কবে হবে চার লেন by হকিকত জাহান হকি ও তৌফিকুল ইসলাম বাবর

Saturday, September 24, 2011

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ কবে শেষ হবে? বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ১৯৬৭ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও এর মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে ২০১০ সালে। গত ৪৪ বছরেও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি 'ইকোনমিক লাইফ লাইন' হিসেবে ব্যবহৃত এ সড়কটি। চট্টগ্রামসহ সারাদেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সার্বিক অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে এ সড়কটি। সব ধরনের আমদানি-রফতানি পণ্য আনা-নেওয়া হয় এ সড়ক দিয়েই। এ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার পর শুরু হবে 'ঢাকা-চট্টগ্রাম অ্যাক্সেস কন্ট্রোল হাইওয়ে'। এ সড়কটি হবে বিশেষায়িত।

২০১৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু গত দেড় বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। হাতে সময় রয়েছে মাত্র ৯ মাস। এ সময়ে প্রকল্পের বাকি ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ করা প্রায় অসম্ভব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় বছরে প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ হলেই কেবল নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বাকি কাজ শেষ হতে বাড়তি আরও এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জুনের আগে চার লেনের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
বর্ষার কারণে সাড়ে তিন থেকে চার মাস ধরে প্রকল্পের কাজ বন্ধ
থাকার পর ক'দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে ঠিকাদারদের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হলেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান দেব কনসালট্যান্ট লিমিটেডকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় ৭-৮ মাস সময়ক্ষেপণ, নতুন লেন নির্মাণে মাটি সংকট, মন্ত্রণালয় থেকে যথাসময়ে অর্থ ছাড় না করা, সর্বোপরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না প্রকল্পের কাজ। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা না গেলেও যত
দ্রুত সম্ভব শেষ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন, প্রকল্প পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও প্রকল্পের দেশি-বিদেশি তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে চার লেনের সড়ক নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী ও প্রধান বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য চার লেনের সড়কের দাবি আজ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পুরোপুরিভাবে সরকারি অর্থায়নে।
সরকারের এক হিসাব থেকে জানা গেছে, জিডিপিতে এ মহাসড়কের অবদান ৩০ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ১৬ হাজার হালকা ও ভারী যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়ে। এর মধ্যে পণ্যবাহী ৬০ ভাগ যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়েই।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, নির্মাণ ব্যয় মেটানোর জন্য যথাসময়ে পর্যাপ্ত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ চার লেনের সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা চলতি ও আগামী অর্থবছরের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্মাণকাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজ পুরোদমে চলছে বলে মন্ত্রী জানান।
যোগাযোগমন্ত্রী আরও বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার জন্য নির্মাণকাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে আগামী ২ বছরের মধ্যে প্রাক্কলিত ব্যায়ের পুরো টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে যথাসময়েই এ সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সড়কের বেশিরভাগ ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণে বেশি সময় লাগবে না। এরপর পুরোদমে শুরু হবে মাটি ভরাটের কাজ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নির্মাণকাজ অব্যাহত আছে। সামনে কাজের চাপ আরও বাড়বে। সে সময় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। অর্থের সরবরাহ থাকলে যথাসময়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পুরো কাজ সম্পন্ন করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৬-৭ মাস সময় বেশি লাগতে পারে।
অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা হলে চার লেনে উন্নীত করার কাজ যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১০ মিটার প্রস্তের ১৯২ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণে চলতি অর্থবছরে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হলে দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা। মাটি ভরাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজে আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে এ টাকা শেষ হয়ে যাবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে ঠিকাদারদের। তখন অর্থ বরাদ্দের জন্য আবারও ছোটাছুটি শুরু করতে হবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। চার লেনের এ নতুন সড়ক নির্মাণে এ পর্যন্ত গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বিদ্যমান সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ডান পাশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ১০ মিটার প্রস্থের নতুন সড়কটি। ১০ মিটার প্রস্থের বিদ্যমান সড়কটি দুই লেনবিশিষ্ট। প্রস্থের দিক থেকে একই মাপের দুই লেনের নতুন সড়কটিসহ প্রায় তিনশ' কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়টি হবে চার লেনের। চার লেনের সড়কের মাঝখানে থাকবে ৬ মিটারের ডিভাইডার। এর মধ্যে ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করা হয়েছে বেশ আগে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি যেভাবে উন্নীত করার কথা ছিল গত ৪০ বছরেও তা হয়নি। এতে রফতানি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন পণ্যবাহী একটি গাড়ি ঢাকা থেকে ছাড়লে তা কখন চট্টগ্রামে পেঁৗছবে নিশ্চিত করে বলা যায় না। চার লেনে উন্নীত হলে এ সংকট থাকবে না। কোনো কারণে নির্মাণকাজ যেন পিছিয়ে না যায় সে জন্য সরকারের সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
মহাসড়কের বর্তমান অবস্থা : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন রীতিমতো মহাদুর্ভোগের মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই সড়কটির নাজুক অবস্থা। তার ওপর ভারী বৃষ্টিতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সড়কটির স্থানে স্থানে শুধু দেবেই যায়নি অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় খানাখন্দ। সড়কের বিভিন্ন জায়গা উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। গাড়িতে স্বাভাবিক গতি তোলা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রামে চলাচলের কথা থাকলেও এখন সময় লেগে যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। সম্প্রতি সড়কটি যানবাহন চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়লে সরকার চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়কের কিছুটা সংস্কার-মেরামত করলেও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি; কিন্তু দায়সারা গোছের কাজের কারণে তা খুব বেশি টেকসই হয়নি।
মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়িচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসড়কের কমপক্ষে ৩০টি পয়েন্ট এখনও ছোট-বড় খানাখন্দে ভরা। এর মধ্যে সড়কের মিরসরাইয়ের ১০টি, সীতাকুণ্ডের ৫টি, কুমিল্লার ১০টি এবং ফেনীর ৪টি পয়েন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। সড়কের মিরসরাইয়ের বড় দারোগাহাট, নিজামপুর কলেজ, হাদিফকির হাট, বড়তাকিয়া, মিরসরাই সদর, মিঠাছড়া, জোড়ারগঞ্জ, বারৈয়ারহাট পৌর সদর, ইসমাইল কার্পেট মিল এলাকা, ছোটকমলদহ বাইপাস মোড় ও মিরসরাই সদর, সীতাকুণ্ডের উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন বাইপাস সড়ক, মছইদ্দা স্কুলের সামনের মোড়, ফৌজদারহাট পোর্ট কানেকটিং সড়কের সংযোগস্থল, এসকেএন জুট মিল এলাকা, ফকিরহাট ফায়ার সার্ভিস মোড়ে সড়ক সংস্কার হয়েছে জোড়াতালি দিয়ে। এ ছাড়া কুমিল্লার রায়পুর, চৌদ্দগ্রামের বাতিসাবৈদ্যের বাজার এলাকা, দক্ষিণ উপজেলার ধনাইতরী, দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজা মোড়, হাসনপুর, বিতপুর, ইলিয়টগঞ্জের আমিরাবাদ রাস্তার মাথা, চৌদ্দগ্রামের চিওড়া এলাকা, বুড়িচংয়ের নিমসার এবং ফেনী জেলার মুহুরীগঞ্জ, লেমুয়াব্রিজ, মহীপাল ও মোহাম্মদ আলী বাজার এলাকায় এখনও আছে ছোট-বড় গর্ত। এসব স্থানে গাড়ি চলাচল করতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে।
ঠিকাদারদের স্বেচ্ছাচারিতা : চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্প কাজের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ তিনটি ঠিকাদার কোম্পানির করার কথা থাকলেও তারা এ কাজ সঠিকভাবে করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোদ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে এ বিষয়ে আপত্তির কথা জানা গেছে। তারা বলেছেন, অনেকটা তাদের অবহেলার কারণেই বিদ্যমান সড়কটির ছোট ছোট গর্ত আজ খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের। নতুন সড়ক নির্মাণের জন্য নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য পণ্য আনা-নেওয়া করতে হয় বিদ্যমান সড়ক দিয়ে। এ ছাড়া জনগণের চলাচল ও পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বও ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড বেশি অবহেলা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড নামমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে বলে জানা গেছে।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন বলেন, নতুন সড়কের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের স্বাভাবিক কাজের দায়িত্ব ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত থাকে। বিশেষ কারণে ব্যাপক সংস্কারের কাজ করে ঠিকাদাররা পোষাতে পারবেন না। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের বেহাল দশা সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কার কাজ না হওয়ায় এখন সড়কটির অবস্থা বেশ নাজুক। সড়কটি সংস্কারের জন্য আলাদাভাবে টেন্ডার ডাকা হবে। নতুন সড়ক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদাররাই এ টেন্ডারে অংশ নিয়ে সংস্কারকাজ করবেন।
মহাজোট সরকারের আমলে নির্মাণ কাজ শেষ হবে কি : বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হলে বাস্তবায়ন কাজে তদারক বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে যথাসময়ে যথাযথ অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। এ বছর বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। শিগগির যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া না হলে নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দে গড়িমসি করা হলে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল।
জানা গেছে, ক্ষমতায় আসার পর এ সরকার ১৫২টি সড়ক প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন এলাকার মন্ত্রী, এমপিদের চাপে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বেশি। এ কারণে দেশের মূল সড়ক নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো, কার্যক্রম ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ যাচাই করে সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
ব্রিজ, কালভার্ট, ওভার পাস, বাস বে : নতুন ১৯২ কিলোমিটার সড়কে ২৮টি ব্রিজ নির্মিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি বড় ব্রিজ। কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ১৯৫টি। দুর্ঘটনা রোধে তিনটি রেলওয়ে ওভারপাস, দুটি আন্ডারপাস, ৩৩টি ফুটওভার ব্রিজ ও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে দীর্ঘ সড়কের পাশে ৬১ স্থানে বাস বে নির্মাণ করা হবে।
প্রাক্কলিত ব্যয় ও বরাদ্দ : প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। গত তিন অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৮ কোটি টাকা। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে ৭০০ কোটি টাকা চাওয়া হলে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা।
রোড ফান্ড : সূত্র জানায়, সারাদেশের সড়ক উন্নয়নে সরকারের আলাদা কোনো তহবিল নেই। এ খাতের জন্য আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা থাকলে জনগুরুত্বসম্পন্ন সড়ক নির্মাণে অর্থ সংকটের কথা ভাবতে হতো না সরকারকে। সরকারের মধ্যে এ তহবিল গঠনের কোনো উদ্যোগও নেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে 'রোড ফান্ড' নামে একটি বিশেষ তহবিল রয়েছে। দেশটির ফুয়েল স্টেশন থেকে প্রতি লিটার তেল বিক্রি করে ক্রেতার কাছ থেকে ২ রুপি করে নেওয়া হয় ওই তহবিলের জন্য। এ ছাড়া সড়কের বিশেষ স্থান থেকে টোল আদায়ের টাকা জমা করা হয় ওই তহবিলে। এ তহবিলের অর্থে ভারত সরকার সর্বশেষ জয়পুর থেকে আজমীর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার সড়ক ৬ লেনে উন্নীত করছে। এর সঙ্গে রাখা হচ্ছে সার্ভিস লেন। জম্মু থেকে অমৃতসর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়কও উন্নয়ন করা হচ্ছে একই তহবিলের অর্থ খরচ করে।
ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি : মহাসড়কটি ১০ ভাগ করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এর মধ্যে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন ৭টি প্যাকেজ, রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড দুটি প্যাকেজ এবং তাহের ব্রাদার্স ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন যৌথভাবে একটি প্যাকেজে কাজ পেয়েছে।
রেজা কনস্ট্রাকশন : এ কোম্পানি দুটি প্যাকেজে ৩৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে। এর মধ্যে ১নং প্যাকেজে দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে কুটুম্বপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার ও ৭নং প্যাকেজে ধুমঘাট ব্রিজ থেকে মিরসরাই বাজার পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। দুটি প্যাকেজে ৩৩৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্ষার কারণে মাটি ভরাটের কাজ তেমন এগোচ্ছে না। আগামী নভেম্বর থেকে শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হবে।
১নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ২২ কিলোমিটারে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ মাটি ভরাট হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এতটুকু সড়কে একটি ছোট আকারের ব্রিজ ও সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এর মধ্যে তিনটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। চুক্তির বাইরে আরও ছয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে বলে জানিয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে।
৭নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ১৫ কিলোমিটারে মাটি ভরাট হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। আগামী মার্চের মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। ৩০টি কালভার্টের মধ্যে সাতটি নির্মিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ ১৫ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদার।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন সমকালকে বলেন, এ সড়কটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। যথাসময়ে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে টাকার সরবরাহ বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। সামনের শীত মৌসুমে কাজের চাপ বেড়ে যাবে। তখন সে অনুপাতে টাকা সরবরাহ করতে হবে। টাকার অভাবে কাজ বন্ধ থাকলে ২০১৩ সালের মধ্যে পুরো সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
তাহের-আল আমীন : কুমিরা বাইপাস থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। ১০নং প্যাকেজের আওতায় এ দুটি কোম্পানি পেয়েছে ১৭২ কোটি টাকার কাজ। তাহের ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার সমকালকে বলেন, তারা এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেছেন। ১৬ কিলোমিটার রাস্তায় মাঝারি আকারের ছয়টি ব্রিজ ও নয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এরই মধ্যে সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজের পাইলিংয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি না হলে ২০১৩ সালের মধ্যে ১৬ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
সাইনোহাইড্রো করপোরেশন : কুটুম্বপুর থেকে ধুমঘাট ব্রিজ পর্যন্ত পাঁচটি প্যাকেজ ও মিরসরাই বাজার থেকে কুমিরা বাইপাস পর্যন্ত দুটি প্যাকেজসহ মোট সাতটি প্যাকেজে ১৩৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। মাটি ভরাট, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। জানা গেছে, দরকষাকষিতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে সাতটি প্যাকেজের আওতায় কাজ পেয়েছে এ কোম্পানি।

ঝুঁকিতে আরও দুই মহাসড়ক

Tuesday, August 16, 2011

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পাঁচ দিন ধরে যাত্রীবাহী বেসরকারি বাস চলছে না। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাস বন্ধ তিন দিন। ফরিদপুর-আলফাডাঙ্গা সড়কেও একই অবস্থা। এখন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের হাটিকুমরুল-বনপাড়া এবং বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর পথেও যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে ইটের খোয়া ও বালু দিয়ে সাময়িক মেরামতের চেষ্টা করছে। বৃষ্টি না হলে দু-এক দিনের মধ্যে জোড়াতালি দিয়ে যানবাহন চালানো যাবে বলে মনে করছে সওজ। তবে অন্য সড়কগুলোর কী হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।
সওজের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আল্লাহ আল্লাহ করছি, যাতে আর বৃষ্টি না হয়। বৃষ্টি হলে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’
এরই মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে যাতায়াতকারী প্রায় ১২টি জেলার বাস চলাচল বন্ধ আছে। গতকাল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) কয়েকটি বাস চালু করা হয়েছে। তবে সরকারি ছুটি থাকায় এর কোনো প্রভাব বোঝা যায়নি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিআরটিসির বাসে ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি ঢাকার যাত্রী ছাড়া অন্য কোনো গন্তব্যে যাত্রী তোলা হয়নি। এ ছাড়া বাড়তি ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান এম এম ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে ৩০টি বাস চলেছে। কোনো সমস্যা হয়নি। অক্ষত ফিরে এসেছে বাসগুলো।’ বাড়তি ভাড়া ও মাঝপথে যাত্রী তোলার অভিযোগ নাকচ করে দেন তিনি।
মহাসড়ক মেরামত সম্পর্কে জানতে চাইলে গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলে রব্বে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এখনো অধিকাংশ স্থানে মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা দোকান-কারখানার বর্জ্যমিশ্রিত পানি আছে। এর ওপর বালু ফেলা হচ্ছে। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। সাময়িক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এটা করা হচ্ছে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সভাপতি গতকাল রাত আটটায় প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের অনেক স্থান এখনো বাস চলাচলের অনুপযোগী। তিনি জানান, আজ যোগাযোগমন্ত্রী মহাসড়ক পরিদর্শনে যাবেন। সীমিত আকারে হলেও বাস চালানো যায় কি না, আজ সিদ্ধান্ত হবে। তবে এক দিন বৃষ্টি হলেই সব শেষ হয়ে যাবে।
পথে পথে দুঃখ: ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের বনপাড়া-হাটিকুমরুল অংশে বড় গর্তে পড়ে গত রোববার একটি ট্রাক উল্টে যায়। এতে দিনভর ওই পথে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। জানা গেছে, মহাসড়কের এই অংশটুকু ৫২ কিলোমিটার। এর মধ্যে অন্তত নয় কিলোমিটার এলাকায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ভারী বৃষ্টি হলে যেকোনো সময় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ওই পথে কুষ্টিয়া, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ—এ পাঁচটি জেলার মানুষ যাতায়াত করে। বাসমালিক, চালক এবং সওজ সূত্র জানায়, ঈদে এই পথে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে এবং এর মধ্যে বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। মহাসড়কটি অচল হয়ে যেতে পারে।
বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কটির বেহাল দশা আট বছরেও কাটেনি। তৈরির কয়েক দিন পরই ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথটির বিভিন্ন অংশ দেবে যায়। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর কয়েক দফা সড়কটি মেরামত করা হয়। কিন্তু এখনো বড় বড় গর্তে ভরা এবং অনেক স্থান দেবে আছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে এর অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়েছে।
২০০৪ সালে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
গত রোববার সরেজমিনে সড়কের মান্নাননগর এলাকায় তিনটি ট্রাক, ৯ ও ১০ নম্বর সেতুর পাশে দুটি ট্রাক এবং খালকুলায় একটি ট্যাংকলরি নষ্ট হয়ে সড়কের গর্তের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে একটি ট্রাক উল্টে পড়ে আছে।
এই মহাসড়কের খালকুলা বাজার, ৬ ও ৭ নম্বর ব্রিজের মধ্যখানের দুটি স্থানে, মহিষলুটি ও মান্নাননগর এলাকার পাঁচটি স্থানে ৫০ মিটার এলাকাজুড়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ৯ ও ১০ নম্বর সেতুর দুই পাশে ২০০ মিটার এলাকা চলাচলের অনুপযোগী।
সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুল খালেক বলেন, ইট-বালু দিয়ে গর্ত ভরাট করার কাজ চলছে। বৃষ্টির জন্য কাজ এগোচ্ছে না।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুন নবী বলেন, গর্তের কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। দ্রুত মেরামতের জন্য ১০ আগস্ট সওজকে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা।
সওজের সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর-ই-আলম বলেন, স্থায়ী মেরামতের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বরাদ্দ ঠিকমতো না পাওয়ায় ঠিকাদার কাজে উ ৎ সাহী হননি।
ফরিদপুর থেকে আলফাডাঙ্গা: এই ৩৪ কিলোমিটার সড়কেও বড় বড় গর্ত। এই সড়কে শনিবার থেকে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সওজ সূত্র জানায়, পুরো সড়কে পিচের চিহ্ন নেই। হাঁটুসমান গর্তে প্রতিদিনই যানবাহন বিকল হয়ে যাচ্ছিল। এই পথে প্রতিদিন ১০০ বাস চলত।
বরিশাল-ভোলা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভোলা অংশের সাড়ে আট কিলোমিটারজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। রোববার ভোরে পূর্ব ইলিশার গুপ্তমুন্সী এলাকায় সড়কের বড় গর্তে মালবাহী ট্রাক আটকে গেলে আট ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। এই পথে এক হাজারের বেশি যান চলে। এ সড়কটি দিয়ে লক্ষ্মীপুর হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যানবাহন চলে।
গাজীপুর থেকেও বাস চলাচল বন্ধ: গাজীপুর থেকে রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন উপজেলায় গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে গতকাল থেকে। ফলে যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকে গাদাগাদি করে যাতায়াত করছেন। এ ছাড়া হিউম্যান হলার, টেম্পো, লেগুনা, অটোরিকশায় করে স্বল্প দূরত্বে লোকজন চলাচল করছে। বাস বন্ধ হওয়ার সুযোগে এসব যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
গাজীপুরের শ্রমিক নেতা দেওয়ান ফিরোজ জানান, গাজীপুর থেকে বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাওয়া ঢাকা পরিবহন, গাজীপুর পরিবহন, কালিয়াকৈর পরিবহন, পলাশ পরিবহন, বলাকা পরিবহন ও নিরাপদ পরিবহন সোমবার থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। চালক বাবুল মিয়া জানান, ভাঙা ও খানাখন্দে ভরা সড়কে গাড়ি চালালে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। পানি ঢুকে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এ ছাড়া গাজীপুর থেকে যাওয়া-আসায় যেখানে আগে তিন ঘণ্টা সময় লাগত, এখন সেখানে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। আগে তেল লাগত সাড়ে চার হাজার টাকার। এখন লাগে ছয় হাজার টাকার। এ অবস্থায় গাড়ি চালানো সম্ভব নয়।

দুর্ভোগের শেষ কবে by রাশেদ মেহেদী ও আলতাব হোসেন

সারাদেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। আসছে ঈদ। অথচ একের পর এক মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংস্কার ও মেরামতের অভাবে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। জনদুর্ভোগও বেড়েছে। সড়ক-মহাসড়কে গুরুতর দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। হাইকোর্টও মহাসড়ক মেরামতের বিষয়ে রুল জারি করেছেন। তারপরও সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার। একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। সময়মতো অর্থ ছাড় না হওয়ায় রাস্তা সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন খোদ যোগাযোগমন্ত্রী। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে তাদের?


এদিকে গতকাল সোমবার টানা ষষ্ঠ দিনের মতো ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং উত্তরবঙ্গগামী বাস ছাড়েনি। ফলে সাধারণ যাত্রীদের উঠেছে নাভিশ্বাস। অন্যদিকে শঙ্কা বাড়ছে ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে। ঈদের আগে দেশে মহাসড়কের এ ধরনের বেহাল অবস্থা নজিরবিহীন। বন্ধ হয়ে যাওয়া সড়কে বাস চলাচলে সরকার ও পরিবহন নেতাদের চোখে পড়ার মতো সমঝোতার উদ্যোগ নেই। কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই চলছে পরিবহন ধর্মঘট। ঈদের আগে ও পরে তিন-চার দিন ঘরে ফেরা এবং ঘর থেকে ফিরে
আসা নিয়ে বড় সংকটের
আশঙ্কা করছেন খোদ পরিবহন মালিকরাই।
দেশের সর্বত্রই ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। দিন যত যাচ্ছে সড়ক যোগাযোগ পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। তারপরও বড় বড় গর্তসহ খানাখন্দে ভরা বেশিরভাগ মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। এক গর্ত থেকে উঠে আরেক গর্তে পড়ার সময় টাল সামলাতে পারছেন না চালকরা। এদিকে যোগাযোগ সেক্টরের সার্বিক অবস্থা জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে আজ সকালে তার দফতরে বৈঠক ডেকেছেন।
মহাখালী টার্মিনাল থেকে ১২টি জেলায় বাস চলাচল বন্ধ থাকার কারণে ওইসব জেলার সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গতকাল সমকালের ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধিরা জানান, এসব জেলার সঙ্গে ঢাকার বাস ও ট্রাক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর এবং জামালপুর জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব এলাকার বাজারে তেল, চিনি, ময়দা লবণ প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে কিছু বিআরটিসি বাস চলাচল করলেও দুর্ভোগ কমেনি। এসব বাসও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় বেশি নিচ্ছে গন্তব্যে পেঁৗছতে। কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব হয়ে সায়েদাবাদ টার্মিনালে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে কিছু বাস চলছে গাজীপুর পর্যন্ত। বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম থেকে মহাখালী টার্মিনালে চলাচলকারী কোনো বাস গতকালও ছাড়েনি। তবে গাবতলী টার্মিনাল থেকে যাতায়াতকারী বাস চলাচল করছে। বগুড়া ও রংপুর জেলা পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা জানান, ঢাকা-বগুড়া এবং বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তাই আগে যেখানে ঢাকা থেকে বগুড়া যেতে চার-সাড়ে চার ঘণ্টা লাগত, এখন সেখানে ছয়-সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগছে।
'দেশে কি দেখার কেউ নেই' : সোমবার দুপুর ২টায় মহাখালী টার্মিনালের সামনে ঘোরাঘুরি করছিলেন অনেক যাত্রী। অনেকে ব্যাগ নিয়ে বসেছিলেন। টার্মিনাল থেকে কয়েক গজ দূরে চলনবিল ট্রান্সপোর্টের একটি বাস এলে হেলপার হাঁক দিচ্ছিলেন_ 'গাজীপুর, মাওনা'। মাঝবয়সী এক যাত্রী আট-দশ বছরের একটি বাচ্চা নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। 'ভাই ময়মনসিংহ যাওয়া যাবে না?' হেলপার উত্তর দিলেন, 'এই গাড়ি ময়মনসিংহ যায় না। মাওনা থেকে লোকাল গাড়ি পাবেন।' লোকটি ফিরে এলেন। কথা হলো তার সঙ্গে। নাম বশীরউদ্দিন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন এক সপ্তাহ আগে। দু'দিন থেকেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে বুধবার থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বাস চলাচল বন্ধ। আজ চালু হবে কাল চালু হবে করে পাঁচ দিনেও চালু হয় না। তিনি বলেন, 'ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের দীঘিরচালা থেকে গাজীপুরের মালেকের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা খুবই খারাপ। এ খারাপ অবস্থা বছরজুড়েই। এখন গাড়ি চলে গর্তের মধ্য দিয়ে, ডানে-বাঁয়ে কাত হয়ে যায়। বুঝলাম না, দেশে কি পাবলিকের সমস্যা দেখার কেউ নেই? সরকারের কারও কি এই রাস্তাটার ওপর চোখ পড়ে না? ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক ছয় দিন ধরে বন্ধ, এটা কি সহজ কথা?' টার্মিনালে বাস কর্মচারীরা জানান, দু'চারটি গাড়ি লোকাল হিসেবে গাজীপুর পর্যন্ত চলছে। ড্রাইভার, হেলপারের দিনের খোরাকির জন্য ফাও ট্রিপ। সমিতির সিদ্ধান্ত ছাড়া পুরোদমে গাড়ি চালু হবে না।
মহাখালী টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহ এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটে বাস চালুর ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, 'যোগাযোগমন্ত্রী আমাদের নেতাদের নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অবস্থা দেখতে যাবেন। আমরা খবর নিয়েছি, রাস্তা মেরামতের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। মঙ্গলবার পরিদর্শনে যদি অবস্থা কিছুটা ভালো দেখা যায় আমরা বাস চালু করব।' ঈদের আগে পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'প্রতি বছর ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকেই যাত্রীর চাপ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এ কারণে মালিকরা ট্রিপের সংখ্যাও বেশি দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে এখন স্বাভাবিক ট্রিপ চালু রাখাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঈদের আগে সমস্যার আশঙ্কা থাকছেই।'
আদালতের রুল : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক মেরামতের বিষয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগ ও অর্থ সচিব, সড়ক ও জনপথের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলীসহ পাঁচজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে মহাসড়কের বেহালদশার জন্য ঠিকাদার বা সংশ্লিষ্টদের কারও কোনো অবহেলা রয়েছে কি-না তা খুঁজে বের করে আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
বাস চলাচল বন্ধের নেপথ্যে চাঁদাবাজি : একটি পরিবহন সূত্র জানায়, রাস্তা ভাঙাচোরা ছাড়াও ময়মনসিংহ পরিবহন মালিক সমিতির নামে চাঁদাবাজি নিয়ে ঢাকার মালিক সমিতির বিরোধ বাস চলাচল বন্ধের আরও একটি বড় কারণ। গত ছয় মাস ধরে ময়মনসিংহ মালিক সমিতির নামে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মধ্যে চলাচলকারী বাস থেকে ৩০০ টাকা হারে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের গাড়ি থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা হারে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। ক'দিন আগে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ময়মনসিংহ পরিবহন মালিক সমিতির নামে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতান সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু। সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের পর ময়মনসিংহ জেলা পরিবহন মালিক সমিতির আর কোনো নির্বাচন হয়নি। এ কারণে সমিতির দু'গ্রুপের মধ্যে বিরোধও তীব্র হয়েছে। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনছে। এ চাঁদাবাজি নিয়ে ঢাকার মালিক সমিতির সঙ্গেও ময়মনসিংহ মালিক সমিতির বর্তমান কমিটির টানাপড়েন চলে আসছিল। ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামতের দাবি বর্তমানে বাস্তব সমস্যা থেকে এলেও চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধও একটি বড় কারণ।
এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, যোগাযোগমন্ত্রীকে চাপে ফেলে লাইসেন্স আদায় করতে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উত্তরাঞ্চলে বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। শ্রমিক ফেডারেশন ২৭ হাজার ৩৮০ নেতাকর্মীর নামে পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুর তালিকা পাঠিয়েছে বিআরটিএতে। এটি এখন যোগাযোগমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
৭০ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা : সারাদেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) অধীন জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ১৮ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা আর খানাখন্দে ভরা। সওজ ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, সারাদেশে অন্তত ১০০ কিলোমিটার মহাসড়ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২১৬টি স্থান আছে যেখানে বছরে অন্তত তিনটি করে দুর্ঘটনা ঘটে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে নয়টি জাতীয় মহাসড়ক আছে। দূরত্ব সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার। এ মহাসড়কের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো হলো_ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর পূর্ব প্রান্ত, গজারিয়া, দাউদকান্দি, সোনারগাঁ ও মধ্যবাউশিয়া। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপারা বাসস্ট্যান্ড, জয়পাড়া বাসস্ট্যান্ড, পুখুরিয়া বাসস্ট্যান্ড, সাভার বাজার ও বাথুলী উল্লেখযোগ্য।
দরকার ৩ হাজার কোটি টাকা :যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে মেরামত না করায় রাস্তার যে অবস্থা হয়েছে, তাতে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ করে আর সামাল দেওয়া যাবে না। অনেক রাস্তা নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। সে জন্য আরও দেড় হাজার কোটি টাকা দরকার। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ আওতাধীন ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর দ্রুত সংস্কার করতে একনেকে একটি প্রকল্প পাস হয়। সরকারদলীয় সাংসদ তোফায়েল আহমেদ সারাদেশের সড়ক ব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলার পর ১ হাজার ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়। দুই বছর মেয়াদি (২০১০-১১ এবং ২০১১-১২) প্রকল্পটি আগামী জুন মাসে শেষ হবে। দেড় বছরে প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় দুই দফায় মাত্র ১০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রথম বছরে ৫০ কোটি টাকা এবং প্রকল্পের শেষ বছরে দিয়েছে ৫৭ কোটি টাকা। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প এ সামান্য অর্থ দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর সারাদেশে দরপত্র আহ্বান করা হয়। অনেক জায়গায় কার্যাদেশ দেওয়া হয়। টাকা ছাড় না হওয়ায় বহু ঠিকাদার কাজ শুরু করেননি। তিনি বলেন, গত তিন বছরে যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ ছিল অপ্রতুল। যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে তার বেশির ভাগই বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্যের মাধ্যমে। এসব প্রকল্পে স্থানীয় বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রকল্পের বকেয়া ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকাসহ নতুন করে আরও ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা দ্রুত মেরামতের জন্য জরুরিভাবে টাকার প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আজ : যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, ঈদের আগে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ভাঙা অংশগুলোতে ইট ফেলে মেরামত করে দেব। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও সারাদেশের রাস্তা সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জরুরিভাবে তিন হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে টাকা ছাড় না করায় রাস্তার ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাই ১৪শ' কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করতে এখন ব্যয় করতে হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, দুই বছরের জন্য মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কার্যক্রমের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৪১০ কোটি টাকা। ব্যয় অনুমোদনও করা হয়েছিল। প্রথম বছর ৫০ কোটি এবং পরের বছর ৫৭ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। জরাজীর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো দ্রুত সংস্কার করতে তার মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই বলে তিনি জানান। তবে সব রাস্তা ঈদের আগে কার্পেটিং করা সম্ভব হবে না। ঈদের পরে সে কাজ এবং নতুন করে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হবে। পুরো রাস্তা সংস্কার হতে কমপক্ষে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস লাগতে পারে।
নির্মাণের ছয় মাসেই বেহাল হচ্ছে রাস্তা : অনেকে অভিযোগ করেন, কোরীয় ও চীনা ঠিকাদাররা যেসব সড়ক বা অবকাঠামো নির্মাণ করেন সেগুলো দীর্ঘদিন টিকে থাকে। অথচ দু'এক বছর পর পর স্থানীয় ঠিকাদার দিয়ে রাস্তা তৈরি বা মেরামত করা হলেও তা কাজ শেষের ছয় মাস যাওয়ার আগেই চলার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম রহমত উল্লাহ বলেন, একটি রাস্তায় কী পরিমাণ ও ওজনের কতো গাড়ি চলবে তার ওপর গবেষণা করে রাস্তা নির্মাণ না হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটছে। অনেকে বলছেন, বিদেশিরা ২০ ভাগ লাভ নিয়ে বাকি টাকার কাজ করে। স্থানীয় ঠিকাদাররা ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে মাত্র ২০ ভাগ অর্থের কাজ করে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া ট্রাক চলাচল, অভারলোডেড, রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের কারণেও রাস্তা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা সম্পর্কে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, 'গত সাত থেকে আট বছর এসব রাস্তা ড্রেসআপ (নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ) করা হয়নি। আমি যতদূর জানি বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে সড়ক সংস্কারের একাধিক প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার খুবই কম অংশ ছাড় করা হচ্ছে। এ কারণে প্রকল্প থাকলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি। ফলে সমস্যাটা ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটসহ কয়েকটি রুটে প্রকট হয়েছে।'
সমঝোতার উদ্যোগ কম : মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, 'যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আগামীকাল বুধবার থেকে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছি। সরকারেরর তরফ থেকে বড় বড় গর্তে ইট সুরকি আর বালি দিয়ে ভরাট করলে বাস চলাচল বন্ধ রাখতে হতো না।' সরকারের পক্ষ থেকে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা জোরালো হয়নি বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বিআরটিসির চেয়ারম্যান এম এম ইকবাল সমকালকে বলেন, বাস মালিকদের হাতে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তাদের বাস চলাচল করতে না পারলেও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বিআরটিসির ২০টি এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ১০টি চলাচল করছে। মালিকরা যাতে ভবিষ্যতে যাত্রীদের জিম্মি না করতে পারে সেজন্য বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।
পরিবহন নেতাদের সঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রীর বৈঠক : সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় ঠিক করতে গতকাল সোমবার সংসদ ভবনে পরিবহন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি জানান, বাসচালকদের দুর্ঘটনার ব্যাপারে সচেতন করতে প্রতিটি জেলার টার্মিনালে পৃথক সমাবেশ করা হবে। ২১ আগস্ট গাবতলী টার্মিনালে প্রথম সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, নৌপরিবহনমন্ত্রী মালিকদের বলেন সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তিনি বেপরোয়া বাস চালানোর বিষয়ে খুবই ক্ষুব্ধ। বৈঠকে মহাখালী টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণকারী পরিবহন নেতারা গাবতলী টার্মিনালের নেতাদের তাদের বাস ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দেওয়ার প্রস্তাব দেন। গাবতলী টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণকারী বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা তাতে রাজি হননি।
খারাপ রাস্তা কত? :সারাদেশে পাকা সড়ক আছে ৯০ হাজার ২১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীনে আছে ২১ হাজার ২১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কের আওতায় ৬ হাজার ৪৪৫ কিলোমিটার, অঞ্চলিক মহাসড়কের আওতায় ৪ হাজার ১০৫ কিলোমিটার ও জেলা সড়কের আওতায় ১০ হাজার ৬৬০ কিলোমিটার। প্রতি বছর কী পরিমাণ সড়ক খারাপ হচ্ছে, তা মেরামত করতে কত টাকা লাগবে_ এসব চাহিদা প্রতিবেদন প্রণয়ন করে সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ। চলতি বছর বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ১২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার রাস্তা খারাপ বলে তারা প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৫০ কিলোমিটার রাস্তা একেবারেই খারাপ, যা যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আরও দেড় হাজার কিলোমিটার রাস্তা খারাপ হলেও মোটামুটিভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারে। বর্ষা শুরু হওয়ার পর বর্তমানে কী পরিমাণ রাস্তা খারাপ হয়েছে সে হিসাব তারা এখনও করেননি। রাজধানীর অবস্থাও খারাপ। এক হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র ২০-২৫ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা মোটামুটি ভালো। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ওই রাস্তাগুলোর সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। ভাঙাচোরা, কাটাকাটি ও গর্তের কারণে বাকি রাস্তা ক্রমেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

আবাসন শিল্প: ক্রেতা-বিক্রেতাকে কাঁদাবে সরকার!

Saturday, June 18, 2011

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে তৃতীয়টি হলো বাসস্থান। আধুনিক ও সভ্য মানুষের জন্য উন্নত আবাসন ব্যবস্থা জরুরি। এ জন্য পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও মানুষের উন্নয়ন আর পরিকল্পিত আবাসন একসূত্রে গাঁথা। এই জরুরি কাজটি করার মূল দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের কোনো সরকারই সে দায়িত্ব পালন করেনি। বরং এই গুরুদায়িত্ব যখন কাঁধে তুলে নিয়েছেন বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরা, তখনো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার। নিরুপায় মানুষ মাথা গোঁজার একটু আশ্রয়ের জন্য শরণাপন্ন হয়েছে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে। সব সঞ্চয় দিয়ে তারা ক্রয় করছে এক টুকরো স্বপ্নের জমি; কিন্তু সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইনের প্যাঁচে পড়ে তারা আজ অসহায়। অসহায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও। উভয় পক্ষের আজ চোখের পানিতে ভাসার দশা।

গতবারের আবাসন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয় এমন কিছু করবেন না। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে কী? আবাসন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয়, এমন কিছুই হচ্ছে। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারি আবাসন খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ খাত এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সিদ্ধান্তের অভাবেই মূলত আবাসিক খাতের বিভিন্ন প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার রাজউক সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলায় এগুলো বাতিলও করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা আরো ভেঙে পড়েছেন। আবাসন শিল্পের এ সংকট কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত ১৫ লাখ শ্রমিকসহ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৫ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বে। পাশাপাশি আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৬৯টি উপখাতে বিনিয়োগ করা অর্থ জলে যাবে এবং এর সঙ্গে জড়িত সারা দেশের অন্তত তিন কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আবাসন খাতের এ সংকটের জন্য রাজউক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করছেন এ খাতের ক্রেতা-বিক্রেতারা। ক্রেতাদের ভাষ্য, 'সরকারি লোকজনের চোখের সামনে আবাসন ব্যবসায়ীরা
প্লট ও ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে সেই বিজ্ঞাপন প্রচারিতও হয়েছে। আমরা বিজ্ঞাপন দেখে প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিজ্ঞাপন প্রচারের সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা জনগণকে যদি সাবধান করত তবে আমরা অননুমোদিত প্রকল্প থেকে প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতাম না। এখন মাথা গোঁজার জন্য এক টুকরো জমি কেনার পর বলা হচ্ছে এটা অননুমোদিত প্রকল্প। আমরা এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব? অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রি করার পর তা রেজিস্ট্রি করে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন, তাঁদের কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?'
আর বিক্রেতাদের বক্তব্য, 'আমরা ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি। এর মধ্যে তারা কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে, আবার বেশির ভাগ প্রকল্পই অনুমোদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। ঝুলিয়ে রাখা প্রকল্পের বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তও দিচ্ছে না। আমরা ধরেই নিয়েছি, যেহেতু কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হবে।'
এ অবস্থায় বিক্রেতা হিসেবে আবাসন ব্যবসায়ীরা ও ক্রেতারা সম্মিলিতভাবে বিপর্যয়ের জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, বিধিমালা চূড়ান্ত করাসহ এ-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে রাজউকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতির জন্যই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ একটি বেসরকারি সংগঠনের জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিটের আদেশ যেন বিনিয়োগকারীদের মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এর দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। তাঁরা বলেন, শেয়ার কেলেঙ্কারির ফলে বিনিয়োগকারীদের যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আবাসন খাতের বিপর্যয় তার চেয়ে অনেক বড় ঘটনা হিসেবে দেখা দেবে।
প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়া : রাজউকের হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক বছরে আবাসিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজউক মাত্র ২৬টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ১৭৪টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে না, আবার অনুমোদন দেওয়া হবে না_এটাও স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। এ কারণে এসব প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা কোনো বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি ও বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী নসরুল হামিদ বিপু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা আবাসন খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা বারবার সংসদীয় কমিটি ও মন্ত্রীকে বলেছি, যেসব প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, সেগুলোর অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হোক। আমারও একটি প্রকল্প আছে, যেটা বন্যাপ্রবণ এলাকা নয়, তার পরও অনুমতি পাচ্ছি না। এখন সরকার বলছে, তারা এগুলো রিভিউ করবে। কিন্তু রিভিউ করতে করতে তো এ ব্যবসার বারোটা বেজে গেছে। এ খাতে মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটি প্লট কিনেছে। কিন্তু সেখানে তারা কোনো বাড়ি বানাতে পারছে না। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।'
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিধিবিধান মেনে যেগুলোর আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর কাগজপত্র ঠিক থাকলে সেটা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। অনুমোদনের জন্য একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি আছে। কমিটি সেটা দিয়ে থাকে। আবেদনকারীরা ৯০ শতাংশ শর্ত পূরণ করলেও আমরা সেগুলোকে পাসের ব্যাপারে সুপারিশ করি। আর যারা শর্ত অনুসরণ না করে অনুমোদনহীন প্রকল্পের প্লট বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি আমরা। সাধারণ লোকজন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আমরা ওয়েবসাইটে অনুমোদিত প্রকল্পের নামগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। এমনকি রাজউকে এসেও তারা জেনে যেতে পারে, কোনটা অনুমোদিত আর কোনটা অননুমোদিত। কিন্তু লোকজন সেটা না দেখে কিনে ফেলছে। কেউ জেনেশুনে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিলে সেই দায় তো সরকার বা রাজউক নেবে না।'
বিধিমালা নেই : বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ প্রণয়ন করে বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ওই বিধিমালা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ব্যবসায়ীসহ সব মহলে এ বিধিমালা সমালোচিত হয়। স্ববিরোধী বিধি থাকায় এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমান সরকারও বিপাকে পড়ে। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিধিমালা যুগোপযোগী করার। এর অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিধিমালাটি সময়োপযোগী করার জন্য একাধিক বৈঠক করে নতুন নতুন প্রস্তাবও দেয়। কিন্ত অদৃশ্য কারণে সেই প্রস্তাব সংযোজন করে এখন পর্যন্ত বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে না। এর পেছনেও আবাসন খাতকে ধ্বংস করতে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ওই বিধিমালা চূড়ান্ত না করে আবাসন প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিতে গড়িমসি করছে রাজউক। অন্যদিকে সরকার নিজেই একের পর এক প্রকল্প হাতে নিচ্ছে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। ওই সব প্লটে লটারির মাধ্যমে খুব সামান্য সংখ্যক লোকই প্লট পেয়ে থাকে। বঞ্চিতের সংখ্যা হাজার হাজার। প্লট না পেয়ে টাকা ফেরত নিতেও তাদের ভুগতে হয়। যারা বরাদ্দ পায়, তাদেরও সময়মতো প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। প্লট বরাদ্দ যারা পেয়েছে, তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছরের আগে রাজউক কোনো প্লট হস্তান্তর করতে পারে না।
এক দেশে দুই নীতি : সরকার ঘোষণা দিয়েছে, জলাশয় ভরাট করা যাবে না, কৃষিজমি অপরিবর্তিত রাখতে হবে ইত্যাদি। অথচ বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ সরকারের নির্দেশ মেনে চলেছেন। কিন্ত সরকারি সংস্থা রাজউক এ নির্দেশ মানছে না। তারা জলাশয় ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে চলেছে একের পর এক। জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই সরকারের প্রশাসন যন্ত্র গড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে সেই যন্ত্রকে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে সরকার। সরকার নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বেসরকারি আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের প্রতি নানাভাবে অবিচার করে চলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান প্লট ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা করলেও তা দক্ষতার অভাবে খুব বেশি লোককে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না।
সরকারি প্লট জনগণের চাহিদা মেটাতে না পারায়, প্লট বরাদ্দ পেয়ে বা না পেয়ে বিভিন্ন হয়রানির কথা শুনে আবাসনের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ ঝুঁকছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। কিন্তু এ খাতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকায় প্লট কেনায় আগ্রহীরাও হতাশ হয়ে পড়েছে। আবার ঢাকা ও এর আশপাশের আবাসন প্রকল্পে যারা বিনিয়োগ করেছে, তারাও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হাতাশ হয়ে পড়েছে। অথচ প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সবার আশঙ্কা দূর হতো বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত।
হাইকোর্টের রায় : রাজউকের অননুমোদিত আবাসিক প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ড ৩০ দিনের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত ৭ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট এ নির্দেশ দেন।
আদালতের আদেশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে রাজউককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। রাজউকের অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার ও মাটি ভরাটসহ তাদের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রিট আবেদনটি করেছিল। জানা গেছে, ৭০টি প্রকল্পের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে রিটটি দায়ের করে বেলা।
হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে আবাসন প্রকল্পগুলোতে আরো স্থবিরতা চলে আসছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজউকে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের নিষ্পত্তি হয় না। তা ছাড়া রাজউক থেকে জানানোও হয়নি যে, এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হবে না। বিভিন্ন আবাসন মেলা হচ্ছে। সরকারের অনুমোদন নিয়েই ওই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে প্লট বিক্রি হচ্ছে। লোকজন কিনছে। কোনো বাধা আসেনি।
রাজউক একের পর এক জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প করে তা বিক্রি করছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হয় না। অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাটি ভরাট করলেই পরিবেশ নষ্ট হয়। এটা আবাসন খাতকে ধ্বংস করারই চক্রান্ত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
ড্যাপ বাস্তবায়ন : গত বছর এ খাতের স্থবিরতার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ড্যাপ। অপরিকল্পিতভাবে তড়িঘড়ি করে ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করায় আবাসন খাতের ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আবাসন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ড্যাপ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে জনগণ ও আবাসন ব্যবসায়ীরা কিছুই অনুমান করতে পারছে না। ড্যাপে ঢাকা ও আশপাশের বিশাল এলাকাকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ড্যাপ নিয়ে একাধিক নকশা প্রকাশ করেছে রাজউক। নকশায় অন্তর্ভুক্ত জমিতে বহুতল ভবন বা আবাসিক এলাকা করার বিপক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এক টুকরো জমি কিনেছে। আবার এমনও আছে, এসব জমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করছে অনেকে। পারিবারিক কারণেই তাদের বসতবাড়ি বড় করতে হয়। সরকার কোনো দিক বিবেচনা না করে হঠাৎ ওই সব এলাকাকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এসব কারণে আগ্রহী সাধারণ মানুষ জমি কেনার বিষয়ে এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। একইভাবে ব্যবসায়ীরা এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জমি কিনে প্রকল্প করে রাস্তা, খেলার মাঠ, মসজিদ বানিয়ে খোলা জায়গা রেখে অবশিষ্ট জমি আবাসিক এলাকা হিসেবে উন্নয়ন করেছেন, রাজউক সেই জমিকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে নিয়েছে। ফলে শহরমুখী মানুষ ওই এলাকার জমি আর কিনতে চাইছে না। এতে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আটকে গেছে। বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে আনার বিষয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। যারা প্লট কিনেছে, তাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ১৩ শতাংশ এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে।
যদিও এসব বিবেচনা করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ড্যাপ পর্যালোচনার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জনকল্যাণের বিপক্ষে এমন একটি পরিকল্পনাও বেসরকারি আবাসন খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

উন্নয়নকাজের নামে নৈরাজ্য by এম জেড হোসেন আরজু

Monday, February 7, 2011

স্বাধীন জাতিসত্তা বিকাশের (১৯৭১) আগে থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্র উন্নয়নের কার্যক্রমে যত নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তার মধ্যে সরকারের যেকোনো ভৌত অবকাঠামো ও শিল্পায়ন কর্মসূচির প্রতি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গণবিরোধিতা অন্যতম।

আমরা কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও প্রকল্প উদ্ভূত ঘটনাবলি কমবেশি অবগত আছি। স্থানীয় বাসিন্দারা তীব্র বিরোধিতা করেছিল সমূহ ক্ষতির আশঙ্কায়। সরকারি কিছু পুনর্বাসন কর্মসূচি তাদের জন্য বরাদ্দ হলেও যে শক্তিশালী বিরোধিতা ও উপেক্ষার আচরণে সরকার তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীতে পরিণত করেছিল, তার মাসুল এখন পর্যন্ত দেশ দিয়ে যাচ্ছে, উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসনের চুক্তি করেও তারা অবিশ্বাস ও অতৃপ্তিতে ভুগছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত শতাব্দীর সাত দশকের দিকে জাতীয় সার্বিক প্রগতি ও সামাজিক জীবনে উৎকর্ষ সাধনে তুলনামূলক অনগ্রসরতার জন্য জনপ্রশাসনের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটকে দায়ী করা হয়। প্রোজ্জ্বল রাজনৈতিক প্রতিভা জন এফ কেনেডির (১৯১৭-১৯৬৩) আকস্মিক আততায়ীর হাতে জীবন হারানোর ফলে মার্কিন জনপ্রশাসন ও রাষ্ট্র-উন্নয়নের যথাযথ রাস্তা বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতীয়মান, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও সে ধরনের রাহুগ্রস্ত। সরকার কর্তৃক আরোপিত প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে জনগণকে একটি বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে গঠনের সুযোগ করে দেয় এবং সেই সুযোগ ব্যবহার করে স্বার্থলিপ্সু কিছু ব্যক্তি অথবা রাজনৈতিক দল। বিশ্বের উন্নতমানের কয়লা খনি হিসেবে স্বীকৃত আমাদের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। নূ্যনতম ১০ লাখ টন বার্ষিক উৎপাদনক্ষম এ কয়লা খনি স্থানীয় অধিবাসীদের অসন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে নিয়মিত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উপনীত হতে পারছে না। গ্রামবাসীর অভিযোগ ও অসন্তুষ্টি, তারা যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তা নিরসনে সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আন্তরিক উদ্যোগের পরিচয় পেতে প্রায় যুগ অতিক্রম করতে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি অবস্থার যে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দৃশ্যমান, তা বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের একান্ত নিজস্ব আন্তরিক চেষ্টার ফল।
সরকারের ধ্রুপদী যে সংজ্ঞা 'ড়োবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব, ঋড়ৎ ঃযব চবড়ঢ়ষব, ইু ঃযব চবড়ঢ়ষব'_বিশ্বজনীন তা মনে-মননে-বিশ্বাসে-কর্মে সক্রিয় রাখতে পারলে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে সরকার ও জনগণের পারস্পরিক প্রতিপক্ষ অবস্থানে দড়ি টানাটানির পরিস্থিতি তৈরি হতো না। বস্তুত এ ধ্রুপদী সংজ্ঞার জ্ঞান স্মরণে না রাখার ব্যর্থতা উত্তরাধুনিক যুগে বড় মাত্রার নৈতিক অপরাধ।
সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রিপরিষদকে অবশ্যই ভাবতে হবে, তাঁদের পরামর্শক ও শুভার্থীরা আবেগাপ্লুত হয়ে অথবা স্বার্থতাড়িত হয়ে অথবা প্রজ্ঞার ঘাটতিঘটিত কারণে অথবা জনবিচ্ছিন্নতার কারণে প্রকৃত মাঠপর্যায়ের অবস্থা অনুধাবন না-ও করতে পারেন। সে অবস্থায় তাঁদের পরামর্শে গুরুতর ভবিতব্যের পথ রচিত হতে পারে। জনগণের বন্ধু বঙ্গবন্ধু (১৯২০-১৯৭৫), যাঁর অবিচ্ছেদ্য স্বভাব গভীর গণসম্পৃক্তি এবং নির্বিশেষে প্রত্যেককে বুকের ভালোবাসা দিয়ে সিক্ত করা, তাঁকে পরামর্শ দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। যে ভুলের মর্মান্তিক মাসুল প্রাণের নেতাকে দিতে হয়েছিল নিজের প্রাণ দিয়ে। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ও অভিভাবক শক্তি আওয়ামী লীগ যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার গঠন ও পরিচালনা করছে, ইতিহাসের শিক্ষায় আলোকিত হয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে গণবিরোধিতা প্রশমনের প্রক্রিয়া আজ অনুসন্ধান করা জরুরি। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু প্রায়ই সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলতেন_জনগণকে ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। এ গুণাবলি সরকারি প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের মনে নেই বলে সেখানে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন; তোয়াক্কা না করে একতরফা উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণে অগ্রসর হোন। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে, প্রজাতন্ত্র বা রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।
এ প্রেক্ষাপটে আরেকটি জ্বলন্ত ঘটনা উল্লেখ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সরকার চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার মাঝেরচর ও রাঙ্গাদিয়া মৌজায় প্রায় ৫৯৬ একর জমি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণে অধিগ্রহণ ও হুকুমদখলের চূড়ান্ত অনুমোদনে প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর মধ্যে ২৬৪ একর জমি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট (প্রা.) লিমিটেডের বরাবরে বার্ষিক প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকার বিনিময়ে ৩০ বছরের জন্য সরকারি অনুমোদনক্রমে ২০০৬ সালে ইজারা দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় ওই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানটি (ইডাবি্লউপিডি) ওই একই এলাকায় একাধিক বৃহদায়তন ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এমনকি সরকার যেখানে বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছে, সেখানে দেশি কম্পানি ইডাবি্লউপিডি একক উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের আগ্রহও সরকারের কাছে উত্থাপন করেছে। তথাপি সরকার ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তে অনড় এবং বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প গ্রহণে মরিয়া। কিন্তু স্থানীয় সচেতন জনগণ সরকারের প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিরূপ অভিব্যক্তি সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেছে। সরকার ও রাষ্ট্র আমাদেরই, আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে টিকে থাকতে আমাদের সরকারের উচিত জরুরিভাবে দেশীয় বুর্জোয়া ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা করা। মালয়েশিয়ার মাহাথির সরকার (১৯৮২-২০০৩) সে রকম রাজনৈতিক অর্থনীতি প্রয়োগ করে বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রবণতা ও কৌশল হলো জাতীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে হাতিয়ে নেওয়া। অধিকন্তু প্রাইভেট করপোরেট হাউসগুলো দেশে সুস্থ ও টেকসই গণতন্ত্র বিকাশের জন্যও যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারঙ্গম_সরকার সম্ভবত এ ধরনের ধারণা পাত্তা দিতে অনিচ্ছুক। তবে কি বাংলাদেশ সর্বাত্মক (টোটালিট্যারিয়ান) রাষ্ট্র হিসেবে নিজের বিকাশকে এগিয়ে নিতে চায়? আমরা টোটালিট্যারিয়ান রাষ্ট্রের পরিণতি দেখেছি ইতালিতে, যার পরিসমাপ্তি ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান মুসোলিনির (১৮৮৩-১৯৪৫) মর্মান্তিক হত্যাজনিত মৃত্যুতে। রাষ্ট্রের জনগণ যন্ত্রের মতো সক্রিয় থাকবে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে_এমন রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় জনগণের সহিষ্ণুতার ভিত ভেঙে সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
সরকার বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে প্রত্যয়ী হতে পারে, গণবিরোধিতা (জমি অধিগ্রহণ অথবা যেকোনো কারণে হতে পারে) একটি মামুলি ও ক্ষণস্থায়ী বিষয় এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে যেকোনোভাবে যেকোনো অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই চট্টগ্রামের মাঝেরচর ও রাঙ্গাদিয়া মৌজায় সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের নীতিগত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা ও প্রতিকারের সম্ভাব্য পথ পাওয়া যেতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে। ১৯৯২ সালে একটি আন্তদেশীয় (কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেঙ্েিকা) কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয় ডাহুক (ধিঃবৎভড়ষি) প্রজাতির এক ধরনের দৃষ্টিনন্দন পক্ষির আবাস সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে। ফলে আট লাখ ৮০ হাজার একর জলাভূমি ও প্লাবনমুক্ত উঁচু জমি অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। পরিকল্পনাধীন ভূমির ৩০ শতাংশ বেসরকারি ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ছিল। এই এসিই বেসিন প্রকল্পটি সরকার ও জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রয়াস ও পরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি চমৎকার উদাহরণ। প্রকল্পের মৌলিক লক্ষ্যকে সামান্যতম বিঘি্নত না করেও বেসরকারি ভূমি মালিকরা তাদের অভ্যস্ত কর্মসূচি ও ব্যবহার ওই জমিতে চালিয়ে যেতে থাকে, যা থেকে আর্থিক সুবিধা অর্জনও সম্ভব হয়। ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানা অক্ষুণ্ন রেখেও সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষ ওই একই প্রকল্প থেকে সন্তুষ্ট মাত্রায় সুযোগ-সুবিধা অর্জন করতে থাকে। প্রাণিজীবন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যমুখী এ অনুভূতিকাতর প্রকল্পের ভেতরে ওয়েস্ট ভ্যাকো করপোরেশন নামে একটি শিল্পকারখানা আছে, যেটি বেসরকারি ভূমি মালিকদের মধ্যে এককভাবে বৃহত্তম। শিল্পকারখানাটির ব্যক্তিগত ভূমি রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার একর। বেসরকারি খাতের ওয়েস্ট ভ্যাকো করপোরেশন ১৯৯১ সালে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক সমঝোতামূলক চুক্তিতে তার মুদ্রণ, কাগজ উৎপাদন, প্যাকেজিং এবং সংশ্লিষ্ট রাসায়নিকসহ বিশাল কর্মযজ্ঞ সেখানে পুরোপুরি চালিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে সরকার সব সময় স্থানীয় জনগণকে পীড়নমূলক পদ্ধতিতে যেকোনো শিল্প প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রসর হওয়ার পথ বেছে নেয়। বিবৃত তথ্যালোকে বিনয়ের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সমীপে ব্যক্ত করা প্রয়োজন মনে করছি, বাংলাদেশে বিকাশমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তথা বিজনেস করপোরেট হাউসগুলোকে মিত্র ও সহায়ক উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বিশ্বাসপূর্বক সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেই গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের সাধনা পূর্ণ হয়ে যায় না। বরং এখানে রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি যখন লুণ্ঠনকারীর মতো আচরণে অভ্যস্ত, স্বদেশি শিল্পোদ্যোক্তারা যখন নিরাশার আঁধারে বেদনা-ক্লান্ত, তখন দিনবদলের প্রতিশ্রুতিশীল জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাসীন হয়ে নতুনভাবে জনগণের হৃদয়ের ধ্বনি ও অনুভূতিসম্ভারকে গভীরভাবে অনুধাবনের নিবিড় প্রচেষ্টা থাকা দরকার।

নতুন বিমানবন্দর কেন

Saturday, January 29, 2011

দেশে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর আছে। এসব বিমানবন্দরের কোনোটারই ধারণক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা হয় না। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে এখন কক্সবাজার বিমানবন্দরকেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর। বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে এই বিমানবন্দরের। তবে এখন ক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী এ বিমানবন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টির মতো বিমান ওঠানামা করলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলা যায়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে প্রতি ঘণ্টায় (পিক আওয়ারে) সর্বোচ্চ ১০টি বিমান ওঠানামা করে। এর মধ্যে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের ওঠানামাও যুক্ত। অর্থাৎ ঢাকায় বর্তমানের পাঁচ গুণ বিমান ওঠানামা এবং যাত্রীর পরিমাণ দ্বিগুণ হলেও এর জন্য হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই যথেষ্ট। তা ছাড়া আধুনিকায়নের মাধ্যমে এ বিমানবন্দরের ক্ষমতা-দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ তো রয়েছেই।
এ অবস্থায় সরকার আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে এ বিমানবন্দর করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি তার জন্য আড়িয়ল বিলের মতো স্থানকে নির্বাচন করা নিয়েও সমালোচনা আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এমন কোনো অগ্রাধিকার প্রকল্পের অঙ্গীকার ছিল না।
অবশ্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিমানবন্দরটিকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় বিমান চলাচলের পথে কেন্দ্রস্থলে (হাব) পরিণত করার চিন্তা আছে। এতে এ খাত থেকে দেশে প্রচুর রাজস্ব আসবে।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই-সমীক্ষা করা হয়নি। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সিটি’ নামের একটি উপশহর গড়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। প্রস্তাবিত এই বিমানবন্দর ও সিটির জন্য আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই অধিগ্রহণের ফলে ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ জেলার তিন উপজেলায় বিস্তৃত মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জলাধারটির প্রায় পুরোটা শেষ হয়ে যাবে। এর ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কী ক্ষতি হবে, তা নিয়েও কোনো সমীক্ষা হয়নি।
পরিবেশবিদদের মতে, মিঠাপানি ও জীববৈচিত্র্যের বড় আধার এই বিল ধ্বংস করা হলে পরিবেশগত ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঢাকার আশপাশে বন্যার প্রকোপও বাড়বে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ হবে। প্রথম পর্যায়ে এখন ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সব সমীক্ষা করা হবে।
নতুন বিমানবন্দরের সিদ্ধান্ত: সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। গত বছরের ২৯ আগস্ট প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, প্রকল্পটি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা কমিটি সাতটি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে তিনটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে। এক. ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ত্রিশাল, আমিরাবাড়ী, মোক্ষপুর ও মঠবাড়ী ইউনিয়ন। দুই. ত্রিশাল উপজেলার রামপাল, কানহর, কাঁঠাল ও বৈলর ইউনিয়ন। তিন. টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর। এই তিনের মধ্যে প্রথম প্রস্তাবের পক্ষে (ময়মনসিংহের ত্রিশাল) গত বছরের ৭ এপ্রিলের বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সুপারিশ করা হয়।
এরপর কমিটি ১৫ নভেম্বর আবার বিমানবন্দরের স্থান নির্বাচনের জন্য ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের শিবচর ও রাজৈর, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের আড়িয়ল বিল এলাকা পরিদর্শন করে। ৩০ নভেম্বর বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব সাংবাদিকদের জানান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান হিসেবে আড়িয়ল বিলকেই চূড়ান্ত করার সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত কমিটি।
গত ১২ ডিসেম্বর আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর এবং পাশেই বঙ্গবন্ধু সিটি নির্মাণের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
নতুন বিমানবন্দরের পক্ষে যুক্তি: মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার গত ৬ ডিসেম্বর স্থান নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠান বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। প্রতিবেদনে নতুন বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়, দেশে এখন ১৭টি বিমান সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বাড়ছে। ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে এর বর্তমান অবকাঠামো যথেষ্ট নয়। ক্ষমতার ৮০ শতাংশ এখন ব্যবহূত হচ্ছে। এ বিমানবন্দরের একটি রানওয়ে এবং বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিমানযাত্রীর তুলনায় তা অপ্রতুল। এই বিমানবন্দরের চারদিকে আবাসিক এলাকা ও সেনানিবাস থাকায় ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। এর যাত্রী টার্মিনাল ভবন অপ্রশস্ত এবং পাঁচ স্তরের আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের যথেষ্ট সুযোগ নেই। এ ছাড়া বর্তমান বিমানবন্দরে সর্বশেষ প্রযুক্তির সুপরিসর উড়োজাহাজ এয়ারবাস এ-৩৮০ পরিচালনের ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এবং এর সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ সড়ক এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি।
পাল্টা যুক্তি: সরকারের এসব যুক্তি সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বিমানের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এয়ারবাস কোম্পানির সর্বশেষ সংযোজন এ-৩৮০ উড়োজাহাজ এখন পর্যন্ত খুব কম এয়ারলাইনসই ব্যবহার করছে। ঢাকা থেকে যেসব গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট আছে, তাতে উড্ডয়ন ঘণ্টা ও যাত্রীর চাপ বিবেচনায় এখানে এ-৩৮০ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার সম্ভাবনা নেই। কারণ উড্ডয়ন ঘণ্টা বিবেচনা রেখে এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইট পরিকল্পনা করে। কম দূরত্বে সুপরিসর উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করলে লাভ হয় না।
আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের জন্য জরুরি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও দক্ষ জনবল। এখানে বিশাল জায়গা বা অবকাঠামো মুখ্য নয়। ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাতে টার্মিনাল ভবন আরও প্রশস্ত করা দরকার। সে জন্য বর্তমান বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত জমি আছে বলে সিভিল এভিয়েশন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এর পরও যদি স্থানসংকুলান না হয়, তাহলে বিমানবন্দরসংলগ্ন ১৩০ একর জমি কেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হলো, সে প্রশ্ন উঠছে। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে এটা ইজারা দেওয়া হয়। পরে তা বাতিলও করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আবার তা ইজারা দেয় কান্ট্রি ক্লাব, গলফ ক্লাব, পাঁচ তারকা, তিন তারকা হোটেল ইত্যাদি করার নামে। কিন্তু গত ১০ বছরে কিছুই করা হয়নি। বর্তমান সরকারের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি ওই জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব করে। বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের ওই সব জমি ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু পরে সংসদীয় কমিটি ইজারাদারের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। তখন বিমানমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সরকারি জমি ফেরত নিতে মন্ত্রণালয় আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভবিষ্যতে বিমানবন্দর সম্প্রসারণে এই জমি দরকার হবে। কিন্তু এখন নতুন বিমানবন্দরের জন্য আড়িয়ল বিলের জমি অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, নতুন বিমানবন্দরকে এ অঞ্চলের বিমান চলাচলের কেন্দ্র করার কথা বলছে সরকার। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা বা সমীক্ষার ভিত্তিতে এ সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে? দুবাই ও সিঙ্গাপুর হাব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেশ দুটির বিমান সংস্থা এমিরেটস ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের। এ দুটি এয়ারলাইনস এখন বিশ্বের শীর্ষপর্যায়ের বিমান সংস্থা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দেশে ও গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। তারা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে বিমান চলাচলে নিজ দেশের বিমানবন্দরকে মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। দুবাই ও সিঙ্গাপুর এমনিতে বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র। তাদের রয়েছে আনুষঙ্গিক এমন সব সুবিধা, যা তাদের নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। ঢাকাকে দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মতো বিমান চলাচলের আঞ্চলিক কেন্দ্র করতে হলে তার জন্য পুরো রাজধানীকে ওই রকম পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকাকে ঘিরে সরকারের এখন পর্যন্ত তেমন চিন্তা-পরিকল্পনার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
বিমান চলাচল বৃদ্ধির চিত্র: জানা গেছে, কুর্মিটোলায় বর্তমান বিমানবন্দরটির জমির পরিমাণ দুই হাজার একর এবং রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। রয়েছে পরিমিত প্রয়োজনীয় সুবিধাদি। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান চলাচল বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তাতে ২০২৫ সালে এখানে মোট ৫৭ হাজার ফ্লাইট পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। ২০১৫ সালে এটা ৩২ হাজার এবং ২০২০ সালে ৪২ হাজার হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় ঢাকায় বিমান ওঠানামা করবে ১৪টি। ২০২০ সালে তা ২০ ও ২০২৫ সালে ২৯টিতে উন্নীত হতে পারে।
এই সমীক্ষা অনুযায়ী আগামী ২০ বছরে যাত্রীসংখ্যা তিন গুণ হতে পারে। বর্তমান সুবিধাদি ও রানওয়ে দিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলবে। তবে কিছু আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির দরকার হবে এবং তা বর্তমান বিমানবন্দরেই করা সম্ভব।
বিমানসচিবের যুক্তি: আরেকটি বিমানবন্দর নির্মাণ কেন দরকার, এ প্রশ্নের জবাবে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহজালালে একটিমাত্র রানওয়ে, যদি কোনো কারণে কোনো প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে রানওয়েতে বসে পড়ে, সেটা সরানো না যায়, তখন তো পুরো বিমানবন্দর অচল হয়ে পড়বে। আর এখানে আগামী ১০ বছরে বিমান চলাচল ও কার্গো বহন দ্বিগুণ হয়ে পড়বে। তা ছাড়া আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই।
তুলনামূলক পর্যালোচনা: দেশে-বিদেশে বিমান পরিবহন-বাণিজ্যে জড়িত একজন পরামর্শক একটি রানওয়ের কারণে নতুন বিমানবন্দর করার যৌক্তিকতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি জানান, যুক্তরাজ্যের গেটউইক বিমানবন্দরে একটি রানওয়ে ছিল। সম্প্রতি তারা দুটি করেছে। কিন্তু একটি রানওয়ে থাকা অবস্থায় সেখানে বছরে সাড়ে তিন কোটি যাত্রী পরিচালন করা হতো। আর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের এখন পরিচালনক্ষমতা ৮০ লাখ, গত বছর প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী এখানে আসা-যাওয়া করেছে। তাঁর মতে, এখানে ক্রমবর্ধমান যাত্রীর চাহিদা মেটাতে আরেকটি বিমানবন্দর বা রানওয়ে নির্মাণ সমাধান নয়। এখানে জরুরি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট উন্নত করা দরকার। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে টারমাক ও টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত জমি শাহজালালেই আছে।
সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহজালালে বর্তমান রানওয়ের ব্যবহারযোগ্য ক্ষমতার ৪০ শতাংশ ব্যবহূত হয়। জাপানের নারিতা বিমানবন্দরও একটি রানওয়ে দিয়ে চলছে। সেখানে ঢাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিমান ওঠানামা করে।
বিকল্প হিসেবে আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরকে পুনরুদ্ধার করে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে এবং শাহজালাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ওড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে।
সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নানের মতে, ‘প্রয়োজন হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের ট্যাক্সিওয়েকে দ্বিতীয় রানওয়েতে পরিবর্তন করার (পরীক্ষা সাপেক্ষে) সুযোগ আছে। এ ছাড়া রানওয়ের পশ্চিম দিকে কিছু কিছু স্থাপনার যুক্তিসংগত পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে দ্বিতীয় রানওয়েও নির্মাণ করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, বর্তমান রানওয়ের লাইটিং সিস্টেম, অ্যান্টিফগ লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের আধুনিকায়ন, হাইটেক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিলে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
আড়িয়ল বিলে কারিগরি ঝুঁকি: সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ বাতাসের বিপরীতে করতে হয়। বাংলাদেশে বছরের ৭০ শতাংশ সময়কালে বায়ুপ্রবাহ দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যায়। বাকি ৩০ শতাংশ সময়কালে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে থাকে। ফলে প্রায় ৭০ শতাংশ উড্ডয়ন ও অবতরণ হয় উত্তর-দক্ষিণ দিকনির্দেশনায়। বাকি সময় ৩০ শতাংশ দক্ষিণ-উত্তর দিকনির্দেশনায়। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েও উত্তর-দক্ষিণমুখী।
কিন্তু আড়িয়ল বিলটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। পশ্চিমে শেষ প্রান্তে পৌঁছে পশ্চিম-উত্তরে বেঁকে গেছে। তাই প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে পূর্ব-পশ্চিম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি তা হয়, তাহলে সারা বছর আড়াআড়ি বাতাসের (ক্রস-উইন্ডের) মধ্যে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে হবে। এটা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে জটিলতা বাড়াবে, খরচও বাড়বে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আড়িয়ল বিলের মাটি মূলত পিটজাতীয় জৈব মাটি (গাছপালা পচে তৈরি হওয়া নরম মাটি)।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, বিলে বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি করতে পুরো এলাকা ২০-৩০ ফুট বালু দিয়ে ভরাট করতে হবে। কিন্তু এখানে গভীর জৈব মাটির (পিট সয়েল) স্তর থাকায় বিমানবন্দরসহ নির্মিত স্থাপনা দেবে যাওয়ার সার্বক্ষণিক ঝুঁকিতে থাকবে। ৪০০ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন ওজনের বিমান ওঠানামার জন্য জৈব মাটি বড় কারিগরি ঝুঁকি হিসেবে দেখা দেবে।

ব্যাংকখাতের দরদী চোখ : উন্নয়নের নতুন মাত্রা by ওয়াহিদ মুরাদ

Friday, January 21, 2011

তানুগতিক ব্যাংকিং কার্যধারার বাইরেও ব্যাংসমুহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অত্যাবশ্যকীয় কাজ করতে পারে এবং করে যাচ্ছে। এ নজির আমরা দেখে যাচ্ছি। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তথা আধুনিকায়নে সহায়তা রাখতে ব্যাংকসমূহ একের পর এক নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে চলছে।

বলতে দ্বিধা নেই, এসব কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরসারি পরামর্শ, উপদেশ এবং উদ্যোগ সকল ব্যাংকসমূহকে সাহায্য করছে নিরন্তর। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিরা আর্থিক সহায়তা দিয়ে সমাজে অনেক বড় বড় জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সে কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডেরই নতুন দিকমাত্রা কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা দেশে প্রায় ৫০টির মতো সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক কাজ করছে। এদের কর্মকাণ্ড এখন টাকা জমা নেয়া কিংবা ঋণ প্রদান অথবা সে ঋণ আদায় কিংবা বলা যায় বিদেশ থেকে প্রেরিত কষ্টার্জিত রেমিটেন্স সংগ্রহই নয় বরং সমাজের প্রতিটি মানুষের সার্বিক উন্নয়নই এখন ব্যাংকের লক্ষ্য এবং অভীষ্ট। হোক সে গ্রামের অথবা শহরের কোনো লোক। এ লক্ষ্যের ফলেই অবহেলিত অনাদরে বেড়ে উঠা আদিবাসী মানুষরাও পাচ্ছে জীবনে নতুন রঙিন আকাশ। যেখানে তারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা পাচ্ছে এবং সহায়তা নিচ্ছে।

আদিবাসীদের মাঝে হস্তশিল্পের কাজ ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি আদিবাসীদের শ্রমকে আরো নিরিড়ভাবে কর্মে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে আদিবাসীদের দুঃখের রাত অনেকটাই কেটে যাওয়ার পথে। গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ শহরে এস হয়ে যায় বস্তিবাসী। সে সব মানুষদের ঋণ সহায়তা দিয়ে পুনরায় গ্রামে ফিরিয়ে দেয়ার মতো মহৎ কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশে কৃষি ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক ভিখারীকে ঋণ দিয়ে কর্মে নিয়োগের ফলে, সব মহল থেকে এ উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ঠোঁট কাটা শিশুদের চিকিৎসা সহায়তা তাদের জীবনে এনে দিয়েছে এক বিশাল মানসিক শক্তি। প্রতিবন্দ্ধী মানুষদের দাঁড়াবার জায়গা ছিল না বললে অতু্যক্তি হয় না। সেই প্রতিবন্দ্ধী মানুষদের বিভিন্ন ধরনের ঋণ সহায়তা দিয়ে স্বানির্ভর করার উদ্যোগ নিয়েছে দেশের সকল রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। এ এক অনন্য নজির ব্যাংক সেবার। এ ধরনের দরদী চোখ নিপতিত হয়েছে গরীব, দুস্থ, অসচ্ছল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বেলায়ও। যাদের লেখা-পড়ার কোনো সুযোগই হতো না- যদি না ব্যাংকসমূহ শিক্ষা ঋণ দিয়ে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুদবিহীন) এগিয়ে না আসতো।

ব্যাংকের উন্নয়নের দরদী ছোঁয়া বিভিন্ন মাধ্যমে দেয়া যেতে পারে। যেমন দেশের যে উপজেলাটি কৃষি উৎপাদনে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে, সে উপজেলাকে চিহ্নিত করে, একটি ব্যাংককে সে দায়িত্বটি দিয়ে দেয়া। অপরপক্ষে যে উপজেলাটি শিক্ষায় কিংবা শিল্পে সবচেয়ে অবহেলিত সেই উপজেলাটিকে চিহ্নিত করে সেখানে একটি ব্যাংক পাঁচ বছর মেয়াদী কিংবা দশবছর মেয়াদী কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এরকম দায়-দায়িত্ব নিয়ে একটি ব্যাংক যখন কাজ করে সফল হবে তখন একটি জেলাভিত্তিক কর্মসূচী নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিষয়টি দেশের সংশিস্নষ্ট সকলের জন্য প্রস্তাব আকারে রাখলাম। যদি এ থেকে কোনো রকম উপকার কোনো মানুষের হয়, যে জন্যই এ প্রস্তাবনা উত্থাপিত হলো।

বর্তমান সময়ে গাভীর দুধের আকাল প্রচণ্ড। বাজারেও এর চাহিদা ব্যাপক। এই দুধের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি উপজেলাকে কিংবা একটি জেলাকে চিহ্নিত করে সংশিস্নষ্ট কৃষক-কৃষাণীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ঋণ সহায়তার মাধ্যমে জেলাটিকে দুগ্ধে স্বনির্ভর করা সম্ভব বলে মনে করি। এটিও বিবেচনায় নেয়ার জন্য সংশিস্নষ্ট সবার কাছে উদাত্ত আহবান জানাই। কারণ শিশু খাদ্য হিসাবে মায়ের দুধের বিকল্প এই গাভীর দুধই একমাত্র সম্বল। সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে দরদী চোখ রাখবে বলে আশা রাখি।

আমরা কি জানতাম, আমদানি বিকল্প তৈলবীজ, আদা, ডাল, মুগ, গরম মশলা, ভুট্টা, পিয়াজ, রসুন ইত্যাদি আমদানি করতে বাংলাদেশের মতো একটি গরীব দেশের বছরে প্রায় সাড়ে বারো হাজার কোটি টাকা চলে যেত। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান মাত্র ২% সুদে এ সব ফসলাদি উৎপাদনে ঋণ সহায়তা দিয়ে যাওয়ার যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তাকি কখনো কল্পনা করা যেত? দেশের রেডিও -টেলিভিশনে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের একটি তৃতীয় চোখ খুলে দিলেন গভর্নর মহোদয়। দেশের সব ব্যাংক যথা সময়ে যথার্থ ব্যক্তিকে যথেষ্ট তদারকির মাধ্যমে স্বচ্ছতার সাথে এ ঋণ সহায়তা যদি দিয়ে যায় তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ তৈলবীজ, আদা, ডাল, মুগ, গরম মশলা, ভুট্টা, পিয়াজ, রসুন ইত্যাদি রফতানিকারক দেশে পরিণত হবে।

অত্যন্ত আশার কথা, যেখানে কারো চোখ পড়ে না, সেখানে ব্যাংকের দরদী চোখ পড়তে শুরু করেছে। ফলে ধীরে ধীরে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের পাশাপাশি ব্যাংক এগিয়ে যাচ্ছে একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে। সে উন্নয়নে জড়িয়ে আছে হতদরিদ্র, দরিদ্র, মধ্যম আয়ের ব্যাপক জনগোষ্ঠী। আমরা আশা করছি, আগামী দিনগুলোতে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৬ কোটি মানুষের ছোট্ট এ দেশ -বাংলাদেশ একদিন ব্যাপক উন্নয়নের সূর্যালোক গ্রহণ করবে। আমরা সে দিনটির অপেক্ষায় আছি, যে দিন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ সমগ্র এশিয়ার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সুন্দর বনের বাঘ্রের মতোই। আর সে জন্য আজকের ব্যাংকের নানাবিধ বিভিন্নমুখী কর্মসূচী এবং দরদী চোখ নতুন করে সবার কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে ধরা দেবে বলেই আশা করি।

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে জাতীয় সংলাপ শুরু

Thursday, January 20, 2011

ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আলোচকরা। তাঁরা খাদ্যের আপদকালীন মজুদের পরিমাণ ১৫ লাখ টন থেকে বাড়িয়ে ২২ লাখ টন করা দরকার বলে মত দিয়েছেন। খাদ্য মজুদ বাড়াতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গুদাম তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন।

গতকাল শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫) দলিলের খসড়া নিয়ে জাতীয় সংলাপে অংশ নিয়ে বক্তারা খাদ্যের মজুদ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আরো বলেন, 'উন্নত কৃষিবীজ উদ্ভাবন, কৃষি বিপণন, শস্যবীমা, সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনাকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্বসহকারে তুলে ধরতে হবে।'
সভায় খাতভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা ধরে তা বাস্তবায়ন কর্মসূচি গ্রহণের ওপর আলোচকরা গুরুত্ব দেন। তাঁরা লবণাক্ততা, খরা, বন্যা ও শীত সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনার দিকনির্দেশনা রাখার মত দেন।
সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বলেন, 'ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে আরো বাস্তবায়নমুখী করতে বিশেষজ্ঞপর্যায়ে এ জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা হয়েছে। আগামী মার্চের মধ্যে পাঁচ বছরের এ পরিকল্পনার চূড়ান্ত দলিল প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।'
জাতীয় সংলাপে আলোচকরা জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ভূমির ব্যবহার, নদী খনন, জলাশয় সংরক্ষণ, মৎস্যজীবী নিবন্ধন, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চলের জমির যথাযথ উন্নয়ন ও ব্যবহার, উন্নত পশু-পাখির জাত উদ্ভাবনের বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে পরিকল্পনায় তুলে ধরার পক্ষে মত দিয়েছেন। জাতীয় সংলাপে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

জাহাজ ভাঙা বন্ধ ১০ মাস-৩৮০টি স্টিল ও রি-রোলিং কারখানাও বন্ধ

Tuesday, January 18, 2011

নজিওর তৎপরতায় ১০ মাস ধরে ভাঙার জন্য পুরনো জাহাজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। জাহাজ ভাঙার ১০০টি ইয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে এখন জাহাজ রয়েছে। জাহাজ ভাঙার লোহা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে রড ও স্টিল তৈরি করে রি-রোলিং ও স্টিল মিলগুলো।

কাঁচামাল না পাওয়ায় এ দুটি খাতের ৩৮০টি কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক। বাকি কারখানাগুলোও কাঁচামালের অভাবে ধুঁকছে। যেকোনো মুহূর্তে এসব কারখানাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘কিছু এনজিও ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পিতভাবে আদালতকে ভুল তথ্য দিয়ে রায় বের করে নিয়েছে। এসব এনজিও জাহাজ ভাঙা শিল্প ও এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল রি-রোলিং মিল, স্টিল মিল, মোল্ডিং ওয়ার্কশপ, কেব্ল্ শিল্প, আবাসন শিল্পসহ প্রায় ৫০টি খাত ধ্বংস করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নেমেছে। ষড়যন্ত্রকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে বেলা নামের একটি এনজিও। এর সঙ্গে কিছু সরকারি আমলাও রয়েছে।’
কালের কণ্ঠকে জাফর আলম আরো বলেন, ‘বর্তমান সরকার জাহাজ ভাঙা শিল্প চালু রাখার পক্ষে, কিন্তু জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকায় সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। কারণ জাহাজ ভাঙা বন্ধ থাকলে রি-রোলিং ও স্টিল মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এতে রডের দাম বাড়লে প্রভাব পড়বে আবাসন ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের ওপর। লোহার ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য খাতও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন খাতের লাখ লাখ বেকার শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসবেন।’
জানা গেছে, পরিবেশ দূষণের অভিযোগ তুলে জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিরুদ্ধে বেলা হাইকোর্টে রিট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বহনকারী জাহাজ আমদানি বন্ধ রাখার রায় দিয়েছেন। এরই মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর একটি নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। সে নীতিমালা না হওয়ায় জাহাজ আমদানির জন্য কোনো ছাড়পত্র দিচ্ছে না অধিদপ্তর। এ কারণে গত বছরের মে মাস থেকে জাহাজ আমদানি বন্ধ রয়েছে।
শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, পরিবেশসম্মতভাবেই জাহাজ ভাঙার কাজ করতে চান তারা। এরই মধ্যে এ খাতে মালিকরা ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত শ্রমিকদের সংখ্যা ১০ লাখ। এ খাতের মালিকরা ইতিমধ্যে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করেছে। তাদের জন্য ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আলী হোসাইন কালের কণ্ঠকে জানান, এনজিওর তৎপরতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকায় রি-রোলিং মিলগুলো কাঁচামাল সংকটে ভুগছে। কাঁচামালের অভাবে এ খাতের ৩০০ কারখানার মধ্যে ১৮০টি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। বছরে মাত্র দু-একটি বর্জ্যবাহী জাহাজ মধ্য সমুদ্রে বর্জ্য অপসারণের পর তা নিয়ে এনজিওগুলো হইচই শুরু করে। কিন্তু ইয়ার্ডে কখনো ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যবাহী জাহাজ আসেনি। তিনি বলেন, ডাইং ও ফিনিশিং কারখানাগুলো থেকে যে পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক নদীতে যাচ্ছে, জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে এর চারভাগের একভাগ দূষণও ঘটছে না।
বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ ফজলুর রহমান বকুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৩০-৪০ বছর ধরে জাহাজ ভাঙা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার নামে হঠাৎ করে জাহাজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আমরাও চাই পরিবেশসম্মতভাবে এ শিল্প গড়ে উঠুক। এ জন্য হঠাৎ সিদ্ধান্ত না নিয়ে কয়েক বছর ধরে এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।’

শতাব্দীর ২য় দশকে দেশের অর্থনীতি যে পথে এগুবে by ড. শামসুল আলম

ত নির্বাচনে রূপকল্প ২০২১ জাতির সামনে পেশ করা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপ। বাংলাদেশ ২০২১ সাল নাগাদ কোথায় পেঁৗছুবে সেখানে ছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের কথা।

জাতি সমৃদ্ধি অর্জনে এগিয়ে যেতে চায়, বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে পরিবর্তন চায় এর প্রমাণ হল, যখনই আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখালো, মধ্যম আয়ের উন্নত দেশ হবার কথা বললো, বিগত নির্বাচনে সত্তরের নির্বাচনের পুনরাবৃতি ঘটিয়ে বিজয়ী হল। বলা হয়ে থাকে নবীন ভোটাররা বিপুল সংখ্যায় গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। এ কথা সত্য যে, নবীন প্রজম্ম পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। তারা হতাশার কথা শুনতে চায় না, দ্বন্দ্ব দেখতে চায় না। আর এ জন্যই নেতিবাচক রাজনীতি করে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই এখন টিকে থাকা কঠিন হবে। যা হোক, পরিবর্তনের কথায় আসি। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রধান উৎস অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। সম্পদের বৃদ্ধি সাধন। জাতিগতভাবে সম্পদের বৃদ্ধিকে পরিমাপ করা হয় জাতীয় উৎপাদনের মাধ্যমে, যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলা হয় জিডিপি বা গ্রস ডমেষ্টিক প্রডাক্ট। প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পেলে, মোটামুটি মাথাপিছু আয় বাড়ে চার শতাংশ। দারিদ্র্যের সংখ্যা কমে যায় প্রায় আড়াই শতাংশ। রূপকল্পের ভিশন অনুযায়ী মধ্যম উন্নত দেশ হতে হলে ২০১৫ সালের মধ্যে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে অন্তত আট শতাংশ এবং তৎপরবর্তী কাল নাগাদ নয় শতাংশ এবং ২০২১ সালের পূর্বেই ১০ শতাংশ জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন।

একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সরকারের দু'টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। বাংলাদেশ মধ্যমেয়াদি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পথ ছেড়েছে ২০০২ সালে এবং সেটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকার প্রণীত পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। ২০০২ জুলাই থেকে তিন বছর মেয়াদী দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (পি,আর,এসপি) বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। সংশোধিত দ্বিতীয় পি,আর,এসপি যা এখনো বাস্তবায়নাধীন আছে যার মেয়াদ শেষ হবে জুন ২০১১ তে। এই পি,আর,এসপি নামীয় কৌশলপত্রের মূল প্রেরণাদাতা হল বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। খণ্ডিত এই পরিকল্পনা কৌশল ছেড়ে বর্তমান সরকার পুনরায় মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং জুন ২০১১ এর পূর্বেই এই পরিকল্পনা দলিল চূড়ান্ত রূপ পাবে। এই সরকারের এটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই জন্য যে, এতে ২০১৫ সালের মধ্যে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ও সেসব অর্জনের বাস্তবানুগ কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বছর এবং ভিশন ২০২১ এর আলোকে এই সরকার একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১১-২০২১)-এর রূপরেখাও প্রণয়ন করেছে যা অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রেক্ষিত পরিকল্পনার রূপরেখার ভিত্তিতেই ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী দু'টো পরিকল্পনা প্রণীত হবে। এই জন্যই একবিংশ শতকের এই দ্বিতীয় দশক হবে বাংলাদেশের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক লক্ষ্য অর্জনের অর্থনৈতিক সংগ্রাম। উলেস্নখযোগ্য হল যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ কি অর্জন করতে চায় ২০২১ সাল নাগাদ, প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় তা স্পষ্টায়ন করা হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে লক্ষ্যসমূহ নির্ধারণ ও কৌশল চিহ্নিত হয়েছে। এই দশকের উন্নয়ন কৌশলের প্রধান চালিকাশক্তি হবে বেসরকারি খাত। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হল উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন ও সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এর মধ্যদিয়েই ২০১৫ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশ কিংবা এর নীচে নামিয়ে আনা। ২০২১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ব মন্দার সময়েই মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় এবং ২০০৮-০৯ বছরে প্রদ্ধির হার ছিল ৫.৭ ভাগ এবং ২০০৯-১০ সালে ৬.০ শতাংশ। বিশ্ব মন্দার প্রেক্ষাপটে এ প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনকই বলতে হবে। তবে বর্তমান আর্থিক বছরে প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়েছে ছয় দশমিক সাত শতাংশ। জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যম হল কৃষি, শিল্প, ম্যানুফেকচারিং ও সেবামূলক কাজে উৎপাদক ও ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা শ্রেণীর অংশগ্রহণ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারও সম্পদ ও পুঁজি সৃষ্টি করে থাকে। তবে সরকারের এ বিনিয়োগ মাত্র (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী) মোট জাতীয় আয়ের চার দশমিক এক শতাংশ। এ ছাড়াও সরকার বেতন-ভাতাদি খাতে ব্যয় করে থাকে, সে ব্যয়ও জাতীয় আয়ের প্রায় সাড়ে বার ভাগ। এটা বিনিয়োগ নয় বরং সরকারী ভোগ ব্যয়। মূল কথা হচ্ছে, জাতীয় সম্পদ সৃষ্টিতে আর যে ছিয়ানব্বই শতাংশ বিনিয়োগ সে সবটাই হচ্ছে বেসরকারী বা ব্যক্তি বিনিয়োগ। এখন অর্থনীতির ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জন চাইলে এই ছিয়ানব্বই ভাগ বিনিয়োগের দক্ষতা প্রসারতার উপরই বহুলাংশে নির্ভর করে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার। মূল কথা হচ্ছে বা বাস্তবতা হচ্ছে, বেসরকারী খাতই আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের মূল বা প্রায় একমাত্র চালিকাশক্তি। এই বেসরকারী খাত বিনিয়োগে কতটা এগিয়ে যেতে পারে বা কত বেশী বিনিয়োগ করতে পারবে, তা নির্ভর করে যোগাযোগসহ অবকাঠামো খাত কতটা দক্ষ এবং সুযোগ দিতে পারে। শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য কতটা প্রয়োজনীয় জ্বালানি শক্তি পাওয়া যায় তার উপর। সড়ক জনপথ, কমিউনিকেশন বন্দরসহ শিল্প, বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে অবকাঠামো গড়ে তোলাই হচ্ছে সরকারী বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ের অন্যতম লক্ষ্য। সরকারী বিনিয়োগ এই কারণেই জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে কম হলেও গুরুত্বপূর্ণ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে যা বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হোক, তার পুরোটা বাস্তবায়ন হয় না। গত আর্থিক বছরে সর্বোচ্চ ব্যয়িত হয়েছিল একানব্বই শতাংশ। সরকারী বিনিয়োগ ব্যয়ের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কাজ না করেই কোটি টাকা ব্যয়ের নজীরও রয়েছে অতীতে এদেশে। সড়ক পাকা করার কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা যায় খোয়া উঠে যাচ্ছে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ হচ্ছে না। এখন তার প্রধান কারণ হচ্ছে প্রয়োজনীয় বিদু্যৎ বা জ্বালানির অপ্রতুলতাসহ অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ অবকাঠামো সুবিধা। আমাদের জাতীয় আয়ের বিনিয়োগ উপযোগী সঞ্চয়ের পরিমাণ হচ্ছে বত্রিশ শতাংশ, যা টাকার অংকে প্রায় দুই লক্ষ বিশ হাজার নয়শ' তিরাশি কোটি টাকা। বিনিয়োগ হচ্ছে জাতীয় আয়ের চবি্বশ শতাংশ মাত্র যা টাকার অংকে প্রায় এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার সাতশ' সাঁইত্রিশ কোটি টাকা। বিনিয়োগযোগ্য অব্যবহূত পঞ্চান্ন হাজার দুইশ' ছিচলিস্নশ কোটি টাকা যা জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশ এবং মার্কিন ডলারে সাত দশমিক ঊননব্বই বিলিয়ন টাকা। আমরা গড় যা বার্ষিক বিদেশী ঋণ সহায়তা পেয়ে থাকি তা আমাদের জাতীয় স্থূল আয়ের মাত্র এক দশমিক চুরানব্বই শতাংশ, টাকার অংকে যা প্রায় তের হাজার তিনশ' সাতানব্বই কোটি টাকা। এ অংক থেকে এটা স্পষ্ট যে আমরা আমাদের বিনিয়োগ সামর্থ্যের পুরোটা কাজে লাগাতে পারলে, বৈদেশিক ঋণ সহায়তার দ্বারস্থ হতে হয় না এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাতাদের খবরদারিত্ব মেনে নিতে হয় না। বর্তমানে জাতীয় আয়ের চার শতাংশ বিনিয়োগে গেলে জাতীয় আয় বৃদ্ধি প্রায় এক শতাংশ। জাতীয় স্থূল আয়ের (জিডিপি'র), বর্তমান ২৪ শতাংশ বিনিয়োগে আমাদের প্রকৃত বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গড় হার এখন ছয় শতাংশ। প্রতিবছর আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি চাইলে জাতীয় আয়ের বত্রিশ শতাংশই বিনিয়োজিত হতে হবে। আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে বছরে দারিদ্র্যের সংখ্যা কমে যাবে সাড়ে তিন শতাংশ হারে। ২০১১ সালের অর্থনীতির খাতে মূল চ্যালেঞ্জ হলো জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার অন্তত সাত শতাংশে পেঁৗছানো, (সরকারী টার্গেট ছয় দশমিক সাত শতাংশ)। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জনগণকে যে স্বপ্নতাড়িত করেছে, তা অর্জনের প্রায় একমাত্র নিয়ামক হল এই প্রবৃদ্ধির হার শুধু ছয় শতাংশে ধরে রাখা নয়। ক্রমান্বয়ে তা সাত এবং পরবর্তীতে আট শতাংশে পেঁৗছানো। বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হলে, দেশের মেধা-মননকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইলে, জনগণের শক্তি বিকাশের সব ব্যবস্থা হাতে নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থার উপর নির্ভর করেই ব্যক্তিখাতের সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালতি হয়ে থাকে। বাজার ব্যবস্থা হবে উন্মুক্ত, প্রতিযোগিতমূলক। বাজার সৃষ্টির প্রতিবন্ধকতা থাকলে (যেমন, যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্রুটি থাকলে বাজার সৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয়), বাজরে প্রতিযোগিতা কোন কারণে ব্যাহত হলে, বাজারে পণ্যের গুণগত মান রক্ষিত না হলে, এসব বিষয়গুলো, বাজারের তত্ত্বাবধান হিসেবে সরকারকেই দেখতে হবে। সরাসরি সরকার ব্যবসায় নামবে না বা ব্যবসা করবে না। আজকের প্রেক্ষাপটে এটিই চরম বাস্তবতা। এই আলোকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১ জানুয়ারী বাণিজ্য মেলায় উদ্বোধনী বক্তব্যে উলেস্নখ করেছেন 'ব্যবসায়ীরাই ব্যবসা করবে, সরকার ব্যবসা করবে না'। কথাগুলো তিনি সহজভাবেই গুছিয়ে বলেছেন, যার নীতিগত মূল্য অপরিসীম। সরকার ব্যবসা করলে কি লণ্ডভণ্ড অবস্থা হয়, আদমজি পাটকল ধ্বংস হয়ে যাওয়াই এর প্রকৃত উদাহরণ ( যেখানে আশি হাজার শ্রমিকের জন্য ছুটা শ্রমিক রাখা হত চলিস্নশ হাজার)। এই বক্তব্যের আলোকেই সরকারের সব লোকসানী শিল্প-কারখানা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া উচিত। মুনাফাভিত্তিক ব্যক্তিখাত সুযোগ পেলেই, গলাকাটা মুনাফা কিংবা রক্তচোষায় পরিণত হতে পারে। সে কারণেই বাজার তদারকী এবং যথাসময়ে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করে বাজারকে সঠিক ধারায় রাখার জন্য, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারকেও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে হয়।

দেশের জন্য এবং দেশের বাইরের জন্য যাতে প্রয়োজনীয় পণ্য বাজার গড়ে উঠে এবং যে পণ্য বাজার সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো বিনা বাধায় যাতে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, সার্বিকভাবে এই বিষয়গুলো দেখাই সরকারের মৌলিক ও প্রধান দায়িত্ব। সুযোগ পেলে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সুবিধা পেলে, বেসরকারী খাত অসাধ্য সাধন করতে পারে। এই বেসরকারী হাত দিয়েই আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বাধীনতার পরে এক কোটি টন থেকে এখন তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টনে পেঁৗছিয়েছি। তিনশ' মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয়কে ষোল দশমিক দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছি। ব্যক্তিখাতের ওষুধ রপ্তানির আয় এখন প্রায় এক বিলিয়ন ডলারে পেঁৗছেছে। ব্যক্তিখাতের রেমিটেন্স আয় এখন দশ দশমিক বাহাত্তর বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উন্নত প্রযুক্তির জাহাজ রপ্তানির সামথর্্যও অর্জন করেছে ব্যক্তিখাত। কাজেই ব্যক্তিখাতই হবে আমাদের উন্নয়নের চালিকাশক্তি। সেই চালিকাশক্তিকে আরো গতি দিতে সরকারকে মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক প্রয়াস নিতে হবে। সড়ক, জনপথ, বন্দরের মত ভৌত অবকাঠামো, বিদু্যৎ উৎপাদন ও জ্বালানি অনুসন্ধানের সর্বোচ্চ ব্যয়ের পরিকল্পনা এবং সেই সংগে বাজার চাহিদা উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে সরকারের জন্য এখন হবে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ ব্যয়। আমাদের প্রতিবেশী চীনে প্রবৃদ্ধির হার বার থেকে তের শতাংশ, ভারতে নয়-দশ শতাংশের বিবেচনায় আমাদের প্রবৃদ্ধির হার এখনো অনেক পেছনে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক বাংলাদেশের জন্য চিহ্নিত হতে হবে প্রবৃদ্ধির জন্য উলস্নম্ফনের দশক হিসেবে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন স্বাধীনতার দল আওয়ামী লীগ জাগিয়েছে তা বাস্তবায়নে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

সৌদি খেজুরের অর্থকরী ও পরিবেশগত দিক

Monday, January 17, 2011

মাদের দেশে যে খেজুর দেখা যায় তা বুনো বা পাতি খেজুর। বুনো খেজুরের বীজ থেকে সহজেই চারা গজায়। খোরমা খেজুরের বীজ থেকে সহজে চারা গজায় না বলে আমাদের দেশে খোরমা খেজুরের বিস্তৃৃতি হয়নি এবং খেজুর চাষ যে বহুমুখী অর্থকরী ফসল তা কখনো কেউ বিবেচনায় আনেনি।

সকলের একটি বদ্ধমূল ধারনা খেজুর মরুর দেশের ফসল। আসলে ধারনাটি সত্যি নয়, খেজুর উষ্ণ মণ্ডলীয় ফল এবং মরুর দেশের চাইতে আমাদের দেশে খেজুরের ফলন অধিক হবে পাশাপাশি ফলের মান হবে উন্নত। আর এর পেছনের কারণ হিসেবে কাজ করছে পানির প্রাপ্যতা। খেজুরই একমাত্র ফল যা স্বাভাবিকভাবে ৩ থেকে ৪ বছর সংরক্ষণ করা যায় আর তাই বিকল্প খাদ্য হিসেবে খেজুরের গুরুত্ব্ব অপরিসীম। চিনি: খেজুর ফলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চিনি থাকে তাই খেজুর পরিশোধন করে চিনি উৎপাদন করা যায়। রস: নারী-পুরুষ উভয় প্রকার খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করা যায়, যা থেকে সহজেই বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা যায়- ক) রাব; খ) গুড়; গ) চিনি; ঘ) ডরহব; ঙ) অষপড়যড়ষ; চ) অপবঃরপ ধপরফ বা ভিনেগার (প্রাকৃতিক)। কাগজ: খেজুর গাছের পাতা বিভিন্ন প্রকার মণ্ড ও কাগজ তৈরির এক উত্তম উপকরণ। কারণ এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার আলফা সেলুলোস (৫০-৫০%) ও হেমিমেলুলোস (২৬-৩০%)। অাঁশের দৈর্ঘ্য ১.২৫ মিঃ থেকে ২.৫ মি. মি. পর্যন্ত হয়। তাই খেজুর পাতা দিয়ে কাগজ তৈরিতে কোনো প্রকার সিন্থেটিক পলিমার যোগ করার প্রয়োজন হয় না। এই কাগজ ১০০ ভাগ পরিবেশবান্ধব। মাটিক্ষয় রোধ: খেজুর গাছের রয়েছে প্রকাণ্ড মূলতন্ত্র যা সোজা ও আড়াআড়িভাবে প্রায় ৫০ ফুট এবং মাটির গভীরে যায় ৭০ ফুট। পাশাপাশি অনেক খেজুর গাছ থাকলে সেগুলোর মূল মাটির গভীরে পরস্পর আড়াআড়িভাবে এক ধরনের জাল সৃষ্টি করে যা মাটি ধরে রাখতে সহায়তা করে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ: বিশাল ও মজবুত মূলতন্ত্রের কারণে খেজুর গাছ তীব্র ঝড় প্রতিরোধ করতে পারে। ঝড়ের তীব্রতা কমাতে উপকূলীয় এলাকায় খেজুরের বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সিডোর আইলা ইত্যাদির মত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা অনেক কমিয়ে দেয়। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় হারকেন এন্ড্রিউ। সেখানে তীব্র ঝড়ের পর যে ক'টি গাছ দাঁড়িয়েছিল তার প্রায় সবগুলোই ছিল পাম জাতীয় গাছ এবং তার অন্যতম ছিল খেজুর গাছ। মরুকরণ প্রতিরোধ: অন্য যেকোনো গাছের তুলনায় খেজুর গাছ মাটির গভীর থেকে অধিক পরিমাণে পানি শোষণ করে উপরে তুলে আনে বলে পানির স্তর নিচে নামতে পারে না।

পদ্মা সেতু: তদারক কমিটি গঠনের পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের

Thursday, January 13, 2011

প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নির্মাণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন তদারকি কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। এ কমিটি গঠন করা হলে সেতুর কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে ‘পদ্মা সেতুর অর্থায়ন ও কাজের গুণাগুণ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রধান অ্যালেন গোল্ডস্টেইন ওই পরামর্শ দেন। সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরস্তু খান ও বিশ্বব্যাংকের পানিসম্পদবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাসুদ আহমেদ।
সংবাদ সম্মেলনে গোল্ডস্টেইন বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের সামগ্রিক কেনাকাটাসহ অন্য সব কাজের তদারক করতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৃতীয় পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন তদারকি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর কাজ এবং পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতিসংক্রান্ত তথ্যাদি জনগণকে জানাতে দেশের গণমাধ্যমে প্রচারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা উচিত। স্বাধীন কমিটি করা হলে তাতে কাজের প্রতি জবাবদিহিতা ও অগ্রগতি বাড়বে।
সেতু নির্মাণ নিয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা থেকে এ পরামর্শ কি নাÑসাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গোল্ডস্টেইন বলেন, সরকারের প্রতি আমাদের অনেক বেশি আস্থা আছে। তবে এ ধরনের বড় ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ থাকে বেশি। তাই বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ধরনের পরামর্শ। পদ্মা সেতু নির্মাণে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, এর মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় এ প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে। বিশ্বব্যাংকের এ ঋণের টাকা ৪০ বছরে দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে আরও ১০ বছর অতিরিক্ত সময় দেওয়া হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক হাজার ১২৫ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ করা হবে ১২ কিলোমিটার। ২০১৩ সালে এ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্প শুরুর সময়ে যে ধরনের ব্যয় ধরা হয়েছিল, ব্যয় এর চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। বাড়তি এ ব্যয়ের বড় একটি অংশ পরামর্শকদের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে কি নাÑসাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গোল্ডস্টেইন বলেন, শুধু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ফি-ই নয়, মূল সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়ানো, দ্বিতল সেতু নির্মাণ ও ভূমির মূল্য বৃদ্ধিসহ সব ধরনের খরচ বাড়াতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে। প্রথমে যখন নকশা করা হয় তখন এ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। তবে গত ১০ জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী এর ব্যয় দাঁড়াবে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থের ১২ হাজার কোটি টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক, চার হাজার কোটি টাকা দেবে জাপান, এক হাজার চার কোটি টাকা দেবে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক দেবে ছয় হজার ১৫ কোটি টাকা।
১২ হাজার কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য এ যাবৎকালে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের সর্ববৃহৎ প্রকল্প বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। সাংবাদিকদের আরো বলা হয়, সেতুটির নির্মাণ শেষ হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।

হালকা প্রকৌশল শিল্পঃ কারিগরির বিস্ময় ধোলাইখালে

Wednesday, January 12, 2011

পুরান ঢাকার ধোলাইখালের দিদার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড গাড়ির নানান যন্ত্রাংশ তৈরি করে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মিলবার্ট ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই দিদার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে যন্ত্রাংশ আমদানির চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ তৈরিও করেছে তারা। নমুনা পরীক্ষা করে সনদও দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক)।

নিউ মিলবার্ট ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী নিশান রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় খুচরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেলে তাঁরা প্রতি মাসে ৫০ হাজার ডলারের যন্ত্রাংশ কিনবেন বাংলাদেশ থেকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক কম্পানিসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির ইচ্ছা জানিয়ে ই-মেইল
পাঠিয়েছে বিটাকের অতিরিক্ত পরিচালক ড. ইহসানুল করিমের কাছে।
শুধু তাই নয়, ধোলাইখালের এই দিদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উৎপাদিত যন্ত্রাংশের নমুনা সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। সৌদি আরবের ব্যবসায়ীরা নমুনা দেখে পছন্দ করে ৪৫ দিনের মধ্যে বিপুল পরিমাণ যন্ত্র কেনার প্রস্তাব করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘আমাদের পুরনো প্রযুক্তি দিয়ে এত কম সময়ে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ উৎপাদন সম্ভব কি না, তা ভেবে বেকায়দায় আছি।’
এ রকম সাফল্য হালকা প্রকৌশল শিল্পের অনেকেরই রয়েছে। যশোরের একটি প্রতিষ্ঠান লোহা দিয়ে তৈরি করেছে গম থেকে আটা তৈরির মেশিন। এ মেশিন তারা অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানিও করছে। চীন থেকে ইঞ্জিন আমদানি করে ব্যাটারিচালিত গাড়ি তৈরি করেছে বগুড়ার রহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। গাড়ির নিজস্ব শক্তি থেকে চার্জ করা ব্যাটারিচালিত এ গাড়ি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। এইচটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামের অন্য একটি প্রতিষ্ঠান ১৭ বছর আগেই নিফ ভালভ তৈরি করেছে। এটি এখন কাগজ কলের পাল্পের ফ্লো নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজধানীর লালবাগের মাফিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নানা ধরনের কমপ্লিট মেশিনারি তৈরি করছে। এর মধ্যে রয়েছে সিলিং অ্যান্ড কাটিং মেশিন, পিপিপিই ফিল্ম মেকিং মেশিন, রোটারি ডাই সিস্টেম, হিপস অ্যান্ড পিপিসেট মেকিং মেশিন, পেলু প্যাক মেশিন, পাউন্স কাটিং মেশিন।
সফটওয়্যার ছাড়া সাধারণ প্রযুক্তিতে সম্ভব এমন সব ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশই তৈরি করতে পারেন হালকা প্রকৌশল শিল্পের উদ্যোক্তারা। পাটকলের সব যন্ত্রাংশ, চা প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহƒত সিটিসি মেশিন বাদে সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, সমিলের ব্লেড বাদে সব যন্ত্র তৈরি হয় ধোলাইখালে। ইস্পাহানি চায়ের সব যন্ত্র ও মেশিন দেশি উদ্যোক্তাদের তৈরি। ধোলাইখালেই তৈরি হচ্ছে ব্যাংকের এটিএম বুথের ঘর। এ ছাড়া পরিবহন সেক্টরের প্রায় সব যন্ত্রই পাওয়া যায় এখানে। আর সেচপাম্প, পাওয়ার পাম্প, পাওয়ার টিলারসহ নানা ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে বগুড়ায়। দেশের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ মিটিয়ে এগুলো ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করা হচ্ছে।
ধোলাইখালের নিপুণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক আবুল হাশিম বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চোখের কন্টাক্ট লেন্স আমদানি করে ঢাকার এক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সঙ্গে দেওয়া টু ওয়ে কাটার দিয়ে লেন্স কাটার পরই তা ভেঙে যাচ্ছিল। আমদানিকারকরা বেকায়দায় পড়ে যান। তাঁরা আলোচনা করেন আমার সঙ্গে। আমি লেন্স আমদানিকারকদের আশ্বস্ত করে কয়েক দিন সময় নিয়ে ফোর ওয়ে কাটার তৈরি করে দিই। মহাখুশি হন আমদানিকারকরা। তাঁরা আমাকে বলেন, আপনি নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কাটার তৈরি করতে দেখেছেন; না হলে কিভাবে ধোলাইখালে বসে এ রকম যন্ত্র তৈরি করলেন আপনি?’
আশির দশকে সরকার শুল্কমুক্তভাবে ডিজেল ইঞ্জিন আমদানির সুযোগ দেয়। স্থানীয় উদ্যোক্তারা ওই ডিজেল ইঞ্জিনকে নৌ (বোট) ইঞ্জিনে রূপান্তর করেন। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সফলতা দেখান হালকা প্রকৌশল শিল্পের উদ্যোক্তারা। তাঁরা সেচপাম্পের ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে থ্রি হুইলার যান তৈরি করেন।
বিইআইওএর সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, এ শিল্পের মালিকরা যেকোনো যন্ত্র একবার মাত্র দেখেই তৈরি করতে পারেন। বর্তমানে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা প্রায় ৩৮ হাজার রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করছেন। এসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষি, বৈদ্যুতিক, যানবাহন, খেলনা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হচ্ছে। এসবের মধ্যে কাগজ ও সিমেন্ট কারখানার যন্ত্রাংশ, বাইসাইকেল, ফ্যান্সি লাইট ফিটিং, নির্মাণ যন্ত্র, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, আয়রন চেইন, কার্বন রড, অটোমোবাইল পার্টস, বৈদ্যুতিক ও স্টেনলেস স্টিল ওয়্যার রপ্তানি হচ্ছে। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে এসব পণ্য।
বিটাক আশা করছে, দেশের হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে উপযুক্ত প্রণোদনা দিতে পারলে এক দশকের মধ্যেই এটি দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হবে। জাহাজ ভাঙা লোহা থেকে তৈরি গাড়ির যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক পণ্য ও কৃষি খাতের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরির পর তা রপ্তানি করলে মুনাফাও হবে অনেক বেশি।
বিটাকের অতিরিক্ত পরিচালক ড. ইহসানুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিউ মিলবার্টের সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক কম্পানিসহ মোট তিনটি প্রতিষ্ঠান টেলিফোন ও ই-মেইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ থেকে গাড়ির পার্টস আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব দেশ এখন গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে না। তারা মূলত চীন, তাইওয়ান ও ভারত থেকে এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করে থাকে। কিন্তু ওই সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশ তুলনামূলক কম দামে যন্ত্রাংশ রপ্তানি করতে পারবে।’ তিনি আরো জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কর্মকর্তারাও বাংলাদেশ থেকে গাড়ির পার্টস আমদানির প্রস্তাব করেছেন। কানাডার বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ড. ইহসানুল করিম বলেন, ‘এসব দেশে যন্ত্রাংশ রপ্তানি করতে পারলে আমাদের আর বাজার খুঁজতে হবে না। ১০ বছরের মধ্যেই গার্মেন্টকে পেছনে ফেলে প্রধান রপ্তানি পণ্যে পরিণত হবে হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং খাত।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) দুই ঊর্ধ্বতন গবেষক নাজনিন আহমেদ ও জায়েদ বখতের ২০১০ সালের জুন মাসে করা ‘লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ : এ কেস স্টাডি’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ শিল্পের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ছয় লাখ টাকা থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত। তারা মাত্র দুই থেকে তিন লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করে। ফলে এ শিল্পে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করাও সহজ।

৪০ হাজারের বেশি কারখানাঃ বিপুল সম্ভাবনার হাতছানি

ষ্ট যন্ত্র বা যন্ত্রাংশের মতো হুবহু আরেকটি যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরিতে প্রয়োজন একই গুণাগুণসম্পন্ন লোহা। লোহায় কার্বন বা অন্যান্য উপাদানের পরিমাণ কত, তা জানতে প্রয়োজন হয় গবেষণাগারে পরীক্ষার। কিন্তু ধোলাইখালের কারিগরদের কোনো গবেষণাগার নেই।

তাঁরা লোহার টুকরোটা ওপরে ছুড়ে মারেন। সেটা নিচে পড়ার পর শব্দ শুনেই 'স্বশিক্ষিত' দক্ষ কারিগররা বুঝে ফেলেন লোহার গুণাগুণ। আবার নমুনা যন্ত্র কাটার সময় আগুনের যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়, তার লাল-নীল রং দেখেই বুঝে নেন তাতে কার্বনের মাত্রা কত।
এভাবেই অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আর মেধাকে পুঁজি করে শূন্য থেকে মহীরুহে পরিণত হয়েছে দেশের 'হালকা প্রকৌশল শিল্প' খাত। ভাঙা জাহাজের পুরনো লোহা দিয়ে তারা তৈরি করছে দামি সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। সেসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সংযোজন করেই চলছে দেশের ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা, বাইসাইকেল থেকে রেলগাড়ি পর্যন্ত।
পুরান ঢাকার ধোলাইখালসহ দেশের কয়েকটি জায়গার উদ্যোক্তা ও কারিগরদের এমন অভিনব উদ্ভাবনী ক্ষমতার বহু নজির রয়েছে।
কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় গবেষণা ও উন্নয়নের (আরঅ্যান্ডডি) দিকে মন দিতে পারছেন না এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বরং রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (অন্যকে অনুসরণ) দক্ষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ শিল্পকৌশল প্রচলিত। এ প্রসঙ্গে একজন উদ্যোক্তা বলেন, 'এ শিল্পে করপোরেট বিনিয়োগ না থাকায় আরঅ্যান্ডডি সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া নয়া প্রযুক্তি আমদানি করে কাজ করতে গেলেও আমাদের জন্য তা লাভজনক হবে না, বরং ২০ থেকে ৫০ বছরের পুরনো প্রযুক্তি পেলেই আমরা খুশি। তাই আমাদের গবেষণার প্রয়োজন নেই। ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ অনেক গবেষণা করছে। আমরা তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।'
এ শিল্পের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে ঢাকার ধোলাইখালে বিহারি ও পাঞ্জাবি মালিকরা গাড়ি মেরামতের জন্য সাত-আটটি ওয়ার্কশপ গড়ে তুলেছিলেন। ওই সময় সারা দেশে এ ধরনের মেরামত কারখানা ছিল ৫০টিরও কম। তখন এসব কারখানায় যাঁরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন, স্বাধীনতার পর তাঁরাই উদ্যোক্তা হয়ে নতুন নতুন ওয়ার্কশপ গড়ে তোলেন। তৈরি করেন নানা ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। কিন্তু এ পর্যন্ত এ খাতের উদ্যোক্তারা সরকারের কাছ থেকে কার্যত কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। প্রয়োজন পড়েনি ব্যাংক ঋণেরও। পোশাক খাতসহ
অন্যান্য শিল্পের মতো এ খাতের উদ্যোক্তাদের সমিতি দল বেঁধে যেমন সরকারের কাছে দাবিনামা তুলে ধরেনি, তেমনি সরকারগুলোও কোনো অনুকম্পা দেখায়নি এ খাতের বিকাশে। তা সত্ত্বেও দেশের চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। আর দেশের বাজারে এ শিল্পের এতটাই চাহিদা যে, ক্রেতারা প্রায়ই যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য উদ্যোক্তাদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে বুকিং দিয়ে রাখেন।
হালকা প্রকৌশল শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইআইওএ) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, এ শিল্পে সারা দেশে গড়ে উঠেছে ৪০ হাজারেরও বেশি কারখানা। এর মধ্যে ৩৬ হাজার প্রতিষ্ঠান রিপেয়ারিং সার্ভিসিং করে থাকে। বাকি প্রায় চার হাজার কারখানা নতুন যন্ত্র উৎপাদন করে। অথচ পুরো সেক্টরে ৫০ জন ইঞ্জিনিয়ারও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত কারিগরদের হাতেই তৈরি হচ্ছে মূল্যবান সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। তিনি আরো জানান, সরাসরি ছয় লাখ লোক কর্মরত হালকা প্রকৌশল শিল্পে। এ শিল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বছরে নতুন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকার। ভাঙাচোরা লোহালক্কড় থেকে তৈরি এসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশে মূল্য সংযোজন গড়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন হাজার গুণ পর্যন্ত হয়। উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে মেরামত যোগ করলে এ খাতের বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন শিল্প খাত ও পরিবহন সেক্টরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের প্রায় ৫০ শতাংশ সরবরাহ হচ্ছে এ শিল্প থেকে। দুই-আড়াই দশক আগেও এর পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। যন্ত্রাংশ ছাড়াও আস্ত নতুন যন্ত্রও তৈরি হচ্ছে ঢাকার ধোলাইখাল, বগুড়া ও যশোরের বিভিন্ন কারখানায়। এসব রপ্তানিও হচ্ছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০ কোটি ডলার আয় হচ্ছে এ খাতের রপ্তানি থেকে। জিডিপিতে এ শিল্পের অবদান প্রায় ২ শতাংশ বলে বিইআইওএ জানায়। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে সাত কোটি ৪০ লাখ ডলারের গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করে। আর হালকা প্রকৌশল শিল্প থেকেই দেশের বাজারে সরবরাহ করা হয় সাত কোটি ৫০ লাখ ডলারের যন্ত্রাংশ।
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), ইউকে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ও নরওয়ে সরকারের সহযোগিতায় সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫০ হাজার অতি ছোট এবং ১০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের হালকা প্রকৌশল শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছয় লাখ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অন্য এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এ শিল্পে কারখানার সংখ্যা ৪০ হাজার আর কর্মরত শ্রমিক আট লাখ।
হালকা প্রকৌশল শিল্পে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) নিবন্ধিত এক হাজার ২০০ উদ্যোক্তা বিভিন্ন সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে রেলওয়ে, তিতাস, বাখরাবাদ ও জালালাবাদ গ্যাস কম্পানি, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ), বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সিভিল এভিয়েশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজিএমসি) ইত্যাদি। যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করা ছাড়াও মেরামতের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজই করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা।
বিইআইওএর সভাপতি আবদুর রাজ্জাক, নিপুণ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক আবুল হাশিম, দিদার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী বাচ্চু মিয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে হালকা প্রকৌশল শিল্পে বাঙালিদের তেমন অবদান ছিল না। বিহারি ও পাঞ্জাবি উদ্যোক্তাদের হাতে ঢাকার ধোলাইখালে ইউনাইটেড ইঞ্জিনিয়ারিং, মডেল ইঞ্জিনিয়ারিং, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ও মমিন ওয়ার্কশপ গড়ে ওঠে। অবাঙালিদের এসব প্রতিষ্ঠানে পুরান ঢাকার মানুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। ওই সময় পাটকলের যন্ত্রাংশ তৈরি করত চট্টগ্রামের ইস্পাহানি ও গালফ হাবিব নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। উত্তরাঞ্চলের যানবাহনের যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতের জন্য রংপুরে একটি ওয়ার্কশপ ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে দেশ ছাড়েন। তাঁদের অনেকে এখনো সেসব কারখানা চালাচ্ছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ইস্পাহানি ও গালফ হাবিব বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের পর পাটকলগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশের অর্ডার আসতে থাকে ঢাকার ধোলাইখালের কারখানাগুলোতে। আগে থেকে ধোলাইখালে কাজ করা শ্রমিকরা তখন নতুন নতুন ওয়ার্কশপ স্থাপন করে যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ শুরু করেন।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ শিল্পে সরকারের তেমন কোনো সহযোগিতা নেই। শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল ও প্রযুক্তি আমদানি, স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফ করা কিংবা নিজেদের উৎপাদিত যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বিপণনেও ভ্যাট অব্যাহতি মেলেনি। ফলে ১০০-২০০ বছরের পুরনো হস্তচালিত মেশিনেই যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হচ্ছে। দু-তিন বছর আগে কেবল রপ্তানি আয়ের ওপর ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। তাতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা সব মিলিয়ে বছরে পান মাত্র ৫০-৬০ লাখ টাকা।
উদ্যোক্তাদের আরেকটি দাবি, কৃষি ও আইটি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বিনা সুদে ঋণের তহবিল (ইইএফ ফান্ড) আছে, সেখানে হালকা প্রকৌশল শিল্পকেও অন্তর্ভুক্ত করা হোক বা ওই তহবিলের মতো এ শিল্পের জন্যও একটি তহবিল গঠন করা হোক।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'দেশে হালকা প্রকৌশল শিল্প থেকে বড় কিছু গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা এটা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। শিল্পনীতিতে ছোট, মধ্য ও বড় কারখানা গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা আছে, সেখানে এ শিল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এমনকি হালকা প্রকৌশল শিল্পপল্লী গড়ে তোলার পরিকল্পনাও সরকারের আছে।'
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু