বদনামের শেষ নেই এমপি বদির by বিপ্লব রহমান ও তোফায়েল আহমেদ

Tuesday, September 27, 2011

বাংলাদেশের দক্ষিণে একদম শেষ প্রান্তের সাগর-পাহাড়-বনভূমিঘেরা সুন্দর জনপদটি এখন বিষে জর্জরিত। এ বিষ ছড়িয়েছেন সেখানকার খোদ সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি। তাঁর বদনামের শেষ নেই এলাকায়। টেকনাফ ও উখিয়া নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪ সংসদীয় আসন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে এমপি বদির চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার দাপটের নজিরবিহীন সব কাণ্ড। তাঁর অপকর্মে এলাকাবাসী এখন অসহায়। বিরোধিতা করলেই নেমে আসে নির্যাতন। এমপি নিজেই মারধর করেছেন সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেককেই।
জানা গেছে, এমপিকে চাঁদা না দেওয়ায় শাহপরীর দ্বীপরক্ষা বাঁধের ঠিকাদার লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এলাকা ছেড়েছেন। সেই বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় ১০টি গ্রাম। আরো জানা গেছে, টেকনাফের সরকারি স্থলবন্দর, মিয়ানমারের চোরাই পণ্য খালাসের ঘাট, দমদমিয়ার বেসরকারি জাহাজঘাট ও সেন্ট মার্টিনের ঘাটের টোল আদায় থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য_সর্বত্রই রয়েছে এমপি বদির ভাগ। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের ভোট হাতিয়ে নিতে জঙ্গি সম্পৃক্ত একটি সন্দেহজনক এনজিওকে তিনি তোষণ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তাঁর স্বাক্ষরিত ৭৫ হাজার পরিচয়পত্রে চলছে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ।
এমপি বদির নামে বিভিন্ন সময় খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, সন্ত্রাসসহ নানা অভিযোগে মোট ২৩টি মামলা হয়েছে। অবশ্য তিনি এমপি হওয়ার পর সন্ত্রাসের দু-তিনটি মামলা বাদে সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। দুর্নীতিবাজের তালিকায়ও তাঁর নাম উঠেছে। এক-এগারোর জরুরি সরকারের সময় জেলও খেটেছেন তিনি। তাঁর দাপটে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরাও এখন কোণঠাসা। প্রকাশ্যেই নেতারা এমপি বদির অনিয়ম-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিক মিয়া ও উখিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আদিল উদ্দীন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এমপি বদি দলের নীতি, আদর্শ ও সততার রাজনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বন্দর দখল, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এমপি হওয়ার পর তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। এ ধরনের লোক দলকে ডোবানোর জন্য যথেষ্ট। লুটপাট ও সন্ত্রাসই এমপি বদির শেষ কথা। দলের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও তিনি ভয়ংকর।
তবে এমপি আবদুর রহমান বদি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাঁর সুনাম নষ্ট করার জন্যই একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা অবনতির সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমি রাজনীতি বুঝি না, দল বুঝি না, আমি দলীয় নেতা-কর্মীদেরও বুঝি না। আমার এলাকার ৭৫ হাজার লোককে ত্রাণের মাধ্যমে খুশি রাখতে পারলেই আমার রাজনীতির ষোলো আনা পূর্ণ।'
কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, গত মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের মতবিনিময় সভায় মো. শফিক মিয়া ও আদিল উদ্দীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এমপি বদির নানা কীর্তিকলাপ তুলে ধরেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান তাঁরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমপি বদি হয়ে উঠেছেন আরো বেপরোয়া।
এ বিষয়ে এমপি বদি বলেন, 'তাঁরা যে অভিযোগ করেছেন, তা সবই তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত। এগুলো দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের বক্তব্য নয়।'
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এইচ কে আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, এমপি বদির উত্থান আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে নয়। তাই দলীয় নীতি-আদর্শ নিয়ে তিনি মোটেই চিন্তিত নন। তিনি মারধর, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও চোরাচালান করে দলকে তছনছ করে ফেলেছেন। টেকনাফ বন্দরকে এমপি বদি ব্যক্তিগত বন্দরে পরিণত করেছেন। তিনি বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের নিয়ে টেকনাফ বন্দর দখল করেছেন। এ ছাড়া তাঁর পরিবারের সদস্যরাও বন্দর ও ঘাটের সব বৈধ-অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁর দাপটে আওয়ামী লীগের লোকজন কাছে ঘেঁষতে পারে না।
টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, এমপির দাপটে ঐতিহ্যবাহী পর্যটন নগরী টেকনাফ এখন পর্যটনশূন্য। টেকনাফের বদলে দমদমিয়া থেকে সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজগুলোকে চলাচলে এমপি বদি বাধ্য করছেন বলে এখানে পর্যটকরা একেবারেই আসছে না। কারণ দমদমিয়া দিয়ে জাহাজ চলাচলের আয়ে এমপির 'বাড়তি কমিশন' রয়েছে।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে বদি এমপির নানা অপকর্মের কথা।
শাহপরীর দ্বীপের দুঃখ : টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ায় বেড়িবাঁধের ৬৬০ মিটার ভাঙা অংশ মেরামত এবং বাঁধের একপাশে সিসি ব্লক বসানোর জন্য চলতি বছর দরপত্র আহ্বান করা হয়। চার কোটি ৭৫ লাখ টাকায় কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'মেসার্স উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল'। ৩০ জুন ছিল কাজ শেষ করার শেষ সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিকাদার কাজই শুরু করতে পারেননি। ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে শাহপরীর দ্বীপের ১০টি গ্রামের কয়েক শ ঘরবাড়ি প্লাবিত হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানির আশঙ্কায় চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
মেসার্স উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আতিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে কার্যাদেশ পাওয়ার পরপরই প্রকল্প এলাকায় নির্মাণসামগ্রী মজুদ করা হয়। শতাধিক শ্রমিক নিয়োগ করে কাজও শুরু করা হয়। তিন দিন পরই এমপি বদির লোকজন মোটা অঙ্কের চাঁদার দাবিতে কাজ বন্ধ করে দেয় এবং প্রকল্প এলাকা থেকে শ্রমিকদের তাড়িয়ে দেয়। ঠিকাদার আতিকুল বলেন, এরপর এমপি বদির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়ে দেন, চাঁদা না দিলে তাঁর এলাকায় কাজ করতে দেওয়া হবে না। এমপির চাঁদা দাবির বিষয়টি লিখিতভাবে গত ২২ মে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারকে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সমাধান না হওয়ায় তিনি কাজ শুরু করতে পারছেন না।
তবে এমপি আবদুর রহমান বদি কালের কণ্ঠকে বলেন, ঠিকাদার আতিকুল ইসলাম ২০১০ সালে এখানে চার কোটি ৪০ লাখ টাকার কাজ করেছিলেন। কিন্তু বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করায় সেটি স্থায়ী হয়নি, যা এখন সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে একই প্রতিষ্ঠানকে আবার চার কোটি ৭৫ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ শুরু করলে স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ জানায়। এরপর ঠিকাদার কাজ না করে পালিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গত ১৭ জুন জেলা প্রশাসক মো. গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ঠিকাদার আতিকুল ইসলাম, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইনুদ্দীন এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা শাহপরীর দ্বীপের ওই ভাঙা বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে যান। এ সময় এলাকাবাসী তাদের দুর্ভোগের কথা জানায়। এরপর ঘটনাস্থলে হাজির হন এমপি বদি। তিনি ঘটনাস্থলেই ঠিকাদার আতিকুল ইসলামের হাত ধরে টানাটানি করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ তোলেন। জবাবে ঠিকাদার তাঁকে জানান, এর আগে তিনি বেড়িবাঁধে ব্লক ফেলার কাজ পেয়ে তা সুষ্ঠুভাবে শেষ করেছেন, বাঁধ নির্মাণ তাঁর কাজের এখতিয়ারভুক্ত নয়। পরে টেকনাফে পাউবোর অতিথিশালায় জেলা প্রশাসকের বৈঠকটি চাঁদা চাওয়া না-চাওয়ার প্রশ্নে উভয়ের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে ভণ্ডুল হয়ে যায়।
সন্ত্রাস ও দখলবাজি : অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ স্থলবন্দর, হাট-বাজার, ঠিকাদারি, পরিবহন, পর্যটকবাহী জাহাজ, টার্মিনাল, জেটিসহ সীমান্ত চোরাচালান ব্যবসা পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন এমপি বদি। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ছোট ভাই আবদুল আমিন। এখন আবদুল আমিনের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকনাফ বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। আমিন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। তিনি ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
এমপির অন্য তিন ভাই মৌলভী মজিদ, আবদুস শুকুর ও মো. শফিকও বন্দরের কোনো না কোনো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এমপি বদির দুই ভগি্নপতি শওকত আলী ও আবদুল গফুর এবং আরেক ভগি্নপতি রাউজান থানার ওসি আবদুর রহমানের ছেলে নিপু, ফুপা হায়দার আলীও বন্দর ব্যবসা করছেন। এমপির চাচা মোজাহের কোম্পানি বন্দরের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করেন। এমপির নিজস্ব বন্দর বলে খ্যাত অবৈধ কাইয়ুকখালী ঘাটের চিংড়ি মাছ, কাঠ, ফলমূল আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর আরেক ভগি্নপতি গিয়াস উদ্দীন ও ফুফাতো ভাই সৈয়দ আলম। এমপি তাঁর প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমার থেকে আনা মালামাল অবৈধভাবে এ ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। এই বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। প্রতিটি মালবাহী নৌকা ও ট্রাকের জন্যও রয়েছে বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা। এ ছাড়া উখিয়া থানা প্রশাসন চলছে এমপির দুই শ্যালক হুমায়ুন কবির মন্টু ও জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর ইশারায়।
অন্যদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের চাহিদা পুঁজি করে জাহাজ জেটিতে চলে চাঁদাবাজি। ফলে পর্যটকদের খরচ অনেক বেড়ে যায়। টেকনাফের কয়েক কিলোমিটার আগে দমদমিয়ায় একটি অবৈধ বেসরকারি জেটি দিয়ে পর্যটকরা এখন টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়া-আসা করে। 'কেয়ারি সিন্দাবাদ' নামের একটি মাত্র জাহাজ দমদমিয়া ঘাট থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত মাত্র ৩৬ কিলোমিটার যাওয়া-আসার ভাড়া নেয় সাড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ সরকারি হিসাবে ভাড়া প্রতি কিলোমিটার মাত্র এক টাকা ২০ পয়সা। উপরন্তু এসব জাহাজ ভাড়ার সঙ্গে পর্যটকদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫০ টাকা করে 'বাড়তি কমিশন' আদায় করেন এমপি বদির লোকজন। অভিযোগ আছে, অবৈধ ব্যবসাটি টিকিয়ে রাখতে তিনি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল চালু করছেন না। ফলে টেকনাফ এখন পর্যটনশূন্য হয়ে পড়েছে।
তবে এমপি বদি তাঁর পরিবারের মাদক, চোরাচালান ও চাঁদাবাজির সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে এলাকায় আমাদের সুনাম রয়েছে। আমার পরিবারের সদস্যরা সবাই বৈধভাবে বহু বছর ধরে ব্যবসা করছেন। আমরা সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কর দিয়ে আসছি। রাজনৈতিক কারণে আমাকে হেয় করার জন্য বিভিন্ন মহল আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে।'
এদিকে 'অবাধ্যতার দায়ে' বিভিন্ন সময় এমপি বদি নিজেই মারধর করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছেন। গত সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের একমাত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিন পর ২২ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে মারধর করেন বদি। এরপর তাঁর হাতে প্রহৃত হন টেকনাফের বন বিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া ভোটার তালিকা তৈরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে টেকনাফের প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক আবদুল জলিল ও পুলিন দে প্রহৃত হন বদি এমপির হাতে। টেকনাফের কুলালপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হাজি মোস্তফা, কক্সবাজারের সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হাকিম, উখিয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলামুর রহমান, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য রাখালচন্দ্র মিত্রও এমপির হাতে প্রহৃত হন। টেকনাফের সাবরাং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুফিজ উদ্দিন, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিনকেও মারধর করেছেন এমপি। গত ১৫ জানুয়ারি টেকনাফ পৌর এলাকায় এমপির চাচা হাজি ইসলামের নির্বাচনী সভার ভিডিও করার সময় কক্সবাজার সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুর রহমানকে ধরে এমপি বদি বেধড়ক পিটুনি দেন। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। সবশেষ গত ৩ জুলাই আবদুর রহমান বদি টেকনাফের শামলাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আলমকে (৫২) প্রকাশ্যে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। আহত হওয়ায় পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে ছেড়ে দেয়। মঞ্জুর আলমকে উদ্ধার করতে গিয়ে শামলাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল্লাহ কোম্পানিও এমপির হাতে নাজেহাল হন। পরে আহত শিক্ষককে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সবার বড় বদি : আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার ছিলেন টেকনাফের এজাহার মিয়া ওরফে এজাহার কোম্পানি। নিরাপত্তা বাহিনীর তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ চোরাচালানির ১২ জন স্ত্রীর ২৬ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আবদুর রহমান বদি। জানা যায়, বাবার বিশাল চোরাই ব্যবসায় কিশোর বয়সেই হাতে খড়ি হয় তাঁর। বঙ্গোপসাগর দিয়ে অস্ত্র, মাদকসহ নানা চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের টানেলখ্যাত টেকনাফের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ একসময় চলে আসে বদির হাতে। রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন দলের সঙ্গেও গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক।
১৯৯৬ সালের দিকে আবদুর রহমান বদি প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করেন। সেই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে প্রথমে বিএনপির টিকিটে মনোনয়ন পাওয়ার দেনদরবার করেন। ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। একই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও পরে দলের পক্ষ থেকে তা বাতিল করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১২ জুনের নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক মো. আলী নির্বাচিত হন। নির্বাচিত এমপির ছত্রচ্ছায়ায় উখিয়া-টেকনাফের সব ধরনের বৈধ-অবৈধ ব্যবসায় ব্যাপক সাফল্য আসে তাঁর। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরে বদির অর্থ-বিত্ত ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে।
২০০০ সালের দিকে আওয়ামী লীগের সমর্থনে টেকনাফ পৌরসভার প্রশাসক হন বদি। তবে এক মাসের মাথায় দলীয় সিদ্ধান্তে তাঁকে অপসারণ করা হয়। ২০০৩ সালের পৌর নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে জয়ী হন বদি। একমাত্র জামায়াত দলীয় কমিশনারকে ১ নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান করায় দলীয় কমিশনাররা তাঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় একের পর এক ধর্ষণ, খুন, মারামারি, নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় যৌথ বাহিনীর 'অপরেশন ক্লিন হার্ট'-এর সময় বদি ছিলেন পলাতক। জোট সরকারের শেষ সময়ে টেকনাফ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন। এক-এগারোর জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেও তিনি এক দফা গ্রেপ্তার হন। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি ডজন দুয়েক মামলা থেকে একে একে খালাস পান। তবে এখনো তাঁর বিরুদ্ধে দুই-তিনটি সন্ত্রাস-মারধরের মামলা রয়েছে।
'আমি সন্ত্রাসী নই, ব্যবসায়ী' : টেকনাফ বন্দর দখল, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের বিষয়ে এমপি বদি বলেন, 'বন্দর দিয়ে আসা ৮০ ভাগ মালই আমার। তাই আমি চাঁদাবাজি করব কিভাবে? আমি ব্যবসায়ী মানুষ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ নই। আমার পরিবারের সবাই বৈধ ব্যবসায়ী। মাদক বা অন্য কোনো চোরাচালানমূলক অপরাধের সঙ্গেও কেউ জড়িত নয়। প্রতিবছর আমরা সরকারকে বিপুল পরিমাণ কর দিই। '
এমপি বদি বলেন, 'টেকনাফ বন্দরের বেশির ভাগ ব্যবসাই মিয়ানমারের সঙ্গে। মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের বেশি বিশ্বাস করেন। এ কারণে তাঁরা বেশির ভাগ ব্যবসা আমার সঙ্গে করতেই আগ্রহী। তবে আমি তো কাউকে ব্যবসা করতে বাধা দিচ্ছি না। অন্যরা চাইলেই ব্যবসা করতে পারে।'
কাইয়ুকখালী নামে নিজের অবৈধ ও ব্যক্তিগত বন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক, অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ চোরাই মালামাল ঢোকার কথা অস্বীকার করে এমপি বদি বলেন, 'এ নামে আদৌ কোনো বন্দরই নেই। আমার ব্যক্তিগত কোনো ঘাটও নেই। টেকনাফের বেশির ভাগ তরুণ-যুবক ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।'
বিভিন্ন সময় অনেককে মারধর করার বিষয়ে জানতে চাইলে এমপি বদি বলেন, 'সব ঘটনা সত্য নয়। আপনারা অনেক খবরই জানেন না। নির্বাচনী ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধরের মামলটি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন, তাই আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করব না। তবে সবশেষ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আলমকে মারধরের যে খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ওই শিক্ষক নিজেই সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ। তিনি শিক্ষক নামের কলঙ্ক। একজন স্কুলশিক্ষক কিভাবে বাজার কমিটির সভাপতি হন? তিনি শিক্ষক হয়ে কিভাবে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হন?'

কিডনি লিভার ব্যবসায় ৫৮ চক্র by পারভেজ খান

Friday, September 9, 2011

রাজধানী ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ৫৮টি অপরাধী চক্র রয়েছে যাদের ব্যবসাই হচ্ছে কিডনি ও লিভার বেচাকেনা। গ্রামের সহজ-সরল দরিদ্র মানুষই তাদের মূল শিকার। দারিদ্র্যের সুযোগে এসব সরলমনা মানুষকে তারা নানা প্রলোভনে আকৃষ্ট করে লিভার ও কিডনি কিনে নেয়। তারা ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে। এ চক্রকে নানাভাবে সহায়তা করছে দেশের কয়েকটি শীর্ষ পর্যায়ের বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর মাঠ পর্যায়ের কর্মী আর সুদ ব্যবসায়ীরা। সহায়তা করছেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কিছু অসৎ চিকিৎসক আর ক্লিনিক ব্যবসায়ীও। খোদ ঢাকাতেই রয়েছে এ রকম আটটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আর তিনটি সংঘবদ্ধ চক্র।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া জয়পুরহাটের একটি চক্রের নেতা তারেক ওরফে বাবুল, জয়পুরহাটে গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুল, সাত্তার, মোস্তফা, ফোরকানসহ র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। র‌্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের গোয়েন্দা ইউনিট এ ব্যাপারে সারা দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। ইতিমধ্যে তারা এ চক্রের সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযানও শুরু করেছে।
গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয় গ্রেপ্তার করা কিডনিচক্রের নেতা তারেক ওরফে বাবুলকে। বাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে শতাধিক কিডনি ও লিভার বেচাকেনা করেছে গত আট বছরে। অনেকের কিডনি প্রতিস্থাপন হয় দেশের বাইরেও।
বাবুল সাংবাদিকদের জানায়, সে উচ্চ শিক্ষিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে সে। টানা ছয় বছর এ চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও দুই বছর ধরে সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন গার্মেন্টের টুকরা কাপড়ের ব্যবসা করছে। চক্র পরিচালনাকালে সে ৩৫ থেকে ৪০টি কিডনি বেচাকেনা করেছে। মূলত তার কাজ হচ্ছে ক্রেতা আর বিক্রেতা জোগাড় করে তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে দেওয়া। কারো কিডনি নেওয়া হলে তাকে দেওয়া হয় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। আর ক্রেতার কাছ থেকে সে যেটা পায় তা থেকে বিভিন্ন খরচাদি বাদে তার ৩০-৪০ হাজার টাকা থাকে। বাবুল আরো জানায়, প্রথমে মানুষের সহায়তার জন্য সম্পূর্ণ মানবিক ও সেবামূলক কাজ ভেবেই
সে এতে জড়িয়ে পড়ে। এতে করে একজন দরিদ্র ব্যক্তিও টাকা পেয়ে সেটা দিয়ে জীবন চালানোর জন্য নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আবার কিডনির কারণে যে ব্যক্তিটি মারা যেতে বসেছিল, সেও আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। এসব ভেবেই সে এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাকে সহায়তা করেছে গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাকসহ স্থানীয় কয়েকটি এনজিওর কর্মীরাও। ঢাকায়ও তাদের তিনটি চক্র আছে। আছে সরকারি-বেসরকারি আটটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এ ব্যবসা শুরুর পর একপর্যায়ে ভালো আয় হওয়ার কারণে সে পেশা হিসেবেই এটাকে বেছে নেয়। পরে যখন বুঝতে পারে, এটা অপরাধ এবং তার মতো শিক্ষিত একজনের এ কাজ করা উচিত হচ্ছে না, তখনই সে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে।
বাবুলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সে বেশ কয়েকটি এনজিও ও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের নাম বলেছে। হাসপাতাল বা ক্লিনিকের চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো খোঁজখবর নিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁরা কি জেনেশুনে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এগুলো করেছেন, নাকি শুধু একজন চিকিৎসক হিসেবে তাঁরা তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন, সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর অদূরে সাভারের কয়েকটি ক্লিনিক ও হাসপাতাল সম্পর্কেও তাঁদের কাছে এ ধরনের খবর আছে। বিশেষ করে একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে, যেটার মালিক নিজেও একজন চিকিৎসক এবং তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এ চিকিৎসক নানাভাবে বিতর্কিত এবং এর আগেও একাধিকবার সংবাদ শিরোনাম হয়ে এসেছেন। তাঁর ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
গতকাল এই প্রতিবেদকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় জয়পুরহাটের দুজন কিডনি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। দুজনই তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলে, তারা দুই বছর হলো এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ, শিবগঞ্জ ও কালাই সীমান্ত এলাকায়ই এ চক্রের তৎপরতা বেশি। ঘটনাক্রমে এ চক্রের সঙ্গে স্থানীয় কয়েকটি এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীরাও জড়িয়ে পড়েছে।
দুই চক্র সদস্য জানায়, সীমান্ত এলাকার মানুষের একটি বড় অংশই অতিদরিদ্র। তাদের মূল ব্যবসা চোরাচালানের পণ্য বহন করা। দুই দেশের পুলিশ, সীমান্তরক্ষীদের দিয়ে তাদের যা থাকে তাতে সংসার চালানো কঠিন। আবার মাঝেমধ্যে মালামাল ধরা পড়লে তারা আরো বিপদে পড়ে। আর এ অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় দাদন বা সুদ ব্যবসায়ী আর এনজিওকর্মীরা ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর নাম করে টাকা ধার দেয়। এ টাকা পরে পরিশোধ করতে না পেরে তারা পড়ে যায় চাপের মুখে। পালিয়ে বেড়াতে থাকে কেউ কেউ। আর এই অবস্থায়ই এনজিওর কর্মী আর সুদ ব্যবসায়ীর দালালরা নানান প্রলোভন দেখিয়ে পরামর্শ দেয় কিডনি আর লিভার বিক্রির। ঋণ শোধের আর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আর লাখ লাখ টাকার প্রলোভনে সেসব সরল মানুষই কিডনি ও লিভার বিক্রি করে দেয়। যেসব ক্রেতার আর্থিক সামর্থ্য বেশি তারা বিক্রেতাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ভারতসহ দেশের বাইরে বিভিন্ন উন্নত দেশেও নিয়ে যায়। তবে এ চক্রের কিছু সদস্য আছে যারা কিডনি বা লিভারদাতাকে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেয় না। প্রলোভনে পড়ে কিডনি বা লিভার দেওয়ার পর তারা প্রতারিতও হয়।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জয়পুরহাটের কালাই ব্র্যাক অফিসের শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মাত্রাই ও উদয়পুর ইউনিয়নের কিডনি বিক্রেতাদের মধ্যে আটজন তাঁদের সদস্য ছিল। কিন্তু ঋণখেলাপির কারণে তারা সদস্য থেকে বাদ পড়ে। কাজেই এনজিওর প্ররোচনার কারণে তারা কিডনি বিক্রি করছে_এমন কথা ঠিক নয়।
কালাই ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বলেন, 'এনজিওগুলোর কারণে নয়, বলতে পারেন গ্রাম্য মহাজন বা দাদন ব্যবসায়ীদের কারণেই ঋণগ্রস্তরা কখনো বাড়ি বিক্রি করে, কখনো বা পলাতক থাকে। দালালদের খপ্পরে পড়ে কিডনি বেচাকেনার এ অবৈধ অপকর্ম ঢাকতে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।'
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং বিএমএর সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট শল্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, যে ব্যক্তি লিভার বা কিডনি দেয়, পারতপক্ষে তার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। লিভার নেওয়া হয় আংশিক। এতে ওই ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করতে পারে। সব কিছু আগাম পরীক্ষা করেই এ প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে এ দেশে যা ঘটছে, তা ভিন্ন। লিভার বা কিডনি বিক্রির শিকার হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণী। সমস্যাটা হচ্ছে, এরা সচেতন নন এবং চিকিৎসা নেওয়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতাও তাদের থাকত না। এ ধরনের একটি অঙ্গ বা অঙ্গের অংশ দান করার পর বা কাউকে দেওয়ার পর তার যে সেবা বা চিকিৎসা দরকার, সে ব্যাপারে তারা কতটা সচেতন, কতটা সচ্ছল আর কতটুকু করবে, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে এর হেরফের হলে তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।

কিডনি ব্যবসায় ঢাকার নামি হাসপাতাল

খোদ রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালগুলো জড়িয়ে পড়েছে অবৈধ কিডনি ব্যবসায়। দালালরা প্রথমে কিডনিদাতাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে। এরপর কিডনি গ্রহীতার তথ্য দালাল চক্রের হাতে তুলে দেন চিকিৎসকরা। বিনিময়ে কিডনিদাতাকে দেওয়া হয় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, কিডনিসহ দেহের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোপনে চুরি করে মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে এ চক্র।

অর্থের লোভ দেখিয়ে গ্রামের অভাবী মানুষকে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করছে দালালরা। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার দুটি গ্রামের বেশ কিছু লোক কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত। কিডনি কেনাবেচা চক্রের প্রধান তারেক আজিম ওরফে বাবুল চৌধুরী দেশের কিডনি ব্যবসার এমন ভয়ঙ্কর তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে তাকে রাজধানীর মিন্টো রোডের মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলে তিনি এসব তথ্য জানান। গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে তারেককে গ্রেফতার করে পুলিশ। অবৈধভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, রাজধানীর এমন পাঁচ-ছয়টি হাসপাতালের নামও জানান তারেক। তবে এসব হাসপাতালের জড়িত চিকিৎসকদের নাম বলতে রাজি হননি তিনি। তারেক আজিজের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলো। রাতেই পুলিশ কয়েকটি ক্লিনিকে অভিযান চালায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পরপরই পুলিশের কাছে তারেক পান্থপথের 'কলম্বো এশিয়া হেলথ কেয়ার' ও বনানীর 'ট্রেট ওয়ার্থ' নামে দুই ক্লিনিকের
নাম প্রকাশ করেন, যারা এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। রাতেই ডিবি তারেককে সঙ্গে নিয়ে ওই দুই ক্লিনিকে অভিযান চালায়। তবে কাউকে আটক করতে পারেনি। তারেক বলেন, এদেশের অনেক প্রভাবশালী মানুষের কাছে আমি কিডনি বিক্রি করেছি। ঢাকার নামকরা হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ কিডনি বেচাকেনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে কিডনি বেচাকেনা যে অপরাধ তা এতদিন জানতাম না।
যেভাবে কিডনি বেচাকেনা হয় : তারেক এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অকপটে স্বীকার করে বলেন, তিনি ২০০৬ সাল থেকে কিডনি বেচাকেনা করে আসছেন। এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি কিডনি বিক্রি করেছেন। প্রতিটি কিডনি বিক্রিতে তিনি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পান। আর কিডনিদাতা পান দেড় লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। তারেক জানান, তিনি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের মাধ্যমে কিডনি প্রয়োজন_ এমন লোকের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেন। মূলত চিকিৎসকদের মাধ্যমে কিডনি গ্রহীতার নাম ও ঠিকানা পাওয়া যায় বলে কিডনি কেনাবেচার টাকার ভাগ দিতে হয় তাদেরও। নাম-ঠিকানা পাওয়ার পর তাদের সঙ্গে চুক্তি করে জয়পুরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনিদাতাদের নাম সংগ্রহ করা হয়। পরে তাদের কিডনি বিক্রিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে ঢাকায় নেওয়া হয়। তারেক সাংবাদিকদের জানান, এভাবে তিনি এ পর্যন্ত সাবেক ডিআইজি আফসার চৌধুরীর স্ত্রী, সাবেক ডিআইজি নুরুল আলম ও গাজীপুরের সাবেক এক সাংসদের স্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কিডনি সরবরাহ করেছেন। এটা তার কাছে মানবিক কাজ হিসেবেই মনে হয়েছে বলে জানান তারেক। এ ছাড়া রাজধানীর 'মুমূর্ষু রোগীর জন্য কিডনি চাই' বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কিডনি সংগ্রহ করতেন তিনি। রাজধানীর বারডেম ও বিএসএমএমইউর দেয়ালে তারেকের মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। কিডনি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
যেসব হাসপাতালে কিডনির অবৈধ প্রতিস্থাপন : তারেকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর বারডেম হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশন, ল্যাবএইড, ইউনাইটেড হাসপাতাল, কলম্বো এশিয়া হেলথ কেয়ার ও ট্রেট ওয়ার্থ ক্লিনিকসহ বেশ ক'টি বেসরকারি ক্লিনিকে তিনি কিডনি সরবরাহ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করে থাকেন। তারেক বলেন, তিনি কিডনিদাতা সংগ্রহ করে শুধু ঢাকায় নয়, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালেও পাঠিয়েছেন। এ জন্য রাজধানীর পান্থপথের এক ব্যবসায়ী ও বেশ ক'জন চিকিৎসক তাকে সহযোগিতা করেন।
তারেককে জিজ্ঞাসাবাদ : ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তারেক জানান, ঝামেলা এড়াতে কিডনিদাতাকে তারা স্বজন পরিচয় দিতেন। পরে মিথ্যা হলফনামা করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে কিডনিদাতা বা গ্রহীতা কিছুই জানতে পারেন না। সবকিছুই দালাল ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ডিবির সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তারেক কিডনি বেচাকেনায় রাজধানীর কয়েকটি বড় হাসপাতালের নাম বলেছেন। তবে এর সঙ্গে জড়িতদের নাম বলেননি। তার দেওয়া প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর দুটি ক্লিনিকে অভিযান চালানো হয়। কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও দালালদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে অভিযান চালানো হবে।
ডিবির সংবাদ সম্মেলন :সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মনিরুজ্জামান জানান, রাজধানীতে কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত তিনটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন তারা। প্রতিটি গ্রুপে সাত-আটজন করে সদস্য রয়েছে। তিনি বলেন, দরিদ্র লোকজনকে নানাভাবে প্রতারণার মাধ্যমে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করে এ চক্রটি। তবে এসব দালাল কিডনিদাতাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বেশির ভাগ টাকাই মেরে দেয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জয়পুরহাটের কালাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফজলুল করিম। তিনি সাংবাদিকদের জানান, বেশ কিছুদিন আগে স্থানীয় একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়, ৫০-৬০ জন লোক কিডনি দিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছেন। খবরটি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় কালাই উপজেলার দুটি ইউনিয়নে ৩৮ কিডনি বিক্রেতার নাম-পরিচয় সংগ্রহ করেন। যারা ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারছেন না। প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধসহ তাদের শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
যেভাবে গোয়েন্দা জালে তারেক : ডিবি পুলিশ মূলহোতা তারেকের সহযোগী সাইফুল ইসলাম দাউদকে বাগেরহাটের মোল্লাহাট থেকে গ্রেফতার করে। সাইফুল বুধবার জয়পুরহাট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কিডনি বেচাকেনার কথা স্বীকার করে মূলহোতা হিসেবে তারেকের নাম জানায়। এর আগে ২৮ আগস্ট কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামের আবদুস ছাত্তার, গোলাম মোস্তফা, আবদুল করিম ওরফে ফোরকানকে এবং ৩ সেপ্টেম্বর মোশাররফ হোসেন নামে এক দালালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় তারেককে।
পুলিশ জানায়, তারেকের আসল নাম বাবুল চৌধুরী। তার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নের ছোট হোসেনপুর গ্রামে। তারেক নিজেকে কখনও তারেক হোসেন আবার কখনও তারেক আজিম বা বাবুল চৌধুরী পরিচয় দিতেন। ঢাকার কয়েকটি ব্যাংকে নামে-বেনামে তার বিপুল অঙ্কের টাকা এবং শ্যামলী ও মিরপুরে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পারে।
আইনে যা রয়েছে : মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯-এর ৯ ধারায় বলা হয়েছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুস্থ স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি অন্যের দেহে সংযোজনযোগ্য কিডনি, হৃদপিণ্ড, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, চর্ম, টিস্যুসহ ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময়ে কোনো সুবিধা লাভ, সেই উদ্দেশ্যে কোনো বিজ্ঞাপন প্রদান বা প্রচার চালাকে পারবে না। একই আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী এ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। আইনে বলা হয়েছে, আত্মীয়র মিথ্যা পরিচয়ে কেউ কিডনি বিক্রি করলে দাতা ছাড়াও ক্রেতা, সহায়তাকারী দালাল ও কিডনি সংযোজনে জড়িত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
দালাল চক্র : কিডনি ব্যবসার মূলহোতা তারেক হোসেন। তার সহযোগী ও দালাল চক্রের সদস্যরা হলো_ সাইফুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, আখতার আলম, জাহান আলম, আবদুল ওহাব, ফারুক হোসেন, রেজাউল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, সৈয়দ আলী, মোকাররম হোসেন, রুহুল আমিন, আবদুল মান্নান ও মোজাম।
আমাদের জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, বাবুল চৌধুরীকে ঢাকায় গ্রেফতারের পর গতকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জয়পুরহাটে নেওয়া হয়েছে। জেলার কালাই থানায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তারেক আজিম।
এদিকে এ মামলায় গ্রেফতার হওয়া কিডনি পাচার চক্রের দালাল সাইফুল ইসলাম দাউদ বৃহস্পতিবার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলমের আদালতে কিডনি পাচারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর গতকাল গ্রেফতার হওয়া অন্য আসামি আবদুস সাত্তার কিডনি কেনাবেচার সঙ্গে নিজে জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে উভয়েই বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ৩০ থেকে ৪০টি কিডনি পাচারে সহযোগিতা করার কথা স্বীকার করে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা বলছে
এদিকে কিডনি পাচারকারী দালাল চক্রের প্রধান রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ অনুযায়ী, নিকটাত্মীয়ের বাইরে অন্য কারও মধ্যে কিডনি আদান-প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, কিডনিদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে আত্মীয়তার সপক্ষে গ্রহণযোগ্য তথ্য-প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরই অস্ত্রোপচার করা হয়।
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক মেজর (অব.) ডা. মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে আত্মীয়তার সপক্ষে কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কি-না তা যাচাইয়ের পরই অপারেশন শুরু হয়। কাগজপত্র যাচাইয়ে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড রয়েছে। তিনি বলেন, দালালের খপ্পরসহ অন্যান্য অপকর্ম বন্ধ হোক_ সেটি আমরা চাই। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার মারপ্যাঁচে প্রতিস্থাপন চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হলে কিডনি বিকল রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বারডেম হাসপাতাল থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৫ সাল থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরুর পর ৮৯টি সফল প্রতিস্থাপন হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রণীত আইন মেনে প্রতিস্থাপন হয় এবং দাতা-গ্রহীতা উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের দলিলপত্র যথাযথভাবে পরীক্ষা এবং হাসপাতালে সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় দালাল বা তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞপ্তিতে এ অপকর্মের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের আইনানুগ শাস্তির দাবি জানানো হয়।
কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশিদ সমকালকে বলেন, বাবা-মা, ভাই-বোনের বাইরে কেউ দাতা হলে সেগুলো যাচাই করার চেষ্টা চালানো হয়। এক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আনা অঙ্গীকারনামা দেখে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিই আমরা। কিন্তু এর মধ্যে যে এত ভুতুড়ে ব্যাপার লুকিয়ে রয়েছে, তা গণমাধ্যমে প্রকাশের আগে জানা ছিল না। দালাল চক্রের মূলহোতা ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দেন। সমকালকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। দালাল চক্রের অপকর্মের সঙ্গে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা মোটেই জড়িত নন। নিয়ম মেনেই কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অপকর্মকারীদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

কিডনি প্রতিস্থাপনে অপরাধের সুযোগ by তৌফিক মারুফ

বাংলাদেশে কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপনের ব্যবসার নামে অপরাধে নেমেছে বিভিন্ন চক্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সরকারের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাব ও আইনের যথাযথ প্রয়োগে দুর্বলতার ফাঁক গলেই সহজ হয়ে উঠেছে এ অপরাধ। এই অশুভ প্রবণতা বন্ধে দেশে এখন মৃত্যুপথযাত্রীদের স্বেচ্ছায় কিডনি ও লিভার দান কার্যক্রম চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কিডনি ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, বাংলাদেশে কিডনিজনিত রোগীর সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার লোকের কিডনি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ১০ বছর আগে এর হার ছিল অর্ধেক। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ তাদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন বা তার উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না তা জানে না বলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। লক্ষণ দেখা দিলেই ছোটে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এরই মধ্যে আক্রান্তদের প্রায় ৭০ ভাগের কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। তখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালিসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ দুটোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, তাদের পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশের কিডনি রোগীদের ৪ শতাংশের ডায়ালিসিস করার সামর্থ্য আছে। দেশে বর্তমানে ৪২টি ডায়ালিসিস সেন্টার আছে। আর কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন বা কিডনি প্রতিস্থাপন সেন্টার আছে মাত্র আটটি। এসব সেন্টারজুড়ে একটি দালালচক্র অনেক আগে থেকেই তৎপর। নিরুপায় রোগীর স্বজনরা এসব দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে একদিকে যেমন কিডনি হারায়, অন্যদিকে আর্থিকভাবে প্রতারিত হয়। এদিক বিবেচনায় ১৯৯৯ সালে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন আইন হয়। এ আইনে নিকটাত্মীয় ছাড়া কারো পক্ষে কাউকে কিডনি দান সম্ভব নয়। এ ছাড়া কিডনি বা মানুষের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর চাইলেই কিডনি বা লিভার দেওয়া যায় না। প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে কিডনি প্রতিস্থাপন এ দেশে জটিল ও কঠিন। এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫০ মানুষের দেহে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর বাইরে বিদেশে আরো ৩৫০ বাংলাদেশি রোগীর দেহে দেশীয় দাতাদের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত দুই প্রক্রিয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ব্রেন ডেথ বা নিশ্চিত মৃত্যুর আগমুহূর্তে উপনীত কোনো ব্যক্তির এবং আরেকটি হচ্ছে জীবিত কোনো নিকটত্মীয়ের স্বেচ্ছায় দান করা কিডনি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেবল জীবিত কোনো নিকটাত্মীয়ের কিডনি দানের আইনগত পদ্ধতিটিই চালু। তবে কোনো রোগীর দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে তাকে বিকল্প পন্থায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় ডায়ালিসিসের। রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা ও সনোগ্রাম করে কিডনির অবস্থান ও আকার দেখা, জিএফআর অথবা সিআর ইত্যাদি পরীক্ষা করে কিডনি অকেজো কি না নির্ণয় করা হয়। কিডনি অকেজো জানার পরই ডায়ালিসিসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর একজন রোগীর সব দিক বিবেচনা করেই কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যিঁনি কিডনি দেবেন তাঁর সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক কী তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আইনানুসারে হলফনামা ও স্থানীয় নির্ধারিত জনপ্রতিনিধির সনদ দেখা হয়। এ ছাড়া দাতার শরীরের অনেক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া আরো জানান, আইন অনুসারে কিডনিদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছরের ওপরে এবং ৬০ বছরের নিচে হতে হবে। আর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার বা কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দুটি কিডনিই সম্পূর্ণভাবে ভালো থাকতে হবে। কিডনিদাতাকে স্বেচ্ছায় কিডনিদান করতে হবে, জোর করা চলবে না।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, রোগীর স্বজনরা নিকট কোনো আত্মীয়কে কিডনি দানের জন্য না পেলে কিংবা টিস্যু বা অন্য উপাদানগুলোর মিল না হলে রোগীকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকের অগোচরেই অবৈধ পথে পা বাড়ান। এতে করেই তাঁরা দালালচক্রের খপ্পরে পড়েন। দালালদের সঙ্গে হয়তো কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অসৎ চিকিৎসক বা অন্য কারো যোগসাজশ থাকলেও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই চক্র আত্মীয় নয় এমন কাউকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নিয়ে আসে, এসব ক্ষেত্রে সনদ প্রদানকারী জনপ্রতিনিধিরাও দায়ী থাকেন।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, যেমন করে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে একজন রোগীর প্রয়োজনীয় উপাদানে অমিল থাকে, তেমনি অনেক অনাত্মীয়ের সঙ্গেও যে কারো শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর মিল থাকতে পারে। দালালচক্র রোগীর স্বজনদের সঙ্গে মিলে এমন ব্যক্তিকেই দাতা হিসেবে খুঁজে বের করে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে যদি ব্রেন ডেথ বা নিশ্চিত মৃত্যুর আগমুহূর্তে উপনীত কোনো ব্যক্তির কিডনি দানের প্রচলন চালু হয়, তখন এসব অপরাধ থেমে যাবে। এজন্য সামাজিক ও মানবিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, যেমনটা হয়েছে রক্তদান বা চক্ষুদান কার্যক্রমের ক্ষেত্রে।
হাসপাতাল সূত্র মতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। এ হাসপাতালে ১৯৮৮ সাল থেকে জীবিত নিকটাত্মীয়ের কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চলে আসছে। ফলে কিডনি বিক্রির সঙ্গে জড়িত চক্রটি এ হাসপাতালেই বেশি সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এ দেশের সর্বোচ্চ এ হাসপাতালে এ চক্রের সদস্যদের খুঁজে বের করার জন্য মাঠে নেমেছে।
তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভুঁইয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই হাসপাতালে এ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর জানা নেই। এখানে যতটা সম্ভব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর তদন্ত করেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
কিডনি নিয়ে এ দেশে অবৈধ ব্যবসার কারণ সম্পর্কে কিডনি বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিজেরা কিডনি দিলেও কিডনি প্রতিস্থাপনে সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ, থাইল্যান্ডে আট থেকে ১০ লাখ এবং ভারতে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা লাগে। ফলে দেশে সরকারিভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন সহজলোভ্য হলে এই অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে।
বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, বাংলাদেশে বড় সমস্যা হলো, যার টাকা আছে, তার ডোনার নেই। আবার যার ডোনার আছে, তার টাকা নেই। ডোনার যাও পাওয়া যায় তারা হচ্ছে, লিভিং ডোনার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ব্রেন ডেথ ডোনার আছে। এতে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশে ব্রেন ডেথ কোনো ডোনার গড়ে তোলা গেলে অপরাধ কমে যাবে।
সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ১৯৯৯ সালে এ দেশে কিডনিসহ মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইন চালু হয়। আইনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথেষ্ট যৌক্তিক। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করার জন্য এ আইনটি করা হয়েছিল। এ জন্য মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ব্রেন ডেথের কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার এখানে সমস্যা হলো, একেবারে ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়নি। এ জন্য দেশব্যাপী একটা নেটওয়ার্ক গড় তুলতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যার কিডনি লাগবে এবং যে কিডনি দিতে চায়, তাদের ডাটা এন্ট্রি করা থাকে। পরে মিলে গেলে তাদের খোঁজ দেওয়া হয়। এখানে এমন প্রক্রিয়া নেই। বাংলাদেশে যদি পর্যাপ্ত পরিবেশ এবং কিডনি দেওয়া যায়, তাহলে আমরা এ প্রক্রিয়া এখনই চালু করতে পারি। এ ছাড়া লিভার ও হার্ট ট্রান্সপ্লান্টও এ দেশে সহজ হয়ে উঠছে।
স্বাস্থ্যসচিব হুমায়ুন কবীর গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে এই কিডনি বেচাকেনার খবরগুলো তাঁদের নজরে এসেছে। আগে এর ব্যাপকতা তাঁদের জানা ছিল না। ফলে সরকার এই প্রবণতা বন্ধ বা অপরাধী চক্রকে আইনের আওতায় আনতে খুব দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে তিনি জানান।

স্ত্রীকে বিক্রি!

Thursday, August 11, 2011

বিয়ের তিন দিন পর মেয়েটি (২২) জানতে পারেন, তাঁর স্বামীর আরেকটি স্ত্রী রয়েছে। এ নিয়ে তাঁদের ঝগড়া হয়। পরে মেয়েটিকে মাদারীপুরের যৌনপল্লিতে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন প্রতারক স্বামী।
খবর পেয়ে র‌্যাব-৮-এর সদস্যরা গত রোববার মেয়েটিকে মাদারীপুর শহরের পুরানবাজার এলাকার যৌনপল্লির সামনে থেকে উদ্ধার করেন; গ্রেপ্তার করেন প্রতারক স্বামী আবদুল আজিজ সরদারকে (৩৮)। আজিজকে গতকাল সোমবার আদালতের মাধ্যমে মাদারীপুর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে মেয়েটিকে তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মেয়েটির বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায়। আজিজের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ কৃষ্ণনগর গ্রামে।
উদ্ধার হওয়া মেয়ে ও তাঁর স্বামীর ভাষ্যমতে, প্রায় এক বছর আগে শ্রীপুরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গেলে আজিজের সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের তিন দিন পর মেয়েটি জানতে পারেন, আজিজের আরেকটি স্ত্রী রয়েছে। এরপর দুজনের ঝগড়াঝাঁটি হলে আজিজ মাদারীপুরে চলে আসেন। গত শুক্রবার আজিজ শ্রীপুর গিয়ে স্ত্রীকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মাদারীপুরের পুরানবাজার এলাকার যৌনপল্লিতে নিয়ে আসেন।
উদ্ধারের পর মেয়েটি সাংবাদিকদের বলেন, মাদারীপুরে বোনের বাসায় রাখার কথা বলে আজিজ তাঁকে যৌনপল্লির সর্দারনি সুরমা বেগমের কাছে রেখে যান। পরদিন শনিবার তিনি বুঝতে পারেন, তাঁকে যৌনপল্লিতে রাখা হয়েছে। তখনই স্বামীকে অনুরোধ করেন, তাঁকে সেখান থেকে আজিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু আজিজ তাঁকে জানান, ১০ হাজার টাকায় তাঁকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁকে খারাপ কাজ করতে হবে।
প্রচণ্ড দুঃখে শনিবার সারা রাত মেয়েটি কান্নাকাটি করেন। রোববার সকালে মেয়েটির ছবি তুলে যৌনপল্লির লোকজন; এবং মেয়েটি যে স্বেচ্ছায় যৌনবৃত্তিতে নেমেছেন, এ জন্য তাঁর কাছ থেকে জোর করে হলফনামায় স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে তারা।
র‌্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সিরাজুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি হলফনামায় স্বাক্ষর করতে না চাইলে তাঁকে মারধর করতে থাকে যৌনপল্লির লোকজন। খবর পেয়ে র‌্যাব-৮-এর মাদারীপুর ক্যাম্পের একটি দল মেয়েটিকে উদ্ধার ও নারী পাচারকারী আবদুল আজিজ সরদারকে গ্রেপ্তার করে।
তবে যৌনপল্লির অন্য কাউকে গ্রেপ্তার করেনি র‌্যাব। আজিজ র‌্যাব ও সাংবাদিকদের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১০ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার স্ত্রীকে বিক্রি করেছি। তবে সর্দারনি সুরমা আমাকে মাত্র ৭০০ টাকা দিয়েছেন। স্ত্রীকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে ভুল করেছি। কাজটি করা ঠিক হয়নি।’
মাদারীপুর সদর থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, উদ্ধার হওয়া মেয়েটি তাঁর স্বামী আজিজের বিরুদ্ধে থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। আজিজকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

এসব কি গুপ্তহত্যা? by গোলাম মর্তুজা

Monday, August 8, 2011

১ জুলাই, সকাল নয়টা, দয়াগঞ্জ বাজার মোড়। স্থানীয় তরুণ জুয়েল গিয়েছিল চিনি, চা-পাতা কিনতে। আর রাজীব বের হয়েছিল নাশতা করতে। এখান থেকেই এদের ধরে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল। এরা নিজেদের ‘ডিবি’ বলে পরিচয় দিয়েছিল। আরেক তরুণ ওয়ার্কশপ কর্মী মিজানুর হোসেনকেও এদের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর পাঁচ দিন পর ৫ আগস্ট এই তিনজনের মধ্যে দুজনের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের পুবাইলে রাস্তার ঢালে। ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশ থেকে পাওয়া যায় আরেক তরুণের লাশ। তিনজনেরই হাত-পা বাঁধা ছিল গামছা দিয়ে। মুখেও গোঁজা ছিল গামছা। জুয়েলের কপালের বাঁ পাশে ও গলায় আর রাজীবের মাথার চাঁদিতে গুলির চিহ্ন ছিল। মিজানের শরীরে গুলির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে তাঁর বাবা জানিয়েছেন। তিন যুবক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে পরিবারগুলো গেন্ডারিয়া ও যাত্রাবাড়ী থানায় পৃথক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিবির এ ধরনের হত্যার কালচার নেই। ডিবি আসামি ধরে, মামলা ডিটেক্ট করে, আসামি আদালতে চালান দিয়ে দেয়। ওই সময় যারা ডিবির নাম বলেছে, তারা অবশ্যই মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে।’
কারা এ গুপ্তহত্যা ঘটাচ্ছে? কী তাদের উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি। পুলিশের দায়িত্বশীল কেউ এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না।
তবে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ এস এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে বা যারাই এ ঘটনা ঘটাক না কেন, আমাদের এজেন্সিগুলো তা খুঁজে বের করবে বলে আমি আশা করি।’
তিন তরুণের পরিচয়: গাজীপুরের পুবাইল থেকে উদ্ধার হয় জুয়েল সরদার (১৮) ও মিজানুর হোসেনের (২০) লাশ। আর সিরাজদিখান থেকে উদ্ধার হয় রাজীব সরদারের (২৩) লাশ।
জুয়েল আর রাজীব চাচাতো ভাই। দয়াগঞ্জের ৩১/১ সরদারবাড়ি তাদের ঠিকানা। তাদের স্বজনেরা জানান, জুয়েল একটি এসি-ফ্রিজ মেরামতের দোকানে কাজ করত। রাজীব বড় ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনের ব্যবসা ও টিউশনি করত। মিজানুরের বাড়ি দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে। ভাইয়ের সঙ্গে ওয়ার্কশপে কাজ করত সে।
তবে মিজানুর হোসেন চার বছর আগে দয়াগঞ্জে মোহন হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামি। অন্য দুজনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অবশ্য রাজীবের এক ভাই রানা সরদার ২০০৫ সালে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়।
রাজীব আর জুয়েলের বিষয়ে জানতে চাইলে গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদ বলেন, গেন্ডারিয়া থানার কাজ শুরু হয়েছে দেড় বছর আগে। এই সময়ের মধ্যে এ দুজনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। এদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা জিডি নেই।
ওসি বলেন, ১ আগস্ট রাজীব ও জুয়েলের পরিবার তাদের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়ে থানায় দুটি জিডি করে।
যেভাবে নিখোঁজ: জুয়েলের বাবা সালাম সরদার বলেন, স্থানীয় জনি চৌধুরীর এসি-ফ্রিজ মেরামতের দোকানে কাজ করত জুয়েল। ৩১ জুলাই খুব সকালে তাদের এক জায়গায় এসি মেরামতে যাওয়ার কথা ছিল। জুয়েল ঘুম থেকে উঠে জনির বাসায় যায়। এর কিছুক্ষণ পরই শোনা যায়, বাজারের মোড়ে কারা যেন জুয়েলকে মারধর করে ধরে নিয়ে গেছে।
জুয়েলের দোকানমালিক জনি চৌধুরী জানান, সকালে জুয়েল কাজে যাওয়ার জন্য বাসায় এলে তাঁর মা জুয়েলকে চিনি ও চা-পাতা কিনতে পাঠান। টাকা নিয়ে বের হয়ে যায় জুয়েল। বেশ কিছু সময় পরও ফিরে না আসায় জনি ফোন করলে জুয়েল বলে, তাকে পুলিশ ধরেছে। এরপর জনি দয়াগঞ্জ বাজার মোড়ে যান।
জনি বলেন, ‘আমি গিয়া দেহি, সিটি তেহারির দোকানের সামনে কয়েকজন মিল্লা জুয়েলরে সমানে মারতাছে। আমি ভয়ে আর সামনে আগাইলাম না। আমি দৌড়ায়া মহল্লায় আইয়া জুয়েলের এক চাচিরে কইলাম, জুয়েলরে ডিবি ধরছে। এরপর পঞ্চায়েতের সরদার ফরিদ চাচারে কইলাম। পরে ফরিদ চাচাসহ মোড়ে গিয়া দেহি, হ্যারা কেউই নাই।’
জুয়েলের বাবা সালাম সরদার বলেন, ‘বাজারের মোড়ে গিয়া আমরা শুনি, ডিবির লোক আইছিল। সাদা মাইক্রোতে জুয়েল আর রাজীবরে তুইল্লা নিয়া গ্যাছে। তারা ওইহানেই মাইরা জুয়েলের মাথা ফাটায়া ফালাইছে। এই সময় একটা পোলা আবার দৌড় পাইড়া ভাগছে।’
রাজীবের ভাই রনি সরদার জানান, সকালে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নাশতা করার জন্য বের হয় রাজীব। এর একটু পরেই শোনা যায়, রাজীবকে ধরে নিয়ে গেছে ডিবি।
দয়াগঞ্জ বাজার মোড়ে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী জানান, ওই দিন সকালে সশস্ত্র কয়েকজন লোক সিটি তেহারির দোকানের সামনে জুয়েল আর রাজীবকে পাকড়াও করে। এ সময় জুয়েল তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু করে। একপর্যায়ে তারা দুজনকে ধরে কী যেন জিজ্ঞেস করতে করতে মারতে থাকে। এ সময় মনে হয়, জুয়েলের মাথাও ফেটে যায়। স্থানীয় কয়েকজন এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে ওই লোকগুলো নিজেদের ‘ডিবির লোক’ পরিচয় দেয়। তারা তাদের আশপাশে কাউকে ভিড়তে দেয়নি। তাদের হাতে ছোট পিস্তল ও শটগান ছিল।
একটি রেস্তোরাঁর কর্মী বলেন, রাস্তার ওপর দুজনকে পেটাতে দেখে সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ ভ্যান ওইখানে দাঁড়ায়। এ সময় জুয়েল আর রাজীবকে মারধরকারী ব্যক্তিদের একজন এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয়পত্র দেখালে সেনাবাহিনীর পিকআপটি চলে যায়। একটু পরেই সাদা একটি মাইক্রোবাসে রাজীব আর জুয়েলকে তুলে নিয়ে যায় তারা। এ সময় এক যুবক দৌড়ে পালিয়ে যায়।
জুয়েল আর রাজীব স্থানীয় হওয়ায় তাদের এলাকার প্রায় সব ব্যবসায়ীই চেনেন। স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, ওই দিন এলাকার অনেক ব্যবসায়ীই জুয়েল আর রাজীবকে হাতকড়া লাগিয়ে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন। প্রথমে কেউ কেউ ভেবেছিলেন, স্থানীয় যুবকদের মধ্যে মারামারি লেগেছে। মুরব্বিরা এগিয়ে এলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই দলটির একজন বলেন, ‘আমরা ডিবির লোক। আমাদের কাজ করতে দেন, এখানে ভিড় করবেন না।’
নিহত মিজান হোসেনের বাসা ৩৬ বি দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী। সেখানে তার বাবা ফারুক হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। ফারুক জানান, ৩১ জুলাই সকালে কাজে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল মিজান। রাজীব তাকে ফোন করে ডেকে নেয়। ওই দিন দুপুরে তাঁকে একজন খবর দেন যে মিজানকে ডিবি ধরে নিয়ে গেছে।
ফারুক হোসেন বলেন, তাঁদের সঙ্গে রাজন নামের করাতিটোলার এক তরুণকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই দলটি ধরেছিল। পরে রাজন দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়। এখন আর রাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
খোঁজাখুঁজি: রাজীব ও জুয়েলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা গেন্ডারিয়া থানা, মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়, মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়, র‌্যাব-১০, র‌্যাব-৩ এবং অন্যান্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাননি।
রাজীবের ভাই রনি সরদার বলেন, ‘থানায় যাওয়ার পর প্রথমে থানা জিডি নিতে চায়নি। থানার এক দারোগা কইল, হয়তো সন্দেহ করে আটক করছে। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ হইলে ছাইড়া দিব। এই কতা শুইনা আমার মায় একটু সান্ত্বনা পাইল।’
গেন্ডারিয়া থানা থেকে একই রকম সান্ত্বনার বাণী শুনেছেন জুয়েলের বাবা সালাম সরদারও। তিনি বলেন, ‘থানায় যাওয়ার পর দারোগারা কইছে, চিন্তা কইরেন না, ডিবি ধরলে তদন্ত শ্যাষে ছাইড়া দিব।’
মিজানের বাবা ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি সব জায়গায় খুঁইজাও কোথায় পাইনি। যাত্রাবাড়ী থানায় জিডি করতে গ্যালে ডিবির কথা হুইনা হ্যারা প্রথমে জিডি নিতে চায়নি। এক দিন পর নিছে।’

নুরুল ইসলাম হত্যা মামলাঃ বিপ্লবের নেতৃত্বেই অপহরণ ও খুন

Friday, July 22, 2011

ক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র আবু তাহেরের ছেলে এ এইচ এম বিপ্লবের নেতৃত্বেই বিএনপির নেতা ও আইনজীবী নুরুল ইসলামকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়। তাহেরেরই বাসায় লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনাটির এই বর্ণনা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার রায়ে উল্লেখ রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক এম হাসান ইমাম ২০০৩ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলাটির রায় দেন। রায়ে বিপ্লব ও তাঁর ভাই আবদুল জব্বার ওরফে লাভুসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড, বিপ্লবের আরেক ভাই টিপুসহ নয়জনকে যাবজ্জীবন এবং দুজনকে পাঁচ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
রায়ে শিমুল কুমার দেবনাথ নামে আসামির দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০০২ সালের ১৩ মার্চ লক্ষ্মীপুরের আদালতে দেওয়া ওই জবানবন্দিতে নুরুল ইসলামকে অপহরণের প্রস্তুতি থেকে লাশ টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে মাইক্রোবাসে ওঠানো পর্যন্ত ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে নুরুল ইসলামকে লক্ষ্মীপুরের বাসা থেকে অপহরণ এবং পরে হত্যা করা হয়।
রায় ঘোষণার সময় চট্টগ্রাম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ছিলেন কামরুল ইসলাম। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল ইসলাম হত্যা মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর আগেই রাষ্ট্রপতি একজন আসামির সাজা যেভাবে মওকুফ করেছেন, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিতে পারে।
দণ্ডিত আসামি যাঁরা: দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিপ্লব ছাড়াও আবদুল জব্বার ওরফে লাভু (তাহেরের পালক ছেলে), আলমগীর হোসেন, জিকো, তানভীর হায়দার চৌধুরী ওরফে রিংকু ও জিয়াউর রহমান ওরফে শিপনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় আবদুল খালেক, আবদুল গণি, পরাণ, জাকির হোসেন, মেহেদী, টিপু (তাহেরের আরেক ছেলে), মাহফুজ, মারজু ও শিমুলকে। এ ছাড়া পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড হয় দীনেশ ও দুলালের।
রায়ে যা বলা হয়: রায়ে বলা হয়, শিমুলের জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনার রাত নয়টা থেকে ১১টার মধ্যে আসামি বিপ্লব, লাভু, জিকু, খালেক, গণি, রিংকু, পরাণ, জাকির, মেহেদী, টিপু, মাহফুজ ও মারজু গং তমিজউদ্দিনের মাঠের পেছনে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়ে বসে মদ পান করে। এরপর রাত ১২টার মধ্যে বিপ্লবের নেতৃত্বে আসামিরা মাহফুজের গাড়িতে করে নুরুল ইসলামের বাসায় যান। এর ৪৫ মিনিট পর ওই মাইক্রোবাসে করে তাঁরা নুরুল ইসলামকে তুলে আবু তাহেরের বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর আসামি টিপু, লাভু, শিপন ও রিংকু আইনজীবী নুরুল ইসলামকে রামদা ও ছেনি দিয়ে কেটে টুকরো টকরো করেন। লাশের টুকরোগুলো দীনেশ, দুলাল ও শিমুলকে বস্তায় ভরার জন্য নির্দেশ দেন বিপ্লব ও লাভু। তাঁরা লাশের টুকরোগুলো বস্তায় ভরে মাহফুজের গাড়িতে ওঠান। এরপর লাশের বস্তা নিয়ে বিপ্লব, লাভু, জিকো, খালেক, গণি, রিংকু, শিপন ও মেহেদী ওই গাড়িতে করে মজু চৌধুরীর হাটের দিকে যান।
রায়ে বলা হয়, সাক্ষী ফাতেমা বেগম (নুরুল ইসলামের প্রতিবেশী) সাক্ষ্যে সুস্পষ্টভাবে বলেন, ঘটনার রাত ১২টা-সাড়ে ১২টার দিকে নুরুল ইসলামের বাসার সামনের কক্ষে বসে কাজ করা অবস্থায় হঠাৎ প্রথমে ফটক ভাঙার শব্দ শোনেন। বাইরে থেকে সন্ত্রাসীরা নুরুল ইসলামকে ঘর থেকে বের হতে বলে। নুরুল ইসলাম ভয়ে ঘরের ভেতর খাটের নিচে আশ্রয় নেন। সন্ত্রাসীরা দরজা ভেঙে সেখান থেকে তাঁকে বের করে নিয়ে আসে। এ সময় নুরুল ইসলাম তাঁকে হত্যা না করতে বিপ্লবকে অনুরোধ করেন। এরপর আসামিরা নুরুল ইসলামকে টেনেহিঁচড়ে বের করে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে দ্রুতগতিতে মাদামের (তাহেরের বাসা) দিকে যায়।
রায়ে বলা হয়, আরেক সাক্ষী নূর মোহাম্মদ পাটোয়ারী হলেন ফাতেমা বেগমের প্রতিবেশী। পাটোয়ারী সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার রাতে বিপ্লবসহ ৮-১০ জনকে নুরুল ইসলামকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে দেখেছেন। সাক্ষী হারুনুর রশিদও বলেন, তিনি দেখেছেন, নুরুল ইসলামের চোখ বেঁধে বিপ্লব, লাভু, জাকির, পরাণ, মেহেদী, জিকো, খালেক ও গণি নিয়ে গেছেন।
রায়ে বলা হয়, ‘উপরোক্ত সাক্ষ্য থেকে আসামি শিমুল কুমারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ঘটনার রাতে আসামি বিপ্লব, লাভু, জিকো, খালেক, গণি, রিংকু, পরাণ, জাকির, মেহেদী, টিপু, শিপন, মাহফুজ এবং অন্যান্য কর্তৃক নুরুল ইসলামকে তাঁর বাসা থেকে অপহরণের ঘটনাটি সুস্পষ্টভাবে সমর্থিত হয়েছে।’
যাঁরা খালাস পান: বিচারক রায়ে এই মামলার আসামি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান আবু তাহের, তাঁর স্ত্রী নাজমা তাহের, ভায়রা হাসু চেয়ারম্যানসহ ১৫ আসামিকে খালাস দেন।
রায়ে বলা হয়, যদিও তাজুল ইসলাম নামের এক সাক্ষী বলেছেন, আবু তাহের, নাজমা তাহের, হাসু চেয়ারম্যান, বাবর, কাশেম জিহাদী গং নুরুল ইসলামকে অপহরণপূর্বক হত্যা করে লাশ গুম করেছেন। তাজুলের এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন সাক্ষী রাশিদা ইসলাম, আইনজীবী মনিরুল ইসলাম ও কবিরুল ইসলাম। যদিও এই সাক্ষীদের জানার উৎস ছিলেন ফাতেমা বেগম। ফাতেমা বেগম স্বয়ং তাঁর সাক্ষ্যে এসব আসামির নাম উল্লেখ করেননি। সাক্ষী তাজুল, রাশিদা ইসলাম ও মনিরুল তদন্ত কর্মকর্তাদেরও এসব আসামির নাম ঘটনার পরপর বলেননি।
রায়ে বিচারক আরও বলেন, ‘আমার বলতে দ্বিধা নেই, রাষ্ট্রপক্ষ আসামি আবু তাহের, নাজমা তাহের, হাসু চেয়ারম্যান, সাজু, মাহবুব, মানিক, আবুল কাশেম জিহাদী, নুরুল আজিম বাবর, রিপন, সুমন, জামাল, কাজল, জাহাঙ্গীর, আবদুল মতিন ও জসিমউদ্দিন ওরফে সাংবাদিক জসিমের বিরুদ্ধে আনীত দণ্ডবিধির ১২০(বি)/৩০২/২০১/৩৪ ধারায় অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।’
বিপ্লবের সাজা মওকুফের চিঠি বিচারিক আদালতের নথিতে সংরক্ষণ: বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মওকুফ-সংক্রান্ত লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষের চিঠি বিচারিক আদালতের নথিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক রবিউল হাসান গতকাল চিঠিতে ‘দেখিলাম’ লিখে এর নিচে সই করেন। এরপর তা নথিতে সংরক্ষণ করা হয়।
আদালত সূত্র জানায়, বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ-সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়। লক্ষ্মীপুর কারা কর্তৃপক্ষ এ-সংক্রান্ত আদেশ ১৪ জুলাই কার্যকর করে। ওই দিন এ-সংক্রান্ত আদেশের চিঠি লক্ষ্মীপুর কারা কর্তৃপক্ষ বিচারিক আদালতে পাঠায়।
প্রথম আলোর রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি জানান, নুরুল ইসলামের ভাই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শামছুল ইসলাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন-চার দিন ধরে প্রতি রাতে নম্বরপ্লেটবিহীন মাইক্রোবাসে করে সন্ত্রাসীরা এসে আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে অবস্থান করছে। এতে আমরা চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছি।’
যোগাযোগ করা হলে লক্ষ্মীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘নুরুল ইসলামের গ্রামের বাড়িতে রাতে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা সম্পর্কে আমি অবগত নই। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নূহার জন্য শোকগাথা by ওমর ফারুক

Friday, July 15, 2011

'মা, তুমি কক্সবাজার চলে এসেছ। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো তোমার প্রিয় কক্সবাজার। আমার কথা যেন বুঝতে পারছিল ও। গুলিতে তার ডান চোখটা বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার চিৎকার শুনে সে বাঁ চোখ দিয়ে তাকাল। তখন যেন সারা দুনিয়াকে দেখে নিয়েছিল ওই একটি চোখেই, এক তাকানোতেই। শেষ পর্যন্ত চোখ খোলা রেখেই আমাদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় আমার প্রিয় সন্তান। আমার হৃদয়ের টুকরো।' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কম্পানির কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক তরুণ।
মেয়ের বায়না ছিল কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। গত ৩০ জুন কক্সবাজারের চকরিয়া এলাকা দিয়ে মাইক্রোবাসে যাচ্ছিলেন তাঁরা। হঠাৎ ডাকাতরা গুলি চালায়। একটি গুলি তরুণের বাঁহাত ভেদ করে তাঁর কোলে ঘুমিয়ে থাকা নুহার মাথায় আঘাত করে।
'নূহা প্রায় দিনই আমার বুকের ওপর ঘুমাত। মেয়ে সামান্য ব্যথা পেলেও সে ব্যথা যেন লাগত আমার গায়ে। আর সেই সন্তানের মৃত্যু হলো আমার কোলেই।' কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন জহিরুল হক তরুণ। 'ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে আমার কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছিল ও। কিন্তু আর জেগে দেখতে পেল না পৃথিবীর আলো। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বাবার কোলে শিশুরা নিরাপদ। কিন্তু আমার কোলে থাকা অবস্থায় আমার মেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। আমি কেন পারলাম না আমার প্রিয় সন্তানকে বাঁচাতে?' তরুণের কণ্ঠে হাহাকার।
নূহার মা মুনমুন ওরফে মুনও শোকে পাথর। তিনি কী বলবেন, কোনো ভাষাই যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শুধু বললেন, 'কোনো দিন গুলির শব্দ শুনিনি। সে দিন শুনলাম। আর সেই গুলিই কেড়ে নিল আমার সন্তানকে। এই কষ্ট কিভাবে সহ্য করব আমি।'
যেভাবে ঘটনা : তরুণ কালের কণ্ঠকে জানান, ৩০ জুন একটি মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি, তাঁর স্ত্রী মুনমুন, মেয়ে নূহা, বন্ধু রিপন, সহকর্মী জাফর ও রিপনের ছোট ভাই সাজ্জাদ ও আজাদ। বিকেল ৩টার দিকে তাঁরা ঢাকা থেকে রওনা দেন। ওই দিন ছিল প্রচণ্ড বৃষ্টি। রাস্তার অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে গাড়ি খুব দ্রুত যেতেও পারছিল না। পথে মিরসরাইসহ কয়েকটি স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যেতে আরো দেরি হয়। রাত হয়ে যাওয়ায় ও বৃষ্টির কারণে রাস্তার পাশের হোটেলগুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে সবাই ক্ষুধার্তও ছিলেন সে দিন। চকরিয়ায় গিয়ে ভালো হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করবেন_এ চিন্তায় চালক জাকিরকে দ্রুত চালাতেও তাড়া দিচ্ছিলেন তরুণ। চট্টগ্রাম পেরোতে পেরোতে রাত দেড়টা বেজে যায়। পটিয়ায় গিয়ে মাইক্রোবাসে গ্যাস নেওয়ার সময় নূহা পেছনে তার মায়ের কোল থেকে গিয়ে বাবার কোলে ওঠে। তরুণ তাকে নিয়ে চালকের পাশের সিটে বসেন। কিছু দূর গিয়ে দেখতে পান একটি ট্রাক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। যে কারণে সেখানে অনেক গাড়ি সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেকটা সময়। ক্ষুধার কথা বলে বাবার কোলেই একপর্যায়ে ঘুমিয়ে যায় নূহা।
সেই মুহূর্তটি : ডুলাহাজারার পর খুটাখালী মেদাকচ্ছপিয়া এলাকায় মোড় নেওয়ার সময় দেখা যায় রাস্তার ওপর গাছের ডাল ফেলে রাখা হয়েছে। তখন রাত ৩টার মতো বাজে। তরুণ সমূহ বিপদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে চালককে বললেন, ডালটি পেরিয়ে দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য। চালক খানিকটা ধীর গতিতে ডাল পেরিয়েও যায়। ঠিক ওই সময় বিকট একটি শব্দ হয়। ভেঙে যায় গাড়ির গ্লাস। সবাই বুঝতে পারেন গাড়িতে গুলি করা হয়েছে। তীব্র ব্যথা অনুভব করে তরুণ বললেন, তাঁর বাঁহাতে গুলি লেগেছে। ঠিক তখন তাঁর বন্ধু রিপন চিৎকার করে উঠে বলেন, তোমার মেয়ের দিকে তাকাও। তরুণ দেখেন, নূহা কোলেই ঢলে পড়েছে। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। বুঝতে বাকি রইল না গুলি তাঁর হাত ভেদ করে মেয়ের মাথায় আঘাত করেছে। দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানেই নূহাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তরুণ বলেন, 'আমি কী মনে করে মেয়ের বুকে চাপ দিয়েছিলাম। দেখলাম সে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। হাসপাতালে যখন চিকিৎসা দিচ্ছিল ডাক্তার তখন আমি চিৎকার করে বললাম, 'মারে তুমি কক্সবাজার চলে এসেছো। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো। আমার মেয়ে যেন তখন আমার কথা বুঝতে পারছিল। সে বাঁ চোখ দিয়ে তাকায়। চোখ খোলা রেখেই আমাদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় সে।'
তরুণ বলেন, 'সেদিন যদি ডাল দেখে দাঁড়িয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না। আমি আবার যদি সেই দিনটিতে ফিরে যেতে পারতাম।'
মর্মান্তিক এ ঘটনার পর মেয়ের লাশ নিয়ে তরুণ নোয়াখালী গ্রামের বাড়ি চলে যান। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করে ফিরে আসেন ঢাকায়। ঘটনার পর থেকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী স্বাভাবিক হতে পারছেন না। পুরো পরিবার বিপর্যস্ত। কান্না যেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে গেছে।
গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ৩৭৩/১৭ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা গেছে তরুণ তাঁর মেয়ের পুতুল জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। বন্ধু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ডা. তৌফিক জোয়ার্দার সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁকে। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই তাঁকে শান্ত করতে পারছিল না।
বেড়ানো পছন্দ ছিল নূহার : তরুণ জানান, ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করে নূহা। জন্মের পর তাকে নিয়ে চারবার কক্সবাজার বেড়াতে গেছেন। নূহা যখন বুঝতে শিখেছে, তখনই কক্সবাজারের কথা বলতেই খুব খুশি হতো। মেয়ের আনন্দ দেখার জন্যই তাঁরা কক্সবাজার যেতে আগ্রহী ছিলেন বেশি। তিনি জানান, ২৯ জুন রাতে নূহা ঘুমাতে পারছিল না। তখন তরুণ জানতে চান সে ঘুমাচ্ছে না কেন। জবাবে নূহা বলে, 'কাল কক্সবাজার যাব, এই আনন্দে ঘুম আসছে না। খুব আনন্দ লাগছে।' এই আনন্দই যে তার শেষ আনন্দ হবে সেটা কে জানত_বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তরুণ। আর তাঁর মুখ দিয়ে যেন কথা বেরোচ্ছিল না। শুধু তরুণ কেন, তাঁর বাসায় উপস্থিত তাঁর বন্ধু ডা. তৌফিক জোয়ার্দারেরও অশ্রু ঝরছিল।
চার ডাকাত গ্রেপ্তার : মর্মস্পর্শী এ ঘটনায় কক্সবাজার থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন তরুণের বন্ধু রিপন। পরে সেটিকেই এজাহার হিসেবে ধরে নিয়ে চকরিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। চকরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ফরহাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঘটনার দুই দিন পরই আমরা চার ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছি।' জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, তারা ১৬ থেকে ১৭ জন ডাকাতির উদ্দেশ্যে রাস্তায় গাছের ডাল ফেলে রেখেছিল। গাড়িটি ডাল পেরিয়ে চলে যাওয়ার কারণে গুলি করেছে। তিনি জানান, এই ডাকাতদের এর আগেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কয়েক মাস আগে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও ডাকাতি শুরু করেছে। তিনি আরো জানান, তাদের অন্য সহযোগীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

নেই ঢাল তলোয়ার, আছে শুধু আবেগ by মাসুদুল আলম তুষার

Saturday, June 18, 2011

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে। আইনি সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি লোকবল সংকটের কারণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান কোনো কাজই করতে পারছে না। এই অচলাবস্থার জন্য সরকার দুষছে কমিশনকে। গত দুই বছরে কমিশন মানবাধিকার ইস্যুতে একটিমাত্র ঘটনার তদন্তে অংশ নিলেও সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়নি। কমিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাগজে-কলমে কমিশনের অস্তিত্ব থাকলেও এখন পর্যন্ত বিবৃতি ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া কার্যত কিছুই করতে পারেনি। তদন্তের বাইরে রয়ে গেছে বহু অভিযোগসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শতাধিক ঘটনা। মানবাধিকার কমিশনে বর্তমানে আইন আছে, বিধি নেই।


অভিযোগ আছে, তদন্ত নেই। পদবি আছে, লোকবল নেই। কমিশনের নিজস্ব কোনো অফিসও নেই। ফলে মানবাধিকার ইস্যুতে কমিশনের দৃষ্টান্তমূলক কোনো কাজ নেই। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে সরকার আন্তরিক। আর এ কারণেই মহাজোট সরকার গঠনের শুরুতেই সংসদে আইন পাস করা হয়েছে। আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। লোকবল ও বিধি অনুমোদন করা হয়েছে। সহসাই গেজেট প্রকাশ করে বিধি কার্যকর করা হবে। আইনবিধিসহ কোনো কিছুতে পরে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তাও করা হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত কমিশন কোনো তদন্ত প্রতিবেদন অথবা সুপারিশ সরকারকে দেয়নি বলে আইনমন্ত্রী জানান। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কমিশন যতটুকু ভূমিকা রাখতে পারত, তা করেনি বলে অভিমত জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, 'সেখানে কাজের চেয়ে কথা বেশি হচ্ছে।'
সম্প্রতি র‌্যাবের গুলিতে আহত ঝালকাঠির লিমনকে পঙ্গু হাসপাতালে দেখতে গিয়ে গণমাধ্যমের সামনেই কাঁদলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি। কিন্তু তিনি নিজে তদন্তের উদ্যোগ নিলেন না। এভাবেই হেফাজতে মৃত্যু, লাশ গুম, ক্রসফায়ারসহ নানা ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও সেসব ইস্যুতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখন পর্যন্ত নজির স্থাপনের মতো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কমিশনের চেয়ারম্যান অবশ্য প্রতিদিনই নানা সভা-সেমিনারে মানবাধিকার বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ। জনবল না পেলে তিনি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী নিয়ে কাজ করবেন বলেও কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এ ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি।
মানবাধিকার কমিশনের কর্মকাণ্ডে হতাশা ব্যক্ত করে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিয়ে প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু কিছুই হয়নি। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যানের কান্না আর আবেগতাড়িত বক্তব্য আমাদের কাম্য নয়। কার্যকর ও গঠনমূলক কাজ প্রত্যাশিত। সরকার কমিশনকে অনেক কিছু না দিলেও যেটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, এর নূ্যনতম ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে না। সীমাবদ্ধতার মাঝেও কমিশন চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কারণ যেকোনো ঘটনা তদন্তে কমিশন চাইলেই লোকবলসহ প্রশাসনিক সহায়তা পেতে পারে। অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোও কমিশনকে নানাভাবে সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু কাজের উদ্যোগ না থাকলে তো কেউ কিছু করতে পারবে না।'
কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটিকে রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ দিতে চেষ্টা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। এর পরও অনেক কাজ হচ্ছে না। বিশেষ করে জনবল দেওয়া হচ্ছে না। প্রকাশ্য বাধা না থাকলেও গোপনে অনেকে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করছে। কমিশনের বিধিমালার অনুমোদন ও জনবল বরাদ্দ হয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে বুঝে পাইনি। মানবাধিকার কমিশনকে সহায়তা করা মানেই হচ্ছে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা জনগণের আস্থা পূরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেখানে কমিশনের কাজ করার সুযোগ নেই, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি। আশা করি, সময় বেশি লাগলেও আমরা সফল হব।'
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের গুজরাটে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা তদন্ত করে সে দেশের মানবাধিকার কমিশন নিজেই দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কমিশন মামলা করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাতে পারবে কেবল। নিজের কিছু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি এ প্রতিষ্ঠানকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া, এমনকি মামলা করারও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কমিশনকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এর প্রতিকার করার কোনো ক্ষমতাও পায়নি কমিশন। শুধু সরকারের প্রতিবেদন চাইতে পারবে তারা এবং এর আলোকে সুপারিশ করতে পারবে। আবার কমিশনের সেই সুপারিশ মানতে সরকার বাধ্য নয়।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কমিশন আইন অনুযায়ী মানবাধিকার-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে আদালতে মামলা হলে কমিশন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ কারণেই বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের অন্তর্ধান নিয়ে কমিশন উদ্যোগ নিতে পারেনি। আরো বেশ কিছু অভিযোগ একই কারণে নিষ্পত্তি করা যায়নি। পার্বত্যাঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনে দুজন কমিশনারসহ তিন সদস্যের টিম কাজ করেছিল। সেটিই ছিল একমাত্র নিজস্ব তদন্ত। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সাংঘর্ষিক এ অবস্থানের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি সুপারিশ কমিশন সহসাই সরকারকে দিতে পারে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গত দুই বছরে বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত হলেও তা নিজস্ব ছিল না। বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজ করেছে কমিশন। বিধি চূড়ান্ত না হলে কোনো অভিযোগের তদন্ত সম্ভব নয়। বিধির পাশাপাশি লোকবল, যানবাহনসহ নিজস্ব অফিসও জরুরি।
জনবল সংকটের সঙ্গে আইনের নানা দুর্বলতার কারণে কমিশন শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার রক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেই বিষয়ে সন্দিহান মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা।
মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন গঠনে সবাই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কমিশনের কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দেশের কোনো ঘটনায়ই এ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ভূমিকায় দেখা যায়নি। এটা দুঃখজনক।
মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুসারে বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে তদন্ত করতে পারবে না কমিশন। আবার বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত শেষে শুধু সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কমিশন নিজে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইন অনুযায়ী কমিশন সরকার বা এর কর্তৃপক্ষের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবেদন চাইতে পারবে। তবে না পেলে করণীয় স্পষ্ট নয়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর 'জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ' জারি করা হয়। ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের কমিশন গঠিত হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ৯ জুলাই সংসদে 'মানবাধিকার কমিশন আইন' পাস করা হয়। বিধি প্রণয়ন বিষয়ে বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী কয়েক দফা সরকারের সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে নিজেই বিধির খসড়া করে ৪ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। কিন্তু সেই বিধি দুই বছরেও চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে চেয়ারম্যান পদে। প্রস্তাবিত বিধির ব্যাপারে সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। কমিশনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালের ২২ নভেম্বর বিভিন্ন পদে ৬২ জন লোকের নিয়োগ চাওয়া হয়েছিল। সরকার সম্প্রতি কমিশনের জন্য ২৮ জন লোক নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু একজনকেও কমিশনে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কমিশনে আপাতত অন্য প্রকল্পের চারজন কর্মকর্তা ও ১০ জন কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। কমিশনের কাজে সহায়তা দিতে শুরুতেই ইউএনডিপির 'প্রমোটিং একসেস টু জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ' অস্থায়ীভাবে পাঁচজন কর্মী দেয়। তাঁরাই কমিশনের নানা দাপ্তরিক কাজে সহায়তা দিয়ে আসছেন।

নৈরাজ্যের অচলায়তন by রাশেদ মেহেদী

Monday, June 13, 2011

রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে।

রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না ভালো বাস আমদানির কথা উঠলেই এখনকার প্রভাবশালী পরিবহন নেতারা হায় হায় করে ওঠেন। কী বলেন! উন্নত, ভালো বাস নিয়ে আসতে গেলে বাসপ্রতি দেড়-দুই কোটি টাকা দাম পড়বে। সেক্ষেত্রে মতিঝিল-উত্তরার ভাড়া নিতে হবে দেড়শ' টাকা। এটা কি সম্ভব? পরিবহন নেতাদের এই যুক্তি আরও একটি বড় প্রতারণা। কারণ বড় বড় পরিবহন নেতারা ঢাকার রাস্তায় উন্নত বাস সার্ভিস চান না। এ কারণে কম দামের উন্নত বাস সার্ভিস হাতের কাছে থাকলেও তাদের চোখে পড়ে না। গণপরিবহনের জন্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশসহ নিউজিল্যান্ড, ইউরোপের ফ্রান্স, চেক, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আমদানি করা হয় জাপানের উন্নতমানের রিকন্ডিশন্ড গাড়ি। এই গাড়িগুলো জাপানের রাস্তায় দশ বছর চলার পরও কমপক্ষে ত্রিশ বছর চলার নিশ্চয়তা থাকে। আরামদায়ক, উন্নতমানের এই গাড়িগুলো এখনও সর্বোচ্চ দাম গড়ে ২৫-৩০ লাখ টাকায় পাওয়া সম্ভব। যদি ২৫ লাখ টাকা দিয়ে নিম্নমানের নতুন বাস কিনে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া হয়, তাহলে জাপানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উন্নতমানের বাস ২৫ লাখ টাকায় আমদানি করলে সেই ২৫ টাকা ভাড়াতেই পোষাবে। চীনের নিম্নমানের নতুন বাসের যেখানে একশ' বছর সুস্থভাবে চলার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে জাপানি রিকন্ডিশন্ড শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ৩০ বছর পর্যন্ত চলার নিশ্চয়তা আছে। তাহলে এসব বাস গণপরিবহনের জন্য আমদানি করতে বাধা কোথায়? এক সময় কিন্তু ঢাকার রাস্তায় রিকন্ডিশন্ড উন্নতমানের গাড়ি চলত। নিরাপদ এবং রোড স্টার সার্ভিসের কথা অনেকেরই মনে আছে। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় নেমেছিল প্রিমিয়াম বাস, ২০০০ সালে নিরাপদ এবং ২০০২ সালে রোড স্টার। এর পাশাপাশি বিআরটিসির ভলভো দোতলা বাস। মানুষ এসব বাসে অনেক নিরাপদে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারত। এসব উন্নত বাস চলার সময় মূল সমস্যা দেখা দেয় তথাকথিত প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের। নামে শ্রমিক নেতা হলেও তারা রীতিমতো বড় বড় মালিক। পুরনো গাড়ি দফায় দফায় ৮-১০ লাখ টাকার মধ্যে হাত বদল করে ভালোই চালাচ্ছেন তারা। এই নেতাদের মূল ব্যবসা অবশ্য চাঁদাবাজি। উন্নত বাসের মালিকরা চাঁদা দিতে চান না, আবার উন্নত বাস চলার কারণে লোকাল বাস, সিটিং বাস এবং অন্যান্য কাউন্টার সার্ভিসের বাসে যাত্রী পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয়। ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানো সহজ হয় না। এই নেতাদের ইশারাতেই বিআরটিএ নিরাপদ পরিবহন ও প্রিমিয়াম সার্ভিসের রুট পারমিট নবায়ন করেনি।
রাজধানীতে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য শুরু হয় কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি মাসে। এ সময় গুলিস্তান-গাজীপুর রুটের মুড়ির টিন বলাকাসহ উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর রুটের সব ঝরঝরা লোকাল বাস সিটিং সার্ভিস হয়ে যায়। দশ টাকার নিচে ভাড়া নেওয়া হয় না তখন থেকেই। মুড়ির টিনের মতো এসব বাসে ত্রিশ আসনের জায়গায় বিয়ালি্লশ আসন বসিয়ে গরু-ছাগলের মতো যাত্রীদের বসানো হয়। তখন থেকেই রাস্তায় বাস সংকটেরও সৃষ্টি হয়। পত্রপত্রিকায় ছোটখাটো সংবাদ হয়েছে। বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে কেউ দেখেনি। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে কর্তা-ব্যক্তিরা সেটা কোনোমতেই বুঝতে চাচ্ছেন না। গণহারে ডাইরেক্ট আর সিটিং হওয়ার কারণে বিপাকে পড়ছেন রাজধানীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বাস করা মানুষ। যে যাত্রী ফার্মগেট থেকে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া কিংবা মোহাম্মদপুর যাবেন কিংবা মহাখালী থেকে এমইএস, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত কিংবা উত্তরা যাবেন, তারাই বিপদে পড়ছেন। তাদের জন্য এখন কোনো বাস নেই। মগবাজার থেকে মহাখালী যাওয়ার বাস কিংবা অন্য কোনো যানবাহন নেই। এসব জায়গার যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর অসংখ্য গাড়িতে উঠতে গিয়ে তথাকথিত সিটিং সার্ভিসের কন্ডাক্টর-হেলপারের গলাধাক্কা খান। সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে মন্ত্রীদের গালাগাল করেন। শেষ পর্যন্ত ৭ টাকার ভাড়া ১৫-২০ টাকা দিয়ে যেতে বাধ্য হন। কখনও কখনও মহাখালী থেকে বিশ্বরোড যেতে হচ্ছে ৩০ টাকাতেও। অথচ বাস সেই মুড়ির টিন। এই মধ্যবর্তী যাত্রীদের জন্য বিআরটিসি কি পারে না সার্কুলার বাস চালু করতে? কিছু বাস তো শাহবাগ থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর-১০ পর্যন্ত চলতেই পারে। কিংবা কিছু বাস তো মগবাজার থেকে মহাখালী হয়ে উত্তরা পর্যন্ত চলতেই পারে। এসব বাসে ৫ টাকা এবং ১০ টাকার দু'ধরনের টিকিট থাকবে। যেমন শাহবাগ থেকে ফার্মগেট ৫ টাকা, শাহবাগ থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত ১০ টাকা। মগবাজার থেকে বনানী ৫ টাকা, উত্তরা পর্যন্ত ১০ টাকা_ এই ভাড়াতেই কিন্তু দিব্যি সার্কুলার বাস চলতে পারে অফিস সময় এবং বিকেলে অফিস ছুটির পর। না পোষালে আরও ৫ টাকা ভাড়া বেশি নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষকে অফিসে যাওয়ার সময় এবং ঘরে ফেরার সময় বাস পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অথচ বিআরটিসির বাসও বেসরকারি পরিবহন মালিকদের মতো করেই চালানো হচ্ছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে যদি বিআরটিসির ভূমিকা না থাকে তাহলে সরকারি মালিকানাধীন এই পরিবহন সার্ভিসের গুরুত্ব কোথায়? ২০০৪ সালে কিন্তু ঢাকার বিআরটিসির বেশ কিছু এ ধরনের সার্কুলার বাস চালু হয়েছিল। দুই-তিন মাস চলার পর সেই বেসরকারি পরিবহন মালিকদের চাপেই এসব বাস বন্ধ করা হয়। কারণ তাদের কম দূরত্বে বেশি ভাড়া নেওয়ার কৌশল মার খায়। রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে। রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার বাস সার্ভিসকে উন্নত করার জন্য বিআরটিসিকে কাজে লাগাতে পারে সরকার। ঢাকার প্রধান দশ-বারোটি রুটের পুরো দায়িত্ব বিআরটিসিকে দিলে কেমন হয়? এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পরিবহন নেতাদেরও বিআরটিসির পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিআরটিসি দশ-বারোটি রুটে তিন ধরনের বাস সার্ভিস রাখবে। একটি হবে ডবল ডেকার লোকাল সার্ভিস স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য, একটি হবে মধ্যআয়ের মানুষের জন্য নন-এসি কাউন্টার সার্ভিস এবং আর একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সার্ভিস। নির্দিষ্ট মডেলের বাস নির্দিষ্ট রুটে চলবে। বেসরকারি মালিকরা বিআরটিসি অনুমোদিত মডেলের বাস কিনে বিআরটিসির মাধ্যমে চালাতে পারবেন। বিআরটিসি তাদের লাভ বুঝে দেবে। বেসরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় কোনো বাস সার্ভিস প্রধান দশ-বারোটি রুটে চলবে না। বিআরটিসির চুরি বন্ধে একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিম থাকবে, প্রয়োজনে গোপন টিম রাখা হোক। এর ফলে সরকার অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে। একই মডেলের বাস একটি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলার কারণে যানজট কমবে। পরিবহনে শ্রমিক সংগঠন, মালিক সংগঠন এবং পুলিশ, বিআরটিএর চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। যখন-তখন পরিবহন মালিকরা ভাড়া নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে না। একই কর্তৃপক্ষের বাস হওয়ার কারণে বেপরোয়া বাস চালানো, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ হবে, ফলে দূর্ঘটনাও কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর সাধারণ মানুষ কম খরচে উন্নত বাসসেবা পাবে। সিএনজির দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া নিয়ে বেসরকারি মালিকরা যে নৈরাজ্য এবং ভাড়ার নামে গণডাকাতির নজির স্থাপন করেছেন, তাতে আজ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রধান দশ-বারোটি রুটে সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিকল্প থাকবে না।

ঢাবি শিক্ষক রুমানার ওপর যেভাবে চালানো হয় নির্যাতন

ঢাবি শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। এ সময় তার স্বামী সাঈদ হাসান রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দেন। রুমানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাঈদ তার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। সঙ্গে সঙ্গে রুমানা পড়ে যান। এরপর সাঈদ তার গলা চেপে ধরেন। তার দু’চোখ আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করে দেন। তাদের সন্তান আনুষার সামনেই ঘটে এ ঘটনা। আনুষা এ সময় মাকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে কান্নাকাটি করেন।

রুমানা ও আনুষার চিৎকারে কাজের মেয়েসহ অন্যরা বাইরে থেকে দরজা খুলে তাকে রক্ষা করেন। ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান স্বজনরা। আর সেখানে বর্তমানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুর। হাসপাতাল ও পারিবারিক সূত্র জানায়, রুমানার দু’টি চোখেই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। অপরটিও নষ্টের পথে। মাথা ও সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন অন্তত চোখ রক্ষা করতে। প্রয়োজনে তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য বলা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। শনিবার রুমানার পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের কাছে তার মেয়ের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচারের বর্ণনা করেছেন। রুমানা এর আগে ২রা জুনও নির্যাতনের শিকার হন। সে সময় রুমানার পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেন মেয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি নির্যাতনের কথা জানান। বিষয়টি জানতে পেরে ঘরজামাই হাসান সাঈদকে তার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন এবং তার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কথা বলেন। এরপর হাসান সাঈদ তার ভাইয়ের বাসা ১০, পরীবাগের ইস্টার্ন কটেজের (ফ্ল্যাট নম্বর ৬০৩) বাসায় চলে যান। সেখানে সাঈদ ঘুমের বড়ি খেয়ে অচেতন হয়ে পড়লে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি ফের শ্বশুরের বাসায় যান। সেদিন ছিল ৫ই জুন। এরপর ঘটে এক নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা। ল্যাবএইড হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় রুমানার পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার মেয়ের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাকে সুস্থ করতে। তার সারা শরীরের আঘাতের চিহ্ন। তিনি বলেন, এখনই বিস্তারিত বলতে চাইছি না। পরে বিস্তারিত জানানো হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, রুমানা ২০১০ সালের ১লা আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের শিক্ষা ছুটি নেন। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব বৃটিশ কলম্বিয়ায় মাস্টার্স করার জন্য এ ছুটি নেন। চলতি বছরের ১লা আগস্ট তার শিক্ষা ছুটি শেষ হওয়ার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া ছুটির আবেদনে লেখা আছে একটি সেমিনারে অংশ নিতে তার আগামীকাল তার ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। তার স্বামী সাঈদ হোসেন রুমানার বিদেশ যাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। রুমানা দেশে আসার পর থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এক বছর ছুটি শেষে তার ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদানের কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, কি কারণে রুমানার ওপর এ ধরনের নির্যাতন হলো তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। তিনি বলেন, রুমানা শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র। তিনি চাপা স্বভাবের মেয়ে। অধ্যাপক ফরিদ বলেন, তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে কোন ধরনের সাহায্য চাওয়া হলে তা করা হবে। আমি বিষয়টি তার পিতাকে বলেছি। তার পিতা মেয়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। রুমানার স্বামী সাঈদ হোসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়ালেখা করেছেন। তিনি বর্তমানে বেকার। থাকেন শ্বশুর বাড়িতেই। রুমানা ১২ই মে কানাডা থেকে দেশে আসে। একটি অসমর্থিত সূত্র জানায়, স্বামী বেকার আর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ নিয়ে তাদের পারিবারিক কলহ লেগেই থাকত। এছাড়া রুমানা কানাডা যাওয়ার পর থেকে সাঈদ হোসেন তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। এ সন্দেহ থেকেও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটতে পারে এমনটাও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রুমানার গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার শালিখা থানার গজদুর্বা গ্রামে। তিনি ঢাকাতেই পড়ালেখা করেছেন।
ধানমন্ডি ১০ নম্বর রোডের ৩/১ নম্বর বাসার (টাইহাট ভবন) ৪ তলার সি/১ নম্বর ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছেন রুমানার পিতা মঞ্জুর হোসেন। রুমানা তার স্বামী হাসান সাঈদকে নিয়ে এ বাসাতেই থাকতেন। একই বাসায় থাকতেন রুমানার বাবা-মা। ঘটনার দিন রুমানার মা ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পিতা ছিলেন বাসার বাইরে। বাসায় ছিলেন রুমানা, ৫ বছর বয়সী তাদের একমাত্র কন্যা শিশু আনুষা এবং ৩ গৃহপরিচারিকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসান সাঈদ ছিলেন অটোরিকশা ‘মিশুক’ ব্যবসায়ী। ৪-৫টি গাড়ি ছিল তার। বছর দেড়েক আগে সব ক’টি গাড়ি বিক্রি করে টাকা বিনিয়োগ করেন শেয়ার ব্যবসায়। শেয়ার ব্যবসায় লোকসানে পড়ে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন, তার চোখেও রয়েছে সমস্যা। চশমা ছাড়া তিনি কিছু দেখেন না।
মঞ্জুর হোসেনের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। রুমানাই বড়। তার ভাই দেশের বাইরে থাকেন। তাই হাসান সাঈদকে ঘরজামাই রাখেন তিনি। নির্যাতন শুরুর আগে রুমের ভেতর থেকে লক করে দেয়া হয়েছিল। ছোট্ট ফুটফুটে শিশুর সামনেই নির্মম নির্যাতন চালানো হয় রুমানার ওপর। শিশুটি তার মাকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। অনেক অনুনয়, বিনয়, কান্নাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি করেছে আনুষা। কোন কিছুতেই পিতার হৃদয় গলাতে পারেনি ওই শিশু। রুমানার নাকের বাম পাশের অংশ কামড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। নাখ, মুখ, কানসহ শরীরের অনেক জায়গায় মাংস ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। রুমানাকে বাসার নিচে নামানোর পর যারা তাকে দেখেছে তাদের একজন বলেন, রুমানা ম্যাডামের অবস্থা দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। তার চোখ, মুখ, গাল, নাখ এবং কপাল বেয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছিল।
গতকাল টাইহাট ভবনে গেলে রুমানার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ-ই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। সূত্র জানায়, রুমানা এবং তার মেয়ের আর্তচিৎকারে কাজের মহিলারা বাইরে থেকে রুমটি খোলে। রুম খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হাসান সাঈদ পালানোর চেষ্টা করে। কাজের মহিলারা তাকে জাপটে ধরে। তিনি ঝাঁকি দিয়ে কাজের মহিলাদের সরিয়ে দিয়ে বলেন, আমি যাচ্ছি। আপনারা রুমানাকে দেখেন। বিকাল ৫টার দিকে বাসা থেকে চলে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে হাসান সাইদ আবার বাসায় আসেন। মঞ্জুর হোসেনের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাকে বাসায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে তিনি বাসার ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। পরে তার ভাই এসে তাকে অনেক বুঝিয়ে ছাদ থেকে নামান। এরপর থেকে সাঈদ পলাতক। তবে তিনি বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য মঞ্জুর হোসেনকে ফোন করাচ্ছেন বলে সূত্র জানায়। মঞ্জুর হোসেন বলেছেন, রুমানার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। আমার মানসিক অবস্থাও খুব খারাপ। দোয়া করুন যাতে রুমানা সুস্থ হয়। রুমানা সুস্থ হলে অনেক কথা আপনাদের বলা হবে।
রুমানা মঞ্জুর ১৯৯৩ সালে রাজধানীর আজিমপুরের অগ্রণী স্কুল থেকে স্টার মার্ক নিয়ে এসএসসি ও ১৯৯৩ সালে ভিকারুন নূন নিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে স্টার মার্ক নিয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ২০০২ সালে বিভাগ থেকে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়ে অনার্স ও ২০০৪ সালে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ২০০৪ সালের ৩রা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৯ সালে ২৫শে অক্টোবর সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানপত্রে তিনি বিবাহিত উল্লেখ করেছেন। স্বামীর নাম লিখেছেন মোঃ হাসান সাঈদ। তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। রুমানার আহত হওয়ার খবর শুনে শনিবার রাতেই ল্যাবএইড হাসপাতালে ছুটে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি রুমানার পিতার সঙ্গে কথা বলে একটি অভিযোগ মানবাধিকার কমিশনে দেয়ার অনুরোধ করেন। অধ্যাপক মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এটি অত্যন্ত বর্বরোচিত ঘটনা। আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও আজ নিরাপদ নন। আমি তার ওপর নির্যাতনের ঘটনা শুনে বিস্মিত হয়েছি। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। ভিসি বলেন, আমরা কোন জগতে বাস করছি একটি ঘটনাই তার প্রমাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ওপর যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে তা না দেখে বিশ্বাস করা যাবে না। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। এদিকে রুমানা মঞ্জুরের পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেন বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর ৫। মামলাটির তদন্ত করছেন এসআই মকবুল হোসেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মকবুল হোসেন বলেন, ঘটনার পর থেকেই সাঈদ পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র মেহেদী হাসান বলেন, রুমানা ম্যাডাম অত্যন্ত ভদ্র । তিনি ছাত্রদের প্রচণ্ড ভালবাসেন। আমরা তার সুস্থতা কামনা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি। তার পিতা একটি মামলা করেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে সহায়তা চাওয়া হলে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
টাইহাট ভবন পরিচালনা পরিষদ সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান খান জানান, ৫ই জুন বিকালে কান্নাকাটি এবং চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি রোমানার বাসায় যাই। দেখি, কাজের বুয়ারা রুমানার রক্তাক্ত শরীর জড়িয়ে ধরে আছে। সঙ্গে সঙ্গেই রুমানার বাবাকে ফোন করি। কালবিলম্ব না করে আমার গাড়ি দিয়েই ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করি। তার বাবা আমার পুরনো বন্ধু। আমি মিডিয়ায় বিষয়টি জানাতে চেয়েছিলাম। তার বাবা আমাকে জানাতে দেয়নি। এ রকম লোমহর্ষক ঘটনা আমি নিজ দায়িত্বে মিডিয়াকে জানাবো কি জানাবো না তা নিয়ে ছিলাম দোদুল্যমানতায়। এ দোদুল্যমানতায় আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। তিনি জানান, এত নম্র-ভদ্র এবং ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে আমি খুব একটা দেখি না। ৬-৭ বছর ধরে রুমানা এ বাসায় থাকেন। তার জীবনে এ রকম দুর্বিষহ যন্ত্রণা নেমে আসবে- কল্পনা করতে পারিনি। তিনি জানান, অনেকদিন ধরেই আমার একটি প্রশ্ন ছিল, বুয়েট থেকে পাস করা রুমানার স্বামী সাঈদ কেন ঘর জামাই থাকেন? কেন তিনি কোন চাকরি করেন না?  শাহজাহান খান জানান, এক সময় তার কয়েকটি মিশুক গাড়ি থাকলেও এখন আর নেই।

যুদ্ধাপরাধ : দালাল আইনে বন্দির তালিকা মন্ত্রণালয়ে

Monday, February 14, 2011

৯৭২ সালে দালাল আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়ে যারা কারাগারে ছিল, তাদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ রকম ৭৭৫ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। সেগুলো কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েও দিয়েছে।

সূত্র জানায়, ওই সময় দেশে মোট ২৩টি কারাগার ছিল। এর মধ্যে চারটি ছিল কেন্দ্রীয় কারাগার, বাকি ১৯টি জেলা করাগার। মূলত এই ২৩টি কারাগারেই সে সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ প্রায় ৩৭ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে বন্দি করা হয়েছিল। তবে এদের অধিকাংশই ছিল জেলা (বৃহত্তর জেলা) কারাগারগুলোতে। এখন পর্যন্ত আটটি কারাগারে বন্দি করে রাখাদের মধ্য থেকে ওই ৭৭৫ জনের নাম-ঠিকানা জোগাড় করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। যথেষ্ট কাগজপত্রের অভাবে বাকি কারাগারগুলোর তালিকা এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাকি কারাগারগুলোতে থাকা যুদ্ধাপরাধের আসামিদের নামও খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কারা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কারা সদর দপ্তর থেকে ২০১০ সালের জুন মাসে তাঁরা নির্দেশ পান ১৯৭২ সালে দালাল আইনে আটক বন্দিদের তালিকা খুঁজে বের করার। এ নির্দেশের পর তাঁরা সর্বোচ্চ গুরুত
্ব দিয়ে ওই তালিকা খোঁজা শুরু করেন। কিন্তু এই কারাগারে সে রকম কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই বিষয়টি তাঁরা সদর দপ্তরে লিখে জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, এখনো নানাভাবে খোঁজার চেষ্টা চলছে। পাওয়া গেলে সদর দপ্তরে তালিকা পাঠানো হবে।
কারা সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত বাহাত্তরের দালাল আইনে বন্দি যে ৭৭৫ জনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ৩০৯ জন, নওগাঁ কারাগারের ২৮৬ জন, পাবনা কারাগারের ১০, কুমিল্লা কারাগারের ৮৩, পটুয়াখালী কারাগারের ৮, ময়মনসিংহ কারাগারের ২৪, জামালপুর কারাগারের ৩২ ও মুন্সীগঞ্জ কারাগারের ২৩ জন। এসব নাম পাওয়ার পর গত বছর জুলাই মাসে কারা সদর দপ্তর থেকে ওই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতার দায়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৩৭ হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭২ সালে দালাল আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ২৬ হাজার কারাবন্দি মুক্তি পায়। আর হত্যা, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টা, অগি্নসংযোগ, নির্যাতনসহ ১৮টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত বাকি ১১ হাজার বন্দি ওই সাধারণ ক্ষমার আওতায় না আসায় তারা সে সময় মুক্তি পায়নি। পরে তাদের বিচারের জন্য ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ওইসব ট্রাইব্যুনালে কিছু আসামির বিচার সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল। বাকিদের বিচার চলছিল। পরে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে দিলে বিচার হওয়া ও বিচারাধীন সব আসামিই মুক্তি পেয়ে যায়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পুস্তিকা 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচালের ষড়যন্ত্র : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়' থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে দালাল আইন বাতিল হলেও ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি বহাল আছে। এই আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া সম্ভব।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বছর ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরে দালাল আইনে বন্দিদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কারা অধিদপ্তর থেকে সেই নির্দেশনা পাঠানো হয় দেশের সব কটি কারাগারে। বর্তমানে দেশে ৬৮টি কারাগার থাকলেও ওই সময় বৃহত্তর জেলাগুলোতে একটি করে কারাগার ছিল।
একটি কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেলার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ পাওয়ার পরই আমরা কাজ শুরু করে দেই। কিন্তু কাগজপত্র পাওয়া বেশ কষ্টকর। অনেক খুঁজে যাদের নাম পেয়েছি তা পাঠিয়ে দিয়েছি সদর দপ্তরে।'
কারা মহাপরিদর্শক মো. আশরাফুল ইসলাম খান বলেন, 'মন্ত্রণালয় দালাল আইনে বন্দিদের নাম-ঠিকানা চাওয়ার পর আমরা যদ্দূর পারি কালেক্ট করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। আরো পাওয়া যায় কি না তার চেষ্টা চলছে।'
যাদের তালিকা পাওয়া গেছে তাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, 'বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারকে হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ঢাকা সিটি আমির ও একাত্তরে আলবদর বাহিনীর নেতা খালেক মজুমদারকে সাত বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। দালাল আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়নি। আমি মনে করি, এখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হওয়া দরকার।'
একজন সাবেক কারা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর হাজার হাজার রাজাকারকে ফৌজদারি আইনে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছিল। পরে তাদের দালাল আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই আইনে বিচারও হয় অনেকের। অনেকে সাজাও পায়। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে একটি অর্ডার হয়_যেসব রাজাকার সাজার অর্ধেক ভোগ করেছে, তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হোক। এভাবে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে অনেকে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চলে যায়।
কারা সূত্র জানায়, ওই সময় দেশে যে ২৩টি কারাগার ছিল, তার মধ্যে ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও যশোরে চারটি কেন্দ্রীয় ও বাকি ১৯টি ছিল জেলা কারাগার। মহকুমাগুলোতেও কিছু সাব-জেল ছিল। তবে যুদ্ধাপরাধীদের জেলা কারাগারগুলোতেই বেশি রাখা হয়েছিল।

লাগামছাড়া অপরাধ গাছাড়া প্রশাসন

Sunday, February 6, 2011

বেশ কিছুদিন হলো দেশজুড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে। অপরাধীদের বেপরোয়া বিচরণ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জনমনে। কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচ্চবাচ্য ও মরিয়া চেষ্টা-সবই বিফলে যাচ্ছে। উপরন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে গাছাড়া ভাব দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও প্রকট।

অপরাধ-আতঙ্ককে সম্প্রতি আরো ভয়াবহ করে তুলেছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থীদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধে হানাহানির ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়েও অস্ত্রধারীরা চালিয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। এরই মধ্যে সংঘটিত লোমহর্ষক কয়েকটি হত্যা, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এর পাশাপাশি পারিবারিক খুন-খারাবি যোগ করেছে আতঙ্কের আরেক মাত্রা। শুধু রাজধানীতেই গত এক মাসে ঘটেছে এক ডজন চাঞ্চল্যকর অপরাধ। পুলিশের গোয়েন্দা শাখাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলমান বাস্তবতা আর গোয়েন্দাদের গোপনীয় প্রতিবেদনে যা-ই বলা হোক না কেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অপরাধ নির্মূলে সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাঁদের এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষকে খুব বেশি আশ্বস্ত করতে পারছে না। অনেকেরই ভাষ্য, অপরাধের মাত্রা আর ধরন কোন পর্যায় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে, সেটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্ব দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে। সরকারের প্রথম বছরে আইনশৃঙ্খলা কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রের মহড়া, অপরাধীদের প্রকাশ্য তৎপরতা, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা চাঞ্চল্যকর অপরাধ প্রশ্নবিদ্ধ করছে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়, র‌্যাব-পুলিশের বিরোধ ও সমন্বয়হীনতায় কর্মকাণ্ডে শিথিলতা, চাঞ্চল্যকর অপরাধ ও মামলার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবসহ নানা ঘটনা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়ক হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গতকাল শনিবারও সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, বেশির ভাগ অপরাধ হচ্ছে ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে। এর বাইরে যা কিছু ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা সুন্দরভাবে সামাল দিচ্ছে। সম্প্রতি সংঘটিত নানা অপরাধের আসামিদের দ্রুত সময়ে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুরেই কালের কণ্ঠকে গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, খুন, ডাকাতির কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। যা ঘটছে এর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত বিরোধের সূত্র ধরে। তাই সামাজিকভাবে এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে অপরাধ কমার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও কাজের চাপ কমে আসবে।
পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেছেন, ক্রসফায়ার ও গুপ্তহত্যা নিয়ে ধারাবাহিক সমালোচনার মুখে র‌্যাব এখন অনেকটাই সতর্কভাবে এবং ধীরে কাজ করছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যাশিত পদোন্নতিসহ সুযোগ-সুবিধা না বাড়ায় পুলিশ বিভাগের অনেকের মধ্যেই এখন কর্ম-অনীহা স্পষ্ট। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে যথেষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিংয়ে বিশেষ এলাকার প্রাধান্য কোণঠাসা করে রেখেছে অনেক কর্মকর্তাকে। আবার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সাহস দেওয়া হলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবে পড়ে অনেক সময় অপরাধমূলক ঘটনায় সমঝোতার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো মনিটরিং করার কথা থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়ায় তদন্তকারীরাও দায়সারা জবাব নিয়ে হাজির হচ্ছেন ঊর্ধ্বতনদের কাছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় বড় মামলা থেকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত আসামিদের ছাড় দেওয়ার ঘটনাও পুলিশকে তাদের কাজ থেকে পিছপা করছে। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেই এক ধরনের শৈথিল্যভাব অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলছে বলে অনেকের মত।
কিন্তু র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল সমন্বয়হীনতা ও কর্মশিথিলতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, নিয়মিত টহল ছাড়াও র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা প্রতিরোধেও কাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমেই তারা কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় র‌্যাব কার্যকর ভূমিকা রাখছে। জঙ্গি দমন ও চরমপন্থীবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি র‌্যাব অন্যান্য অপরাধী গ্রেপ্তারেও সফলতা পেয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন এবং একুশের বইমেলা নিয়ে রাজধানীতে পুলিশ বাহিনী ব্যতিব্যস্ত। এরই মধ্যে ঘটে চলেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অপরাধ। গত এক মাসে রাজধানীতেই খুন হয়েছে ২৯ জন। এর মধ্যে তিনটি জোড়া খুন; যদিও ১৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ব্যক্তিগত কারণ বা বিরোধের জের ধরে, রাজনৈতিক কারণেও ঘটেছে দুটি। ডাকাতির ঘটনায় নিহত হয়েছে দুজন এবং ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মারা গেছে একজন। অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণ এবং অপরাধী শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
অনেকেই মনে করছে, অপরাধমূলক নানা ঘটনাকে পুলিশ ব্যক্তিপর্যায়ের বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধেও পুলিশের দায়সারা মনোভাবের অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থির হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধন অনেক দুর্বল হয়ে পড়ছে বলেই খুনসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। মানসিক অস্থিরতা থেকে সামন্য কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এটি অপরাধের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়কেও প্রকাশ করে। সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় প্রতিহত করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বলেন, ‘পারিবারিক ও সামাজিক কারণে অনেকে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। চরম মানসিক অস্থিরতা থেকে এ ধরনের অপরাধের সৃষ্টি। ঘটনার সময় হত্যাকারীর চেতনাবোধ লোপ পায়। মানুষের জন্য তাদের মনে ভালোবাসা থাকে না।’
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান সাদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধের কাজে জড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ বা ভালো মনে করলে অপরাধী ওই অপরাধ বারবার করে। অপরাধ-সহায়ক পরিবেশে মানসিক বিকাশ অল্প বয়সেই অপরাধপ্রবণতা তৈরি করতে পারে। বর্তমানে যুবসমাজের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা বেশি। অস্থিরতার কারণে হত্যাকে কেউ বড় অপরাধ বলে ভাবতে পারে না। তাই সামান্য কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে অপরাধের কৌশল পাল্টায়। তবে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় প্রতিহত করা সম্ভব।’

রাষ্ট্রের হত্যাকাণ্ডের নাম ক্রসফায়ার!

Wednesday, February 2, 2011

ত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পাল্টা গুলি চালায়। এ সময়...পলায়নকালে তিনি ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হন। ফাঁকা জায়গাগুলোতে কারো নাম পূরণ করে নিন, তাহলে দেখবেন সংবাদপত্রে ছাপানো কোনো ক্রসফায়ারের সংবাদের সঙ্গে মিলে যাবে। এই গল্প শুনতে শুনতে পাঠক ক্লান্ত হয়ে গেছেন। নতুন কোনো গল্পও নেই।
অভিযোগ উঠেছে বিশেষ ধারার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা করার জন্যই ক্রসফায়ারের আবির্ভাব হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের অল্প কিছুদিনের মাথায় শুরু হয় ক্রসফায়ার নামের হত্যাকাণ্ড, তাও আবার দেশের অন্যতম রাজনৈতিক নেতা সিরাজ সিকদারকে দিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থন করা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। বিশ্লেষকরাও বলছেন তাই। বিশেষ ধারার সশস্ত্র কমিউনিস্টরা ক্রসফায়ারের বলি হয়েছেন মুজিব আমল থেকেই। সেই যাত্রা খালেদা-নিজামী পার হয়ে মহাজোট সরকারের আমলেও অব্যাহত রয়েছে। এই  বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ...

ঘটনা-১
১৯৭৫ সালের ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন বুধবার। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সভাপতি সিরাজ সিকদার চট্টগ্রাম থেকে গোয়েন্দা বিভাগের একদল সাদা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর জরুরিভাবে ওই দিন রাতেই তাঁকে ঢাকায় আনা হয়। তারপর কিছু জানা যায়নি। শুধু ৩ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালের পত্রিকায় একটি সরকারি প্রেসনোট দেখে দেশবাসী হতবুদ্ধি হয়ে যান। যেখানে লেখা থাকে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সভাপতি সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাভারে নিয়ে যাওয়ার সময় ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় সিরাজ সিকদার পালানোর চেষ্টা করেন। উভয়পক্ষের গোলাগুলিতে সিরাজ সিকদার নিহত হন।
কেউ কোনো প্রশ্ন করলেন না, গভীর রাতে সিরাজ সিকদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেন সাভারে নিয়ে যাওয়া হলো? হ্যান্ডকাপ পরা একজন মানুষ কিভাবে দৌড়ে গেলেন? এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার সিরাজ সিকদার।

ঘটনা-২
২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্ষীয়ান নেতা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সাধারণ সম্পাদক মোফাখকার চৌধুরী। এরপর ওই দিন রাতেই কুষ্টিয়ায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরের দিন পত্রিকার বড় বড় ছাপা অক্ষরে দেখা যায় সেই পুরনো গল্প। উভয় পক্ষের গুলি বিনিময়কালে চৌধুরী পালানোর চেষ্টা করেন; অতঃপর ক্রসফায়ারে নিহত হন। বর্ষীয়ান এই কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন আজীবন অকৃতদার। তাঁর মৃত্যুর পর দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

ঘটনা-৩
দেশে জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন চলছে। মত প্রকাশের কোনো অনুমতি নেই। ২০০৮-এর ২৫ জুলাই ভোরে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের ৮ নম্বর রোডের একটি বাড়ি থেকে র‌্যাবের সদস্যরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান টুটুলকে গ্রেপ্তার করে। তবে সংবাদমাধ্যমের কাছে তথ্যটি গোপন করলেও সংবাদপত্রগুলো তাঁর গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে। ২৬ জুলাই সকালে ডা. টুটুলের বাড়িতে পুলিশ আসে। পুলিশের কাছ থেকেই টুটুলের মা ছেলের গ্রেপ্তারের খবর শুনতে পান। ছেলেকে 'ক্রসফায়ারের' হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান নভেরা খাতুন। কিন্তু মায়ের আর্তির প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ২৭ জুলাই ভোরে রাজশাহীর তানোরে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের হাতে নিহত হন ডা. মিজানুর রহমান টুটুল।

ঘটনা চার-৪
মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ বৈরাগী ক্রসফায়ারে
অতঃপর একটি বিদ্রূপ নাটকের মঞ্চায়ন

৮ অক্টোবর ২০০৮ রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ সেখানে পেঁৗছে। সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। ৩৫ মিনিটব্যাপী বন্দুকযুদ্ধের পরে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিরাপদ বৈরাগী (৫৮) নামের একজনকে উদ্ধার করে। ডুমুরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ েনিলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ওসির দাবি, নিরাপদ বৈরাগী নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ অক্টোবর (মঙ্গলবার) পুলিশ বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ বৈরাগীকে গ্রেপ্তার করে এবং শুক্রবার রাতে ক্রসফায়ারে হত্যা করে।
নিরাপদ বৈরাগীকে দাহ করার জন্য তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে শ্মশানে। শ্মশানে উপস্থিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফাউজুল কবিরসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ। পুলিশ লাশটি নামিয়ে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে তাঁর সামনে দাঁড়াল। কর্মকর্তারা তাঁকে স্যালুট করলেন। এরপর দাহ করা হলো। এলাকার মানুষের বিস্ময়ের সীমা নেই। যাঁকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হলো, তাঁকে আবার জাতীয় পতাকায় গার্ড অব অনারে শেষ বিদায়! নাটক আর কাকে বলে!
নিরাপদ বৈরাগীর মুক্তিযোদ্ধা নম্বর-৯৭৭০। প্রতিমন্ত্রী ও সচিব স্বাক্ষরিত স্মারক-মুবিম/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/১৭৬। ২০০৩ সালের ২ মার্চ থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন। প্রথমে ৩০০ টাকা করে ভাতা পেলেও পরে তিনি ৫০০ টাকা করে ভাতা পেতেন। অনেক দিন পর একসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২৬ হাজার ৪০০ টাকাও উত্তোলন করেছেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

ঘটনা-৫
ছেলেটির নাম কাজী মোহাম্মদ ইমতিয়াজ। ডাকনাম আবীর। পরিবারের মধ্যমণি। বন্ধু-বান্ধবের কাছেও অত্যন্ত প্রিয়। প্রাণবন্ত আড্ডাপ্রিয় আবীর বন্ধুদের প্রিয় মুখ। এমনই একটি দিন ছিল ১০ জানুয়ারি। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায়ই ছিল আবীর। সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডার বায়না ধরেছিল সে। কিন্তু তার মা রাজি নন এই রাতে বাইরে যাওয়ায়। অবশেষে আবীর মায়ের কাছ থেকে আধাঘণ্টার ছুটি পেল। দুরন্ত ছেলে এক দৌড়ে তিনতলা থেকে নামল। তখন সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৭টা। প্রথমে গেল বাসার পাশে খালি পড়ে থাকা একটি প্লটে। সেখানে তখন চলছে ব্যাডমিন্টন খেলা। সেখান থেকে রূপনগর আবাসিকের ২২ নম্বর রোডে যায় সে। সেখানেও ব্যাডমিন্টন খেলা দেখে সে। রাত তখন প্রায় সাড়ে ৮টা। আধাঘণ্টার ওয়াদা এক ঘণ্টায় পেরলো। মা এবার ফোন দিলেন। ছেলেটির যেন হুঁশ ফিরল। ফোন রিসিভ করলে বাড়ি ফেরার কথা বললেন মা। আবীর বলে 'মাত্র ১৫ মিনিটে আমি বাসায় আসছি।' মা সন্তুষ্ট। কিন্তু সেই ১৫ মিনিটও কেটে গেল। তবুও ছেলের খোঁজ নেই। মা আবার ফোন দিলেন। এবার রিকশায় বসে ফোন রিসিভ করে আবীর বলল, 'এই তো আম্মু, আমি রিকশায়। পাঁচ মিনিট লাগবে।' এ সময় রিকশার বেলের শব্দ শুনে মা আশ্বস্ত হলেন। তারপর আবার কেটে গেল ১৫ মিনিট। রাত ৯টায় রেগেমেগে মা আবার ফোন দিলেন। কিন্তু ফোন রিসিভ করল অচেনা কেউ। কে জিজ্ঞেস করতে ও পাশ থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে আসল। জানতে চাইল, আপনাদের বাসার নম্বর কত? মা যেন হকচকিয়ে গেলেন। বাসা নম্বর জানতে চাওয়ায় ভাবলেন, হয়তো আবীর ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছে। তাকে জিম্মি করে হয়তো বাসায় ঢুকতে চাইছে। তাই তিনি এড়িয়ে গিয়ে বললেন, 'বাসা নম্বর জেনে কী হবে, আবীরকে দাও। আমি ওর মা।' কিন্তু আবীরকে আর দেওয়া হলো না। এরপর সে রাতে আরো কয়েকবার ফোন দেওয়া হলো আবীরের নম্বরে; কিন্তু কেউ আর রিসিভ করল না। এরই মধ্যে বাবা বাসায় ফিরেছেন। তিনি ভাবলেন, আবীর হয়তো কোনো বন্ধুর বাসায়। তাই ফোন রিসিভ করতে ভয় পাচ্ছে।
সংশয়ে আচ্ছন্ন মা সারা রাত ছটফটিয়ে পার করলেন। সকালেই এল সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ। টেলিভিশনের সংবাদ শিরোনামে জানা গেল, গতকাল রাত ১১টায় বেড়িবাঁধ বালুর মাঠসংলগ্ন এলাকায় একদল যুবক ডাকাতির উদ্দেশ্যে একত্র হওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। এ সময় ক্রসফায়ারে আবীর নামে এক ডাকাতের মৃত্যু হয়েছে। মুহূর্তেই পরিবারের সবাই হতবাক। এরপর ঘটনার আরো নিশ্চয়তা মিলল ইত্তেফাকের সংবাদে। সেখানেও আবীরের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পল্লবী থানায় যোগাযোগ করা হলে ঘটনার সত্যতা মেলে। কিন্তু ততক্ষণে পরিবারটি নিস্তব্ধ। কিভাবে আবীরকে ডাকাতের খাতায় নাম লেখাল পুলিশ? যে ছেলে উঁচু গলায় কারো সঙ্গে কথা বলেনি, চোখ রাঙাতে শেখেনি_সে কিভাবে ডাকাতি করে? এলাকাবাসীও হতবাক। অবশেষে বিকেল ৫টায় পরিবারের কাছে আবীরের লাশ হস্তান্তর করা হয়। পোস্টমর্টেমে দেখানো হয়েছে, তার হাঁটুতে গুলি লেগেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তার এই মৃত্যু। অবশেষে ওই রাতে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। মর্মান্তিকভাবে শেষ হয় একটি ছেলের উচ্ছ্বসিত জীবন।

ক্রসফায়ার
অর্থ ও ক্ষমতাবানদের দাপট

শুরুতে ক্রসফায়ার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে যাঁরা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন তাঁদেরও ছ্যাঁচড়া সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমন অভিযোগই করেছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড-বিরোধী কমিটি। কিছু চিহ্নিত চোর-বদমায়েশকে হত্যা করে সেসব এলাকায় মিষ্টি বিতরণও করা হয়েছে ওই সব বাহিনীর পক্ষ থেকে। ফলে মানুষের মধ্যে সন্ত্রাসীদের শাস্তির বিধান হিসেবে বিকল্প পথ ক্রসফায়ারের ওপর এক ধরনের নৈতিক সমর্থন তৈরি হয়। যদিও আইনের বিচারে চূড়ান্ত সাজা না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলার কোনো সুযোগ নেই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এই সর্বগ্রাসী রোগ রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার মধ্য দিয়ে আরো সংঘাতময় জায়গায় গিয়ে পেঁৗছায়। আর হত্যার পর ওই রাজনৈতিক নেতাদের হিংস্র, অজানা শত শত মামলার আসামি হিসেবে উল্লেখ করে ক্রসফায়ারের পক্ষে এক ধরনের নৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে র‌্যাব-পুলিশসহ ক্রসফায়ার সংঘটিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু সেই রোগ এখন জনগণকে গিলে খাওয়ার পর্যায়ে পেঁৗছেছে, যে জনগণ ক্রসফয়ারের প্রাথমিক পর্যায় সমর্থন করেছিল। যার ফলে কোনো রকম রাজনীতি বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মানুষও নিহত হচ্ছেন। বর্তমান সরকারের আমলে এমন সব মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে না আছে রাজনীতির সংস্রব, না আছে সন্ত্রাসের সর্ম্পক। ভুক্তভোগী পরিবার বলছে, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে স্থানীয় শত্রুতার বলি হয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারের মতো রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় ক্রসফায়ার করছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম থেকে ক্রসফায়ার করা হয়েছে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থেকে। এখন সেই মিশন শেষ। কিন্তু ক্রসফায়ার এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে এসব বাহিনী এখন অর্থের বিনিময়েও ক্রসফায়ারে মানুষ নিহত করছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, এটা স্রেফ একটি ভাড়াটিয়া ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এর কুফল দীর্ঘমেয়াদি।

ইশতেহার থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ
দিনবদলের সনদ বলে খ্যাত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ৫.২ অনুচ্ছেদে দলটি অঙ্গীকার করেছিল, 'বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে।' তবে এই প্রতিশ্রুতি ফাইলের নিচে চাপা পড়েছে আর জনগণকে বন্দুকের সামনে দাঁড় করিয়ে করা হয়েছে ক্রসফায়ার। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই হুঙ্কার বাস্তবে কোনো কাজে আসেনি, বন্ধ হয়নি বিচারবহির্ভূত হত্যার মিছিল।

পুলিশের চরিত্র : শাসক সরকারের আদেশ-নিষেধ
পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল বা সংক্ষেপে পিআরবি অনুযায়ী পুলিশের র্কমকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ১৮১৩ সালে প্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবিরোধী বিপ্লবীদের দমন-নিপীড়ন।
পুলিশ আরো যেসব আইন দ্বারা পরিচালিত হয় তা হলো পুলিশ আইন ১৮৬১, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩ প্রধানভাবে উল্লেখযোগ্য। এ আইনগুলোর আলোকে পরে যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ল ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮৪ ও ১৯৯২ এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অর্ডিন্যান্স ১৯৭৯ জারি করা হয়। এ আইনগুলোর মাধ্যমে বিভাগীয় শহরে পুলিশের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তবে ১৮৬১ সালের আইনটিকে মূল ধরে এখনো পুলিশ বিভাগের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৮৬১ সালের ওই আইন তৈরি করা হয়েছিল ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তিকে দমনের জন্য, যাতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে আর কোনো আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে। এ আইনের ধারাবাহিকতায় পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩ জারি করা হয় তেভাগা আন্দোলন দমনের জন্য। পুলিশ বাহিনী গঠনের ইতিহাস শাসকদলকে রক্ষা করার ইতিহাস। ইতিহাসের এই ট্র্যাজেডি থেকে পুলিশ আজো বের হয়ে এসে একটি কল্যাণধর্মী জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। শাসক সরকারের ভাড়াটিয়া হিসেবে বিরোধীদের দমাতে সংগঠনটির জুড়ি নেই।

পুলিশকে কি ক্রসফায়ারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, 'আমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসীরা গুলি চালাবে, আর তারা বসে থাকতে পারে না।' বিষয়টি হলো আত্মরক্ষার অধিকারে পুলিশ গুলি চালাতে পারে। সেটা পুলিশ কেন, যে কেউ আত্মরক্ষার জন্য গুলি অথবা যেকোনো উপায়ে আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করতে পারে। পুলিশের জন্য আত্মরক্ষার আলাদা কোনো আইন নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কোনো ব্যক্তি আটক হলে রাষ্ট্রই হবে তার একমাত্র হেফাজতকারী। সেখানে কোনোভাবে কোনো আটক ব্যক্তি বা বন্দির মৃত্যু হলে সেটা অবশ্যই তদন্ত হতে হবে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত না হলে তার কোনো আইনি মূল্য নেই। অথচ বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের গল্পে যত মানুষ বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত হয়েছেন তার কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়নি।
পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশ সদর দপ্তরের পূর্বানুমতি ছাড়া তারা গুলি চালাতে পারে না। তবে তিন ধরনের পরিস্থিতিতে গুলি চালাতে পারে।
১. মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বা যাবজ্জীবন করাদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামি পালানোর চেষ্টা করলে, সেই আসামিকে রুখতে গুলি চালাতে পারে।
২. দাঙ্গা দমনকালে প্রথমে হুঁশিয়ারি, তারপর পর্যায়ক্রমে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ছোড়া; এর পরও যদি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন ওই দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ গুলি চালাতে পারে।
৩. বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে যদি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা আত্মরক্ষার স্বার্থে পুলিশ গুলি চালাতে পারে।
এই তিন ধরনের প্রেক্ষাপটে পুলিশ গুলি চালালে পরবর্তী সময়ে পুলিশের বিভাগীয় একটি তদন্ত সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। শুধু পুলিশের নিজস্ব বিভাগের তদন্ত এ ক্ষেত্রে গ্রহণীয় নয়, বিচার বিভাগীয় তদন্তও সম্পন্ন করতে হবে। তবে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যাঁরা ক্রসফায়ারের নামে লাইন অব ফায়ারে সরাসরি নিহত হচ্ছেন তাঁদের বেলায় এসব আইন এ পর্যন্ত কার্যকর ছিল বলে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

র‌্যাব গঠন
'যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ'_বাঙালির এই পুরনো প্রবাদের প্রতি সম্মান রেখেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী প্রতিবার কিছু নিবর্তনমূলক আইন নতুবা কোনো বাহিনী করে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় রক্ষীবাহিনী করে সে সময়কার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক বামপন্থী সংগঠনের নেতা-কর্মীকে নিশ্চিহ্ন করার দায়ভার এখনো আওয়ামী লীগের শরীর থেকে মুছে যায়নি। এর পর জিয়াউর রহমান থেকে সদ্যবিদায়ী ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জারি করা নিবর্তনমূলক আইনে লাখ লাখ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তবে এ সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে খালেদা-নিজামীর সময় করা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব গঠন। 'ঞযব অৎসবফ চড়ষরপব ইধঃঃধষরড়হং (অসবহফসবহঃ) অপঃ ২০০৩' আইনটি ১২ জুলাই ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে। 'ঞযব অৎসবফ চড়ষরপব ইধঃঃধষরড়হং ঙৎফরহধহপব, ১৯৭৯' সংশোধন করে র‌্যাব গঠন করা হয়।
দেশের বিভিন্ন বাহিনী থেকে সদস্য নিয়ে র‌্যাব গঠিত হয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলে যেকোনো বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে যেকোনো বিভাগে নিয়োগ করতে পারে। সরকারের এই ক্ষমতাকে নির্বাহী ক্ষমতা বলে। র‌্যাবে যেমন পুলিশের সদস্য আছে, তেমনি আছে বিমান ও সেনাবাহিনীর সদস্য। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হলো বিভিন্ন বাহিনী থেকে এনে র‌্যাব গঠন করা হলেও এখানে যদি কোনো সদস্য ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে আমলযোগ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তবে তাঁকে কোন আইনে বিচার করা হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। যদি দিকনির্দেশনা না থাকে তবে ধরে নেওয়া যায়, বিভিন্ন বাহিনী থেকে প্রেষণে আসা সদস্যদের নিজ নিজ বিভাগের আইন দ্বারা বিচার হবে। র‌্যাবে আসা সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য যদি হত্যার মতো মারাত্মক ফৌজদারি দণ্ডবিধি লঙ্ঘন করেন, তবে তাঁর বিচার হবে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আদালতে। আর এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তা ছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাজ তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা নয়, তাঁদের কাজ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মতো কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় বাহিনীকে র‌্যাবে এনে বিতর্কিত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা মূলত পুলিশের কাজ। পুলিশের কাজ অন্য কোনো বাহিনী দিয়ে করানোটা উচিত নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

উইকিলিকস এবং র‌্যাব
বিকল্প গণমাধ্যম ইউকিলিকসের তারবার্তায় বাংলাদেশের র‌্যাব সম্পর্কে মূল্যবান অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ১১ আগস্ট ইউকিলিকসের ফাঁস হওয়া তারবার্তায় জানা যায়, '২০০৮ সালের ১২ থেকে ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল র‌্যাব সম্পর্কে ধারণা পেতে এবং র‌্যাবের সঙ্গে একত্রে কাজের উপায় বের করতে বাংলাদেশ সফর করে। ওই তারবার্তায় র‌্যাবের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে র‌্যাবের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়, কারণ তাতে সে দেশের আইন লঙ্ঘন হবে।' তবে ১৪ জানুয়ারি ২০০৯-এ পাঠানো অন্য একটি তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের বাংলাদেশি প্রতিরূপ হয়ে ওঠার সবচেয়ে ভালো সম্ভাবনা আছে র‌্যাবের।' এ বার্তায় রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি র‌্যাব চালু রাখার পক্ষে যুক্তির অবতারণা করলে ভারতের রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর তাতে সমর্থন জানানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
১৪ মে ২০০৯-এর একটি তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাজ্য ১৮ মাস ধরে র‌্যাবকে 'অনুসন্ধানী জেরা' এবং অন্যান্য 'কর্মকৌশল'-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র দুজন ইউএস মার্শালকে তিন মাসের জন্য র‌্যাবের কাজ গোছানোর জন্য পাঠাচ্ছে। পশ্চিমা দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাব-পুলিশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু তাদের দেশগুলো আবার র‌্যাবকে নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, এ স্ববিরোধিতার পেছনের রাজনীতি আরো গভীর।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে সত্যিকারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে যেন কোনোভাবেই মানবাধিকার ইস্যুটি বাদ না পড়ে তার জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে মার্কিনিরা। কিন্তু বাস্তবে তা মিলছে না। মার্কিনিরা র‌্যাবকে সহযোগিতা করার পরও শুধু র‌্যাবের হাতে ২০১০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৫ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে গুপ্তহত্যা। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, মার্কিনিদের পরামর্শে ক্রসফায়ারের বদলে সরকার কি গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে?

সংবিধান মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেয়নি
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার চ্যাপ্টারের ৩৩-এর (১) অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার ও আটক ব্যক্তির হেফাজত সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
(২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চবি্বশ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে (আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।'
সংবিধানের মৌলিক অধিকার চ্যাপ্টারের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সম্পর্কে ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।'
সংবিধান মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেয়নি। আর যে গল্পটি জনগণকে শোনানো হয় তা কোনোভাবেই এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। সাংবিধানিক সরকারের হাতে সংবিধান লঙ্ঘন কোনোভাবেই গণতন্ত্রের জন্য সুখবর নয়। গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সবার আগে শক্তিশালী করতে হবে, বিচার বিভাগের সম্মান ঊধর্ে্ব তুলে ধরতে হবে। এ কাজ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের।

টার্গেট বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ
ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্নটি আমজনতার মুখে_জঙ্গিরা কেন ক্রসফায়ারে নিহত হয়নি? র‌্যাবের সঙ্গে সম্মুখ সমরে জঙ্গিনেতা বাংলাভাই ধরা পড়ে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। শুধু বাংলাভাই নয়, র‌্যাব-পুলিশের সম্মুখযুদ্ধে জেমএবির অনেক রাঘব-বোয়ালই গ্রেপ্তার হয়েছে, তবে তাদের কারো ভাগ্যেই ক্রসফায়ার জোটেনি। ক্রসফায়ার শুধু সশস্ত্রপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীর বেলায়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কমিউনিস্ট দলের যেসব নেতা-কর্মী ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, তাঁদের স্বজনদের পক্ষে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় জামায়াত নেতাদের অভিযোগের কারণেই পুলিশ, র‌্যাব কিংবা যৌথবাহিনী তাঁদের ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে। এমনও অভিযোগ রয়েছে, যেখানে জামায়াত নেতারা গোপন দলের ওই সব নেতা-কর্মীকে শনাক্ত করতে সোর্স হিসেবে কাজ করেছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচকরা মনে করেন, দেশের বাম প্রগতিশীল নেতৃত্বদের টার্গেট করেই মার্কিন নির্দেশে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার; আর সে হত্যা এখনো চলছে।
মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। সমাজ ও পরিবেশ সর্বোপরি সামাজিক অবস্থাই তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করে।
সে ক্ষেত্রে আইন শক্তিশালী হলে, বিচার বিভাগ সমুন্নত হলে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঘটিয়ে কেউ নিস্তার না পেলে সমাজে সন্ত্রাসের প্রবণতা কমবে। বিনাবিচারে হত্যা করে সন্ত্রাস কমে না বরং তা আরো নানা মাত্রায় সমাজের ওপর চেপে বসে। সাম্প্রতিক সময়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি তা-ই নির্দেশ করে।
আবার রাজনৈতিক সংগ্রামকে শাসক শ্রেণী সন্ত্রাস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রতিরোধ করার ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই প্রতিরোধ করতে হয়। এর বাইরে কোনো বিকল্প নেই। হত্যা কিংবা গুপ্তহত্যা কোনোভাবেই তার সমাধান নয়। বরং হত্যা-গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিলে তার ফল ভবিষ্যতের জন্য আরো কোনো গভীর সংকট ডেকে আনে।
একটি গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে যদি বিচার বিভাগ শক্তিশালী না হয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হয় তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রই বিপন্ন হবে।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. News 2 Blog 24 - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু