সপ্তাহের হালচাল- বিএনপি কি তাহলে হেরে যেত? by আব্দুল কাইয়ুম

Friday, February 7, 2014

বিএনপি হারত না, কিন্তু এখন হেরে গেছে!!! সর্বশেষ এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, সব দল অংশগ্রহণ করলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অন্তত সাড়ে ৫ শতাংশ ভোট কম পেত।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) এই জরিপ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম। তাহলে প্রশ্ন, নির্বাচনের আগে একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ভোটে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে, সেটা কি ভুল ছিল?

না, তা নয়। ওই জরিপের ফলাফলও যথার্থই ছিল। ওই সময় যদি বিএনপি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলত, ঠিক আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করব, তাহলে বিএনপির বিজয় ছিল অবধারিত। এটা মনগড়া কথা নয়। গত ২৪ জানুয়ারি রাতের ট্রেনে রাজশাহী যাচ্ছিলাম। সেখানে পরদিন গণিত উৎসব হবে। আমাদের কক্ষের বাকি দুজনের সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিলাম। তাঁরা রাজশাহীর অধিবাসী। বললেন, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি মারাত্মক ভুল করেছে। তাদের বিজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আওয়ামী লীগের সাংসদেরা বহাল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায়, এ অবস্থায় কি বিএনপিকে জিততে দেওয়া হতো? তাঁরা কথাটা উড়িয়ে দিলেন। বললেন, কারচুপির কোনো সুযোগই ছিল না। মানুষের বন্যায় সব ভেসে যেত।

আমি রাজশাহীতে গিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, নির্বাচনে গেলে মোট ছয়টি আসনের সব কটিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। কারও মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়নি। যেমন রাজশাহী-৬, বাঘা-চারঘাট আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এক লাখ ২৭ হাজার ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। এবারও তিনি জিতেছেন। বিএনপির প্রার্থী ছিল না। ছিল আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এই দুই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীর মিলিত ভোটের পরিমাণ মোট মাত্র ৯১ হাজার। গত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও প্রায় ৩০ হাজার কম! তাহলে দেখুন, আওয়ামী লীগের অবস্থান কত পড়ে গেছে। বিএনপি থাকলে তাদের বিজয় কে ঠেকাত?

দুই দিন আগে ঢাকায় সাতক্ষীরার একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ওদের ওখানে নির্বাচন হলে চারটি আসনের সব কটিতেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হতো। সেখানে মূলত জামায়াতের প্রভাব। বিএনপির তেমন প্রভাব নেই। কিন্তু কথা তো একই। জামায়াত জিতলেও তো বিএনপির ভাগেই যেত। হয়তো সদর আসনে জাতীয় পার্টি জিতত। বাকি তিনটির মধ্যে জামায়াত একটি ও বিএনপি দুটি আসন পেত। আমি ওখানের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দেখেছি, তাদের চিন্তার সঙ্গে সব মিলে যায়।

সিলেটে কথা বললাম। পরিচিতজনেরা জানালেন, সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৭টিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। আওয়ামী লীগ হয়তো দুটি আসনে জিততে পারত।

অবশ্য আলোচ্য তিন জেলায় বিএনপির পাল্লা ভারী। ফরিদপুর, দিনাজপুরসহ অন্য অনেক জেলায় হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও জিতত। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি জিতলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হতো। বিএনপি হয়তো ভেবেছিল সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনে গেলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। এই চিন্তাই তাদের কাল হয়েছে। মানুষ এখন আর কোনো দলের একাধিপত্য চায় না। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্য যে বিএনপি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেনি।

মোটের ওপর নির্বাচনে গেলে বিএনপি অনায়াসে জিততে পারত। প্রশ্ন ওঠে, অবস্থাটা যদি ওই রকমই হয়ে থাকে, তাহলে আজ কেন জরিপে মানুষ বলছে যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি কম ভোট পেত? এর কারণ হলো, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের জন্য যে মারাত্মক ও নির্মম সহিংসতার পথ ধরেছিল, তার ফলে মানুষ ক্রমে দূরে সরে গেছে। পেট্রলবোমা, ককটেল, পুলিশ হত্যা, বাস-ট্রাকের চালক হত্যা, শিশু হত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ—এর প্রতিটি কর্মসূচি মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে। কৃষক থেকে শুরু করে গরিব দিনমজুর-খেটে খাওয়া মানুষ ছিল অসহায়। অনেক ব্যবসায়ী শিল্পপতিকে লোকসান গুনতে হয়েছে।

বিএনপি যদি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করত, তাহলে মানুষের ঢল নামত বিএনপির পক্ষে। কিন্তু পরে যখন দেখল দেশকে বিএনপি সহিংসতার বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিচ্ছে, তখনই ভোটারদের মনোভাব বদলাতে থাকে। এ জন্যই নির্বাচনের আগে ও পরে জরিপের ফলাফল উল্টে গেছে। বিএনপি বলবে, ওরা কোনো সহিংসতা করেনি, করেছে জামায়াত। হতে পারে। কিন্তু তাদের মৌন সমর্থন
ছাড়া কি জামায়াতের সাধ্য ছিল সহিংসতা করার? এটা তো মানুষ বোঝে।

আরেকটি প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষে এত বিশাল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন রাস্তায় নেমে নির্বাচন প্রতিহত করল না? কারণ, মানুষ সহিংসতার পথে নয়, গণতন্ত্রের পথেই ওই একতরফা নির্বাচনকে ‘না’ বলাকে শ্রেয় মনে করেছে। দু-চারটি ছাড়া বাকি সব কটি আসনেই মানুষ বাসায় বসে থেকে, ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের একটা বড় অংশ বলতে গেলে বিএনপির সহিংসতার প্রতিও ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে। তাদের দলে দলে রাস্তায় নেমে না আসার কারণ এটাই। এখানে বিএনপি ভুল করেছে। তাদের হিসাব ছিল জনপ্রতিরোধ নির্বাচন রুখে দেবে, সরকারের পতন ঘটবে। মানুষ কিন্তু সেই মেজাজে ছিল না।

বিএনপির সহিংসতা ও একটানা হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে আজ, নির্বাচনের পর, মানুষ আগের মতো আর বিএনপিকে ঢালাওভাবে ভোট দিতে আগ্রহী না। ডিআই জরিপের ফলাফলের এটাই তাৎপর্য। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর মানুষ একটু স্বস্তি পেয়েছে। দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ-ককটেল খেতে কেউ রাজি নয়। এখন শান্তিতে চলাফেরা করা যাচ্ছে। পথেঘাটে বোমা-ককটেলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা কম। এটাই ভালো।

একটা বিষয় পরিষ্কার। বোমা মেরে সরকারের পতন ঘটানোর স্বপ্ন থেকে বিরোধী দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াত যে বৃহস্পতিবার আবার হরতাল ডেকেছে, তার বোঝা কিন্তু ওই বিএনপিকেই টানতে হবে। তাই জামায়াতের সংশ্রব ছাড়তে হবে, অথবা পরিষ্কার বলতে হবে জামায়াতের হরতাল বিএনপি সমর্থন করে না। তারা সংবাদ সম্মেলন করে, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলুক যে জামায়াতের সঙ্গে ওরা নেই।

যদি বিএনপির বোধোদয় হয় ভালো। না হলে মানুষ তার পথ বেছে নেবে। বাঙালির টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা। সেদিন প্রথম আলো কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান বলছিলেন, সাধারণ বাঙালি ইটালিতে যায়। প্রথমে রাস্তায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পথচারীদের কাছে গোলাপ ফুল বিক্রি করে দুই পয়সা কামাই করেন। একটু পয়সা জমলেই ছোটখাটো ব্যবসা খুলে বসেন। তাঁরাই দেশে টাকা পাঠান। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার সমৃদ্ধ করেন।

অবরোধের সময় আমি বাসে করে যাচ্ছিলাম। খুব ভিড়। হঠাৎ একজন আসন ছেড়ে আমাকে প্রায় জোর করে বসিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম, তিনি আমাদের পত্রিকা অফিসের সামনে রোজ বিকেলে জুতার খুচরা দোকান বসান। রমজান মিঞা। তিনি বাসে করে গুলিস্তানে যান আর সেখান থেকে জুতা কিনে এনে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেন। লাভ মোটামুটি ভালো। তিনি জানালেন, এত হরতালের মধ্যেও ক্রেতা মোটামুটি ছিল, তিনি খেয়েপরে বেঁচে আছেন। অল্পে খুশি বলেই তাঁর মুখে হাসিটি অমলিন। বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যেও তো সংসার চালাতে হবে। রোববার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বলেন, স্যার, আমাদের ব্যবসা আবার পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। রমজান মিঞাকে হাজার সালাম জানাই। তাঁরা আছেন বলেই দেশ অচল হয় না।

রাজশাহীতে কথা হচ্ছিল আলমিরা আর্টস অ্যান্ড ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী আরাফাত রুবেলের সঙ্গে। পারটেক্সের ব্যবসা করেন। নিজে ডিজাইন করেন, তাঁর আসবাব জনপ্রিয়। তিনি বললেন, রাজনৈতিক গোলযোগে যেটুকু লোকসান হয়েছিল, গত তিন সপ্তাহে পুষিয়ে গেছে। এখন কেনাকাটার ধুম পড়েছে। আর চিন্তা নেই।

এই মানুষগুলো আছে বলেই বাংলাদেশ টিকে আছে। টিকে থাকবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।

quayum@gmail.com     

বিশেষ সাক্ষাৎকার: রেহমান সোবহান- সুশীল সমাজের প্রভাব আগের চেয়ে কমেছে by আব্দুল কাইয়ুম

Tuesday, February 4, 2014

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। তিনি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এই স্বনামধন্য ও বরেণ্য অর্থনীতিবিদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম
 
প্রথম আলো : প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?
রেহমান সোবহান : গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগের ৬৫ বছরের গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ সেই ১৯৪৯ সাল থেকে প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং অবাধ নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করার মধ্য দিয়ে সব সময় ক্ষমতায় এসেছে। তাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি কতটা নষ্ট হয়েছে, সে সম্পর্কে ক্ষমতাসীন জোটের ১৫৩ জন সদস্যের চেয়ে বেশি আর কেউ সচেতন হতে পারেন না, যাঁরা একটিও ভোট না পেয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দশম জাতীয় সংসদের সদস্যের শপথ নিয়েছেন। প্রথম আলো : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? এ রকম একটি নির্বাচন কি বৈধতা দাবি করতে পারে?
রেহমান সোবহান : ৩০০ জন সাংসদের মধ্যে ১৫৩ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দশম সংসদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রকাশিত সরকারি হিসাব অনুযায়ী, অবশিষ্ট ১৪৭টি আসনের সদস্যরা ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। এসব সংখ্যার হিসাব এটাই প্রতিষ্ঠা করে যে নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে আনুমানিক ১৮ শতাংশ নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এ রকম একটি নির্বাচন ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে কোনো অংশেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওই নির্বাচনে ২৬ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোট দিয়েছিলেন বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। ১৯৯৬ ও ২০১৪ উভয় নির্বাচনেই বাস্তবতার চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে বলে দাবি করা হয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যুক্তিসংগতভাবেই প্রশ্ন ওঠার কারণে বিএনপি সরকারের বৈধতা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ওই সরকার তখন সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার প্রথম দিন থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল এবং শাসনকালের মেয়াদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা কোনো উৎসাহ পায়নি। দশম সংসদের সদস্যরা এবং তাঁদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারকে তাদের দুর্বল ম্যান্ডেট নিয়ে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না এবং মনে হচ্ছে তারা মনে করে যে বিরোধীদের যেকোনো চ্যালেঞ্জকে ব্যর্থ করে দিয়ে টিকে থাকতে পারবে। এ ধরনের মনোভঙ্গির মধ্যে আছে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।
প্রথম আলো : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিস্থিতিকে কীভাবে নেয়? কোনো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে কি?
রেহমান সোবহান : আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ, যদিও সবাই নয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার ব্যাপারে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ সচিবালয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এ ধরনের ঘটনার অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। তারা গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী পদ্ধতি প্রণয়নের লক্ষ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারত ও চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বার্তা এসেছে। পাশাপাশি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছ থেকে অভিনন্দন প্রাপ্তির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে কোনো জোরালো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে বলে এখন পর্যন্ত ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশকারী ওই দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা বঙ্গভবনে ১২ জানুয়ারি সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। কয়েকটি দেশের দূতেরা নির্বাচনের মান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও নির্বাচিত নতুন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সেই হতাশা বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। অবশ্য আজকের বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কেবল অর্থনীতি নয়, লাখ লাখ পরিবারের জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের প্রধান দুটি বাজার হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ক্ষমতা রাখে, যাতে তাদের বাজারে আমাদের রপ্তানি কমে যেতে পারে। তবে সে ধরনের আশঙ্কা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আমরা একটি সার্বভৌম দেশ এবং যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো পদক্ষেপের চড়া মূল্য যদি সাধারণ জনগণকে দিতে হয়, তখন এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জোরালো জনসমর্থন প্রাপ্তির ব্যাপারে সরকারকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারত একটি ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে?
রেহমান সোবহান : অংশগ্রহণবিহীন হলেও একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রক্ষার পথে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ভারত তুলনামূলক বেশি সহানুভূতিশীল অবস্থান নিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে, এ রকম ভালো বন্ধুও একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কদাচিৎ নির্বিকার থাকতে পারে, যাদের এবারের নির্বাচনী ম্যান্ডেট ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে অর্জিত ম্যান্ডেটের একটি ভগ্নাংশমাত্র। তা ছাড়া, ভারতের বর্তমান সরকার নিজেই একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং এ সরকার হয়তো আগামী তিন থেকে চার মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকবে না। এ ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যেকোনো সরকার তাদের বৈদেশিক নীতিতে বড় কোনো ধরনের পরিবর্তনে আগ্রহী হয় না। তাই আমাদের এমনটা আশা করা উচিত হবে না যে আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের পর নয়াদিল্লিতে নতুন একটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত খুব একটা সক্রিয় ভূমিকা নেবে।
প্রথম আলো : বিএনপি হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়ে কোনো সুফল পাবে কি?
রেহমান সোবহান : খালেদা জিয়া গত ১৫ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা হরতালের মতো কর্মসূচি বন্ধ রেখে শান্তিপূর্ণ বিকল্প উপায়ে রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাবেন বলে জানিয়েছেন। নীতি এবং প্রাজ্ঞ রাজনীতির বিবেচনায় এটি একটি সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। হরতাল হচ্ছে প্রতিবাদ করার একটি উপায়। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি গত কয়েক বছরে সব ধরনের রাজনৈতিক তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। খুব সামান্য লোক আজকাল প্রতিবাদ জানানোর লক্ষ্যে হরতাল পালন করে। এখন যেভাবে হরতাল পালিত হয় তা কেবল সহিংসতার হুমকি দিয়ে লোকজনকে কাজে যেতে বাধা প্রদানের মধ্যেই সীমিত রয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে, যাতে সুনির্দিষ্টভাবে সাধারণ নাগরিকেরাই আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় হরতাল চলাকালে হতাহতের সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ঢাকার মতো পুলিশবেষ্টিত অঞ্চলে হরতালের প্রভাব সামান্য হলেও দূরতর পাল্লার আন্তনগর যানবাহন চলাচলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া বিপণন, যোগাযোগ ও গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল নাগরিকদের দূরপাল্লার যাতায়াত বিপর্যস্ত হচ্ছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপির ভাবমূর্তি অনেকটাই নষ্ট হয়েছে, বিশেষ করে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মৈত্রীর কারণে। দলটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে রাস্তায় সহিংসতা বাড়ানোর কৌশল বেছে নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সহিংসতা তাই অত্যন্ত অজনপ্রিয় হয়েছে, যাতে করে বিএনপির আন্দোলনের কর্মসূচির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
প্রথম আলো : সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে।
রেহমান সোবহান : সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অবলম্বনের কাজটি অত্যন্ত জঘন্য এবং কাপুরুষোচিত। কারণ, জনগণের সবচেয়ে অরক্ষিত অংশটি এই সহিংসতার লক্ষ্যে পরিণত হয়, যাদের প্রতিরোধের সামর্থ্য সবচেয়ে কম। আর যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা হলে সেটা আরও নিন্দনীয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা নতুন নয় এবং রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে বেড়েই চলেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সুনির্দিষ্ট হামলার সব রকম সম্ভাবনা ছিল। কারণ, তারা চিরাচরিতভাবে আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়ে থাকে—এমন ধারণা প্রচলিত রয়েছে। অতএব, সম্ভাব্য হামলা এড়াতে নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে আরও ভালো সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। অপরাধী যে-ই হোক না কেন, এ ধরনের হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু এটিই যথেষ্ট হবে না, যেহেতু আমাদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করছে। যেকোনো সরকারের আমলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
প্রথম আলো : অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, করণীয় কী?
রেহমান সোবহান : সহিংসতা ও হরতালের কারণে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে আরও ক্ষতি হতে পারে। যেসব দিনমজুর ও কৃষক তাঁদের ফসল বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। সব ব্যবসাই নির্ভরশীল পরিবহনব্যবস্থার ওপর। পণ্য সরবরাহ ও বাজারব্যবস্থায় বিঘ্ন হলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তবে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্বল্পমেয়াদি প্রভাব, অন্তত সামষ্টিক অর্থনীতিতে, জিডিপি ও রপ্তানি বৃদ্ধির ভিত্তিতে পরিমাপ করা হয়। এটিকে অতিরঞ্জিত করা উচিত নয়। অব্যাহত রাজনৈতিক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় আসলে অনিশ্চয়তার ওপরই জোর দিতে হয় এবং যা নতুন বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর প্রভাব ফেলে এবং আমাদের রপ্তানি বাজারকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। অর্থমন্ত্রীর প্রতি সুপরামর্শ, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় অর্থনীতি রক্ষার স্বার্থে স্বল্পমেয়াদি কিছু উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের-স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করতে হবে এবং তাতে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ধরনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিরোধী দল জনস্বার্থের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রমাণ
দিতে পারে।
প্রথম আলো : কোনো অর্থবহ সংলাপের সম্ভাবনা কি এখনো আছে?
রেহমান সোবহান : সংলাপ আয়োজন করা সব সময়ই সম্ভব কিন্তু এটির কার্যকারিতা নির্ভর করবে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে মীমাংসায় পৌঁছানোর ব্যাপারে উভয় দলের সদিচ্ছার ওপর। ক্ষমতাসীন জোট যদি মনে করে যে নির্বাচনে ম্যান্ডেট অর্জনের মধ্য দিয়ে তারা সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারে যত দিন পর্যন্ত বিরোধী দল রাজপথে আন্দোলন পরিচালনার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে সরকার সংলাপের ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। এই নেতিবাচক উদ্দীপনার প্রভাব বিরোধী দলের ওপরও পড়তে পারে, যারা বিক্ষোভ-আন্দোলন অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে সম্ভাব্য আগাম নির্বাচনে (একাদশ সংসদ) জয়লাভের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার বাধ্যতামূলক উপায় মনে করতে পারে। এ ধরনের আন্দোলন থেকে চাপের মাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিএনপিকে রাজপথে জামায়াতের সহিংস কর্মকাণ্ডের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হতে হবে। সংলাপের মধ্য দিয়ে আরও গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার লক্ষ্যে উভয় জোট যদি এ ধরনের বিকৃত কৌশল পরিহার না করে, তাহলে রাজপথে সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কবলে পড়ে বাংলাদেশকে আবার একটি বছরব্যাপী অনিশ্চয়তায় পড়তে হতে পারে।
প্রথম আলো : নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি কি গণতন্ত্রে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?
রেহমান সোবহান : যেকোনো ধারণা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসহ, গ্রহণযোগ্য হবে যদি সেটি গণতন্ত্রকে উন্নীত করে এবং প্রধান দলগুলোর সমর্থন অর্জন করে। গণতন্ত্রে চিরন্তন কোনো ধারণা নেই। আসলে এটি মূলত এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যাতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে কোনো ধরনের ভয় বা জবরদস্তি বা সহিংসতার হুমকি ছাড়াই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিএনপি ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে প্রবর্তন করেছিল। এটি তৎকালীন বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দলের কাছে পরিপূর্ণভাবে অবশ্যই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ, ১৯৯৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিবেচনা করেছে। কেবল ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পরই ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যটি আলোচনায় আসে এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। নবম জাতীয় সংসদে প্রতিষ্ঠা করা হয় সংবিধান সংস্কারবিষয়ক সংসদীয় কমিটি। এটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করে। এমনকি প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে তাঁর সংক্ষিপ্ত রায়ে পরামর্শ দিয়েছেন যে নতুন বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
প্রথম আলো : এ রকম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংকটের সমাধান অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে কি?
রেহমান সোবহান : অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা।

সপ্তাহের হালচাল- ব্যাকফুটে বিএনপি by আব্দুল কাইয়ুম

Wednesday, January 22, 2014

সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণসমাবেশে জামায়াত-শিবিরকে ব্যানার নিয়ে দৃশ্যমানভাবে উপস্থিত থাকতে না দেওয়ায় এটা পরিষ্কার যে বিএনপি এখন ‘ব্যাকফুটে’ খেলতে চাচ্ছে।
তা-ই যদি না চাইত, তাহলে জামায়াতকে ঠেকিয়ে রাখবে কার সাধ্য। যদিও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে না যে তাদের কোনো নিষেধ ছিল। ওদের ব্যাখ্যা হলো, সেদিন নাকি ১৮ দলের সমাবেশ ছিল না, ছিল বিএনপির সমাবেশ। কিন্তু এসব কথা বলে জামায়াতের অনুপস্থিতির সাফাই গাওয়া যাবে না। এই মুহূর্তে জামায়াতকে একটু দূরে দূরে রাখার কৌশলের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো বিদেশি বন্ধুদের পরামর্শ। অন্যটি জামায়াতকে সঙ্গে রাখার বিপদ।

বিদেশি বন্ধুরা জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে সুস্পষ্ট দূরত্ব রাখা, সোজা কথায় তাদের সঙ্গ ছাড়ার জন্য পরামর্শ দেওয়ার পর বিএনপির পক্ষে আগের মতো করে চলা কঠিন। তাই অনেকটা ‘ব্যাকফুটে’ খেলার কৌশল নিতে হয়েছে। পাকা খেলোয়াড়েরা সব সময় পিটিয়ে খেলেন না। বিশেষত শতরান পূর্ণ করার বাস্তব সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে কিছুটা ধীরে, দেখেশুনে খেলার কৌশল নিলে দলের হতাশ হওয়ার কিছু থাকে না। বরং সবাই উত্সাহিত হয়। বিএনপি ২৯ জানুয়ারি হরতাল না ডেকে কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। আরও ভালো করেছে, অন্তত ছয় মাস শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বাইরে কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে।
যদি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে হয়, তাহলে জামায়াতকে সামনে রাখা বিপজ্জনক। যেমন সেদিন যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের দলীয়ভাবে যোগদানের সুযোগ থাকত, তাহলে মাঠের চিত্রটা একটু চিন্তা করুন। জামায়াতের টার্গেট হলো মঞ্চের সামনের পুরো জায়গাটা ব্যানার-মিছিল নিয়ে আগে থেকেই দখল করে রাখা। এটা সব সময় দেখা গেছে। বিএনপির সমাবেশে গেলে তো তাদের মহা সওয়াবের কাজ হয়। কারণ, কিছু একটা ছলছুতায় ককটেল ফুটিয়ে দোষটা সরকারের এজেন্সির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে, যখন বিদেশি বন্ধুরা জামায়াতের ব্যাপারে সন্দিহান, তখন তাদের ঢাকঢোল পিটিয়ে সমাবেশে আনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিএনপি সেই বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।
বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলেছে বটে, কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? বিএনপি কি তাদের আগের অনুসৃত রাজনৈতিক অবস্থানের পর্যালোচনা করবে না? যদি না করে, তাহলে আর লাভ কী হলো। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, তাদের দলের প্রতি মানুষের এত বড় সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কেন এখন কপাল চাপড়াতে হচ্ছে? নির্বাচনের ১০-১২ দিন আগেও তাদের দলের মধ্যে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে দিন সাতেকের মধ্যে সরকার পড়ে যাবে, নির্বাচন ভেসে যাবে। কে ভাসিয়ে দেবে নির্বাচন? সাধারণ মানুষ, নাকি কর্মীরা? নাকি জামায়াত-শিবিরই তাদের একমাত্র ভরসা ছিল? যেটাই হোক না কেন, তাদের হিসাব যে মেলেনি, বিরাট গরমিল ছিল, সেটা না বুঝতে চাইলে দলের আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু তাকে আদৌ নির্বাচন বলা যায় কি না সেটা বোধ হয় আওয়ামী লীগও বোঝে। একতরফা নির্বাচন এবং নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে পড়ায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতার লজ্জায় মাথা কাটা গেছে, এটাও ঠিক। মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা আওয়ামী লীগ উড়িয়ে দেয়নি। যদিও শর্ত দিয়েছে, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে, তারপর আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতা! তার মানে এই নির্বাচন নির্বাচন না, আরও নির্বাচন আছে।
এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক আন্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অব্যাহত রাখা এবং আগের মতোই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার কথা বলার পর বিএনপির পক্ষে সরকারের বৈধতার প্রশ্ন তুলে কঠোর লাইনে চলাও কঠিন। তাদের বিবেচনায় এটা আছে নিশ্চয়, না হলে কেন তারা বলবে যে জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঐক্য স্থায়ী কিছু নয়, কৌশলগত। আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের কথাও তো তারা বলেছে।
এ অবস্থায় জোট-ছুট যেন না হতে হয়, সে জন্য জামায়াত বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। ওরা না থাকলে যে বিএনপির আগামী দিনের আন্দোলনে বর্শাফলক হিসেবে কাজ করার কেউ থাকবে না, এ রকম একটা কিছু তারা দেখাতে চাইবে। এখন বিএনপিকে ঠিক করতে হবে, পেট্রলবোমা ও ককটেল মারার লোকের জন্য তারা জামায়াত-শিবিরের কাছে ধরনা দেবে কি না। পুলিশ ও সাধারণ নাগরিক হত্যার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দলের লোকজনকে তারা রাজনৈতিক ছাড়পত্র দেবে কি না। এসব সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
জামায়াত-শিবিরকে দূরে ঠেলে দেওয়ার সুস্পষ্ট অবস্থান না নিয়ে বিএনপি যে সেই আগের সুরে আলোচনার মাধ্যমে ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে’ দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে চলেছে, তা তো কোনো ফল দেবে না। ‘ব্যাকফুটে’ খেলতে হলে কিছু কৌশল তো বদলাতে হবে। না হলে আবার হরতাল-অবরোধের পথে কি তারা যেতে চায়?
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তত তিনটি দেশে এখন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংকট চলছে। শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন এমন নগ্নভাবে প্রভাবিত করে যে কল্পনাও করা যায় না। সেদিন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞ উত্তর প্রাদেশিক কাউন্সিল নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এসে বললেন, ওরে সর্বনাশ, বল প্রয়োগ কাকে বলে, ভোট জালিয়াতি নিয়ে কারও টুঁ শব্দটি করার উপায় নেই! এ অবস্থার মধ্যে নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকেরাও যাচ্ছেন।
থাইল্যান্ডে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে সরকার ২ ফেব্রুয়ারি যে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়েছে, বিরোধী দল তা বর্জন করে একটি অনির্বাচিত ‘পিপলস কাউন্সিল’-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি করছে। প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা হাসিমুখে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বিরোধী পক্ষের আন্দোলন-অবরোধ সত্ত্বেও তিনি অবিচল। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় বিরোধীরা দখল করে নিলে সরকার তাদের মন্ত্রণালয় অন্য ভবনে স্থানান্তর করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধীদের বিক্ষোভ দমনে কোনো রকম বল প্রয়োগ না করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। আন্দোলন-বর্জন নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। গত রোববার থাই প্রধানমন্ত্রী ইংলাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছেন।
কম্বোডিয়ার অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে ১৯৭৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হুনসেন ক্ষমতায় রয়েছেন। গত বছর জুলাই মাসের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে হুনসেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু হুনসেন নির্বিকার। নির্বাচন হয়, কিন্তু বিরোধী দল সুবিধা করতে পারে না। কারণ, হুনসেনের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল পূর্ববর্তী পলপটের খুনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে পলপট সরকার অন্তত ২০ লাখ কম্বোডীয় নাগরিককে নির্মমভাবে হত্যা করে। ‘সমাজতন্ত্রের’ নামে তারা ভিয়েতনামি, মুসলিম ও বিশেষভাবে ‘বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের’ নির্মূল করার অভিযান চালায়। যার চোখে চশমা, তাকেই বুদ্ধিজীবী বলে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়। একপর্যায়ে ভিয়েতনামের বাহিনী অভিযান চালিয়ে পলপট চক্রকে উত্খাত করে। হুনসেন সরকার ক্ষমতায় আসে। সেই থেকে ওই সরকার চলছে।
গত মাসে কম্বোডিয়ার বিরোধী দল আন্দোলন শুরু করলে বল প্রয়োগে দমন করা হয়। পোশাককর্মীদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনকে সামনে রেখে বিরোধী দল আন্দোলন করছিল। পোশাককর্মীরা মজুরি দ্বিগুণ করে ১৬০ ডলার দাবি করছিল। এরপর আন্দোলন দমন করা হয়। তখন বিরোধীদলীয় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো গার্মেন্টস শ্রমিকদের ধর্মঘট ও মিছিল বন্ধ করে কাজে যোগদানের আহ্বান জানায়। অবস্থা এখন ঠান্ডা।
আপাতত সেখানে বিরোধী দল ‘ব্যাকফুটে’ খেলছে। কারণ, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, তাদের একটা প্লাস পয়েন্ট। তারা পলপট আমলের বিভীষিকাময় অধ্যায়ের অবসানে সামনের সারিতে ছিল।
বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি এখন ‘ব্যাকফুটে’ খেলে কতটা সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারবে, তা নির্ভর করবে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ এবং হরতাল-অবরোধ-সহিংসতা বন্ধ রেখে শান্তিপূর্ণ যৌক্তিক আন্দোলনই হবে তাদের উত্কৃষ্ট দাওয়াই। এর মধ্য দিয়ে আলোচনা ও আগামী নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হতে পারে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু