেগুলো নাটকীয়তায় সরেস হলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসকে কলুষিত করেছে সন্দেহ নেই। নিরাপত্তা বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর হাসপাতাল ব্যবহূত হয়েছে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে। র‌্যাবের গাড়িতে করে জেনারেল এরশাদকে হাসপাতালে নেওয়ার দৃশ্য দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন যে কারও হার্ট অ্যাটাক হলে অ্যাম্বুলেন্সের বদলে র‌্যাবকে ফোন করা উচিত, তাহলেই দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া যাবে। নিরাপত্তার নামে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে কার্যত গৃহবন্দী করা, হরেদরে বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার, এগুলো সামাল দিতে সরকার যতটা তৎপর ছিল, তাতে করে ঝুঁকিতে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দিকে তাদের নজর দেওয়ার সময় কোথায়? সে কারণেই যেসব এলাকায় এসব সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গার স্থানীয় রাজনীতিক এবং সরকারের পরিকল্পনা কিছু ছিল কি না সেটাও বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর উদ্বেগ এবং দাবির মুখে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং বিএনপির নেতা এম কে আনোয়ার ২০১২ সালের ডিসেম্বরেই অঙ্গীকার করেছিলেন যে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলায় তাঁরা একযোগে কাজ করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের তোড়ে সেই সহযোগিতা ভেসে গেলেও সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

নির্বাচনী সহিংসতার ক্ষেত্রে ৫ জানুয়ারির একতরফা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন নতুন রেকর্ড করেছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে। আর এই সহিংসতার একটা বড় ক্ষত বহন করছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হতে পারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে নির্যাতনের শিকার লোকজনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা ভালো উদাহরণ। রাষ্ট্রের অন্তত একটি প্রতিষ্ঠান কিছুটা হলেও নৈতিক দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আইনে কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে তার সদ্ব্যবহার করে তাদের উচিত হবে অচিরেই একটি ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত শুরু করা। সময় চলে গেলে অনেক স্মৃতিই ফিকে হয়ে যাবে, সাক্ষী হারিয়ে যাবেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট হবে। আইন তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেই ক্ষমতার বলে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের নথিপত্র তলব করার এখতিয়ার মানবাধিকার কমিশনের রয়েছে। সুতরাং, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হলো, তার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য আশা করি কমিশন আরেকটু সাহসী হবে। মাঠ পর্যায়ের অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়দায়িত্ব নির্ধারণে বৃহত্তর তদন্ত ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি রোধের জন্যই বেশি প্রয়োজন। শুধু ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন, পরিবার এবং সম্পদের ওপর হামলা হবে, রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবে, অথচ দায়িত্বহীনতার জন্য কারও শাস্তি হবে না—এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান প্রয়োজন।

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

বিশ্বায়নের কাল- বিতর্কের বিষয় যখন বাংলাদেশ by কামাল আহমেদ

Monday, January 20, 2014

বাংলাদেশ সম্পর্কে ভিনদেশের পার্লামেন্টে বিতর্কের ঘটনা সচরাচর ঘটে না বললে কমই বলা হবে; বরং বিরল শব্দটিই এ ক্ষেত্রে যথার্থ হতে পারে। বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, ওয়েস্টমিনস্টারের উভয় কক্ষ—হাউস অব কমন্স এবং হাউস অব লর্ডসে প্রশ্ন উত্থাপন বা মন্ত্রীর বিবৃতির দৃষ্টান্ত আছে।
কিন্তু গত কয়েক দশকে শুধু বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ বিতর্ক অনুষ্ঠানের কথা ইউরোপ বা আমেরিকার কোথাও হওয়ার তথ্য খুঁজে পাচ্ছি না। গত বছর প্রথম এ ধরনের একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় ইউরোপীয় পার্লামেন্টে—রানা প্লাজার প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার পর। সেই বিতর্কের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের অধিকার, কাজের নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম মজুরির মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। এরপর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে গত ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধের বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসির বিষয়ে নিন্দা জানিয়ে আলোচনা এবং প্রস্তাবের কথা জানা গেল। তারপর, এ বছরের শুরুতেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পার্লামেন্টের তিনটি উদ্যোগ এবং প্রতিটিই বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক কলহের আপসহীনতায় সৃষ্ট অচলাবস্থা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে তেমন একটা বিতর্ক ছাড়াই গৃহীত হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়ে সমঝোতার আহ্বান জানানোর প্রস্তাব। আর গত বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) একই দিনে মাত্র ঘণ্টা চারেকের ব্যবধানে লন্ডন এবং স্ট্রাসবুর্গে দুটি বিতর্ক।

পাকিস্তানের পার্লামেন্টের বিতর্ক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে আহত করে বলে তার প্রতিবাদ জানানো যুক্তিসংগত হলেও অন্যগুলোর ক্ষেত্রে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া অচিন্তনীয় বলেই ধারণা করি। যদিও দলকানা বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ‘নির্বাচনী প্রহসনে’র সমালোচনায় সোচ্চার বিদেশিদের অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সরকার এসব স্বার্থান্ধ বুদ্ধিজীবীর মন্ত্রণায় কান দেবে না বলেই আশা করি।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দুটি বিতর্কই বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। হাউস অব কমন্সে সেদিনকার উপস্থিতির চিত্রটি তেমন একটা আশাপ্রদ না হলেও বিতর্কের গুণগত মান ছিল খুবই সমৃদ্ধ এবং ধারালো। ওই একই দিনে একই সময়ে পার্লামেন্টের অন্য আরেকটি কক্ষে সে সময় চলছিল একজন অভিজ্ঞ এমপির স্মরণসভা, যে কারণে উপস্থিতি ছিল কম। এই বিতর্কে কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব (মোশন) ছিল না। কোনো কোনো খবরে বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো প্রস্তাব পাসের বিষয় ছিল না। হাউস অব কমন্সের কার্যবিবরণী (হ্যানসার্ড) দেখলেই তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
প্রতিমন্ত্রীসহ যে ১৩ জন আলোচনা করেছেন এবং অন্য যাঁরা নানা প্রশ্ন বা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের কোনো সময় বাঁধা ছিল না। ফলে, তাঁরা মন খুলে বলেছেন। বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, নিজেদের নির্বাচনী এলাকার বাংলাদেশিদের কথা বলেছেন, কেন বাংলাদেশ তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন। ২০০৬ সালের রাজনৈতিক বিরোধকে কেন্দ্র করে সেনাসমর্থিত সরকারের নির্বাচনী সংস্কারের প্রশংসা যেমন ছিল তাঁদের বক্তৃতায়, তেমনি ছিল দুই নেত্রীকে মাইনাস করার রাজনীতির বিপত্তি এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের সমালোচনা। তবে, তাঁদের কণ্ঠে সবচেয়ে বেশি ছিল হতাশা এ কারণে যে ওই রাজনৈতিক সংকট থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা কোনো শিক্ষা নেননি। তাঁদের আরেকটি হতাশার বিষয় ছিল যে রাজনীতিকদের বিবাদের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ক্রসফায়ারে মৃত্যুর কথাটি তাঁরা যেমন নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সংঘাতে বেঘোরে প্রাণ হারানো নিরীহ মানুষের ক্ষেত্রেও তা উচ্চারণ করেছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বিতর্কটি ছিল মাত্র ৩০ মিনিটের এবং তাতে প্রায় তিন ডজন ্রএমইপি অংশ নেন। ফলে আলোচনার সূচনাকারী ছাড়া আর কেউই মিনিট খানেকের বেশি বলার সুযোগ পাননি। তবে অধিবেশনকক্ষে উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বিতর্কের জন্য ১৪ জানুয়ারি প্রস্তাব (মোশন) জমা পড়ে ছয়টি। ছয়টি রাজনৈতিক গোষ্ঠী—দ্য গ্রিনস ইউরোপিয়ান অ্যালায়েন্স, ইউরোপিয়ান কনজারভেটিভস অ্যান্ড রিফর্মিস্টস গ্রুপ, সোশ্যালিস্টস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস, অ্যালায়েন্স অব লিবারেলস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস ফর ইউরোপ (এএলডিই), ইউরোপিয়ান ইউনাইটেড লেফট অ্যান্ড নরডিক গ্রিন লেফট এবং ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি। এই ছয়টি মোশনই আমি পড়েছি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে মিল থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্যও ছিল। বিএনপিকে জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বানটি ছিল শুধু এএলডিইর প্রস্তাবে। পরে ১৫ জানুয়ারি এসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী একটি সম্মত প্রস্তাবের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছায় এবং সেই অভিন্ন প্রস্তাবে জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গ ত্যাগের এই আহ্বানে আওয়ামী জোটের খুশি হওয়ার কারণ থাকলেও তাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে পুরো প্রস্তাবের মূল বার্তা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেউই প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন হিসেবে মানছেন না।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট—উভয় স্থানের বিতর্কেই কতগুলো অভিন্ন বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিরতায় হতাশা ও নিন্দা। দ্বিতীয়ত, আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে একটি স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতা। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, নিপীড়ন বন্ধ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। চতুর্থত, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সহিংসতা বন্ধে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় উদ্বেগ এবং বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দেখার প্রত্যাশা। এ ক্ষেত্রে প্রধান দুই দলের একে অন্যকে দায়ী করার প্রবণতার বিষয়ে সচেতন ইউরোপীয় জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচার নিশ্চিত করার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। পঞ্চমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ এবং জবাবদিহি না থাকায় উদ্বেগ। ষষ্ঠত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগকে যথাযথ হিসেবে অভিহিত করে তার প্রতি সমর্থন জানালেও তাঁদের সবাই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ এমপিদের উদ্বেগ হচ্ছে বিচার-প্রক্রিয়ার মান সম্পর্কে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাক্ষী এবং আইনজীবীদের নিরাপত্তার বিষয়।
ব্রিটিশ এমপিদের সমালোচনার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাবের ভূমিকা। র‌্যাবকে ঘাতক বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করে তাঁরা বিভিন্ন গুম ও খুনের ঘটনার জন্য র‌্যাবকে দায়ী করে তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারার জন্য সরকারের সমালোচনা করেন। এমনকি, র‌্যাব ভেঙে দেওয়ার দাবি জানানোর আহ্বানও এই বিতর্কে শোনা গেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিতর্কে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, প্রধান তিনটি দলের এমপিরাই তাঁদের নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। ফলে, কনজারভেটিভ পার্টির অ্যান মেইন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আবশ্যকতা স্বীকার না করলেও তাঁর দলেরই রিচার্ড ফুলার ও রেহমান চিশতি বলেছেন যে, ওই ব্যবস্থা ছাড়া অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। আর এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন বিতর্কের সহ-উদ্যোক্তা লেবারের সায়মন ড্যানচুক।
উভয় বিতর্কেই জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজত প্রসঙ্গ আলোচিত হলেও কেউই সরাসরি নাম উল্লেখ করে কোনো দলকে নিষিদ্ধের কথা বলেননি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত দলগুলোকে নিষিদ্ধের আহ্বান জানানো হলেও সেখানে কোনো দলের নাম কেউ উল্লেখ করেননি। জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গ ত্যাগ করার আহ্বান অবশ্য এসেছে উভয় পার্লামেন্ট থেকেই। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আহ্বানটি ছিল সরাসরি বিএনপির প্রতি। কিন্তু, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিস্তারিত আলোচনায় জামায়াতের প্রসঙ্গটি এলে অন্যান্য দেশের উদাহরণ দিয়ে রেহমান চিশতি এমপি প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হলে তা দেশটিতে গোপন উগ্রপন্থার উত্থান ঘটবে কি না। এর জবাবে বাংলাদেশি-অধ্যুষিত পপলার এলাকার এমপি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত জিম ফিটজপ্যাট্রিক বলেন যে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, সব দলের উচিত হবে জামায়াতকে সঙ্গে না রাখা। তবে অন্যদের জামায়াতকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
যে তিনটি পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সমসাময়িক সংঘাতের রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক এবং প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, সেগুলো বিশ্বের সমৃদ্ধ অর্থনীতিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানির বাজারগুলোও ওই ইউরোপ এবং আমেরিকায়। বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা (বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে) দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই দুই মহাদেশের দেশগুলোর ভূমিকা ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত। আধুনিক প্রযুক্তির উৎস হিসেবেও তাদের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা কম নয়। তারপর প্রবাসী আয়ের উৎস
বিবেচনায় নিলে এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বই আলাদা। তাদের জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা কর্কশ শোনাতে পারে, পরামর্শগুলো মধুর না হয়ে তেতো মনে হতে পারে, কিন্তু এগুলো উপেক্ষা করা নিজেদের জন্যই মঙ্গলজনক নয়। বেলারুশের স্বৈরশাসক আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, রাশিয়ার নব্য জার পুতিন অথবা উত্তর কোরিয়ার অভিনন্দনে পুলকিত হওয়ার স্বাধীনতা আমাদের নিশ্চয়ই আছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের অভিনন্দনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু সেটুকু অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল থেকে বাকি বিশ্বকে ‘কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না’ কথাটা শোনানো কতটা যৌক্তিক, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এসব বিতর্ককে অনেকটা সিনক্রোনাইজড (তাল মেলানো) নাচ মনে হতে পারে। এটা কারও পক্ষেই নিশ্চিত করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তা নাকচ করাও অসম্ভব। কারণ, পাশ্চাত্যের রাজনীতিকদের মধ্যে সমন্বয় ঘটাটা অস্বাভাবিক নয়, তবে বাংলাদেশকে নিয়ে তেমনটি হয়ে থাকলে তা যথেষ্ট ভাবনার বিষয়।
এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো, বিশ্বরাজনীতিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সুনির্দিষ্ট বিতর্ক বিশেষ ধরনের ভূমিকা রেখে থাকে। পাঠকদের এ ক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেব সিরিয়াবিষয়ক বিতর্কের কথা। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সীমিত আকারে সামরিক অভিযান পরিচালনার কথা প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা করার পর ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে ব্রিটেনসহ নেটো জোট সামরিক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। ওই অভিযানের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে হাউস অব কমন্সে বিরোধী নেতা এড মিলিব্যান্ড বিতর্কের সূচনা করলে সেই বিতর্কের পর সরকার ভোটে হেরে যায়। ফলে, ব্রিটেন পরিকল্পিত সামরিক অভিযান থেকে সরে আসে। আর তারই সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও ফরাসি পার্লামেন্টেও বিতর্ক হয় এবং পাশ্চাত্য জোট আরেকটি সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

বিশ্বায়নের কাল- হতাশ হয়েছে বিশ্ব by কামাল আহমেদ

Friday, January 10, 2014

বাংলাদেশ আর কখনো এভাবে প্রায় পুরো বিশ্বকে হতাশ করেছে বলে শুনিনি। ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। সেটা নিকটতম প্রতিবেশী, যার সহায়তা ও অঙ্গীকারগুলো সময়মতো পূরণ হলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের জনসমর্থন হয়তো এতটা কমে যেত না।
ফলে, বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নির্বাচনে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী সরকারকে বাস্তবে কোনো সাহায্য করবে কি না বলা মুশকিল; বরং ভারতবিরোধিতার রাজনীতির প্রচারণা উসকে দেওয়ায় তা সহায়ক হওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করা এখন সহজ নয়।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনে হতাশা জানানোর পালা শুরু হয় লন্ডন থেকে। তারপর ওয়াশিংটন, টরন্টো, জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তর হয়ে ক্যানবেরা ও টোকিও—সব জায়গা থেকে প্রায় অভিন্ন প্রতিক্রিয়া। তাদের হতাশার কারণ অনেক। প্রথমত, অর্ধেকের বেশি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের ভোটদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং অবশিষ্ট এলাকাগুলোয় ভোটারদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার বিষয়। দ্বিতীয়ত, বেআইনি সহিংসতায় বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানি, নাগরিকদের ভীতি প্রদর্শন এবং স্কুল-কলেজসহ সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। তৃতীয়ত, শান্তিপূর্ণ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হওয়া। কমনওয়েলথ দেশগুলোর জোট কমনওয়েলথের মহাসচিবের বিবৃতিতেও কোনো ব্যতিক্রম ছিল না।
নির্বাচনের সপ্তাহ দুয়েক আগেই ইঙ্গিত মিলতে শুরু করে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই নির্বাচন কীভাবে মূল্যায়ন করতে যাচ্ছে। কমনওয়েলথ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও এই নির্বাচন যে কমনওয়েলথের গৃহীত সনদের নীতিমালা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, সে কথা তারা তখন স্পষ্ট করেনি সম্ভবত কূটনৈতিক শালীনতার কারণে। তবে নির্বাচনোত্তর বিবৃতিতে সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের জন্য ব্যাখ্যা দিয়ে তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে কেন তারা পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারেনি। সেখানে তারা বলেছে, কমনওয়েলথ সনদের নীতিমালা, বিশেষ করে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচনের সঙ্গে পরিস্থিতি সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় কমনওয়েলথের পর্যবেক্ষকেরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাননি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সমতুল্য কর্মকর্তা ক্যাথরিন অ্যাশটন অবশ্য খোলাসা করেই জানিয়ে দেন যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ায় তাঁরা এটি পর্যবেক্ষণের কোনো প্রয়োজন দেখছেন না। গত ২০ ডিসেম্বর তাঁর মুখপাত্র পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানো স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দেশটির প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো ব্যর্থ হওয়ায়’ তাঁরা এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অন্যতম মুখপাত্র জেন সাকি ২২ ডিসেম্বরেই তাঁদের হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের চোখে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকলেও প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে না পারায় তেমন নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় এই নির্বাচনে যুক্তরাজ্য কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে হতাশার পর ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়েও ইঙ্গিতটা এসব বিবৃতিতে স্পষ্ট। কূটনীতির একটি প্রধান উপাদান হচ্ছে কঠিন কথা মিষ্টি ভাষায় বলতে পারা। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান উন্নয়ন এবং বাণিজ্য-সহযোগী এসব দেশের বিবৃতিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে তারা চায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে দ্রুততম সময়ে প্রত্যাবর্তন। সে কারণেই অস্ট্রেলিয়া ও জাপান স্পষ্ট করে আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছে। আর অন্যরা কিছুটা ঘুরিয়ে বলেছে। যেমন ব্রিটিশ সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক জবাবদিহির ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাকে জরুরি অগ্রাধিকার দিয়ে ভয় ও প্রতিশোধের আশঙ্কামুক্ত অংশগ্রহণমূলক ভবিষ্যৎ নির্বাচনের জন্য একযোগে কাজ করা বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সাড়া দিয়ে শিগগিরই অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অর্থবহ সংলাপের কথা বলেছেন। ‘অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’ যে আরেকটি নির্বাচন, সে কথা নিশ্চয়ই আমাদের রাজনীতিকদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে পাশ্চাত্যের এসব দেশ ও আন্তর্জাতিক জোট বা সংস্থার কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সহিংসতা, বিশেষ করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হামলাগুলোর নিন্দার ক্ষেত্রে বাইরের দুনিয়ায় কোনো ধরনের মতভিন্নতা নেই। ভারত এ ক্ষেত্রে বেশি উদ্বিগ্ন। তার কারণ, নির্যাতনের শিকার মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হলে ভিটেছাড়া উদ্বাস্তুদের তাদেরই আশ্রয় দিতে হবে। তবে অন্যদের উদ্বেগও কম নয়। কেননা, বাংলাদেশে নির্বাচন হলেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা গত কয়েক দশকে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সেগুলোর কোনোটিরই বিচার হয়নি। মানবাধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নতুন উপলব্ধি ও দায়িত্ববোধের পরিচায়ক কিছু উদ্যোগ বা পদক্ষেপ তাই মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তাবে সরকারের ওপর। শুধু বিরোধী দল বা জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করলেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
২০১২ সালের ডিসেম্বরের কথা। লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি কমিটিকক্ষে ব্রিটিশ রাজনীতিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠকেরা বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের প্রতিনিধিদের কাছে নির্বাচনোত্তর সংখ্যালঘু নিপীড়নের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন বলে কথিত অত্যন্ত প্রভাবশালী সাবেক আমলা এইচ টি ইমাম সরকারের পক্ষে অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন যে এ ধরনের হামলা প্রতিকারে সব ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হবে। বিরোধী দল বিএনপির এম কে আনোয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁর দল এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তারের পর তাঁদের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপালে তা কতটা ধোপে টিকবে, বলা মুশকিল। তবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে না পারার বিষয়ে সরকারের ব্যাখ্যা কতটা হালে পানি পাবে, বলা দুষ্কর। বিবিসিতে যশোরের পুলিশ সুপারের যে উদ্ধৃতি দেখলাম, তাতে এটা স্পষ্ট যে সরকারের কাছে জেদ-জবরদস্তির ভোটরক্ষা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, নাগরিকের জীবনরক্ষা বা নিরাপত্তার বিষয়টির অগ্রাধিকার ততটা ছিল না। এ কারণে সব জায়গাতেই পুলিশ, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা গেছেন হামলা হওয়ার পর। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর বেশি দিন চুপ থাকবে বলে মনে হয় না। হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই এ বিষয়ে তো আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন।
বিরোধী দলকে মতপ্রকাশের সুযোগ না দেওয়া, গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক হয়রানির প্রসঙ্গেও এসব বিবৃতিতে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। স্পষ্টতই তাঁদের উদ্বেগের প্রধান বিষয় হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারী শাসনের পথে ধাবিত হয় কি না। নির্বাচন শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই নতুন করে বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকার বহির্বিশ্বে যে বার্তা পাঠাল, তা কতটা বিবেচনাপ্রসূত হলো, তা তারাই ভালো বলতে পারবে। বিরোধী দল দমন এবং শক্তি প্রয়োগে মতপ্রকাশের সুযোগ খর্ব করা অব্যাহত থাকলে অচিরেই মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো যে নতুন ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে, তাতে সন্দেহ নেই। আর সে রকম ক্ষেত্রে উন্নয়ন-সহায়তা ও বাণিজ্য-সুবিধার ওপর যে প্রতিকূল প্রভাব পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না।
নির্বাচন-পূর্ব বিবৃতিগুলো এবং নির্বাচনোত্তর প্রতিক্রিয়াগুলোয় পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ব্যবহূত ভাষায় যে ধরনের মিল, তা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়ে তারা অভিন্ন কৌশল অনুসরণ করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও তাদের কর্মকৌশলে সেই অভিন্নতা বজায় থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
প্রতিটি বিবৃতিতেই বাংলাদেশে স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য দেশটির জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা রয়েছে। এটাকে অনেকেই নতুন সরকারের প্রতি সমর্থনের অঙ্গীকার বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা শঠতাপূর্ণ। যাঁরা কূটনৈতিক শালীনতা বজায় রেখেও গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন, তাঁরা সেই প্রহসনজাত নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা বজায় রাখবেন—এমনটি কল্পনা করে কেউ আত্মহারা হতে চাইলে অন্যদের আর কী করার আছে?
এবার অন্য একটি দেশের কথা বলি। ২০০৮ সালের ২৯ মার্চ। ব্যাপক সহিংসতার পর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে একযোগে ভোট অনুষ্ঠিত হলেও ভোট গ্রহণের ৩৬ ঘণ্টা পরও নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় অস্বীকৃতি জানাল নির্বাচন কমিশন। কারণ হিসাবে তারা বলল, ২১০টি আসনের পার্লামেন্টে ২৩টি আসনের ভোট পুনর্গণনা প্রয়োজন। এই কটি আসনের ফলাফল উল্টে দিতে পারলেই নির্বাচনে শাসক দলকে বিজয়ী ঘোষণা করা যায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আবেদন-নিবেদন সবই উপেক্ষিত হলো। সরকারের প্রভাবাধীন হাইকোর্টও ফলাফল পরিবর্তনের চেষ্টা বন্ধে হস্তক্ষেপের জন্য বিরোধী দলের আবেদন প্রত্যাখান করলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও বিরোধী দল জয়ী হওয়ার দাবি জানাল, কিন্তু কমিশন সেই ফলাফলও স্থগিত রাখল। প্রায় এক মাস পর তারা বিতর্কিত ভোটগুলো পুনর্গণনার উদ্যোগ নিল এবং যথারীতি আশঙ্কা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী ঘোষিত হলো।
পশ্চিমা বিশ্বে রীতিমতো হইচই। এমনকি যে দেশটিতে এসব নির্বাচনী প্রহসন মঞ্চস্থ হলো, সেই দেশটির প্রতিবেশীদেরও অনেকে প্রকাশ্যেই এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের কথা বলল। তবে তাদের এক বৃহৎ প্রতিবেশী তাদের সমর্থনে অনড় থাকল। এ কারণে আঞ্চলিক জোটের দেশটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলো না। তবে নির্বাচনের প্রায় চার মাস পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দেশটির বিরুদ্ধে নানা রকমের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। এরপর আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যস্থতায় আপস-রফার মাধ্যমে দেশটির দুই আপসহীন প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করতে বাধ্য হলো।
যে দেশটির কথা বলছিলাম, সেটির ক্ষমতাসীন দল ও তার নেতার কৃতিত্ব হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করে নিজেদের স্বাধীন করা। আর সেই ক্ষমতাসীন দলটি ছিল ওই দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল এবং তার স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু দলটিও যেমন দিনে দিনে গণবিচ্ছিন্ন কোটারির রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল, তেমনি সেই নেতাও অপশাসন তথা দুঃশাসনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
দেশটির নাম জিম্বাবুয়ে। আর দলটির নাম জানু পি এফ এবং স্বাধীন দেশটির জনক হলেন রবার্ট মুগাবে। প্রতিবেশী হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশের ভেতরে বিরোধীদের কোণঠাসা করে মুগাবে গত বছর আবারও পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু দেশটি এখনো খুঁড়িয়ে চলছে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে মুগাবে এখনো একঘরে।

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু